উকুন বাছা দিন। ০৪। ঘুণপোকা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ০৫/০৩/২০০৮ - ২:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘুণপোকা

এ বাড়িতে একশ’টি পরিবার থাকে একসাথে। সাড়ে নয়শ’জন মানুষ। এক টেবিলে খায়। এক চুলায় রান্না হয় এ বাড়ির সবার

কলি অসুস্থ। কিন্তু এ বাড়ির কেউই তার অসুস্থতার কথা স্বীকার করে না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলে দিয়েছেন ওর কোনো অসুখ নেই। সে মূলত অন্যদের সহানুভূতি ও দৃষ্টি আর্কষণের জন্যই অসুখের ভান করে

কলিকে সবাই গালমন্দ করেন অসুখের ভান করে বাড়ির কর্তাদের দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য। বিশেষ করে সাদা নানি। দু’বছর আগে এ বাড়ির নতুন দশজন সদস্যের একজন তিনি। জন্মসূত্রে বিদেশি। এদেশে এসেছেন বেড়াতে। আর এ বাড়ির সদস্য হয়ে থেকে গেছেন একেবারে। দু’বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তায় এ বাড়িতে সবার শীর্ষে তিনি। সাদা নানি কলিকে যত বেশি পছন্দ করেন তত বকাঝকা করেন অসুখের ভানের জন্য

বাড়ির সবচে আকর্ষণীয় মেয়ে কলি সবার সাথে কথা বন্ধ করে দেয়। কেউ তার অসুখ বিশ্বাস করে না। তবুও সে একা একা বলতে থাকে আর কাউকে দেখলেই জোর করে সুস্থ হয়ে উঠতে চায়

আমিও ডাক্তারের কথা মানি। কলির অসুখ নেই। কিন্তু আমি জানি কলি অসুস্থ। আমার ধারণা এ অসুখ কলির নয়। অন্য কারো। কেউ একজন তার নিজের অসুস্থতা কৌশলে কলির ভেতর পাচার করে দিচ্ছে। কলি ভোগ করছে অন্য কারো যন্ত্রণা
কলির প্রচণ্ড কষ্ট হলে সে আমার কাঁধে মাথা রাখে। যন্ত্রণায় মোচড়াতে থাকে। ঠিক তখনই মনে হয় এ মানুষ কলি নয়। অন্য কেউ। প্রচণ্ড বৃদ্ধ কোনো মানুষ

কলি তার কোনো যন্ত্রণা আমাকে লুকায় না। শরীর দুর্বল হয়ে গেলে আমাকে ধরে হাঁটে। এক সময় প্রচণ্ড বমি করে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। বমির সাথে যে খাবারের টুকরোগুলো বের হয়ে আসে কলি তা কোনোদিন খায় না। অথচ সবসময়ই ওর বমির সাথে বের হয়ে আসে ওর না খাওয়া খাবারগুলো
কথাটা কলি ওর মাকে বলেছিল- বলেছিল সাদা নানিকে। তারা বললেন নিশ্চয়ই কলি চুরি করে ওই খাবারগুলো খায়। ওই খাবারগুলো বড়োদের। এ বাড়ির নানা নানি- দাদা দাদিরাই এই খাবারগুলো খায়। কলি আমাকেও আর বলেনি কথাটা। কিন্তু আমার চোখে ধরা পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে আমিই তাকে সব খাইয়ে দেই। সারাদিন ওর সাথে থাকি। হঠাৎই আমি টের পাই ও যা খায় বমির সাথে তা আসে না। যা খায় না বমি করে তাই। গত পরশু যে খাবারের টুকরোগুলো বের হয়ে এল আমিই তা বাজার থেকে এনেছিলাম বাড়ির বড়োদের জন্য। এবং বড়োরা আমার সামনেই সবগুলো খাবার খেয়ে ফেলে। এ খাবার কলির বমিতে আসার কথা নয়

বাড়ির সামনেই বিশাল মাঠ। এ বাড়িতে যারা আমাদের বয়সী কিংবা তারও কম- তারা এ মাঠে খেলাধুলা করে। মাঠের শেষ মাথায় বাড়ির ভাগ্যমন্দির। মূলত বাড়ির মধ্যবয়সীরাই ভাগ্যমন্দিরের সেবক এবং যাতায়াতকারি। শিশু এবং মহিলাদের মন্দিরে যাওয়া নিষেধ। বৃদ্ধরা নিজেরাই যায় না। কারণ সেখানে গেলে তারা নিজেদের ভাগ্যে পতন ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। মধ্যবয়সী কেউ ইচ্ছে করলে আমাদের বয়সী কোনো তরুণকে নিয়ে যেতে পারেন। তবে একা যাওয়া নিষেধ

ভাগ্যমন্দিরে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সাতটি ভিডিও মনিটর রয়েছে। দিনরাত খোলা থাকে। ছয়টি মনিটরে এ বাড়ির সবার ভাগ্য; অতীত বর্তমান ভবিষ্যত দেখা যায়। আর সপ্তম মনিটরে দেখা যায় এই বাড়ির সার্বিক ভাগ্য। মধ্যবয়স্করা মনিটরে সবার ভাগ্য দেখে এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন

মনিটর কক্ষের পাশেই বন্দিশালা। যে সমস্ত রাহু- শনি এবং দৈত্য-দানোরা দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী; তাদেরকে ধরে এনে এখানে বন্দী করে রাখা হয়। মাঝে মাঝে এদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে অন্যান্য রাহু-শনিকেও বন্দী করা হয়। অথবা হত্যা করা হয়

বন্দিশালার পাশের ঘরটি প্রতিরক্ষা কক্ষ। এখানে প্রথমে কম্পিউটারে শত্রু দানব-রাহু-শনিদের ইমেজ তৈরি করা হয়। তারপর আগে থেকেই কম্পিউটারে মজুত করা সৈনিক ইমেজগুলোকে বলা হয় শত্রু ইমেজগুলোকে হত্যা করার জন্য। প্রায় ক্ষেত্রেই যুদ্ধে আমাদের কম্পিউটার সৈনিকরাই জয়ী হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন শত্রু জয়ী হয়ে যায় তখন দুর্ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না। প্রতিরক্ষা কক্ষের আটত্রিশটা কম্পিউটারে অনবরত যুদ্ধ চলছে সৈনিক আর দুর্ভাগ্যের মাঝে

গত কিছুদিন ধরে বাড়ির মধ্যবয়সীদের ঘুম নেই। হঠাৎ করেই মনিটরে দেখা গেছে মাত্র এক বছর পরই এ বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা রাহুর দৃষ্টি পড়েছে বাড়িটার উপর
রাহুটাকে বন্দীও করা হয়েছে। কিন্তু বন্দী করার পর জানা গেছে এটা শুধু সেই রাহুটার দেহ। রাহুটা অনেক আগে থেকেই নিজের দেহের মধ্যে আরেকটা নিরীহ দানবের প্রাণ ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে ছদ্মবেশে চলাফেরা করে

কোনো কম্পিউটারই রাহুটাকে খুঁজে বের করতে পারছে না। কোনোমতেই তার কম্পিউটার ইমেজও তৈরি করা যাচ্ছে না। এখন একমাত্র ভরসা তার ফেলে যাওয়া দেহ। রাহুর দেহে ঢোকানো দানবটি রাহু সম্পর্কে কিছুই জানে না। দু’বছর আগে তাকে হঠাৎ করেই ধরে ঢুকিয়ে চলে গেছে। তার ধারণা রাহুটা নিজের যৌবন ফিরে পাবার জন্য কোনো কঠিন কাজ করতে গেছে। তবে রাহুরা কোনোদিনও নিজের দেহকে একেবারে ফেলে যেতে পারে না। আজ হোক কাল হোক নিজের দেহে তাকে ফিরে আসতেই হবে

রাহুর দেহটাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে প্রতিরক্ষা কক্ষের কম্পিউটারের সামনে। যাতে যখনই রাহু তার দেহের কাছে আসবে তখনই যেন কম্পিউটার তার ইমেজ তৈরি করে ফেলতে পারে। কিন্তু এ কয়দিনে রাহু তার দেহের কাছেই আসেনি

বাড়ির সবাই আমাকে পছন্দ করে। মদের টেবিলে আমাকে পাবার জন্য আগ্রহী থাকে সবাই। বুড়োরা পছন্দ করে তাদের স্মৃতির মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে। তরুণরা পছন্দ করে আড্ডায় আমার আসর জমানোকে। আর কেউ কেউ হিংসার সাথে সমীহ করে বাড়ির সবচে আকর্ষণীয় মেয়ে কলি আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায় বলে। মাঝবয়সীরা আমাকে পছন্দ করে আমার ভবিষ্যতের জন্য। প্রায়ই তাদের টুকটাক কাজ আমাকে দিয়ে করায় তারা; যাতে ভবিষ্যত দায়িত্বের জন্য আমি দ্রুত দক্ষ হয়ে উঠতে পারি

মহিলারা পছন্দ করেন তাদের কারো মেয়ের গালেই আজ পর্যন্ত আমার দাঁতের দাগ দেখা যায়নি বলে। আর ছোটরাতো আমাকে দেখলেই ঘিরে ধরে নতুন গল্প শোনানো অথবা নতুন নতুন খেলা শিখিয়ে দেয়ার জন্য। আমার আরও তিন বন্ধু আছে যারা এ বাড়িতে সমান জনপ্রিয় তারা রাহুল- সজীব আর জীবন

আমার ভাগ্য ভালো ছিল। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে আমার ভবিষ্যত ভাগ্যরেখায় একটা লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ মৃত্যু। মাত্র দু’মাস পরই আমার মৃত্যু ঘটবে। একই অবস্থা সজীব- রাহুল আর জীবনের ভাগ্যরেখায়

কম্পিউটার বলছে এটা সেই রাহুর কাজ। রাহু আমাদের চারজনকে নির্বাচন করেছে তার অমরত্বের জন্য। ছ’মাস পরে কলির ভাগ্যরেখায় একটা দীর্ঘ হলুদ দাগ। অর্থাৎ ছ’মাসের মধ্যেই কলি বৃদ্ধা হয়ে যাবে। কম্পিউটার ধারণা করছে বাড়ির সবচে সতেজ তারুণ্যটিকেই রাহু বেছে নিয়েছে নিজের যৌবনের জন্য

কলি ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তার অসুস্থতা বাড়ছে। সে সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আমার সাথেও কথা বলে খুব মেপে। কথা বলতে খুব কষ্ট হয় তার। ইদানীং শুধু একটা কথাই বারবার বলে- আমি কোনোমতেই তোমাকে মরতে দেবো না। কিন্তু এর উত্তরে আমি তাকে বলতে পারি না- কলি তোমার তারুণ্য আমি তোমাকেই ফিরিয়ে দেবো। পারি না আমি

একদিন বিকেলে একজন মধ্যবয়সী আমাকে ভাগ্যমন্দিরে নিয়ে গেলেন। বললেন আমরাতো ব্যর্থ হলাম; দ্যাখ্ নিজের জন্য কিছু করতে পারিস কি না। আমাকে তিনি প্রতিরক্ষা কক্ষে নিয়ে গেলেন। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখলাম। হঠাৎ শুনলাম সেই কক্ষে বেঁধে রাখা রাহুর দেহটা আমাকে ডাকছে। প্রচণ্ড ভয় লাগল আমার। মন দিয়ে যুদ্ধ দেখতে লাগলাম। কিন্তু বারবার ডাকছে সে। গেলাম। দেহের ভেতরের দানবটা কানে কানে বলল- তোর সাথে কথা আছে বাবু। তুই একা আসিস

রাহুটার দেহে বিকট মুখ। একপাশে মাত্র গোঁফ। অন্যপাশে ফাঁকা। গালের বামপাশে চামড়া নেই। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে বিশ্রীভাবে। রাহুটা প্রচণ্ড বৃদ্ধ। তার শরীরের সবগুলো চামড়া ঝুলে আছে

ফিরে এসে কলিকে বললাম রাহুটা একা যেতে বলেছে। কলি যেতে নিষেধ করল। আমাকে একা পেলে ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা কলি আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। একটাও কথা বলতে পারছে না সে। কলি বোবা হয়ে গেছে। মধ্যবয়সীদের সাথে দৌড়ে গেলাম মন্দিরে। শুনলাম কাল শেষ রাতে কলি পুরুষের ছদ্মবেশে ভাগ্যমন্দিরে গিয়ে রাহুর দেহের সাথে কথা বলে। কম্পিউটার বলছে সম্ভবত কলি রাহু সম্পর্কে সব জেনে গিয়েছিল তাই রাহু তাকে বোবা করে দিয়েছে। কলি এখন বোবা

দিন যাচ্ছে। আতঙ্কিত সবাই। মধ্যবয়সীরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলেন। আমাদের মরতেই হবে। আমাদের জন্য ভাগ্যমন্দির খুলে দিয়েছেন তারা। যদি নিজে থেকে কিছু পারি যেন করি। রাহুল-সজীব-জীবন আর আমি প্রায়ই মন্দিরে যাই। মনিটর দেখি

আজ কলি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল আমার মায়ের বিছানায়। হঠাৎ বমির ভাব আসায় আমি তাকে বৃদ্ধাদের বাথরুমে নিয়ে যাই। আমার মা-ই বলেছেন ওখানে নিয়ে যেতে। কারণ কাছাকাছি অন্য কোনো বাথরুম ছিল না। বাথরুমে ঢুকেই একটা সাদা শাড়ি ঝোলানো দেখি। সাদা শাড়িতে চিকন সবুজ পাড়। এরকম শাড়ি এ বাড়িতে কেউ পরে না। আমার কেমন সন্দেহ হয়। কাছে যাই। শাড়ি থেকে অবিকল কলির বমির গন্ধের মতো গন্ধ বের হচ্ছে

বমি করতে গিয়ে কলির কিছু বমি আমার হাতে লেগে যায়। আমি ইচ্ছে করেই হাতটা সাদা শাড়িতে মুছে ফেলি। হলুদ দাগ লেগে থাকে শাড়ির গায়ে

কম্পিউটার একটা নতুন তথ্য দিয়েছে। ভয়ংকর রাহুটি এ বাড়িতেই কোনো ছদ্মবেশে আছে। মধ্যবয়সীরা নতুন তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে রাহুর মুখের মতো একটা মুখোশ তৈরি করে বাড়ির সব পুরুষদের পরিয়ে পরীক্ষা করেছেন। কারো সাথে মিলছে না রাহুর দেহের গঠন। প্রত্যেকের দেহের গঠনের সাথে রাহুর দেহের গঠন মিলিয়ে পরীক্ষা করেছে কম্পিউটার। অবশেষে তরুণদের ডাকা হলো পরীক্ষার জন্য। আজকে আমরা চারজন। আমি-সজীব-জীবন আর রাহুলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রত্যেককে মুখোশ পরানোর পর কম্পিউটারে কমান্ড দিতেই কম্পিউটার প্রত্যেককে বাতিল করে দিচ্ছিল একে একে। অথচ অনবরত বলেই যাচ্ছে যে রাহু এ বাড়িতেই আছে
আজকেও রাহুর দেহে বন্দী দানবটা বারবার আমাকে ডেকেছে। কিন্তু ভয় ও ঘৃণায় আমি কাছে যাইনি

দলে সবার শেষে পরীক্ষা হলো জীবনের। মুখোশ পরাতেই অবিকল মিলে গেল সব কিছু। কিন্তু কম্পিউটার তাকেও বাতিল করে দিলো। আমাদেরকে পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া মধ্যবয়সী হতাশ হয়ে বললেন- সব পুরুষকেইতো পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু মিলছে না তো। হঠাৎ রাহুল বলে উঠল- রাহু যদি মহিলার ছদ্মবেশে থাকে?
- মহিলা? হতে পারে। কিন্তু মহিলাদেরতো পরীক্ষার জন্য মন্দিরে আনা যাবে না। তা হলে?
আমাদের মধ্যে সবচে বুদ্ধিমান রাহুল। বলল- সামনে উৎসব। ওই উৎসবে আমরা সবাই ছদ্মবেশ পরবো। এবং এ বাড়িতে যে বা যারা আমার শত্র“ তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করব। রাহুল বলল- যেহেতু আমাদের আয়ু উৎসবের পর মাত্র একদিন। সেহেতু রাহু ছদ্মবেশ পরে আমাদেরকেই হত্যা করতে আসবে। আমরা চারজনই থাকব একসাথে এবং...
চমৎকার বুদ্ধি। মধ্যবয়স্ক মেনে নিলেন

উৎসবের দিন ঘণ্টা পড়তেই মুখোশ আর ছদ্মবেশ নিয়ে সবাই বেরিয়ে এল মাঠে। কেউ পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ মাছ-কুমির হয়ে দিঘিতে সাঁতরাচ্ছে। কেউ বাঘ-সিংহ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে। কেউ কেউ সেই রাহুর মুখোশ পরে দাপাদাপি করছে। আবার কেউ শত্রুকে খুঁজে বের করে তার সাথে মারামারি করছে

মধ্যবয়স্করাও ছদ্মবেশ নিয়েছেন কিন্তু চুপচাপ সবাই। আমাদের চারজনের কাছাকাছি থেকে সবাই অপেক্ষা করছে ভয়ংকর একটা কিছুর। আমরা চারজন এমনভাবে ছদ্মবেশ নিয়েছি যেন সহজেই আমাদেরকে চেনা যায়। আমরা একটা নারকেল গাছের কাছে দাঁড়িয়েছি। কলি কিছুতেই আমাকে একা থাকতে দেবে না। সেও পাখি হয়ে নারকেল গাছে বসে আছে চুপচাপ

দুপুর হয়ে গেছে। কেউই আমাদের চারজনকে খুঁজতে আসেনি। হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক সবাইকে গুণে বললেন একজন মহিলা কম। এখনও ছদ্মবেশ নিয়ে বের হয়নি একজন। তিনি মাইকে সবাইকে বের হতে বললেন। আজকে ঘরে থাকা নিষেধ

ছদ্মবেশ নিয়ে কোথায় কী হচ্ছে তা দেখার জন্য আমি নারকেল গাছ বেয়ে কলির কাছে উঠে গেলাম। সবাই আমাকে উঠতে নিষেধ করছে। কারণ যেহেতু আমি পাখি বা বানরের ছদ্মবেশ নেইনি সেহেতু গাছে এসে কেউ আক্রমণ করলে আমি লড়াই করতে পারব না। তবুও আমি বসে থাকলাম কলির কাছে। হঠাৎ দেখলাম ঘর থেকে অবশিষ্ট মহিলা বের হলেন। একটা বাজ পাখির ছদ্মবেশ। পরনে সেই সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি। সরাসরি উড়ে আসছে আমাদের দিকে। কাছে আসতেই শাড়িতে আমার হাত মোছা বমির দাগ স্পষ্ট দেখতে পেলাম

বাজ পাখি এসেই আমাদের চারজনকে খুঁজতে লাগল। নিয়ম হলো কেউ এসে যদি বলে তুমি কি অমুক? তবে উত্তরে শুধু হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে। মিথ্যে বলা যাবে না। কিন্তু বাজ পাখি রাহুলকে যখনই বলল- তুমি কি রাহুল? রাহুল নির্দ্বিধায় বলল- না। তার দেখাদেখি সজীব আর জীবনও মিথ্যে বলল। বাজ পাখি শেষে যখন আমার কাছে এসে বলল তুমি কি বাবু? কলি ইশারায় আমাকে না বলতে বলল। রাহুল-সজীব-জীবনও আমাকে না বলতে বলল। কিন্তু আমি বলে ফেললাম- হ্যাঁ। সাথে সাথে সে আমাকে জাপটে ধরল। মুহূর্তের মধ্যে ওর তিনটা লম্বা নখ আমার ঘাড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। ঝুলে রইলাম ওর হাতে

একজনের বিপদে এই দিনে অন্যজনের সাহায্য করার নিয়ম নেই। কিন্তু আইন ভঙ্গ করে কলি ঝাঁপিয়ে পড়ল বাজ পাখির ওপর
আমাকে ছেড়ে দিলো বাজ পাখি। নিচে পড়ে গেলাম। রক্তাক্ত তুমুল লড়াই চলছে কলি আর বাজ পাখির মধ্যে। নিচে পড়ে গেছে তারাও। কলিকে দুয়েকবার সাহায্যের জন্য যখনই এগিয়েছি; বোবা কলি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে আমায়

রক্তে ভেসে যাচ্ছে দুজন। বেশি আহত কলি। বাজ পাখিটি যখনই আমার দিকে আসতে চাইছে তখনই মরীয়া হয়ে কলি ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ওপর

কলি প্রায় আধমরা। বাজ পাখি ওকে মেরেই ফেলবে। কলি একটানে বাজ পাখির শরীর থেকে সাদা শাড়িটি খুলে ফেলল। আমাদের কাছে মানুষটাকে খুব পরিচিত মনে হলো। কিন্তু সে আরো ক্ষেপে গেছে। কলি কিছুতেই শাড়ি ছাড়ছে না। হঠাৎ সে কলির বুক ছিদ্র করে হাত ঢুকিয়ে দিলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম দ্রুত বদলে যাচ্ছে কলির চেহারা। কলি মুহূর্তেই থুত্থুরে বুড়িতে পরিণত হলো। সজীব-রাহুল আর জীবন ঝাঁপিয়ে পড়ল বাজ পাখির উপর। এক টানে খুলে ফেলল ওর ছদ্মবেশ। সাদা নানি। চিৎকার করে উঠল ওরা তিনজন। কিন্তু চিৎকার থামার আগেই সাদা নানি এক থাবায় ওদের তিনজনের মাথা ছিঁড়ে ফেলল। আমার দিকে এগিয়ে আসতেই অবশ দেহ নিয়েই কলি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সাদা নানি এক টানে কলির হাত থেকে শাড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল ভাগ্যমন্দিরে। চোখের পলকে মন্দিরের ছাদ ভেঙে বন্দী রাহুর দেহটা নিয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল সাদা নানি

বাড়িটার ভাগ্যরেখা থেকে লাল দাগ সরে গেল। আমার ভাগ্যরেখা হয়ে উঠল আরো উজ্জ্বল। শুধু সেদিন বিকেলেই আমার কোলে ঢলে পড়ল বৃদ্ধ- বোবা কলির নিষ্প্রাণ দেহ
১৯৯৯.১২.১৩ সোমবার

উকুন বাছা দিন

প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫

............................................

উকুন বাছা দিন। ০১। ফসিল
উকুন বাছা দিন। ০২। মাকড়া
উকুন বাছা দিন। ০৩। টিকটিকি
উকুন বাছা দিন। ০৪। ঘুণপোকা
উকুন বাছা দিন। ০৫। নখর
উকুন বাছা দিন। ০৬। সমাবর্তন
উকুন বাছা দিন। ০৭। বংশ
উকুন বাছা দিন। ০৮। নির্বাণ
উকুন বাছা দিন। ০৯। অশোক বন
উকুন বাছা দিন। ১০। রাজসাক্ষী
উকুন বাছা দিন। ১১। অতল
উকুন বাছা দিন। ১২। উদ্বাস্তু
উকুন বাছা দিন। ১৩। অনির্ধারিত
উকুন বাছা দিন। ১৪। অপারেশন ক্লিন হার্ট
উকুন বাছা দিন। ১৫। ফিনিক্স
উকুন বাছা দিন। ১৬। জন্মান্তর


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

পুরা বই আছে। পড়াও শেষ। তাই এইবার আর পড়িনি। কিন্তু আজকে এমনি পড়তে গিয়ে দেখি স্ক্রিনে পড়তে খারাপ লাগছেনা। তাই নতুন করে পড়া হল আবার।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অনিন্দিতা এর ছবি

একটা বেক্কল প্রশ্ন করি-
গল্পটা রূপক ধর্মী মনে হচ্ছে। নেপথ্যের বিষয়টা বলা যাবে?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বিষয়টা?

যদি বলি বিশ্বায়ন তবে মাইন্ড করবেন?
প্রাণহীন শরীরের ভার আমাদের দুই পায়ের উপর ফেলে দিয়ে আমাদের প্রাণ আর প্রাণশক্তি নিয়ে যাচেছ কোনো ভিন্নদেশী হাত

এই ব্লগে অনেক মেধাবী আছেন
যাদের মেধা অন্যরা নেবার বিনিময়ে তাদরেকে ধরিয়ে দেয় অনন্ত ক্লান্তি...

হয়তো তারা বলতে পারবেন...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ (অপু)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমি এটাকে স্যাটায়ার ভাবতে চাই না। ভাবলে বিপদে পরে যাবো। আমি ফিকশনটাই উপভোগ করলাম।

সমস্যা হচ্ছে গল্পগুলো পড়ে ক্ষুধা এমন চারা দিচ্ছে যে, বইটা পাবার বাসনা তৈরি হচ্ছে।

মোট গল্প কতোগুলো?

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ফিকশন ধরলে ফিকশন
না ধরলে রূপকথা অথবা বিশ্বায়ন

মোট গল্প ১৬ টা
সবগুলোই দেবো এখানে একটা একটা করে

হাসিব এর ছবি

একটা ইবুক হিসেবে ডান দিকে লটকায় দেওয়া যায় নাকি ?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইবুকের দপ্তর আলাদা
বহুত কঠিন প্রক্রিয়া
এবং সিস্টেমটাও জানি না আমি

দ্রোহী এর ছবি

বস, আগের গল্পে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আপ্নে কি খান?" উত্তরে বলেছিলেন, "আলু—ডিম—আর—ডাইল !"

শুধু "আলু—ডিম—আর—ডাইল" খেয়ে এইরকম লেখা সম্ভব কি? নিজেই বলেন— "ভাত" না খাইয়া এই গল্প লেখা সম্ভব?


কি মাঝি? ডরাইলা?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সঙ্গে বিড়িও খেতে হয়

তাপস শর্মা এর ছবি

অসাধারণ। কিছুই বলার নাই। আমি ভাবছিলাম সত্যিই ফিকশান। তবে মন্তব্যে আপনার বলা বিশ্বায়ন দেখে ব্যাপারটা অন্যভাবেও ভাবলাম। দুর্ধর্ষ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।