ভবিষ্যত প্রজন্মঃ সাংস্কৃতিক সংঘাতের সীমানায়

ধুসর গোধূলি এর ছবি
লিখেছেন ধুসর গোধূলি (তারিখ: শনি, ০২/০৮/২০০৮ - ৩:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

: বাংলাদেশের মানুষজনের সাধারণ আর নাগরিক জ্ঞান ভয়ঙ্কর ভাবে কম।
: মোটা দাগে সবাইকে মাপা তো ঠিক না। ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে। এই ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না।
: ব্যতিক্রম থাকে তখনই যখন সংখ্যাটা অনুল্লেখ্য হয়। কিন্তু সংখ্যাটা যখন বড়সড় একটা অনুপাত হয়ে দাঁড়ায় তখন আর সেটা ব্যতিক্রম থাকে না। সেটা হয়ে যায় ঐতিহ্য।

আমার জার্মান ভাবীর সঙ্গে যৌক্তিক চাপাবাজী করে বুঝানোর চেষ্টা করি সে যে পরিসংখ্যানে সংখ্যাটাকে অগ্রগামী সমাজের সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করছে সেটা ভুল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনগণ বিশেষতঃ এখনকার প্রজন্ম এই সব ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। তারা ব্যাপার গুলো নিয়ে ভাবে, যথেষ্ট গবেষণা করে।

কথা হচ্ছিলো আমার ভাইঝির বিয়ে নিয়ে। যদিও সেটা দূর-অস্ত, তথাপি একদিন গাড়িতে কথাচ্ছলে তুলেছিলাম যে ওকে দেশে নিয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করা হবে, যেমনটা আমাদের সংস্কৃতিতে আবহমানকাল ধরে হয়ে আসছে। ভাবীর তেঁতে ওঠার সেটাই কারণ। বাংলাদেশে বিয়ে করাতে আপত্তি, সেটা সে খোলাখুলি বলেনি মোটেও। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সামনে এক কঠিন সময় আসছে। দুইটা দেশের ও সময়ের সংস্কৃতি ও সীমানার 'গ্যাপ'।

সংস্কৃতির ধারা মোতাবেক পশ্চিমা স্রোত সবসময়ই পুবে বহমান। এটা মেনে নিয়েছি আমরা। কিন্তু সেই স্রোতের ধাক্কায় আমাদের উত্তরসূরীরা যখন পশ্চিমের সামাজিক ধাচের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে যাবে তখন কি আমরা আসলেই মানতে পারবো! আমার মেয়ে যদি তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকতে চায়, আমি কি সেটা মেনে নিতে পারবো? না পারলে সেটা কি আমার মনের সংকীর্ণতা হবে? সে যদি কিছুদিন পর পর তার ছেলে বন্ধু পাল্টায় কিংবা আমার ছেলেটা যদি প্রায় প্রতি সপ্তাহে একজন করে নতুন মুখের মেয়ে নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, আমার কী-ই বা করার থাকবে তখন!

কিংবা ধরে নিলাম আমার যে ভাইঝি। ও বড় হচ্ছে মোটামুটি একটা মিশ্র পরিবেশে যেখানে ঘরে প্রাধাণ্য পায় বাঙালীয়ানা আর বাইরে, স্কুলে সর্বত্র সে দেখছে জার্মানীর মতো একটা দেশের অতীব স্বাধীন একটা জীবন। এখন তাকে যদি দেশে নিয়ে গিয়ে তার মানসিকতার চেয়ে অনেক আলাদা কারো সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয় সে কি পারবে তাল মিলিয়ে চলতে, কিংবা যাকে সে বিয়ে করবে সে কি পারবে জার্মান একটা জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে!

গিয়েছিলাম একটা গ্রীল পার্টিতে। সেখানে খাওয়া শেষে আমন্ত্রিত সবাই যার সিংহভাগই আমাদের দেশী তারা তাদের বাসনখানা টেবিলের ওপর রেখেই উঠে গেছেন। সাথে আধাভরা পানীয়ের বোতল, গ্লাস ইত্যাদি। ছেলেরা যেমন এটা করেছেন, আমাদের দেশীয় মহিলারাও কম যান নি। পরবর্তী কেউ এসে যে বসে খাবে সেই অবস্থাটা ছিলো না মোটেও। অথচ এটা খুব স্বাভাবিক মাত্রার কমনসেন্সের ব্যাপার। খাওয়ার পরে নিজের প্লেটটা নিয়ে কাছে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা উচ্ছিষ্ট ফেলার পলিথিনে ফেলে দিলেই হলো। কিন্তু কেউ সেটা করে নি। এগুলো করেছে আমার ভাবী আর আরও একজন ভাবী যিনি ইটালিয়ান। আমার ভাবী পরে আমাকে খোটা মেরেছে এই নিয়েও। হয়তো মারতো না, আমি বাংলাদেশীদের নিয়ে বেশ উঁচু স্বরে কথা বলেছি বলেই হয়তো!

সমস্যটা আসলে কোথায়! আমাদের কি আসলে এ্যাডপ্টেশনে সমস্যা নাকি আমরা আমাদের ট্র্যাডিশন ফেলতে চাই না। যদি ট্র্যাডিশন ফেলতে না চাই তাহলে একটু আগে যেটা বললাম পরবর্তী জেনারেশনের বেলায় কী হবে আমাদের মনোভাব। আর যদি এ্যাডপ্ট করেই ফেলি তাহলে আমরা সবকিছু মেনে নিতে তৈরী আছি কীনা!

আমরা যারা কোনো না কোনো দায়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশটি থেকে এসেছি, কোনো না কোনো ভাবে বসবাস করছি পশ্চিমা দেশগুলোতে, চোখের সামনে পরিবর্তনগুলো অনুধাবন করছি, তারা কি সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্মুখীন হয়েছি! সংঘাতের মুখে কি আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি বা গেছি হেরে যাবার ভয়ে! আমরা কি মেনে নিতে পারছি সবকিছু!

আমি নিজেকে দিয়ে চিন্তা করি, চলনসই ন্যুনতম সিভিক আর কমনসেন্সের সেন্সের দোহাই দিয়ে আমি হয়তো নিজেকে এ্যাডপ্টেড হিসেবে চালিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু যখন পশ্চিমা বাস্তবতা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, আমি সহজে মেনে নিতে পারবো না। এবং এটাই রূঢ় বাস্তবতা! দুইটা ভিন্ন সংস্কৃতি'র সংঘাত এক সময়, কোনো না কোনো ভাবে আসবেই, আসতে বাধ্য।

কিন্তু আগামী প্রজন্মগুলোর কী হবে। তারা কি সময়ের স্রোতে হাইব্রীড / ডাবল হাইব্রীড প্রজন্ম হয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেবে নাকি পূর্বপুরুষের একগুঁয়ে জীন বয়ে বেড়াবে। অন্য সংস্কৃতির বেলায়ই বা ঘটনাটা কেমন দাঁড়াবে!


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

কঠিন প্রশ্ন। এ ব্যপারে গুরু তীরন্দাজের একটা লেখা পড়েছিলাম।
না ঘরকা না ঘাটকা এমন না হতে দিলেই মনে হয় মঙ্গল।
ভাতিজীর জন্য আলেছ গুটে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

রায়হান আবীর এর ছবি

আমি নিজে যা সেটাই তো আমার সংস্কৃতি। আমার মনে হয় অন্য দেশে যেয়ে নিজ দেশীয় প্রথা, আচার আচরণকে সম্পূর্ণভাবে নিজের মধ্যে ধরে রাখতেই হবে এমন কোন কথা নেই। পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেকে পরিবর্তন করা আমার কাছে খারাপ মনে হয় না। তবে নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা, কৃষ্টি কালচারের প্রতি ভালোবাসা ভুলে চলবে না। চেষ্টা করতে হবে সেগুলোর ভালো অংশগুলো আশে পাশের মানুষদের কাছে তুলে ধরা। সেটাকে সংস্কৃতির আদান-প্রদান বলা যেতে পারে।

আপনার মেয়ে যদি পশ্চিমা সংস্কৃতির মতো চলাফেরা করতে চায় তাহলে আপনার বাধা দেওয়াটা হবে অনুচিত। যে মেয়েটি আজীবন পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ তাকে এখন দেশের একটা ছেলের সাথে বিয়ে না দেওয়াটাই ঠিক। অবশ্য ছেলেটি যদি নতুন সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে সেটা ভিন্ন ব্যপার। এই সব নিয়ে আপাতত চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ আপনার যেই অবস্থা দেখতেছি, আগে তো বিয়া...তারপর না হয় পোলা মাইয়া নিয়া চিন্তা করা যাবে। হো হো হো

---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

খুব ভালো রকম একটি সমস্যা। যে বাচ্চারা যারা পশ্চিমা ধাঁচে বড় হচ্ছে তাদের মানসিকতা একরকম আর বাবা মা তাদের উপর আরোপ করতে চান ভিন্ন রকম। ফলে দুটো মানসিকতার পাল্লায় পড়ে সন্তানটি হচ্ছে না ঘরকা না ঘাটকা। সে না পারছে পুরোপুরি পশ্চিমা হতে না পারছে পুরোপুরি বাঙালী হতে। মূল সমস্যাটার ভূক্তভোগী বাঙালীর মিশ্র সংস্কৃতির সন্তানটি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাবা মাদেরই ঠিক করতে হবে যে সন্তানটি কোন মানসিকতায় বড় হবে। পশ্চিমা হলে পুরোপুরিই পশ্চিমা নয়তো পুরোপুরিই বাঙালী। কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে যে শিশুটি জন্ম নিলো এবং বয়োঃপ্রাপ্ত হলো সে কী করে নিজকে বাঙালীয়ানার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে। যদিও বেশির ভাগ সময়েই তার উপর বাঙালীয়ানা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি সন্তানটিকে মানসিক ভাবে কষ্ট দেয়া হচ্ছে।
কথায় আছে- কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাসঠাস!

বাংলাদেশের বাইরে বাচ্চারা যখন বড় হয়ে যায় তখন তাদের কাছ থেকে আমাদের সামাজিকতা আশা করাটা বোকামী বলেই মনে করি।

কিন্তু পশ্চিমা ধাঁচে যদি ছেলেটি বা মেয়েটি তার সঙ্গী নিয়ে বাঙালী আত্মীয় পরিজনের সামনে দোর দেয় তা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের এখানেও যদি জোর পশ্চিমা হাওয়া লাগে- নতুন যখন পুরোনোকে ঝেঁটিয়ে দূর করে দিয়ে নিজের জায়গা করে নেয় তখন পুরোনোকে অবশ্যই তা মেনে নিতে হবে। এখানে হেরে যাওয়ার কিছু দেখি না। যে যেখানের পরিবেশে বড় হচ্ছে তার সঙ্গেই তার খাপ খায়। অযথা চাপিয়ে দেওয়া বা দুঃখ পাওয়াতেও কোনো সমাধান আসবে না। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালুদেরই মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি।

আমি নিজেকে দিয়ে চিন্তা করি, চলনসই ন্যুনতম সিভিক আর কমনসেন্সের সেন্সের দোহাই দিয়ে আমি হয়তো নিজেকে এ্যাডপ্টেড হিসেবে চালিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু যখন পশ্চিমা বাস্তবতা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, আমি সহজে মেনে নিতে পারবো না। এবং এটাই রূঢ় বাস্তবতা!

আমি বলি মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের থাকতে হবে। এবং এটাই চরম বাস্তব! আর এটাই আমি নিজের বেলায় ভাবি।

খুব সহজ একটি উদাহরণ- আমরা পিচ্চি। আজম খানের গানশুনি আর নাচি। বাবা-চাচা আর মুরুব্বীরা দেখে নাক সিঁটকান। কী গান! কোনো সুর-তাল কিছু নাই!

আজকাল আমরা আইয়ুব বাচ্চুদের গানশুনে পিচ্চিদের একই কথা বলি। কাজেই যুগের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়, হারায়, যুক্ত হয়। হয়তো ব্যক্তিমানসিকতার সংকট কাটতে কিছুটা সময় লাগে। আর সময়ই সবকিছু ঠিক করে দেয়।

পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

শিক্ষানবিস এর ছবি

আমি জোক্স করে হলেও ইদানিং একটা কথা বলি, সবাই বিদেশী বিয়ে করেন। কারণ আন্তঃজাতি বিয়ের মাধ্যমে জাতিতে জাতিতে বিভেদ অনেকটাই কমানো সম্ভব। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে তাহলে অমুক দেশের, অমুক জাতির বলে কিছু থাকবে না; অন্তত দেখে বোঝা যাবে না। তাই আবার বলি, সবাই ভিন্ন জাতি এবং ধর্মের কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিন।
অবশ্য আমি নিজেই এটা করতে পারবো না!! দেঁতো হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় ধুসর গোধূলি, দু’টো জনগোষ্ঠীর কথা আপনি এখানে বলেছেন। যারা আপনার মত বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি সারা জীবনের জন্য পশ্চিমে চলে গেছেন (তাদের কথাই মূলতঃ বলেছেন)। আর যারা আমার মত বাংলাদেশেই আছেন। যে যেখানেই থাকুন না কেন, বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ আর নাগরিক জ্ঞান নিয়ে আপনার উপলদ্ধির সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। দ্বিমত অনেকেই পোষন করতে পারেন। তবে এটি আমারও অনেক ঠেকে, অনেক কষ্ট পেয়ে পাওয়া উপলদ্ধি। আপনি যাকে ঐতিহ্য বলেছেন তা আসলে আমাদের জাতিগত চরিত্র। এই পরিমাপ আমার নিজেকে বা আমার চারপাশের মানুষকে দিয়ে করলে হবে না। স্থান-কাল নির্বিশেষে (স্থান মানে বাংলাদেশের সকল জনপদ, কাল মানে প্রায় একশত বৎসর) বাংলাদেশের মানুষের লদ্ধি আচরন লক্ষ্য করলে এই সত্য অনুধাবণ করতে পারবেন। এটি পরিসংখ্যানগত বিষয় নয়, বোধের বিষয়।

একথা ঠিক যে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এ’নিয়ে ভাবেন এবং নিজেদের পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরও গাধার চামড়ার ভেতর সিংহ বা তার উল্টোটা থেকেই যায়। মূলধারার সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য রেনেসাঁ এবং শিল্প বিপ্লবের মত অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। প্রসঙ্গতঃ কোলকাতাকেন্দ্রিক যে সব বুদ্ধিজীবি বাংলায় রেনেসাঁ সম্পন্ন হয়েছে বলে অংকের হিসাব করে দেন, তারা সম্ভবতঃ কোলকাতার পঞ্চাশ মাইল বাইরে যান নি। যদি যেতেন তাহলে বাংলার আসল মুখ দেখতে পেতেন।

আপনারা যারা ইতোমধ্যেই পশ্চিমে শেকড় গাড়ার চেষ্টা করছেন তাদের মনে এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব প্রবল আকারে থাকবে আমৃত্যু। মুখে আপনি যাই বলুন, আপনার মেয়ের বিয়ে না করে ছেলে বন্ধু নিয়ে আলাদা থাকা বা আপনার ছেলের প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন মেয়েবন্ধু নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করা কোনটাই মন থেকে মানতে পারবেন না। এখানে নৈতিকতা বা পাপ-পূণ্যের হিসাব অবান্তর।

আপনার স্ত্রীও যদি বাংলাদেশের হন তাহলে আপনার অন্তর্গত দ্বন্দ্বের বেশ কিছু পরিমান আপনার সন্তানদের মধ্যে থাকবে। কিন্তু আপনার স্ত্রী যদি পশ্চিমা হন, তাহলে আপনার সন্তানদের মধ্যে আপনার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব সামান্য কিছু পরিমান থাকতে পারে। উভয় ক্ষেত্রে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ’ধরনের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের উত্তরাধিকার হবার কথা না। তবে মূলধারার জনগোষ্ঠীর সদস্য হতে তাদের কত বৎসর লাগবে তা বলতে পারবো না। চীনা বা ভারতীয়রা একশত বৎসরে পারেনি। আফ্রিকানরা দুইশত বৎসরে অনেকটা পেরেছে। তবে চীনা বা ভারতীয়দের তুলনায় আফ্রিকার সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ তা বিচার্য। যে সংস্কৃতি যত বেশী সমৃদ্ধ তার রেশ তত বেশী দিন ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে থাকবে।

আরেকটি বিষয়, আপনি যত বয়সের ভারে নুব্জ্য হবেন, আপনার মানসিক দৃঢ়তা তত কমতে থাকবে। ফেলে আসা জগতের জন্য আপনার হা-হুতাশ তত বাড়তে থাকবে। অবশ্য এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে, তবে তার সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।

কাউকে হেয় বা অপদস্থ করার জন্য আমার এই মন্তব্য না। তারপরও যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে আমি নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী। জানবেন সেটা আমার সাধারণ আর নাগরিক জ্ঞানের অভাব।

================================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আলমগীর এর ছবি

গোধুলি
আমি মোটামুটি নিশ্চিত আমাদের কালচারের ব্যপারে। এটা ছাড়া মুশকিল। আয়োজিত বিয়ের বিষয়ে বলি, এটা হতেই থাকবে। সাদাদের সাথে সবচেয়ে ভাল আত্মীকৃত হয়েছে ভিয়েতনামিজরা। এটা ভাল না মন্দ সে তর্ক নিরর্থক। আপনার ভাইঝির একটা বাংলাদেশী বা বাংলা বলে (প্রবাসী আর দেশবাসী যাই হোক) এরকম একটা ছেলের সাথে বিয়ে হবে- এমনটা আশা তার বাবা মা করতেই পারে। আবার সে নিজে যদি তার বিবেচনায় সাদা কাউকে বিয়ে করে, না লিভিং-টুগেদার করে সেটা তার উপরই ছেড়ে দেয়া যায়।

প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের মেয়ে সন্তানদের নিয়ে খুব চিন্তিত। এর চেয়ে সত্যি কথা আর নেই।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

অনেক অভিবাসী মনে করেন তারা চাইলেই ছেঁকে-বেছে নিতে পারেন - হোস্ট দেশ থেকে কি নিবেন আর কি নিবেন না। ভাবখানা এমন যে, আমি ইউরোপ আমেরিকাতে এসেছি শ্রেফ অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে। তাই আমি শুধু এদের টাকা উপার্জনেই আগ্রহী, এদের জীবন-যাত্রা সংস্কৃতি সবকিছু থেকে আমি নিজেকে তো গুটিয়ে রাখবোই, তার উপরে আমি আমার বাচ্চাদেরও এই বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো, ওদের আমি খাঁটি বাঙ্গালি / খাঁটি মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলবো।

বলা বাহুল্য যে এর মতো নিষ্ফলা বোকামি আর হয় না। অভিবাসন মানে সবরকম ভাবেই অভিবাসন। আমি কেবল ইকনোমিক ইমিগ্র্যান্ট হবো, ওদের কালচার আমার বাচ্চাদের স্পর্শ করতে পারবে না, এটা ভাবা হাস্যকর। কিন্তু তারপরেও প্রচুর ইমিগ্র্যান্ট এরকম ভাবেন। ভেবে ভেবে নিজেদের ব্লাড প্রেশার তো বাড়ানই। তার উপর নানা বিধি-নিষেধ নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল দিয়ে ছেলেপেলেদের চতুর্পাশে আটকে দেন - ছেলেপেলেরা নিজেদের স্বত্ত্বা নিয়ে অতিশয় কনফিউজড ভাবে বেড়ে ওঠে। না এস্পার না ওস্পার। বাপ-মার মন রাখতে গিয়ে নিজে অনেক সময় নানাভাবে কষ্ট পায়, আর বাপ-মার নিয়মনীতি উপেক্ষা করতে গেলে বাপ-মাকে কষ্ট দেয়। আমেরিকাতে একটা কথাই প্রচলিত আছে - ABCD - American Born Confused Desi!

অবশ্য আমার দেখা মতে আমেরিকাতে দেশীয় অভিবাসীদের ইন্টিগ্রেশান অনেক বেশী এগিয়ে। এর একটা কারণ আমেরিকাতে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টদের সমাগম (ডিভি-ওয়ালাদের বাদ দিলে)। ইউরোপে ডিগ্রিধারী ইমিগ্র্যান্ট এসেছে তুলনায় অনেক কম, বরং গ্রামের অশিক্ষিত অল্প-শিক্ষিত লোকই এসেছিল বেশী - বিলাতে সিলেটী ও কাশমীরের মীরপুরী সম্প্রদায়, ফ্রান্সে উত্তর আফ্রিকা ও ফরাসী-ভাষী কালো আফ্রিকানেরা, হল্যান্ড ও বেলজিয়ামে মরক্কোর মানুষ, জার্মানীতে তুর্কি অভিবাসী ইত্যাদি ইত্যাদি। তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত রক্ষণশীল ধর্মভীরু গ্রামবাসীদের পক্ষে এই অতি-আধুনিক, সেক্যুলার এবং sexually liberated পশ্চিমের সাথে খাপ খাওয়ানো প্রায় অসম্ভব। মিশরীয় ট্যাক্সি চালক বাবা তাই নিজ হাতে তার মেয়েদের গুলি করে খুন করে টেক্সাসে। বিলাতের পুলিশ হিসাব করে যে প্রায় ১৭,০০০ দেশী বংশোদ্ভূত মেয়েরা প্রতি বছর বিভিন্ন অপরাধের শিকার হয় - জোরপূর্বক বিবাহ থেকে খুন (honour killing) পর্যন্ত। এই চাপা সাংস্কৃতিক সংঘাতের আরেক সাইড নিয়ে ইউরেবিয়া শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম গত বছর। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।

যেই অভিবাসীরা দেশীয় সংস্কৃতি / বিজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত, তাদের উচিৎ বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে দেশে ফেরত চলে যাওয়া। বিদেশ মানে মানসিকভাবে হাজারো এডজাস্টমেন্ট। এটা না করতে পারলে বিদেশে থাকা বেদনাদায়ক এবং নিরর্থক।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

মুজিব মেহদী এর ছবি

যতটা ধরতে পেরেছি, সুবিনয়ের কথাগুলো যৌক্তিক মনে হলো।

আমার মনে হয় অভিবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাঙালিয়ানা যদি খানিকটা ছায়াপাত করেই তবে সেটা স্বাভাবিকভাবেই করবে, জোর করে করানো যাবে না। করানো ঠিকও নয়। ছেলেমেয়েদের অধিকার আছে নিজে কীভাবে চলবে না চলবে সে ব্যাপারে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবার। তারাই নিক না! মিশ্র সংস্কৃতিতে বড়ো হওয়া এই মিশ্র মানুষগুলোই হয়ত পৃথিবীকে নতুন রঙ দেবে। সে রঙ কেমন রঙ জানি না যদিও।
................................................................
জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।
(দীন দ্বিজদাস)

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সুবিনয়ের মন্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। পশ্চিমা বিশ্বে আমি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অভিবাসী হবো, সেখানকার জীবনযাত্রার যাবতীয় সুবিধা ভোগ করবো, অথচ সংস্কৃতিগতভাবে নিজেরটা অক্ষুণ্ণ রাখবো - এটা আসলেই হয় না। এইসব নিয়ে জোর-জবরদস্তি চলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর, যা কখনোই ভালো ফল দেয় না। এ সম্পর্কে বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যেই অনেকগুলি খারাপ উদাহরণ আমার নিজেরই জানা।

আমেরিকায় অভিবাসীদের মধ্যে পৃথিবীর তাবৎ জাতি ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি আছে। দীর্ঘকাল বসবাসের সূত্রে সব দেখে ফেলেছি, এমন দাবি করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, অভিবাসীদের নিজের সংস্কৃতি রক্ষার চেষ্টা এক ধরনের হেরে-যাওয়া যুদ্ধ। প্রথম বিসর্জন দিতে হয় ভাষা। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এটা সঞ্চারিত করতে পারে, এমন অভিবাসী অতি বিরল। জীবনাচরণের অন্যসব ক্ষেত্রেও একই কথা। যেটা মোটামুটি টিকে থাকে তা হলো, খাদ্যাভ্যাসের খানিকটা, ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচরণগুলি এবং পারিবারিক কিছু প্রথা।

একটা বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই, কেউ লিখলে ভালো হয়। বাঙালিদের যে অংশটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়ে আছেন, তাঁদের উঠতি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি সেখানকার সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হচ্ছে, সেইভাবে বেড়ে উঠছে? নাকি তারাও পশ্চিমমুখী?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

যা বলতে চেয়েছি, বিজ্ঞজনেরা সব বলে দিয়েছেন। তাই কিছু না বলে শুধু ধন্যবাদ দেব এই বহুল আলোচিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়োপযোগী বিষয়টি নতুন করে তুলে ধরার জন্য হাসি
ধুগো'দা, আপনি কোথায় বিয়ে করবেন? বিদেশে না দেশে? চোখ টিপি

দ্রোহী এর ছবি

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু দেখেছি। প্রবাসে বাঙালি জিনিসটা বেশি সুবিধার না। এ কথাটা মোটা দাগে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

প্রথমত - বাঙালিদের কেউ সহজ কথাটি সহজে বলতে চায় না। পাছে লোকে কিছু বলে ভাবতে ভাবতেই আর কিছু করা হয় না।

দ্বিতীয়ত - জাতিগতভাবেই আমরা দ্বিধাবিভক্ত! সুতারাং, কোন এক জায়গায় থিতু হবার পরে দেখি নানাধরনের গ্রুপিং। বিবাহিত-অবিবাহিত গ্রুপিং ও যে হতে পারে সেটাই ভাবতে পারিনি কখনো।

আমি নিজে যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছি সে আগাগোড়া বড় হয়েছে বিদেশে। সে আমার চাইতেও চমৎকার বাংলায় কথা বলে, নজরুল সংগীত গায়। শরৎচন্দ্র, মানিক সে আমার আগেই পড়ে শেষ করেছে। বিদেশিদের সাথে মেলামেশায় সে আমার চাইতে বেশি সাবলিল, চটপটে।

পক্ষান্তরে আমার বর্তমান শিক্ষকের [তিনি বাঙালি] মেয়েটি বাংলায় কথা বলতে পারে না। এটা নিয়ে শিক্ষক মহাশয় গর্ব করেন। বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বড় গলায় এটা সবাইকে জানিয়ে দেন যে নিজের মেয়েটিকে তিনি পুরোপুরি আমেরিকান হিসাবে গড়ে তুলেছেন।

তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে সন্তান কীভাবে বেড়ে উঠবে তা নির্ভর করে বাবা-মার উপর।

বিদেশের মাটিতে বসে জোর করে কাউকে বাঙালি বানানো যাবে না। যদি সে নিজে গ্রহণ করতে প্রস্তুত না থাকে।


কী ব্লগার? ডরাইলা?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আহারে ভাইজান অত কান্নাকাটি করে না
মাইনা লন মাইনা লন
আপনি হইলেন গিয়া হ্যাঙ্গিং অবস্থয় ঝুলন্ত জেনারেশন
দুই নৌকায় দিয়া পা
ডট ডট ফাইরা হইছে হা....

পরের জেনারেশন আপনার চিন্তা শুনলে হাসবো...

চাইপা যান

স্নিগ্ধা এর ছবি

তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে সন্তান কীভাবে বেড়ে উঠবে তা নির্ভর করে বাবা-মার উপর।

মানতে পারলাম না। বাবা মা'র ভূমিকা বা প্রভাব তো থাকে অবশ্যই, কিন্তু সেটাই প্রধান নয়। আমি অনেক দক্ষিণ এশিয়দের (বাংলাদেশী তো বটেই) চিনি, যারা বাবা মা'র চাপাচাপিতে বাড়িতে একরকম ব্যবহার করে আর বাড়ির বাইরে বেরুলেই অন্যরূপ ধারণ করে। যে কোন দেশে দ্বিতীয় প্রজন্ম কি হিসেবে বেড়ে উঠবে সেটা তার নিজের ব্যক্তিগত রুচি এবং ব্যক্তিত্ব, পারিপার্শ্বিকতা, বাবা মা, অর্থনৈতিক অবস্থান এরকম বহু কিছুর ওপর নির্ভর করে। ভিন্‌ দেশের মাটি হলে তো তার সাথে যোগ হবে বাবামা নিজে সে সমাজে বিদেশী হিসেবে কতখানি গৃহীত বা উপেক্ষিত সে ব্যাপারটাও।

রায়হান আবীরের কথাটা আমার খুব পছন্দ হলো! আসলেই তো,

আমি নিজে যা সেটাই তো আমার সংস্কৃতি।

আর 'না ঘরকা না ঘাটকা' কথাটা নিয়ে আমি একটু সংশয়িত। এটাকে মনে হয় খুব একটা ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না? তার মানে কি এই যে, কোন মানুষকে 'পুরোপুরি' বাংলাদেশী/প্রতীচ্যের অনুসারি বা 'পুরোপুরি' আমেরিকান/প্রাচ্যীয় হতে হবে? মধ্যপন্থায় তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হবে? যদি তা মেনেও নেই (নিচ্ছি না কিন্তু হাসি ) তাহলে সেই পরিপূর্ণ দেশী বা বিদেশীর সংজ্ঞা এবং সীমারেখা কি?

মনজুরাউল এর ছবি

আপনার অনেক বিষয়ের সাথেই একমত।

মানিয়ে নেওয়ার কথা যেটা বলছেন সেটা হয়ত হয়ে যাবে । এক সময় এ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে, কিন্তু

নাকি পূর্বপুরুষের একগুঁয়ে জীন বয়ে বেড়াবে।

এটা সহজে মিনিমাইজ হবার নয়।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

আকাশ এর ছবি

দ্রোহী ভাষার উদাহরন দিলেন। ভাষা, পোশাক আশাক, এগুলো যে কেউ যে কোন দেশেরটা শিখে নিতে পারে, এগুলো বাহ্যিক ব্যাপার। বাবা মা, বন্ধুবান্ধব, ভালোবাসার মানুষ, যে কারো থেকে ইন্সপায়ারড হয়ে এগুলো শিখে নেয়া যায়। বিদেশে বড় হওয়া আমার এক বাঙালী বান্ধবী পুরাদস্তুর জাপানিজ বলে, সকাল বিকাল সুশি খায়, জাপানীজ সাহিত্যও পড়ে রীতিমত। এগুলোতে ওর বাবা মায়ের হাত ছিলো না। তবে আপনার স্ত্রী যে বিদেশীদের সাথে আরও সাবলীল ভাবে মিশতে পারে, এই ব্যাপারটা স্রেফ শিখে নেয়া যায় না। এটা করতে হলে বিদেশীদের 'নিজের' করে ভাবতে হয়। সেই হিসেবে আপনার স্ত্রী আপনার চেয়েও অনেক বেশী 'বিদেশী'। বিদেশে বড় হওয়া যারা দেশী ভাষা জানে, সাহিত্য পড়ে, ওদের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে কথা বলে বুঝবেন, ওরা দেশী সংস্কৃতির অনেক কিছু বুঝে না, বুঝলেও মানতে পারে না। যেমন বড়রা যতই এবসার্ড কথা বলুক, ওদের মুখের উপর কথা বলতে হয় না, এটা বাঙালী সমাজে বড় হওয়া একটা মেয়ে স্বাভাবিক বলেই জানবে, তার ভালো না লাগলেও সে ছোটবেলা থেকেই সেটাকে মেনে আসবে। বিদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের কিন্তু এটা বুঝতে, মানতে কষ্ট হয়। এটা 'ভিতরের' ব্যাপার। ধুসর গোধুলী যা বলতে চেয়েছেন, তা ওই ভিতরের ব্যাপারগুলো নিয়েই মনে হয়, শুধু বাহ্যিক ব্যাপারগুলো না।

একজন মানুষের লাইফ স্টাইল, একদম ভিতরের উচিত অনুচিত, স্বাভাবিক অস্বাভাবিক লাগালাগির সংজ্ঞার কথা বলেছেন ধূগো, এই সংজ্ঞায়নটা চারপাশের পরিবেশ থেকে বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়। আমি একটা বাঙালী মেয়েকে চিনি যার মুখটা দারুণ বাঙালী, অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলে, হারমোনিয়াম বাজায়, বাঙালী অনুষ্ঠানে নাচে। ও যখন শাড়ি পরে, তখন দেখে মনে হয় এই মেয়ে এখনই লজ্জায় লাল হবে। অথচ ও বিয়ে ব্যাপারটাকে মানতে পারে না, ওর মনে হয় অন্তত: দুই বছর লিভ টুগেদার করা ছাড়া বিয়ে করা স্রেফ বোকামী।

এসমস্ত ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় শুধু দেশী সংস্কৃতির কথা বলে কিছু হয় না। তার চেয়েও অর্থবহ কিছু লাগে। সেটা যুক্তির মারপ্যাঁচই হোক আর ধর্মবিশ্বাস রক্তে রক্তে ঢুকিয়ে দিয়েই হোক।

থার্ড আই এর ছবি

আমার মনে হয় একটা দ্বন্দ কাজ করে সেটা হলো প্রজন্মের দ্বন্দ। বাবা মা যেখানে শাড়ি লুঙ্গির প্রতি দূর্বল সেখানে ছেলে মেয়েরা জিন্স টি সার্টে অভ্যস্ত, সংস্কৃতির এই রুপান্তর নিয়ে যেমন অনেক পিতা মাতা এখন মাথা ঘামান না তেমনি এই সংস্কৃতি আমাদের দেশেও অনেকটা সাধারণ ব্যপার হয়ে গেছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে যেমন ছেলে মেয়ের বিবাহ বহিভূত সম্পর্ককে তেমন অনৈতিক বলে বিবেচনা করা হয়না। তেমনি আমাদের সমাজেও ধীরে ধীরে নিজেদের পছন্দে ছেলে মেয়ের বিয়ে অনেক পিতা মাতাই ভালো চোখে দেখছে।

একটা সময় ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েতে কথা বলতে হতো শিক্ষকদের উপস্থিতিতে অনুমতি নিয়ে এখন মেয়ে ছেলে প্রকাশ্যে ক্যম্পাসে হাত ধরে হাটে। তাই বলে এটাকে আমি খারাপ বলবো কোন যুক্তিতে ?

সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়, এই মিশ্রন ঠেকানো যাবেনা, এখন আপনি কোনটা গ্রহন করবেন কোনটা বর্জন করবেন এটা আপনার নিজস্ব বিবেচনা। তবে ছেলে মেয়েদের স্বাধীনতার পাশাপাশি পিতামাতাকে অবশ্যই তাদের সন্তানদের সহায়তা করা উচিত যা কিছু ভালো সেটি গ্রহন করতে আর অনৈতিক কিছূ বর্জন করতে। সংস্কৃতি কোন গন্ডি কিংবা কোন নিদিষ্ট ছাঁচে আটকে থাকেনা। তবে নিজের হেরিটেজ নতুন প্রজন্ম যেন ভুলে যায় সেই দায়িত্বটা পরিবারের উপর বর্তায় অনেকখানি।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

অনিন্দিতা এর ছবি

আমার ও মনে হয় নিজের সংস্কৃতির যাকিছু ভালো (নৈতিকতা/ মূল্যবোধ সহ)সেগুলো পরিবার থেকেই আসা উচিত।
আসা দরকার।
বাকী কিছু বাইরে থেকে নিতে গেলে কতটুকু নিবে বা বর্জন করবে সেটা ছেলেমেযেরা অনেকটাই নিজেরা ঠিক করে নিতে পারবে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

প্রজন্মের ব্যবধানের দূরত্বও কি আগের মতো আছে? আগে প্রজন্মের বদল হতো দশ বারো বছর পরে পরে... বাবা আর ছেলের ব্যবধান হতো প্রজন্মের... এখন তো বড় ভাই আর ছোটভাইয়ের মধ্যেই প্রজন্মের ফারাক... দুই বছরেই প্রজন্ম পাল্টায়ে যায়... নতুন একটা প্রযুক্তিই পাল্টায়ে দেয় সবকিছু...
সামনে কঠিন সময়... হুশ কইরা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মহাচিন্তার বিষয় !
দেশ থেকে বিদেশে সেটল করা বাবা মা, আর পুরোপুরি সেখানে বড় ও বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মতের মিল হওয়াটা আমার কাছে অনেকটাই অসম্ভব মনে হয়। বিশেষ করে যে ঘরে পাচ্ছে বাঙালী সংস্কৃতি আর বাইরে পাচ্ছে পশ্চিমাটা। এই দুটোর মাঝামাঝি জায়গাটাতে অ্যাডজাস্ট করাটা আসলে কঠিন। তবে যে যাকেই বিয়ে করুক না কেন, তাদের মধ্যে বিয়ের আগে অন্তত ছয়মাসের বোঝাপড়াটা জরুরী বলে মনে করি।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ফেরারী ফেরদৌস এর ছবি

বিজ্ঞজনদের সব কথা পড়ে আমি তো ব্যাপক চিন্তায় পইড়া গেলাম! এইসব ভাবলে তো উন্নত জীবনের আশায় কারোই আর বিদেশ যাইতে ইচ্ছা করবো না। আবার দেশেও ম্যালা গ্যাঞ্জাম...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

স্টিরিওটাইপগুলোকে বিশ্লেষণ করে মনে হয়, আমরা যেই বাঙালিয়ানাকে ধরে রাখতে চাই এবং যেই পশিমা সংস্কৃতিকে দূরে রাখতে চাই, তার মাঝের বিভেদরেখাটি শালীনতা।

শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু আমি আমার সন্তান গুলশানের বাঙালি হওয়ার চেয়ে ব্যাটন রুজের আমেরিকান হলেই পছন্দ করবো বেশি।

আমার সন্তানকে দেশবিযুক্ত একটা জায়গায় জন্ম দিয়ে, বড় করে, তার কাছ থেকে বাঙালি ব্যবহার আশা করাটা অনেক বড় অন্যায় হবে। আমি শুধু আশা করবো "এই কাজটা আমার বাবা-মা পছন্দ করবে না" চিন্তা টুকু তার মাথায় কাজ করবে, যেমনটা আমাদের প্রত্যেকের ভেতর করে।


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- সমস্যা আছে ইশতি ভাই।

গুলশান কিংবা ব্যটন রুজের আমেরিকান আসলে ফ্যাক্টর না। লিভিংটুগেদারটাও আমি গণনায় আনতে চাইছি না। আমাদের দেশে লিভিং টুগেদার প্রথা নেই। কিন্তু বিয়ের আগের দৈহিক সম্পর্ক থেমে নেই এতে। খাঁটি বাঙালী যে সত্ত্বা, আমি সেটা নিয়ে বলতে চাইছিলাম। একজন জার্মান মাও তার মেয়েকে কোনো সম্পর্কে জড়ানোর পর উপদেশ দেয় যেনো অতি তাড়াতাড়ি সে "কিছু" না করে। এটা কেনো? আগে যাচাই করো, যাকে দিচ্ছো সে সেটার মর্ম বোঝে কীনা! সে তোমার প্রতি আসলেই শ্রদ্ধাশীল কীনা! কারণ এই ক্ষেত্রে ন্যাড়া একবার বেল তলায় যাওয়া শুরু করলে বারবারই যাবে। সম্পর্কের বাঁধন তখন আর থাকবে না। যা থাকবে সবই মেকী, একটা "কিছুর" জন্য সবকিছু। বাস্তবতা হলো, ঘটছে ঠিক এগুলোই। সম্পর্ক ভাঙছে, গড়ছে, গড়ছে আবার ভাঙছে। আমার আপত্তিটা বোধহয় সেখানেই।

আমি উত্তর প্রজন্মকে কোনো ভাবেই কনফিউজড করার পক্ষপাতি না। আর তার জন্য তাদের মতের স্বাধীনতা দিতে হবে। সেই স্বাধীন মতকে প্রাধাণ্য দিতে গেলে তারা তাদের চারপাশে যা দেখবে সেটা থেকেই শিক্ষা নেবে। সেক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনই যদি আমাদের দেশী হয় আর তাদের মধ্যে সংস্কৃতির বন্ধনটা খুব মজবুত হয় তাহলে হয়তো আপনি যেটা বললেন সেই বোধ তৈরী হবে সন্তানের ওপর। কিন্তু বাবা কিংবা মায়ে'র একজন যদি পশ্চিমা হয় তখন কী দাঁড়াবে!

আমার ঠিক এখনকার অবস্থান থেকে যদি নিজেকে ব্যাখ্যা করি তাহলে এমন একটা জিনিষ পাই। আমি যদি এখন কোনো জার্মান ললনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি তাহলে কিন্তু আমি আমার কৃষ্টি বজায় রেখে তার সঙ্গে সম্পর্ক আগাতে পারবো না। আমি এই সম্পর্কের বেলায় হয়তো তার কৃষ্টিই গ্রহণ করবো। কিন্তু আমার ছেলে বা মেয়েকে আমার মতো অবাধ একটা সম্পর্কে দেখতে আমি নারাজ। এখন পর্যন্ত এটাই আমার বাস্তব, পার্ভার্ট মানসিকতা। পরে পরিবর্তন হলেও হতে পারে, শিউর না।

এই মানসিকতার পেছনের কারণ হিসেবে আমি যে জিনিষটা বলতে চাইবো তা হলো-
আমার দেখামতে জার্মানীতে দুজন জার্মানের মধ্যকার সম্পর্কের স্থায়ীত্ব একজন জার্মান ও একজন বিদেশীর মধ্যকার সম্পর্কের স্থায়ীত্ব অপেক্ষা অনেক বেশি। আমি কিংবা আমার উত্তর প্রজন্ম এই সমস্যাটা থেকে উৎরাতে পারবে না সহসা। ভঙ্গুর কোনো সম্পর্কের প্রতি আমার কোনো কালেই কোনো আগ্রহ ছিলোনা, এখনো নেই, ভবিষ্যতে যে থাকবে সে নিশ্চয়তাও দেয়া যাচ্ছে না।

এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি আমার এ্যাডপ্টেশনে সমস্যা হচ্ছে, আমার কি আমার নিজের দেশে ফিরে যাওয়া উচিৎ তাহলে!
এটা হয়তো আপাতঃ একটা উপায় বোধ হতে পারে। কিন্তু আলটিমেটলী সেটাও কোনো সমাধান না। কারণ পশ্চিমা স্রোত পাশ্চাত্যের দিকে চিরকারলই বহমান। আমি এখন এই স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে গেলেও একসময় না একসময় এই স্রোতে আমাকে পড়তেই হবে। তখন আমি বা আমার মতো যারা আছে, তাদের অবস্থা কী হবে! আমার ভাবনাটা আসলে সেইখানেই।

উপরের প্রত্যেকটা মন্তব্য থেকে দারুণ সব জিনিষ উঠে এসেছে। বিশেষ করে সুবিনয় মুস্তফী দারুণ বলেছেন। অভিবাসী হতে হলে আসলে সব দিক থেকেই অভিবাসী হওয়া উচিৎ। ডেনমার্কে বসে মাইকে আযান দেয়ার কথা চিন্তা করা অবান্তর। সশব্দে আযান দিতে হলে ঢাকা কিংবা ইস্তানবুলে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু দূর পরবাসে বসেও যদি নিজের দেশটাকে, নিজের পরিবার পরিজনের হ্যারিটেজকে লালন করা যায় স্বল্প পরিসরে হলেও সেটা মন্দ কী! অভিবাসন তো কোনো কালচারকে বিলুপ্ত করার জন্য না বরং সেই কালচারকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কোনো কালচারের জন্য সুফলদায়ক জিনিষটা পিক করে নিজের কালচারের প্রায় সদৃশ ইলেমেন্টের পাশে সেট করে দেয়া, কালচারাল এক্সচেঞ্জ তো আসলে সেটাই।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।