উকুন বাছা দিন। ০৬। সমাবর্তন

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শনি, ০৮/০৩/২০০৮ - ১২:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সমাবর্তন

এই মৌসুমে আজকেই শেষ দিন। চাল কুমড়ার বীজ আজকে না আনলে ঘরের চালে এ বছর কোনো কুমড়ার লতা উঠবে না

বীজবিক্রেতা লোকটি কৃষি যুগের সত্য পুরুষ। মৌসুম শেষ হয়ে গেলে সে দোকান বন্ধ করে বংশধরদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। আর দেখে তার বংশধররা কেউ প্রকৃতির কৃষি আইন লঙ্ঘন করে কি না। আজকেই সে তার দোকান বন্ধ করে এ শহর ছেড়ে চলে যাবে গ্রামে। মা বলল আজকেই যেন সংগ্রহ করি চাল কুমড়া বীজ

আপা তার কোনো এক মানুষের জন্য সারা বছর যেন কিসের প্রস্তুতি নেয়। সেই মানুষটির জন্মদিনে নিজের হাতে বানানো পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমি উপহারটি তুলে দেয় সে। আগামীকাল সেই দিন। কিন্তু এবারের উপহারটি এখনো সাধারণ রয়ে গেছে। সোনালি ফেব্রিকের আঁচড় না পড়লে উপহারটি অসাধারণ হবে না। আজই সোনালি ফেব্রিক কিনে আনতে বলল আপা

ঘর থেকে যখন বেরোলাম তার আগেই দুটো খবর জেনে গেছি আমি। গতকাল সুজন গেছে তার বন্ধুদের শহরে। সেখান থেকে আমার জন্য সুসংবাদ আনবে সে। আর এক বছর ধরে হাসপাতালে থাকা ছোট বোনটি ছাড়া পাবে আজ। এই এক বছরে ডাক্তাররা তার পায়ের সাথে যুদ্ধ করে গত মাসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পা দুটো ছাড়াই তাকে বাঁচতে হবে বাকি কয়টা দিন

আমার কাজ খুব সহজ। সুজনের বাড়ি থেকে সুসংবাদ নিয়ে হাসপাতালে। পঙ্গু বোনটাকে নিয়ে ফেরার পথে সোনালি ফেব্রিক আর চাল কুমড়ার বীজ নিয়ে ফিরব ঘরে

সুজনের বাড়িটা আজকে একটু বেশি চুপচাপ। এ বাড়ি চুপচাপ থাকে না। এ বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে না কোনোদিন। আজ বন্ধ। ওর দরজায় কোনো কলিংবেল নেই। আমি চিৎকার করে ডাকলাম- সুজন... একবার- দুইবার- কয়েকবার

দরজা খুললেন সুজনের মা। তিনি কখনো দরজায় দাঁড়ান না কিংবা কেউ এলে সামনে আসেন না। ... দরজা আগলে দাঁড়িয়ে তিনি আমার পরিচয় জানলেন। লাঠিতে ভর দিয়ে নিজের শরীরটাকে আরও বেশি বৃদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন- আমার ছেলে কি তোমার কাজেই বাড়ির বাইরে গেছে গতকাল?
- হ্যাঁ
- তবে তুমি ভেতরে এসো। যখন স্বীকার করেছ যে আমার ছেলে তোমার কাজে গেছে সেহেতু এই যাওয়ার দায়িত্ব তোমার। তুমি ভেতরে এসো

সুজনের মা যেন ক্রমাগত বৃদ্ধ হয়েই চলেছেন চোখের সামনে। সোফায় যখন বসলেন তখন তাকে মনে হলো পৃথিবীর বৃদ্ধতম মানুষ

- তুমি যখন দায়িত্ব স্বীকার করেছ তখন কিছু দায় বহন করাও তোমার উচিত। সুজন মারা গেছে। সে তার বন্ধুদের হাতে খুন হয়েছে। কিন্তু তার বন্ধুরা তাকে খুন করেনি। সে খুন হয়েছে তার নিজেরই হাতের অস্ত্রে। ...আমি খবর পেয়েছি সে তার বন্ধুদের খুন করতে যাচ্ছিল... তার বন্ধুরা তখন তারই অস্ত্রের মুখ তার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ...আসোলে সে তার বন্ধুদের কাছে গিয়ে নিজেই নিজেকে খুন করেছে। ...অস্ত্রটা যদি তোমার হতো কিংবা সুজনের বন্ধুরা যদি তোমারও বন্ধু হতো তবে আমি তোমাকেও খুনের দায় দিতাম এবং বলতাম সুজনকে ফিরিয়ে দিতে। ...অস্ত্রটা সুজনের এবং বন্ধুরাও তার নিজের। কিন্তু সে তোমার জন্যই তার বন্ধুদের খুন করতে যাচ্ছিল। সে তোমার জন্য সুসংবাদ আনতে গেছে...

...সুজন মারা গেছে গতকাল। সে তোমার জন্য শহর ছেড়েছে। তুমি তার লাশকে শহরে ফিরিয়ে আনবে। আজকেই আনতে হবে তোমাকে। ...আমার ছেলে মারা গেছে গতকাল। তার লাশ পঁচে যাওয়ার আগেই আমার হাতে তাকে ফেরত দিতে হবে। লাশ পঁচে গেলে তাকে সন্তানের লাশ বলে স্বীকার করব না আমি। তখন তুমি আমাকে আমার সন্তান ফেরত দিতে হবে। আজকেই তোমােেক লাশ আনতে হবে। ...আজকেই। নইলে ধরে নেব তুমিও খুনি

আমি ছুটলাম সুজনের বন্ধুদের শহরে

ঘরের দরজা খোলা। ঘরে কেউ নেই। শুধু সুজনের লাশ। চার দিকে চার হাত-পা ছড়ানো। ঠান্ডা- শক্ত। বুকের ছিদ্র দিয়ে বেরোনো রক্ত জমে আছে পাঞ্জাবি আর ঘরের মেঝেতে। জিজ্ঞেস করার মতো কেউ নেই। অনুমতি দেবার কেউ নেই। দুমড়ানো হাত-পাসহ লাশটাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দরজায় পুলিশ

মাথার টুপি খুলে দারোগা হাসল
- আমি নিশ্চিত ছিলাম কেউ না কেউ এসে লাশটা ধরবে। এজন্য লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমি নিশ্চিত এ খুনের সাথে আপনি জড়িত নন। কারণ ঘটনার একটা বিবরণ আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু লাশের পরিচয়টা এখনো পাইনি। আপনি লাশটাকে নামিয়ে রেখে লাশের পরিচয়টা আমাদের দিন

লাশের পরিচয় দিলাম আমি। বললাম আমি লাশ নিয়ে যাব। দারোগা আবারো হাসল- আপনাকে আমরা ইচ্ছে করলেই খুনের দায়ে গ্রেফতার করতে পারি- কিন্তু তা করব না। আপনাকে চলে যেতে হবে। লাশ থাকবে আমাদের কাছে। যাবে হাসপাতালে। সেখানে পোস্টমর্টেম হবে। তারপর...

- ততক্ষণে লাশ পঁচে যাবে
- তা না হলে নিয়ম পূর্ণ হবে না
- সুজনের মা লাশ পঁচার আগেই ফেরত চেয়েছেন
- নিয়ম পূর্ণ না হলে কোনো লাশই ফেরত দেয়া যায় না
- কিন্তু আজকেই আমি লাশ নেব
- ঠিক আছে। খুন হওয়ার সময় যারা এখানে ছিল আপনি যদি তাদের ঠিকানা জোগাড় করে দেন তবে বিবেচনা করব আমরা
- আমি ওদেরকে চিনি না
- আমি বলিনি যে আপনাকে চিনতে হবে। আমি বলেছি ওদের ঠিকানা আপনি জোগাড় করে দেবেন

এই শহরে সুজনকে কেউ চিনত না। সুজনের বন্ধুদেরও চিনতে পারে না কেউ। সবাই নাম জানতে চায়- চেহারার বর্ণনা চায়। আমি ওদের চিনি না। নাম বলতে পারি না। চেহারা বর্ণনা করতে পারি না। শুধু বলি ওরা সুজনের বন্ধু। ...কারো ঠিকানা পাই না আমি

লাশ ছাড়াই ফিরতে হয় আমাকে হাসপাতালে

তিন তলায় একুশ নম্বর বিছানায় পঙ্গু বোনটির কাছে যাই। সে তার সুই ও সুতায় হাত ব্যস্ত রেখে ভুলে আছে পায়ের দুঃখ। আমার দিকে তাকিয়ে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে

- সকালে আসলে হয়ত ওরা আমাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন আরও কয়েকদিন আমাকে থাকতে হবে
- কেন ?
- ওরা বলেছে আমি মা হতে যাচ্ছি। প্রসবের পরেই ওরা ছাড়বে আমাকে
- তোর মা হবার প্রশ্নই ওঠে না। তুই এক বছর এখানে ছিলি
- ওরা বলে এই এক বছর এখানে আমাকে যারা দেখতে আসত তাদেরই কেউ আমাকে মা বানিয়ে গেছে
- এখানেতো শুধু আমিই আসতাম
- ওরা তোকেই ইঙ্গিত করেছে
- অসম্ভব
- ওরা বলে আমার অচেতন অবস্থায় তুই নাকি... তবে ভাইয়া আমি টের পেয়েছি। যখন ওরা আমাকে ওষুধ দিত তখন ওদের কেউ কেউ... বলত... আমি তখন... দ্যাখ্তো ভাইয়া নতুন শিশুর জন্য এই জামাটা কেমন হবে? ...ভাইয়া তুই যদি না বলিস এই
সন্তান তোর; তবে ওরা তাকে মেরে ফেলবে... বলবি ভাইয়া? ...এই কাগজে তোকে
দস্তখত করতে হবে সন্তানের দায়িত্ব স্বীকার করে। নইলে...

সুজনের খুনের দায়- বোনের সন্তানের পিতৃত্ব আর সোনালি ফেব্রিকের ব্যর্থতা নিয়ে যখন পথে নামলাম তখন গভীর রাত। হাঁটতে লাগলাম শহর থেকে বেরিয়ে যাবার
রাস্তা ধরে। শুধু একটা কথাই মনে পড়ছিল বারবার। সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু মায়ের ঘরের চালে এবার উঠবে না কোনো কুমড়ার লতা
২০০০.১২.২৩-২৫/ শনি-সোমবার

উকুন বাছা দিন

প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫

............................................

উকুন বাছা দিন। ০১। ফসিল
উকুন বাছা দিন। ০২। মাকড়া
উকুন বাছা দিন। ০৩। টিকটিকি
উকুন বাছা দিন। ০৪। ঘুণপোকা
উকুন বাছা দিন। ০৫। নখর
উকুন বাছা দিন। ০৬। সমাবর্তন
উকুন বাছা দিন। ০৭। বংশ
উকুন বাছা দিন। ০৮। নির্বাণ
উকুন বাছা দিন। ০৯। অশোক বন
উকুন বাছা দিন। ১০। রাজসাক্ষী
উকুন বাছা দিন। ১১। অতল
উকুন বাছা দিন। ১২। উদ্বাস্তু
উকুন বাছা দিন। ১৩। অনির্ধারিত
উকুন বাছা দিন। ১৪। অপারেশন ক্লিন হার্ট
উকুন বাছা দিন। ১৫। ফিনিক্স
উকুন বাছা দিন। ১৬। জন্মান্তর


মন্তব্য

শেখ জলিল এর ছবি

....দুঃসময়ের ঘোরলাগা দিন বড়ো কষ্টের...গল্পগুলো পড়ছি।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুঃসময় যায় কিংবা আসে
কিন্তু তার ঘোর ঘাপটি মেরে থেকে যায়

তাপস শর্মা এর ছবি

চোখে অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে গল্পটা ভাসছে। অসম্ভব!!! বিধ্বস্ত। এভাবেও বেঁচে থাকা যায়, এটাই বেঁচে থাকার দায়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।