উকুন বাছা দিন। ১৪। অপারেশন ক্লিন হার্ট

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: রবি, ২৩/০৩/২০০৮ - ১২:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অপারেশন ক্লিন হার্ট

ঢুকেই সিঁড়ির বামপাশের দ্বিতীয় ঘরে আমাকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দেয়া হলো। ঘরটা একটু অন্ধকার। স্যাঁত স্যাঁতে। কিন্তু আমার তেমন খারাপ মনে হলো না। এর চেয়ে বেশি ভালো জায়গায় থাকার অভ্যাস আমার নেই। এগুলোকেই আমি ভালো বলি। আমি নিশ্চিন্তে বিছানাটা ঘরের মাঝখানে পেতে আমার জিনিসপত্র বের করে নিলাম ব্যাগ থেকে। এই কয়টা দিন এখানে থাকতে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ঘরটা যে ভালো নয় তা আমাকে বললো নিরালা। নিরালা আমাকে এখানে খাবার দাবার দেবে। রান্না করবে। চাইতো কাপড়চোপড়ও ধুয়ে দিতে পারে

ঝিকঝিকে শরীরের নিরালার শাড়ির নিচে পেটিকোট কিংবা ব্লাউজ কোনটাই নেই। হয়তো সে পছন্দ করে না। অথবা তার পরার অভ্যাস নেই। সে আমার ঘর ঝাড়– দিতে এসে বললো এ ঘরটা মোটেই ভালো নয়। সিঁড়ির ডানপাশের প্রথম ঘরটা অনেক ভালো। সেখানে অবশ্য এই মুহূর্তে একজন মহিলা আছেন তিনি অসুস্থ কিন্তু চলে যাবেন আজ বিকেলেই। ম্যানেজারকে বললে সে ঘরটা আমি পেতে পারি। আমি বললাম কী দরকার। ভালোইতো থাকি না এখানে
না এখানে থাকা যাবে না। এমনিতেই নোংরা তার উপর পেছনে যারা যাতায়াত করে তারা একেবারে ঘরের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায়। ঠিক আছে বিকেলে আমি ম্যানেজারকে বলবো বদলে দিতে

জিনিসপত্র ছড়িয়ে ফেলেছি- আবার বদলানো। কিন্তু নিরালা যেহেতু বলেছে সেহেতু না বলা ঠিক না। সে ঘরটা তার পছন্দ। সেখানে সে রাতেও আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে। পছন্দ বলেই হয়তো বসবে বেশ অনেক্ষণ। বলা যায় না ঘুমিয়েও পড়তে পারে আমার সাথে। রাজি হয়ে গেলাম

আপনিতো বের হতে পারবেন না। বেরুলেই মিলিটারি ধরবে। যদি কিছু কিনে আনাতে হয় তবে আমাকে বলবেন। আর বিকেলে আমি আপনার ঘর বদলে দেব

কথাগুলো বলছিলো সে ঘর ঝাড়– দিতে দিতে। আর আমি মেঝেতে বিছানায় বসে বসে দেখছিলাম তার শাড়ি কীভাবে অন্তর্বাসহীন শরীরের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে মিশে যাচ্ছে। আবার কোথাও কীভাবে তার শরীর বের হয়ে আসছে শাড়ি ঠেলে। সে নির্বিকার। শুধু ঝাড়– দেয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো- দেখার সুযোগ পাবেন। এখন জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখুন

আমি আর গোছাইনি কিছুই। এ ঘর থেকে রাস্তাও দেখা যায় না। বাইরে মিলিটারিদের চলাফেরা দেখাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঝিমাতে ঝিমাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো নিরালার ডাকে। মাথার কাছে বসে চুলের মধ্যে বিলি কাটার মতো করে আঙ্গুল ঢুকিয়ে মুঠো করে ধরে ঝাঁকি দিলো। ঘুম ভাঙ্গতেই আমার চোখ গিয়ে পড়লো তার মুখে। সেখান থেকে চোখটা তার বুকে নামিয়ে আনার আগেই সরে গিয়ে আঁচলটা টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বললো- জীবনে দেখেননি আর?
আমি তার হাত ধরে টান দিয়ে আমার বুকের কাছে চেপে ধরে বললাম- তোমাকে দেখাতে ইচ্ছে করছে
এখানে না। বাইরের লোকজন দেখবে। এখন ঘরটা বদলান আগে
নিরালা উঠে গিয়ে আমার জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলো- যেভাবে ছড়ানো ছিটানো দেখেছিলাম সেভাবেইতো আছে। অন্য কাউকে আবার দেখা শুরু করে দিয়েছিলেন নাকি?
না সে চান্স পেলাম কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া এই সামান্য জায়গায় আর গোছানোর দরকার কী। জড়ো করে নিয়ে গেলেই হবে। সেখানেওতো খুলতে হবে। বাইরে মিলিটারিদের অবস্থা কী?
- ব্ইারে যেতে চান?
- একটু দরকার ছিলো। কিছু সিগারেট কিনব
- আমাকে দেন। আমি নিয়ে আসি। আপনি গেলেই ধরবে
- তোমাকে ধরবে না?
- আমাকে কেন ধরবে। আমাকে বড়োজোর ধমক টমক দিতে পারে। উঠেনতো ওঘরে গেলে জানালা দিয়ে মিলিটারি দেখতে পাবেন

আমি উঠে তাকে টাকা দিলাম। এর মধ্যেই সে জিনিসপত্র মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। বের হয়ে নতুন ঘরের দরোজা পর্যন্ত এসে সে বললো- আপনি যান। আমি দোকান থেকে ঘুরে আসি। সে আর ঢুকলো না ঘরে। ঘরে ঢুকে দেখলাম আসলেই ঘরটা আগেরটা থেকে অনেক ভালো। খোলা মেলা আর সামনের দিকে জানালা আছে। জিনিসপত্র মেঝেতে রেখেই জানালার দিকে এগুলাম। আলো আর জ্বালিনি। জানালা খুলতেই চোখে পড়লো একপাশে বেঞ্চে কে যেন শুয়ে আছে। আমার শব্দ পেয়েই সে নড়ে চড়ে উঠে বসলো। এক মহিলা।
- আমি আসোলে এই ঘরে ছিলাম। আজ চলে যাব বলে ছেড়েও দিয়েছি। কিন্তু শরীর খারাপ থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনতো বেরুতে পারবো না। মিলিটারিরা সব গাড়িঘোড়া বন্ধ করে দিয়েছে
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।- তার মানে কী আপনি এখানে থাকতে চান আজ?
- যদি আপনার কোনো অসুবিধা না হয়। আমি এই বেঞ্চে শুয়েই রাত কাটিয়ে দিতে পারবো
- কিন্তু তাতে আমার অসুবিধা আছে
- আপনার সাথে কী রাতে কেউ থাকবে এখানে?
- নিরালা থাকবে
- ঠিক আছে আমি মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকব

আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানালা দিয়ে তাকালাম বাইরে। সাঁই সাঁই করে পাশের রাস্তা দিয়ে দুটো পিক আপ ভ্যান চলে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম বাম দিকে। দুটো জোয়ানের একটা ঠাস ঠাস করে চড় মারছে নিরালার গালে। সাথে অশ্রাব্য গালাগাল। আরেকটা নিরালার চুল ধরে ঘুরিয়ে তার পেছন দিকে মাজায় লাথি মারলো। নিরালা পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। উঠে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। আমি তাড়াতাড়ি জানালা থেকে সরে দরোজার কাছে এলাম। নিরালা এসেই সিগারেট বাড়িয়ে দিলো- তেমন কিছু না। ওরা সিগারেট আনতে দেখে ক্ষেপে গেছে

নিরালা কাঁপছে। আমি জড়িয়ে ধরালাম তাকে। বুকের সাথে। হঠাৎ টের পেলাম আমার বুকের কাছে কিছু ভেজা ভেজা। তাকাতেই দেখি নিরালার রক্তে ভিজে গেছে আমার শার্ট। ওরা তাকে লাথি দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়ায় বুক ছিঁড়ে গেছে তার। নিরালা আমার বুকের সাথে যেন মিশে গেছে। তাকে আরো জড়িয়ে ধরে বললাম- আজ আমি কিছুই দেখব না নিরালা। আজ তুমি আমার বুকের মধ্যে ঘুমাবে
২০০৪.০৬.১৪ সোমবার

উকুন বাছা দিন

প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫

............................................
উকুন বাছা দিন। ০১। ফসিল
উকুন বাছা দিন। ০২। মাকড়া
উকুন বাছা দিন। ০৩। টিকটিকি
উকুন বাছা দিন। ০৪। ঘুণপোকা
উকুন বাছা দিন। ০৫। নখর
উকুন বাছা দিন। ০৬। সমাবর্তন
উকুন বাছা দিন। ০৭। বংশ
উকুন বাছা দিন। ০৮। নির্বাণ
উকুন বাছা দিন। ০৯। অশোক বন
উকুন বাছা দিন। ১০। রাজসাক্ষী
উকুন বাছা দিন। ১১। অতল
উকুন বাছা দিন। ১২। উদ্বাস্তু
উকুন বাছা দিন। ১৩। অনির্ধারিত
উকুন বাছা দিন। ১৪। অপারেশন ক্লিন হার্ট
উকুন বাছা দিন। ১৫। ফিনিক্স
উকুন বাছা দিন। ১৬। জন্মান্তর


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

জটিল লেখা!! এরপর কি হইলো....নিরালার কি হইলো!

কল্পনা আক্তার

...................................................
সব মানুষ নিজের জ্ন্য বাঁচেনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এরপরে নিরালা নিরিবিলিতে বসবাস করিতে থাকিল

অনিন্দিতা এর ছবি

আপনার লেখার মধ্যে কী যেন আছে! গল্পের বিষয় বস্তুর সাথে কখন ও একমত না হলেও কোথায় যেন আটকে যাই। পড়ার পর কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকি।রহস্যটা কি বুঝতে পারছি না। এই নিরালাকে এখন খুব অপার্থিব চরিত্র মনে হচ্ছে। এটা আমার সমস্যা/সীমাবদ্ধতা/অজ্ঞতার জন্য ?নাকি আপনার সৃষ্টিশীলতার জন্য?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার কৃতিত্বের পরিমাণ খুবই কম
কিন্তু আমার একটা কৌশল বোধহয় অন্যদের থেকে একটু আলাদা
সেটা হলো আমি চারপাশ থেকে দুহাত ভরে কুড়াই
আর তার জড়ো করে এনে ফেলে দেই সকলের সামনে

হয়তো একারণেই কোনো কোনো জায়গা একটু ভালো লেগে যায় কারো কারো

০২

নিরালা সম্ভবত পার্থিব কেউ না
অথবা অতিপার্থিব কেউ

অনিন্দিতা এর ছবি

উহু, আমি একটা বিষয়ে আপনার সাথে একমত না।
বেয়াদবি নিয়েন না।
অন্য অনেক লেখক ও আপনার মতো চারপাশ থেকে দুহাত ভরে কুড়ান আর সেটা সাধারন পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন্।( শ্রদ্ধা রেখে ই বলছি)।
আপনার উপস্থাপন কৌশল ই মনে হয় আলাদা । যে কারণে আমরা পাঠকরা আটকে যাই।
ঠিক বলেছি না?এটা আমার একটা observation.এরকম
আরও আছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ
তবে এইবার একটু সমালোচনা করেন। যাতে পরের লেখাগুলোতে খেয়াল রাখতে পারি
এই বইয়ের আর দুটো গল্প বাকি আছে
শেষ গল্প- জন্মান্তর
ওই গল্পটাতে একটু ভালো করে সমালোচান করবেন
ওই গল্পটাকে আমি আরো বহুবার লিখতে চাই বহুরকম করে

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল !

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গল্পের শেষ অংশটুকু অদ্ভুত ভালোলাগার মতো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শেষ অংশটা তাহলে পুতুপুতু রোমান্টিক হইয়াছে বলিয়া ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আমি প্রথমে ভাবছিলাম - নায়ককে ড়্যাব রিমান্ডে নিয়ে গেছে। পরে দেখি নিরালার সাথে হার্ট ক্লিনিং হাসি

জাঝা ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কিন্তু তা আর করতে পারলো কই?

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

- নিরালা থাকবে
- ঠিক আছে আমি মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকব

এটা গল্পটার সেরা অংশ, আমার বিবেচনায়।
এখানেই আপনি লীলেন। কেমন একটা গা ছাড়া ভাব। উঁচু দেয়ালগুলো আপনি হেটে পার হবেন, আর নীচুগুলো স-ব পা একেবারে মাথায় তুলে "হেইও" বলে!

আপনি ব্যাক টু টপ গিয়ার, সমালোচনার যোগ্যতা নেই, তাই কথা বাড়ালাম না ...

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জীবনের কত বিপরীত বাস্তবতা যে একসাথে থাকে তা কি কেউ অংক করে কিংবা লিখে দেখাতে পারে?

মাঝে মাঝে চোখের সামনে দুয়েকটা পড়ে গেলে আমরা চেষ্টা করি তুলে আনার

তাপস শর্মা এর ছবি

গল্পটা বাস্তবতা থেকে একটু দূরে আবার স্বাভাবিকতা থেকে অনেক কাছের মনে হল। বলা যায় নিরালা একটা অবয়ব, সেই অবয়বে লুকোনো আছে দুইটা সত্তা। প্রথমটা দোলাচল এবং ২য়'টা নিঃসঙ্গ।

মাহবুব লীলেন এর বলার স্বাভাবিকত্বেই গল্পটা অস্বাভাবিক জটিল হয়ে উঠেছে। চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।