ভাষা নিয়ে ভাসাভাসা ভাবনাঃ ভাষার জাতিভেদ প্রথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০৯/২০১৪ - ৯:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদে বলা আছে, দুনিয়ার মাত্র চারটি ভাষা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত - গান গাওয়ার জন্য গ্রীক, যুদ্ধের জন্য ল্যাটিন, কান্না ও শোক প্রকাশের জন্য সিরিয়াক ভাষা (সিরিয়াক/Syriac ছিল প্রাচীনযুগে উত্তর মেসোপটেমিয়ার ভাষা, যা একটি প্রধান সাহিত্যিক ভাষা হয়ে উঠেছিল খ্রীষ্টীয় প্রথম থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত) এবং দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য কাজের জন্য হিব্রু ভাষা। কোন ভাষা কোন কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত, সে বিষয়ে অন্য অনেক জ্ঞানী-গুণীরা নানা ধরণের মতামত দিয়েছেন নানা সময়। স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লস অনেকগুলি ইউরোপীয়ান ভাষা জানতেন। তিনি বলেছিলেন, আমি ঈশ্বরের সাথে স্প্যানিশে, মহিলাদের সাথে ইতালিয়ানে, পুরুষদের সাথে ফরাসীতে এবং আমার ঘোড়ার সাথে জার্মানে কথা বলি। পঞ্চম চার্লস যে ঈশ্বরের সাথে স্প্যানিশ বলবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই - আমরা বাঙালীরা নামাজে যতই আরবীতে 'ইয়া কা'না বুদু ওয়া ইয়া কা'নাস্তাইন বলি না কেন, অথবা পুজোয় সংস্কৃত মন্ত্র আওড়াই না কেন, ঠেলায় পড়লে মুখে বাংলাতেই ডাকি 'হায় আল্লাহ!/হায় ভগবান!' বলে। অনেকে এতদুরও বলেছেন যে, কিছু ভাষার ব্যাকরণ এবং আভ্যন্তরীণ সংগঠন জটিল বিষয়াদি প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ উপযুক্ত বা সাবালক নয়। জার্মানে যা বলা যায়, সাঁওতালি বা চাকমা ভাষাতে কি সেটা প্রকাশযোগ্য? জার্মান ভাষার জটিল বিষয় প্রকাশের সক্ষমতার কারণ এই ভাষার ডিসিপ্লিন ও গঠন - ফলে দর্শন এবং বিজ্ঞান সেখানে সমৃদ্ধি লাভ করেছে, এবং সাধারণতঃ জার্মানরা অন্য অনেক জাতির লোকেদের চেয়ে বেশি ভাবুক ও দার্শনিক মনের অধিকারী হয়।

নানা আড্ডায় শুনবেন এরকমের নানা কথা। সময়ে সময়ে আমরা অনেকেই শখের ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত হয়ে যাই। বেশ অকাট্য যুক্তি। একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা তার সংস্কৃতি, মানসিক গঠন ও চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে - এই ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিকই মনে হয়। তবে মাঝে মাঝে লোকে এমন সব মন্তব্য করে বসে, যে সেটা ভাবনার জগতের বাইরে এসে বাস্তব দুনিয়ায় আঘাত হানে। একজন আমাকে বললেন যে, বাংলা সম্ভবত হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ধারায় ধ্রুপদ/ধামার বা এমনকি গজলের জন্যও খুব একটা উপযুক্ত নয়। হ্যাঁ, কাজ চালানো যাবে, তবে উর্দু/হিন্দি/ব্রজবুলি বা ফারসীতে সেই একই জিনিস আরো মধুর শোনাবে। ফেসবুকে শুনলাম, কোন দেশের জাতীয় সংগীত নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে মধুর জাতীয়সংগীত নির্বাচিত হয়েছে। ক্রিয়ার কাল বা টেনস সব ভাষাতে একরকম নয় - কোন কোন ভাষাতে ভবিষ্যত কাল নেই। সেক্ষেত্রে আমরা কেউ কেউ হয়তো ধারণা করতে পারি যে, ভবিষ্যতের বিষয়ে সেই ভাষাভাষীদেরকে কিছু বুঝাতে গেলে বেশ কষ্ট হবে, অথবা তারা আদৌ বুঝবে না - তারা সম্ভবত বর্তমান নিয়েই শুধু ভাবে। সেখান থেকে অতি আগ্রহীদের কেউ কেউ আবার বলে বসবেন, সেই ভাষাভাষীরা বাংলা/ইংরেজীভাষীদের তুলনার আদিম ও অসভ্যতর। প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ান ভাষায় অপরাধ এবং শাস্তি প্রকাশের জন্য একটামাত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়, কাজেই তারা এই দুইটার পার্থক্য করতে পারত না, অথবা এই দুটাকে প্রাকৃতিকভাবেই একত্রে জড়িত মনে করত। ফরাসী হলো প্রেমিকদের ভাষা - আহা, কি তার সুর আর কি তার প্রকাশভঙ্গী! ইংরেজী হল খটমটা ভাষা, কেজো ভাষা, promiscuous ভাষা, যারা নানা ভাষা থেকে নির্বিচারে অনেক অনেক নিয়েছে এবং নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করেছে - ঠিক যেন ইংরেজ জাতির মতোই, যারা সারা দুনিয়ায় দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করে ব্রিটেনকে আজকের ব্রিটেন বানিয়েছে।

এরকম আরো অনেক বলা যায়। ব্যাপারগুলি আমাকে ভাবাত এবং কৌতুহলী করত। হাই স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বাসাতে একটা বই পেয়েছিলাম আমার বাবার আমলের পুরাতন খাতাপত্রের ধুলাময় স্তুপের মধ্যে - যে বইটির একটি শব্দও আমি বুঝতে পারি নি, যদিও তা দেখে ইংরেজী মনে হয়েছিল। তাতে আমার সেই সময়ের সদ্যার্জিত ইংরেজীজ্ঞানসম্ভূত গরবিত অহম বেশ আঘাত পেয়েছিল - কি এই ইংরেজী বই, যার একটা শব্দও আমি বুঝতে পারছি না? আমি কি তাহলে ইংরেজীর কিছুই জানি না? পরে বড় ভাইয়ের কাছে শুনলাম, সেটি ছিল ল্যাটিন ভাষার বই, যাদের আছে ইংরেজীর মত সেই একই বর্ণমালা। শুধু এই দুটি ভাষাই নয়, আরো অনেক ভাষাতে আছে সেই এ বি সি ডি। খুবই অবাক হয়েছিলাম জেনে যে, সেই একই ছাব্বিশটি অক্ষর দিয়ে মানুষ তার মনের সকল ভাব প্রকাশ করছে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ভাষায়, অথচ কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না। ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসী ও ইংরেজীর ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম - ওদের যেহেতু প্রায় একই অক্ষরমালা - কিন্তু ইংরেজী আর আরবীর কি হবে? এখানে অক্ষরসংখ্যা খুব একটা কম-বেশী নয়, অথচ মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করছে এক্কেবারে আলাদা কায়দায় - একজন আরেকজনের ভাষা পড়তেও পারবে না আগে থেকে না জানা থাকলে। অথবা, ইংরেজী-বাংলার কথা ভাবুন - আমাদের অক্ষরসংখ্যা ইংরেজীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, তাহলে কি আমাদের ভাষার প্রকাশক্ষমতা অথবা আভ্যন্তরীণ সংগঠনের জটিলতা ইংরেজীর চেয়ে বেশী? চাইনীজ ভাষাতে তো অক্ষরসংখ্যা আরো অনেক বেশী, এবং সে ভাষায় অক্ষর বা শব্দের ধারণাটাও আলাদা। সেই তো একই মানুষ, একটাই পৃথিবী, একটাই রবি-শশী, তাহলে এত এত ভাষা কি শুধু তাদের নিজের কায়দায় সেই একই বাস্তবতাকে বর্ণনা করছে? আসলে ব্যাপারটা কি এমন যে, মানুষের মনের ভাবগুলি এবং তাবত বাস্তবতা ধ্রুব, যা যে কোন ভাষাতেই সমভাবে প্রকাশ করা সম্ভব?

ভাষার সঙ্গে মানুষের ভাবনা ও তাদের সংস্কৃতির সম্পর্কের এই ব্যাপারটা একটা স্পেক্ট্রাম বা ধারাবাহিক ক্রমের মতন, যেটার এক প্রান্তে আছেন উপরে যাদের কথা বললাম, সেই শখের ভাষাতাত্ত্বিক আড্ডাবাজেরা। তারা বলেন, উমুক ভাষার কারণে উমুক জাতিটা এইরকম, তমুক জাতি তাদের ভাষার কারণে সেইরকম, এই ভাষাটা আদিম, ওই ভাষাটা আধুনিক/জটিল, এই ভাষাটা খটমটা, ওই ভাষাটা মধুর/কাব্যিক ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও কেউ কেউ হালকা প্রতিবাদ করে বলতে পারেন যে, গারো ভাষায় কম্পিউটারের প্রতিশব্দ নেই বটে, কিন্তু একজন গারোভাষীকে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দিলে এবং শেখালে সে অবশ্যই বুঝতে পারবে কি সেই বস্তু। আবার, যে সব ভাষাতে ক্রিয়াপদের ভবিষ্যতকাল নেই, তারা সবাই যে আদিম, ভবিষ্যতভাবনাবিহীন এবং আমাদের মানদণ্ডে unsophisticated, এমন ভাবাটাও অন্যায়, কারণ এর উল্টোটাও করে দেখানো সম্ভব। এমনকি ইংরেজীভাষীরাও ক্রিয়াপদের ফিউচার টেন্স ব্যবহার না করেই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে পারেন - I am going to buy a computer next Monday. I am flying to Dhaka soon. কাজেই, ভাষাতে ভবিষ্যতকাল নেই বলেই যে সেই ভাষাভাষীরা ভবিষ্যত সম্পর্কে ভাবেন না, সেটা সম্ভবত সঠিক নয়। তবুও, সাধারণভাবে, ভাষার সাথে মানুষের চিন্তনপ্রক্রিয়ার এবং সংস্কৃতির নানা দিকের গভীর সম্পর্ক আমরা সবাই মোটামুটিভাবে স্বীকার করে নেই।

এই ভাবনার আরেক প্রান্তে আছেন আধুনিক সিরিয়াস ভাষাতাত্বিকেরা, যারা বলেন, সকল ভাষাই শেষ বিচারে এক। তারা বলেন, দীর্ঘ ইতিহাস, ব্যাকরণ, সাহিত্যভান্ডার আর শব্দভান্ডারে হিমালয়প্রায় ল্যাটিন ভাষায় যা প্রকাশ করা যায়, মাত্র কয়েকশো শব্দবিশিষ্ট এবং লিখিত রুপহীন যে কোন আদিম ভাষাতেও তা প্রকাশ করা সম্ভব। হ্যাঁ, পরিভাষা বা শব্দভাণ্ডার একটা সমস্যা হতে পারে বটে, তবে তা কৃত্রিম। কোন ভাষাই, তা সে সাদা চোখে যতই আদিম ও সরল ভাষা হোক না কেন, বিশ্বমণ্ডলের সবচেয়ে জটিল ভাবটি প্রকাশের জন্য অনুপযুক্ত নয়। পার্থক্য যেটুকু আছে, তা হয়ত বিষেশায়িত শব্দমালা এবং কিছু বাক্যগঠনের নিয়মকানুন, যা সহজেই ধার করা যায় অন্য ভাষা থেকে। প্রায় সব ইউরোপীয়ান ভাষা যেমন সেগুলো ধার করেছে ল্যাটিন থেকে, আর ল্যাটিন সেগুলো পাইকারী দরে ধার নিয়েছিল গ্রীক থেকে। কাজেই জুলু, গুগু ইমিথির (Guugu Yimithirr - অস্ট্রেলিয়ার একটা আদিবাসী ভাষা, আধুনা বিলুপ্ত) কিম্বা চাকমা ভাষাতেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অশুভ পাঁয়তারা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করা যায়, অথবা পুঁজিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু আর্থিক বাজারে কর্পোরেট গভর্নেন্সের প্রয়োজনীয়তার নৈতিক-দার্শনিক দিকটিতে আলোকপাত করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে বাংলা গদ্যের ইতিহাস স্মর্তব্য। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান মিশনারিদের ধন্যবাদ দিতে হয় অন্তত একটা কারণে যে, তারা তাদের নিজেদের ধর্মীয় ধান্দার কারণেই হোক আর সম্রাজ্যবাদের ডানহাত হিসেবেই হোক, বাংলা গদ্যকে ন্যাংটাকাল থেকে এক্কেবারে যৌবনে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে মনিপুরী ভাষা সম্ভবত বাংলার চেয়ে জটিলতর ছিল। আজকে আমরা যারা বাংলার তুলনায় অন্য আদিবাসী ভাষাকে ছোট করে দেখি, তাদের জন্য এতে শেখার কিছু আছে। একইসঙ্গে সেই মিশনারীরা আরো একটি কাজ করেছিলেন - ভারতবর্ষের নানা জানা-অজানা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেছিলেন। এতে করে ভাষা নিয়ে আমরা যারা অহংকার করি, অথবা ভারতবর্ষে সংস্কৃত/আরবী-উর্দু/হিন্দী/তামিল হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে চাই ভাষাতাত্বিক যুক্তি দেখিয়ে, তাদের মুখে ঝাঁটা মারার কাজটি বেশ প্রামান্যভাবে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।

আধুনিক ভাষাতত্ব বলছে, ভাষা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে, এবং তা সারা মানবজাতির জন্যই এক ও অভিন্ন। নোয়াম চোমস্কি তো এটাও বলেছেন যে, যদি কোন ভিন গ্রহের এলিয়েন পৃথিবীতে এসে আমাদের ভাষাগুলোকে বিশ্লেষণ করে, তাহলে তারা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে, পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে। এর প্রমাণের জন্য বেশিদুর যাওয়ার দরকার নেই, একটা চীনা মানবশিশুকে জন্মের পরে চীনদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যান, সেই শিশুটি ফরাসী ভাষা শিখবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে। একইভাবে একটি ফরাসী শিশুকে বাংলাদেশে আনেন, সে বাংলা শিখবে অনায়াসে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে। আরো গভীরে গেলে দেখা যাবে যে, তাদের ব্যাকরণ সেই একই রকমের, তাদের সবারই বাক্যগঠন ও ভাব প্রকাশের ক্ষমতাও একই। অর্থাত আমাদের মাতৃভাষা আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়াকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে না, কেননা সে সুযোগ নেই, এবং প্রভাবিত করে থাকলেও তা খুব একটা স্থায়ী নয় বলেই ধর্তব্যও নয়। মানবজাতি একইভাবে চিন্তা করে। অথচ মানবজাতির লিখিত ইতিহাসের বয়স যে আজ পাঁচহাজার বছর, তার প্রায় পুরোটাতেই মানুষ এর উল্টোটা জেনে এসেছে। প্রায় সকল জাতির চিন্তানায়কেরা এবং দার্শনিকেরা নানা যুগে নিজেদের ভাষার গুনগান করেছেন এবং কোন জাতির চরিত্রের উপরে তাদের ভাষার সুগভীর প্রভাব অথবা নিদেনপক্ষে কোন জাতির চারিত্রিক-সাংস্কৃতিক নানা দিক তাদের ভাষাতে প্রতিফলিত হয়, এই ব্যাপারে মোটামুটি নিঃসন্দেহ ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংলিশম্যান ফ্রান্সিস বেকন বলছেন, 'One can infer significant marks of the genius and manners of people and nations from their language'। শতাব্দীকাল পরে ফরাসী দার্শনিক Étienne Bonnot de Condillac একমত হয়ে বললেন, 'সবকিছু আমাকে মানতে বাধ্য করছে যে, ভাষা কোন জনগোষ্ঠীর চরিত্রকে প্রকাশ করে'। তারই সমসাময়িক জার্মান ইওহান গোটফ্রেড হার্ডার বললেন, 'The intellect and character of every nation are stamped in its language. The genius of a nation is nowhere better revealed than in the physiognomy of its speech.'। ১৮৪৪ সালে আমেরিকান কবি ও প্রাবন্ধিক র‍্যালফ ওয়ালদো এমারসন বললেন, 'ভাষা একটি বিশালাকার ভবনের মতন, যেখানে একটি জাতির মানুষেরা বিভিন্ন যুগে একেকটি শব্দ দিয়ে এর নির্মানে সাহায্য করেছে। ফলে আমরা ধারণা করতে পারি যে ভাষা একটি জাতির প্রাণশক্তির বেশ ভাল একটা মাপকাঠি'।

হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, বাঙালী আগন্তুককে দেখলে প্রশ্ন করে, কি চাই? এখান থেকেই বাঙালীর চরিত্রের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বাঙালীর কাছে সে নিজেই সবচেয়ে বড়, আর আগন্তুক মাত্রেই ভিক্ষুক - সে কিছু চাইতেই যেন এসেছে। অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে বাঙালির চরিত্রের ব্যাখ্যা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেঃ ‘‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।…. যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদর মুক্তি আসবে না।” নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার বাংলা আত্নজীবনী 'আজি হতে শতবর্ষ আগে' বইতে বলেছেন, "১৯০৮ সনে আমি যখন কিশোরগঞ্জে ন্যাশনাল স্কুলে পড়ি, তখন কেদার নামে একটি বালক আমার সহপাঠি ছিল। সে কিছুতেই ইংরেজীতে সাফল্য লাভ করিত না। তাই একদিন ক্লাসের বাহিরে আসিয়া ইংরেজী পাঠ্যপুস্তক হাতে লইয়া বলিল, 'গোলাম হইবার ভাষা শিখিব না', এবং বইখানা ছিঁড়িয়া ফেলিল। এই ইতিহাসবিরুদ্ধ ধারণাটি কখনোই লোপ পায় নাই, এবং ইহার বশেই ১৯৫০ সনে ভারতীয় কন্সটিটিউশানে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল যে, ১৯৬৫ সনের মধ্যে ভারতবর্ষের শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা হইতে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা হইবে। তাহা হইতে পারে নাই, হইতে পারিত না'। এখানে ইংরেজী মানেই শাসকের ভাষা, এই রকম একটা ধ্যাণধারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে - অর্থাত তা যেন ভারতীরতার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। যদিও বাস্তবতা হল, ইংরেজদের ভাষা বাংলা/হিন্দি হলে এবং আমাদের ভাষা ইংরেজী হলে আমরা তখন এর উল্টোটা মনে করতাম।

ফরাসী ভাষা প্রেমের, রোমান্সের, সৌন্দর্য্যের ও আধ্যাত্নিকতার ভাষা, এই নিয়ে সম্ভবত কোন দ্বিমত নেই। আমাদের দ্বিমত থাকলেও ফরাসীরা একেবারেই নিঃসন্দেহ - ১৮৯৪ সালে ফার্ডিনান্ড ব্রুনেট (Ferdinand Brunetiere) ফরাসী একাডেমীর সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, 'আমাদের ভাষা ফরাসী হলো মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে সাবলীল, যৌক্তিক ও স্বচ্ছ ভাষা'। তিনি এই মতবাদের সমর্থন পেয়েছিলেন তার পূর্বসুরী ভলতেয়ারের লেখাতে, আর ভলতেয়ার তার সমর্থন পেয়েছিলেন তার পূর্বসুরীদের কাছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসী ব্যকরণবিদেরা ভাবিত হয়ে পড়েছিলেন তাদের ভাষার এই আশ্চর্য স্বচ্ছতা ও সাবলীলতা নিয়ে। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, কি কারণে ফরাসী ভাষা এত উঁচু স্তরের ভাষা, এবং কি যাদুবলে অন্য ভাষার কোন লেখা ফরাসীতে অনুবাদ করা মাত্রই তার মাধুর্য সৌন্দর্য স্বচ্ছতা সাবলীলতা সবই বেড়ে যায়। অনেক দশকের ভাবনার শেষে তারা স্থির করলেন, ফরাসী ভাষার বাক্যগঠন ও শব্দক্রম ঠিক সেই ক্রম অনুসরন করে, যা প্রকৃতির নিজস্ব স্বাভাবিক ক্রম। ফলে এই ভাষায় কোন অস্বচ্ছতা নেই। Ce qui n'est pas clair n'est pas français ; ce qui n'est pas clair est ENCORE anglais, italien, grec ou latin (Antoine de Rivarol) - অর্থাত, যা পরিষ্কার নয়, সেটা ফরাসী নয় - সেটা ইংরেজী, ইতালিয়ান, গ্রীক অথবা ল্যাটিন। That which is not clear is not French; that which is not clear is still English, Italian, Greek, or Latin. যদিও বেশ কিছু ভাষাবিদ এ ব্যাপারে একমত নন, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, তাদের প্রায় সবাইই ফ্রান্সের বাইরের লোক। ডেনমার্কের ভাষাবিদ ওটো জেসপারসেন ইংরেজীকে ফরাসীর চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন বেশ কয়েকটি দিক থেকে - 'ইংরেজী হল ব্যবসায়ের ভাষা, যেটি মনের সুক্ষ সংবেদনশীল নানা অবস্থা, শিল্পের নানা কারুকার্য ও আভিজাত্যের তোয়াক্কা করে না। ইংরেজীর যৌক্তিক কাঠামোও বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইংরেজ এবং ফরাসীদেরকে দেখেই বুঝতে পারবেন এই ভাষাগুলির ব্যবহারিক কার্যকারিতা'।

বার্ট্রান্ড রাসেলও বাদ যান নি। ১৮৮৯ সালে তরুন রাসেল লিখেছিলেন, 'একটি ভাষা কোন ধরনের ধারণাগুলোকে ভালভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা থেকে আমরা সেই জাতির চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। উদাহরণস্বরুপ, ফরাসীতে 'স্পিরিট' বা 'স্পিরিচুয়াল' শব্দগুলো আছে, অথচ এই ধারণাগুলো ইংরেজীতে ব্যাখ্যা করতে কষ্ট হয়। যেখান থেকে আমরা উপসংহারে পৌঁছুতে পারি, এবং বাস্তবে এই দুই জাতিকে পর্যবেক্ষণের দ্বারাও নিশ্চিত হতে পারি যে, ইংরেজদের চেয়ে ফরাসীরা বেশি স্পিরিচুয়াল'। ভাবুন একবার, রাসেল, তুমিও! কোন ভাষায় কোন শব্দ আছে, তা দিয়ে যেমন সেই জাতির চরিত্র বোঝা দুষ্কর, তেমনি কোন ভাষায় কোন শব্দের ব্যবহার নেই, তা দিয়েও সেই জাতির চরিত্র বোঝা দায়। কৃতঘ্ন বা পরশ্রীকাতরতা শব্দটা ইংরেজীতে নেই বটে, কিন্তু ইংরেজীভাষীরা যে এসব জিনিস বোঝে না, এমনকি এসবের অভিজ্ঞতালাভ করে না, সেটা বলা যায় না। দার্শনিক সিসেরো বলেছিলেন, গ্রীকদের ভাষায় ল্যাটিন শব্দ ineptus (English: having no sense of what is fitting/impertinent/tactless) এর কোন প্রতিশব্দ নেই। সিসেরো ব্যাখ্যা দিলেন - এই শব্দের অনুপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, গ্রীকদের মধ্যে এই দোষটা এত বেশিমাত্রায় বিদ্যমান ছিল যে, তারা সেটা খেয়াল পর্যন্ত করত না। আমি অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা দিতাম। আমার মতামত হতো এরকমঃ যে সমস্যাটা গ্রীকদের সমাজে ছিল না, সেই অদৃশ্য/অনস্তিত্বশীল সমস্যার জন্য তাদের ভাষাতে শব্দই বা থাকবে কেন? অর্থাত, গ্রীকরা কথাবার্তায় ও আচরণে অপ্রাসংগিকতার দোষ থেকে একেবারেই মুক্ত ছিল। নানা মুনির নানা মত। আস্তে আস্তে চিন্তাবিদেরা বিভিন্ন জাতির উপরে ভাষার প্রভাবকে টানতে টানতে মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়ার উপরে ভাষার প্রভাবের দিকে নিয়ে গেছেন। অর্থাত ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষেরা ভিন্ন ভাবে চিন্তা করে, এই হচ্ছে তাদের বক্তব্য। এ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন অনেকেই, এবং সম্প্রতি পড়ছি গাই ডয়েচার নামক এক লেখকের বই, যার নাম 'কেন আলাদা আলাদা ভাষার চশমা দিয়ে দেখলে জগতটাকে আলাদা দেখায়'। সেখানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার গুগু ইমিথির ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, যাদের ভাষায় অবস্থান বা দিক-প্রকাশক শব্দাবলী বেশ জটিল - তারা কোন বস্তুর আপেক্ষিক অবস্থান বর্ণনা করার সময়ে আমাদের মতন ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্থানাংক বা কো-অর্ডিনেটস ব্যবহার করে না, ব্যবহার করে স্থির স্থানাংক। এর ফলে একজন গুগু ইমিথিরভাষী ও একজন ইংরেজী/বাংলাভাষীর বর্ণনাকৃত বাস্তবতা একই বস্তুনিচয়ের জন্য আলাদা হতে পারে কি-না, তাই তার জিজ্ঞাস্য। জার্মান ভাষা নিয়েও তার কাজ আছে - জার্মানে যেহেতু সব বস্তুরই ব্যাকরণগত লিঙ্গভেদ আছে এবং ইংরেজী বা বাংলায় তা নেই, তা এই ভাষার মানুষের লিঙ্গসংক্রান্ত ভাবনাকে আলাদা করে দেয় কিনা, এই নিয়ে। আমার নিজের কিছু ভাবনা ছিল বাংলায় তিনপ্রকার সর্বনাম (তুমি তুই আপনি) এবং ইংরেজীর মাত্র একটি সর্বনামের তুলনা করা, এবং তাতে করে ইংরেজীভাষী ও বাংলাভাষীদের সামাজিক সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়ে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা নিয়ে। এগুলো নিয়ে পরে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে।

এইখানে দুইটি বিবাদমান পক্ষ - একপক্ষে আধুনিক কালের ভাষাতাত্বিকেরা বলছেন সব ভাষাই আসলে এক ও অভিন্ন; মানুষের বা জাতির চরিত্রে ও ভাবনায় তার প্রভাব অমোচনীয় নয়। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার দূরত্বও আসলে মামুলি। আরেক পক্ষ ভাষার সাথে মানুষের সংস্কৃতি ও চিন্তাপ্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক খুঁজে পান। এমনকি ভাষার মধ্যেই জাতির চরিত্রেরও খোঁজ পান তারা। ফলে সেখানে ভাষার জগতে বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ আছে, অভিজাত ভাষা এবং বৈশ্য-শুদ্র ভাষা আছে। কোনটা সত্য? এ বিষয়ে সামান্য কিছু পড়াশোনা করে আমার ধারণা হয়েছে যে, জগতের যাবতীয় বিষয়ের মতই এই বিষয়েও সত্যটা সম্ভবত এই দুই মেরুর মাঝখানে কোথাও লুকিয়ে আছে, একেবারে মেরুতে নেই।

আশরাফুল আলম


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভাষা নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো (সাধারণত) খটমটে আর শুকনো হয়, কিছুটা পড়ার পরে আর উৎসাহ থাকে না। আপনার লেখাটা সেদিক থেকে ব্যতিক্রম, আরাম করে পড়েছি। সাথে সাথে একগাদা নতুন নতুন জিনিসও জানা হল।

আরেকটা জিনিস: যে ভাষাগুলো আমি বুঝি না, সেগুলোর একেকটা শুনতে একেক রকম অনুভূতি হয়। কেউ জার্মান ভাষায় কথা বললে মনে হবে ঝগড়া করছে। কোন কোন ভাষায় উচ্চারণ টানা টানা, কোনটা ছাড়া ছাড়া।

লেখাটার জন্য আপনি শ্রম দিয়েছেন বোঝা যায়।

শুভেচ্ছা হাসি

প্রাসঙ্গিক কারণে মনে পড়ল:

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ভাষা নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো (সাধারণত) খটমটে আর শুকনো হয়, কিছুটা পড়ার পরে আর উৎসাহ থাকে না।

কত নদী সরোবর পড়েছেন?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

আমি পড়িনি সত্যানন্দ ইয়ে, মানে...

এনকিদু এর ছবি

জলদি পড়েন।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

অ্যাঁ এক্ষণ পড়েন
[লগে লাল নীল দীপাবলী টাও পইড়েন না পইড়া থাকলে]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মেঘলা মানুষ এর ছবি

পড়া হয় নি। মাথায় রাখলাম।
হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ। হ্যাঁ, ঠিক এই ভিডিওটাই আমারও চোখে পড়েছিল ক'দিন আগে। সমস্যা একটাই - আমাদের ভাষা অন্যদের কাছে কেমন লাগে সেটি আমাদের নিজেদের কানে কখনোই ধরা পড়বে না, কারণ আমাদের কান আজন্ম পক্ষপাতদুষ্ট। আপাতত একমাত্র উপায়, এরকম ভিডিওতে অজানা ভাষা আমাদের কাছে কেমন লাগে, সেটা থেকে বাকীটা আন্দাজ করে নেয়া। শুধু আমাদের কান নয়, দুনিয়ার সব লোকেরই মন/কান পক্ষপাতদুষ্ট - (সেটিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অবজেকটিভ/যৌক্তিক না করা হলে) - আর সেটাই সম্ভবত 'আমার মাতৃভাষা সবচেয়ে মধুর' সিন্ড্রোমের মূল কারণ।

আশরাফুল আলম

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক
আরও লিখুন পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, সাক্ষী সত্যানন্দ। লেখার ইচ্ছা আছে, এরকম খটমটে বিষয়ে।

আশরাফুল আলম

এক লহমা এর ছবি

চলুক
দামী লেখা। ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক কত নদী সরোবর কই পামু? কারো কাছে ডিজিটাল ভার্সন আছে? কিনতেও আপত্তি নেই।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

ডিজিটাল কপি কোথাও চোখে পড়ে নি। কিনতে চাইলে রকমারীতে আছে, দাম ১৩৫ টাকা। পড়ুয়াতেও আছে, দাম ১৫০ টাকা।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আলোচনা ভালো লেগেছে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় চারটি ভাষা রয়েছে, বাংলা, ইংরেজী, হিন্দী আর ফরাসী। ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ থেকে আপনার প্রবন্ধের মূল সুরের সাথে আমি একমত, ভাষা জাতির চরিত্রকে সামান্যই প্রভাবিত করে। বরং আমি বলব, ভাষা ভাবনার খোরাক জোগায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফরাসী ভাষায় 'আজ' (Aujourd'hui ) শব্দটির কথা। আদিতে শব্দটি ছিলো কেবলই hui। কিন্তু 'হ্যাঁ' (oui) এর সাথে উচ্চারণ এর সাথে পুরোপুরি মিলে যাওয়াতে ব্যাপক বিভ্রাটের উপক্রম ঘটে। 'আজ' বলতে গেলে ব্যাখ্যা করে বলতে হতো, 'আজকের দিনটি' (At the day of today)। যা ফরাসীতে Au jour du hui বা সংক্ষেপে Aujourd'hui হয়ে যায়। এইরকম বিভিন্ন শব্দের উৎপত্তি এবং গঠন নিয়ে অবসরে কিছুটা ভাববার প্রয়াস পেয়েছি। কিন্তু ফরাসী ভাষা শিখে একজন বিশেষ পন্ডিত হয়ে গেলেও (সুদূর পরাহত সম্ভাবনা) সেটা আমার ব্যক্তিত্ব বদলে দেবে, এমনটা আমি মনে করি না।

একজন ফরাসী তার মাতৃভাষা সংক্রান্ত বিপুল শব্দভান্ডার এবং জটিলতা জন্মসূত্রে পায় ঠিকই, কিন্তু সে কেমন আচরণ করবে, সেটা নির্ধারণ করে তার আশেপাশের মানুষ, পারিপার্শ্বিক, নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং অর্জিত জ্ঞান, ভাষা নয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, ইয়াসির আরাফাত। আমারও আপনার মতই চারখান ভাষার অভিজ্ঞতা - বাংলা ইংরেজী ছাড়া জার্মান ও জাপানীজ। ভাষার মূল যে কাজ, মনের ভাব প্রকাশ, সেখানে হয়তো সব ভাষা একই কাজ করে, তবে প্রকাশের ভঙ্গীর তফাত অনেক সময় একটা আলাদা স্বাদ এবং স্বাধীনতা দিতে পারে। সেগুলোও দুর্ল্যঙ্ঘনীয় নয় অবশ্য। উদাহরণ দিই - স্বাদের কথায় মুজতবা আলীকে উদ্ধৃত করা যায়। কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পান্তা মেরে দিলুম - এর কোন অনুবাদ ইংরেজীতে করে সেই স্বাদ আমরা পাব না সম্ভবত, অথবা জার্মানরা বিয়ারের যে বাহাত্তুরটা প্রকার জানে, তাকে আমরা এক নামে 'বিদেশী মদ' বলেই চালিয়ে দেব। স্বাধীনতার কথায় আমাদের মধ্যম পুরুষকে সম্বোধনের সর্বনাম দেখুন - আপনি, তুমি আর তুই। ইংরেজীতে একটাই, ইউ। কাজেই, আমাদের চয়েস বেশী, আবার কাকে কি সম্বোধন করব সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় আর্থ-সামাজিক নানা দিক বিচার করে, যেটা ইংরেজীভাষীদেরকে করতে হয় না। তবে এগুলো শুধু স্বাদ আর স্বাধীনতারই ব্যাপার, মৌলিক কোন পার্থক্য নয়। কাজেই ভাষার ভিত্তিতে জাতীয় চরিত্রের স্টেরিওটাইপিং একটা অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার।

বন্দনা এর ছবি

মেঘলা মাণুষের সাথে এক্কেবারে সহমত। আপনার লেখাটা অনেক ইন্টেরেস্টিং মনে হয়েছে, পড়তে গিয়ে থেমে যেতে হয়নি। তবে আর ও একটু গোছানো ও ডিটেইলস করে লিখলে আর ও অনেক তথ্য পাওয়া যেত।

অতিথি লেখক এর ছবি

বন্দনা, আপনার সপ্রশংস মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চেষ্টা থাকবে গুছিয়ে লেখার।

হিমু এর ছবি

সচলায়তনে নিবন্ধন করে ফেলুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই তাড়াতাড়ি।

মন মাঝি এর ছবি

চলুক
জটিল একটা বিষয় ঝরঝরে ভাষায় অত্যন্ত চমৎকার ভাবে লিখেছেন। তবে আপনার লেখাটার ব্যাপারে আমার একটু দ্বিধা রয়েই গেল এর পরও। খাইছে

আমি ভাষাতাত্ত্বিক বা ঐ বিষয়ের ছাত্র না, এ ব্যাপারে জানিও না তেমন কিছু - তাই প্রচুর দ্বিধা্সংকোচ নিয়েই বলছি - আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকদের মত ও মতবাদ সম্পর্কে আপনার ভাষ্যটার ব্যাপারে আমার সংশয় দূর হচ্ছে না। ভুল হলে আগাম ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি কোনই রেফারেন্স দেননি। দিলে ভাল হত। তাই যেসব বিষয়ে আমি দ্বিধান্বিত, তা নিয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য --

১।

আধুনিক ভাষাতত্ব বলছে, ভাষা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে, এবং তা সারা মানবজাতির জন্যই এক ও অভিন্ন।

ভাষাতাত্ত্বিকরা বা নোয়াম চমস্কি কি জেনেটিসিস্ট? তা যদি না হন, ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে কি নেই তা কি উনারা বলার যোগ্যতা সম্পন্ন ও অধিকারী? জিনের বিষয়ে কি ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান ও গবেষণার স্কোপ বা এক্তিয়ার থেকে কোন নতুন আবিষ্কারের দাবী করা যায়, নাকি জেনেটিক্সের ক্ষেত্র থেকে করতে হয়? "ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে" - হুবহু এই কথাটা কি জেনেটিক্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? আমি এই বিষয়ে এখনও ধোয়াঁশার মধ্যে। দুটোর কোনটা সম্পর্কেই ভাল জানি না। আপনি পরিষ্কার করে দিলে ভাল হয়।

২। 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে' - এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আপনি চমস্কির একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবে -

যদি কোন ভিন গ্রহের এলিয়েন পৃথিবীতে এসে আমাদের ভাষাগুলোকে বিশ্লেষণ করে, তাহলে তারা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে, পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে। এর প্রমাণের জন্য বেশিদুর যাওয়ার দরকার নেই, একটা চীনা মানবশিশুকে জন্মের পরে চীনদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যান, সেই শিশুটি ফরাসী ভাষা শিখবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে।

চমস্কি কি ঠিক এই প্রসঙ্গেই, অর্থাৎ 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে' প্রমান করতেই, ঠিক এইভাবেই কথাটা বলেছিলেন? উদ্ধৃত অংশটুকুর পুরোটাই কি চমস্কির - ঠিক এইভাবেই? একথা জিজ্ঞেস করছি কারন, "একটা চীনা মানবশিশুকে জন্মের পরে চীনদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যান, সেই শিশুটি ফরাসী ভাষা শিখবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে।" - শুধু এই উদাহরণ থেকে 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে' এবং পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে - এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় না বা দু'টি বক্তব্যের কোনটিই প্রমানিত বা প্রতিপন্ন হয় না। চীনা মানবশিশুকে জন্মের পরে চীনদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার পর তার ফরাসী ভাষা শিখতে পারা থেকে মানুষের অন্তর্গত যেকোন ভাষা শেখার ক্ষমতা বা এ্যাবিলিটিটুকুই কেবল বুঝা যায়, আর কিছুই না। এবং নিশ্চিত ভাবেই - 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে' বা 'পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে' - এই বক্তব্যগুলি প্রতিপন্ন হয় না। "ভাষা" আর "শেখার ক্ষমতা বা এ্যাবিলিটি" - দু'টি অত্যন্ত ভিন্ন জিনিস। একটি ইতিমধ্যে ফুলে-ফলে বিকশিত দস্তুরমত বিদ্যমান ও অস্তিত্ত্বমান একটি প্রপঞ্চ বা বাস্তবতা, অন্যটি নেহাৎই একটি সুপ্ত পোটেনশিয়াল বা ক্ষমতা / এ্যাবিলিটি। একটা সম্ভাবনা মাত্র। এই দুইয়ে বিশাল ও মৌলিক পার্থক্য। পোটেনশিয়াল / ক্ষমতা / এ্যাবিলিটি / সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়ে বিদ্যমান ও অস্তিত্ত্বমান হওয়ার পরই কেবল বলা যাবে তা কতটুকু ও কি রূপে বাস্তবায়িত হল কি হল না, কতটুকু সফল হল কি হল না। এবং তারপরই কেবল তাকে অন্য আরেকটি বিদ্যমান ও অস্তিত্ত্বমান প্রপঞ্চের সাথে তুলনা করা যাবে। তার আগে যেকোন তুলনা অর্থহীণ বলেই মনে হয়। এমনকি এই দুইয়ের (সম্ভাবনা ও বাস্তবতা) অন্তর্নিহিত মূলগত বেয়ারবোন্‌স যুক্তিকাঠামোতে যদি মিলও থাকে। কারন সম্ভাবনা আর বাস্তবতার মধ্যে যে দুস্তর পারাবার সেখানে অনেক ধরণের ফ্যাক্টর বা প্রভাবক আছে, যেগুলি পেরুতে গিয়ে একই সম্ভাবনা বিভিন্ন ধরণের বাস্তবতায় রূপ নেয় অথবা আদৌ বাস্তবায়িত হয় না। অতি সরলীকৃত করলে, এটা অনেকটা গরীবের অশিক্ষিত ছেলে আর বড়লোকের উচ্চশিক্ষিত মহাপন্ডিত ছেলের মধ্যে তুলনা করার মত হয়ে যায়। গরীবের অশিক্ষিত ছেলেটিও শিক্ষার সুযোগ পেলে বড়লোকের পণ্ডিত ছেলেটির মত কোয়ান্টাম ফিজিক্সে মস্ত অবদান রেখে ফেলত, সুতরাং তাদের উভয়ের জ্ঞানই তুল্যমূল্য এবং তারা একই বিজ্ঞানের বিভিন্ন ডায়ালেক্ট চর্চা করে এবং শেষ বিচারে উভয়ের জ্ঞানই এক - যেহেতু গরীবের ছেলেটিও সম্ভাবনাময় ছিল - এই রকম কিছু বলা যায় কি? চমস্কি কি এটাই বলেছেন?

৩। নিজে কিছু জানি না বলে উইকি ঘাটতে গিয়ে দেখলাম এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে -

A popular misconception is that Chomsky proved that language is entirely innate, and that he discovered a "universal grammar" (UG). Chomsky simply observed that while a human baby and a kitten are both capable of inductive reasoning, if they are exposed to exactly the same linguistic data, the human will always acquire the ability to understand and produce language, while the kitten will never acquire either ability.

এবং

many researchers in this area such as Elizabeth Bates[133] and Michael Tomasello[134] argue very strongly against Chomsky's theories, and instead advocate emergentist or connectionist theories, explaining language with a number of general processing mechanisms in the brain that interact with the extensive and complex social environment in which language is used and learned

.

****************************************

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

হিমু এর ছবি

আপনার এই লেখাটির ক্যাটেগোরিতে "চিন্তাভাবনা", তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে আপনি লেখাটির বহুলাংশকে নিজের চিন্তা থেকে উৎসারিত বলে দাবি করছেন। তা-ই যদি হবে, গাই ডয়চারের 'থ্রু দ্য ল‌্যাংগুয়েজ গ্লাস' থেকে প্যারার পর প্যারা বাংলা করে কেন তুলে দিচ্ছেন? সেটা দিলেও কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু সূত্রটুকু তো উল্লেখ করবেন?

আপনার পরবর্তী লেখায় যদি অন্যের লেখা থেকে কিয়দংশ অনুবাদ করে দেন, আশা করবো সূত্রটুকুও উল্লেখ করবেন।

এক লহমা এর ছবি

আপনার দেওয়া সূত্র ধরে ডয়চারের লেখাটি পড়ে আসার পর অস্বস্তির সাথে নজর করলামঃ
এই পোস্টে ডয়চারের কথার অনুবাদ আর নিজের জুড়ে দেওয়া কথাগুলিকে ব্যবহার করার সময় কোনটি কার কথা সেটি আলাদা করবার কোন উপায়ই রাখা হয়নি। ডয়চারের যে সব বাক্যগুলি হুবহু অনুবাদ করা হয়েছে কোথাও তাদের উদ্ধৃতি চিহ্ন("")-র মধ্যে রাখা হয়নি। যেন কথা গুলি পোস্ট লেখকের নিজের কথা, অনুবাদ নয়। অনুবাদের আনুপাতিক পরিমাণের ভিত্তিতে এই কাজ এই পোস্টটিকে সরাসরি লেখা চুরির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার অবস্থানে রাখতে পারে বলে মনে হয়। লেখার কোথাও ডয়চারের লেখাটির উল্লেখ না থাকা সেই অবস্থানকে আরো দৃঢ় করছে। অসতর্কতার কারণে এটি ঘটে থাকলে আশা করব পোস্ট লেখক সেটি একটি মন্তব্যে জানাবেন এবং ভবিষ্যতে সাবধান হবেন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

@হিমু ও এক লহমাঃ শুরুতেই বলি, আমি এই বিষয়ের পণ্ডিত বা গবেষক নই, স্রেফ আগ্রহী পাঠকমাত্র। অনুবাদের পরিমাণের আধিক্য অথবা প্রকারান্তরে লেখা চুরি, কোনটাই অস্বীকার করছি না, যেহেতু আমি সূত্র উল্লেখ করিনি এবং কোটেশান মার্কও ব্যবহার করিনি। আর হ্যাঁ, অনুবাদের পরিমাণও বেশ অনেকখানি। তবে সেটা সজ্ঞানকৃত নয়, অসচেতনতাবশতঃ এবং অলসতাবশতঃ। ফেসবুকে যে ধরনের হালকাচালে লেখালেখি করি, সম্ভবত সেই অভ্যাসের বশেই ব্যাপারটা ঘটেছে, যদিও তা কাম্য নয়। আমার লেখাতে একবার গাই ডয়েচারের বইটির নাম এলেও তা রেফারেন্স হিসেবে আসে নি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই যত্নবান হওয়ার চেষ্টা থাকবে। ধন্যবাদ। (সচলায়তনের নীতিবিরুদ্ধ হলে লেখাটি সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব করছি)

আশরাফুল আলম

হিমু এর ছবি

সরিয়ে ফেলার মতো নীতিবিরোধিতা মনে হয় ঘটেনি। প্রসঙ্গটি যেহেতু আগ্রহোদ্দীপক, এবং এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে আরো লেখার অপেক্ষা করছি, তাই আমার পর্যবেক্ষণ আপনাকে জানানোই আমার উদ্দেশ্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

@মন মাঝি, দুঃখিত, উত্তর দিতে দেরী হয়ে গেল। ভয়ানক ব্যস্ত ছিলাম বেশ ক'দিন। সম্ভবত খেয়াল করে থাকবেন যে, আমার লেখাটির ব্যাপারে একটা বড়সড় অভিযোগ এসেছে - সূত্র উল্লেখ না করা এবং ঠিকমত উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার না করা। তাছাড়া, লেখাটির বেশীর ভাগই আমার নিজের নয় - অনুবাদ করেছি মাত্র। শুরুতেই বলি, আমি ভাষাতত্বের পণ্ডিত বা মনোযোগী ছাত্র কোনটাই নয়, স্রেফ আগ্রহী পাঠকমাত্র। এ বিষয়ে অল্প কিছু পড়েছি, আর সেগুলো থেকেই লিখার চেষ্টা করেছি।

আপনার দুটো প্রশ্ন আছে - যার প্রথমটা হল ভাষাতাত্বিকেরা জীন-বিশেষজ্ঞ কিনা এই নিয়ে। প্রশ্নটা এসেছে, কারণ কিছু ভাষাতাত্ত্বিক বলেছেন যে, 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে, এবং তা সারা মানবজাতির জন্যই এক ও অভিন্ন'। যতদূর জানি, নোয়াম চোমস্কি জীন বিশেষজ্ঞ নন, কিম্বা আমি যে বই থেকে নোয়াম চোমস্কির উদ্ধৃতিটা পেয়েছি (এবং এই লেখার বেশ কিছু অংশ অনুবাদ করেছি), সেই গাই ডয়েচারও জীন বিশেষজ্ঞ নন। নোয়াম চোমস্কির উদ্ধৃতিটা আমি পেয়েছি এখানে - Deutscher, Guy. Through the Language Glass: Why the world looks different in other languages, 1st Ed, Metropolitan Books, 2010. Page 6. নোয়াম চোমস্কির বক্তব্য শুধু এটুকু - 'যদি কোন ভিন গ্রহের এলিয়েন পৃথিবীতে এসে আমাদের ভাষাগুলোকে বিশ্লেষণ করে, তাহলে তারা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে, পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে।', আর গাই ডয়েচারের বক্তব্য হচ্ছেঃ 'আধুনিক ভাষাতত্ব বলছে, ভাষা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে, এবং তা সারা মানবজাতির জন্যই এক ও অভিন্ন।' তাদের কথাকে আমি আক্ষরিক অর্থে নেই নি, বরং পৃথিবীর প্রতিটি মানবশিশু যে পৃথিবীর যে কোন ভাষা শেখার সক্ষমতা রাখে, সেই সাধারণ অর্থে নিয়েছি। ফলতঃ আমার তরফে কোন আপত্তি ছিল না তাদের উপরোক্ত বক্তব্যে। আপনার জবাবে শুধু এটুকু বলি - 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে, এবং তা সারা মানবজাতির জন্যই এক ও অভিন্ন', এমন কথা জীনতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় নি আজতক।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রসঙ্গে আসি। নোয়াম চোমস্কি বা গাই ডয়েচার কি বলেছেন সেটা উপরে বলেছি। আপনি অবশ্য ভাষা শেখার সক্ষমতা এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে ভাষা জানার মধ্যে একটা বিশাল পার্থক্য গড়েছেন - বলেছেন, এই দুটোর একটা হচ্ছে অস্তিত্ত্বমান প্রপঞ্চ, আরেকটা হচ্ছে সেরেফ সম্ভাবনামাত্র; নেহায়েতই সুপ্ত ক্ষমতা। অতি সরলীকরণ করে বলেছেন, 'গরীবের অশিক্ষিত ছেলেটিও শিক্ষার সুযোগ পেলে বড়লোকের পণ্ডিত ছেলেটির মত কোয়ান্টাম ফিজিক্সে মস্ত অবদান রেখে ফেলত, সুতরাং তাদের উভয়ের জ্ঞানই তুল্যমূল্য এবং তারা একই বিজ্ঞানের বিভিন্ন ডায়ালেক্ট চর্চা করে এবং শেষ বিচারে উভয়ের জ্ঞানই এক - যেহেতু গরীবের ছেলেটিও সম্ভাবনাময় ছিল'। এখানে আপনি দুটো অসম জিনিসের তুলনা করেছেন। সাধারণ অর্থে বিরাট অবদান রাখা বলতে আমরা যা বুঝি, তা পদার্থবিদ্যায় লেখাপড়া করে ডিগ্রী নেয়া মানুষদের শতকরা দশজনও রাখতে পারেন না। শুধু পদার্থবিদ্যা কেন, জ্ঞানের সকল শাখার বেলাতেই সেটা খাটে। এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও দেখুন, বাংলাভাষা জানা মানুষের শতকরা ক'জনে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, হুমায়ুন-আনিসুল বা সচলের হিমু-কনফুসিয়াস হন, সে তো হাতে গুণে বলা যায়। একটা শিশুকে জন্মের পরপরই চীনদেশ থেকে বাংলাদেশে আনলেই যে সে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-আনিসুল-কনফুসিয়াস হতো, সে কথা বলা যায় না কোনমতেই, তবে সে যে বাংলাভাষা শিখতো তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কাজেই প্রশ্নটা অবদান রাখা নিয়ে নয়, শেখা নিয়ে বা শেখার সক্ষমতা নিয়ে। আপনি যদি বরং এভাবে চিন্তা করেন যে, গরীবের অশিক্ষিত ছেলেটিকে যদি বড়লোকের ছেলেটির মত একই পরিবেশে রাখা যেত জন্মের পর থেকেই, সে কি ক্লাস ফাইভ পাশ করতে পারত? সম্ভবত পারত। দেখুন, 'বিরাট অবদান রাখা' থেকে ক্লাস ফাইভে নামিয়ে আনলাম, তবুও যেন ঠিক বোঝাতে পারছি না - ভাষার ক্ষেত্রে আমরা কথা বলছি শুধুই ভাষা শেখা নিয়ে, বিরাট অবদান রাখা নিয়ে নয়। একটা মানবশিশু যে পরিবেশে থাকবে সেখানকার ভাষাই শিখবে, এখানে কোন ব্যতিক্রমের উদাহরণ বা সুযোগ কোনটাই নেই, অথচ গরীবের ছেলেকে বড়লোকের বাড়িতে রাখলেও তার ক্লাস ফাইভ পাশ সুনিশ্চিত নয়; সেখানে সচেতন চেষ্টার ব্যাপার আছে, সুযোগের ব্যাপার আছে, আরো নানান ফ্যাকরা আছে। আপনার কথাতেই বলি, 'একটা সম্ভাবনা বাস্তবতায় রুপ নিতে অনেক ধরণের ফ্যাক্টর বা প্রভাবক পেরিয়ে যেতে হয়, যেগুলি পেরুতে গিয়ে একই সম্ভাবনা বিভিন্ন ধরণের বাস্তবতায় রূপ নেয় অথবা আদৌ বাস্তবায়িত হয় না'। ভাষা শেখার ব্যাপারটা সেসবের অবকাশ রাখে না আদৌ। কাজেই, "একটা চীনা মানবশিশুকে জন্মের পরে চীনদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যান, সেই শিশুটি ফরাসী ভাষা শিখবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে" - শুধু এই উদাহরণ থেকে 'ভাষা আমাদের জীনের মধ্যেই কোডিং করা আছে' এবং পৃথিবীর সব মানুষ একই ভাষার নানা ডায়ালেক্ট বা উপভাষাতে কথা বলে - এই উপসংহারে পৌঁছানো না গেলেও, তাতে করে মানবশিশুর যে কোন ভাষা শেখার সক্ষমতার ব্যাপারটা অস্বীকার করা যায় না। নোয়াম চোমস্কি বা গাই ডয়েচারের বক্তব্যের মূল কথাটা সম্ভবত সেটাই, তবে তারা জীন নিয়ে কথা না বলে মানব মস্তিষ্কের সক্ষমতা নিয়ে কথা বললেই বেশি গ্রহণযোগ্য হত। এখানে 'জীন' শব্দের ব্যবহারকে রুপক অর্থে নেয়া যেতে পারে।

এটা অবশ্যই সত্য যে, সকল মানবশিশুই সমান সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, আর 'গরীবের ছেলেরা অশিক্ষিত হবে এবং বড়লোকের ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত মহাপণ্ডিত হবে', সে জিনিসটাও আমাদের স্টেরিওটাইপিং এবং সামাজিক বৈষম্যের ফসল। আপনার উত্তরে বলছি, 'গরীবের অশিক্ষিত ছেলেটিও শিক্ষার সুযোগ পেলে বড়লোকের পণ্ডিত ছেলেটির মত কোয়ান্টাম ফিজিক্সে মস্ত অবদান রেখে ফেলত, সুতরাং তাদের উভয়ের জ্ঞানই তুল্যমূল্য এবং তারা একই বিজ্ঞানের বিভিন্ন ডায়ালেক্ট চর্চা করে এবং শেষ বিচারে উভয়ের জ্ঞানই এক - যেহেতু গরীবের ছেলেটিও সম্ভাবনাময় ছিল' - এই রকম কিছু বলা যায় না, এবং নোয়াম চোমস্কি সেটা বলেনও নি।

আশরাফুল আলম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।