মহাভারতের মহাভজঘট ০৬: ভূগোল ভগদত্ত ঘটোৎকচ শিখণ্ডী

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ২৩/০২/২০১৫ - ১১:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভূগোল নিয়া বহুত ঝামেলা পাকাইছে মহাভারত। মগধ সময়কালের মানচিত্র আর রাজনীতি যে মহাভারতে ঢুইকা গেছে সেই প্যাঁচালও আগে পাইড়া আসছি। এর বাইরে মহাভারতের মূল জায়গাগুলারে বর্তমান কালে চিহ্নিত করা গেছে ঠিকঠাকমতোই। কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর আছিল হরিয়ানায়। দ্বারকা হইল বর্তমানের গুজরাট। মৎস্যদেশ হইল রাজস্থানের জয়পুর; তক্ষক নাগের রাজধানী তক্ষশিলা হইল রাওয়ালপিন্ডি; গান্ধার হইল কান্দাহার। মানে মূল ঘটনাটা ওই অঞ্চলের কাহিনি কারবার। কিন্তু যখনই এর লগে মাইনসে মহাভারতের সূত্র ধইরা কয় বর্তমান মণিপুরের কথা মহাভারতে আছে তখনই বাঁধে ঝামেলা। হিসাব মিলে না। রাজশেখর বসুও কন সেই মণিপুর এই মণিপুর না। কিন্তু তাতে মণিপুরের মানুষের মহাভারতের কাহিনির লগে নিজেগো কাহিনি মিলাইয়া ঐতিহ্য সন্ধান থাইমা থাকে না...

ড. অতুল সুর নৃতাত্ত্বিক সাক্ষীসাবুদ ভূগোল ইতিহাস ঘাঁইটা কন যে দ্রৌপদী আছিল বাঙালি নারী। এতে বাঙালিরা খুশি হইলেও অন্যরা কিন্তু যুক্তি দিয়া কিলাইতে পারে। কারণ অতুল সুর বারণাবত থাইকা পাণ্ডবগো নৌপথে পলাইয়া বীরভূম পর্যন্ত আসার একটা যুক্তিসংগত বিবরণ দিলেও পাঞ্চালের লগে হস্তিনাপুর বা বীরভূমের লগে হরিয়ানার অত দ্রুত যোগাযোগ কেমনে হইল সে বিষয়ে যেমন কিছু বলেন না; তেমনি মহাভারতের অন্য কোথাও নৌ যোগাযোগের কোনো সংবাদও পাওয়া যায় না। আমার ধারণা অতুল সুর বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়াও আবেগি বাঙালি হইয়া কবিগো মতো কিছু ভাঙ্গা যুক্তি দিয়া দাবি কইরা বসছেন যে দ্রৌপদী হইল বাঙালি নারী। তার উপরে অনেকেই কন যে কর্ণের অঙ্গ রাজ্যের ভিতরে আছিল বর্তমান বাংলা অঞ্চল; মানে কর্ণ আছিলেন বাঙালির রাজা; এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ পইড়া বাঙালিজাতি কর্ণের লাইগা যে কান্দনটা কান্দে; তার উপ্রে যদি প্রমাণিত হয় যে কর্ণ আছিল বাংলার রাজা তাইলে তো বাংলার কবিরা কৃষ্ণ অর্জুনরে ভর্তা বানাইয়া নতুন মহাভারত লিখতে বইসা যাইব কাইল...

কর্ণের অঙ্গরাজ্য কিংবা পাঞ্চালের লগে বাংলার সম্পর্কসূত্র খাড়ার উপ্রে বাতিল করতে না পারলেও হরিয়ানার লগে যখন আসামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটাইয়া দেওয়া হয়; তখন পুরাই আউলা হইয়া উঠে মহাভারতীয় ভূগোলের পাঠ...

ভগদত্ত নামে একখান চরিত্র আছে মহাভারতে। তিনি দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতির বাপ। প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরক-এর পোলা। তার বাহিনীর মূল শক্তি হইল হাতি আর তার সৈনিকরা হইল চীনা আর কিরাত। দাবি করা হয় মহাভারতের প্রাগজ্যোতিষপুর হইল পরবর্তীকালের কামরূপ রাজ্য যার সীমানায় পড়ছে বর্তমান সময়ের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল...

আসাম থাইকা দিল্লির আকাশ-দূরত্ব দুই হাজার কিলোমিটারের মতো। আধুনিক মিলিটারিগো হিসাবমতে গ্রাউন্ড ডিসটেন্স কমপক্ষে এয়ার ডিস্টেন্সের ডাবল হয়। সেই হিসাবে আসাম থাইকা দিল্লির কাছাকাছি হরিয়ানার স্থল-দূরত্ব কমবেশি চাইর হাজার কিলোমিটার। যে যুগে ট্রেন বাস বিমান জাহাজ নাই; রাস্তাঘাট নাই; নদীতে ব্রিজ বা ফেরি নাই; থাকা-খাওয়ার লাইগা দোকানপাট কিংবা হোটেলপাতি নাই; সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা যাইতে কত দিন লাগতে পারে?

মিলিটারিরা কয় ভালো রাস্তায় সৈনিকগো হাঁটার কার্যকর গতি গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলো। আর যেইখানে রাস্তাঘাট তেমন নাই সেইখানে গড়ে তা নাইমা আসে ৩ কিলোতে। দৈনিক কার্যকর হাঁটার ঘণ্টা হইল ১০ আর বচ্ছরে পায়ে হাঁটার কার্যকর মাস হইল সাত। মানে ২১০ দিনের কার্যকর বচ্ছর। তো এই অবস্থায় এই গতিতে আসাম থাইকা রওনা দিয়া একলা এক সৈনিকের হরিয়ানা যাইতে হইলে হাঁটতে হইব মোট ১৩৪ দিন; মানে প্রায় ৮ ক্যালেন্ডার মাস। তাও যদি সবগুলা নদী-উপনদীতে তার লাইগা নৌকা রেডি থাকে তয়...

তো সেই যুগে বাহিনী আর হাতি নিয়া হাঁটার হ্যাপাগুলা কী? পয়লা কথা হইল সেনাপতিরা হাতিতেই যাউক আর ঘোড়াতেই যাউক; দলের মালপত্র টানা মুটে-মজুরগো চলার গতিই আছিল তাগো অগ্রগতির গড় গতি। সেনাপতিগো কিছুদূর গিয়া থামতে হইত; পায়েদল মজুররা আসার অপেক্ষায়। তারপর তারা আইসা আশপাশ থাইকা খাবারদাবার জোগাড় করত; রান্নাবান্না করত; থাকার ব্যবস্থা বানাইত; হাতিঘোড়ার খাবার দিত; বিশ্রাম দিত। তার উপরে ঝড়বাদলা বৃষ্টিতে থাইমা অপেক্ষা করতে হইত; অসুখ-বিসুখে মানুষ মরত; কাহিল হইয়া পড়ত; পাহাড়-জঙ্গলের ভিতর রাস্তা বানাইতে হইত; লোকাল মাতবর কিংবা ডাকাত-ফাকাতের লগে মারামারি করতে হইত; তারপর হইত আগাইতে। কিন্তু নদীতে কী উপায়?

নৌকা বহুত পুরানা জিনিস। কিন্তু হাতি কেমনে নদী পার করে? সাঁতরাইয়া? সেইটা সম্ভব না। কারণ হাতি সাঁতরায় শরীর ডুবাইয়া শুঁড় পানির উপরে ভাসাইয়া। হাতিরে পানিতে ভাসাইয়া তার ঘাড়ে বইসা বড়ো নদী পার হইতে গেলে মাহুত ভাইসা যাইবার কথা। মহিষের মতো হাতির ল্যাঞ্জে ধইরাও সাঁতরানো সম্ভব না; কারণ সাঁতরাইবার সময় হাতির ছোট ল্যাঞ্জাটা ডুইবা থাকে পানির কয়েক ফুট নীচে। ছোটখাটো নৌকায় তুইলা হাতিরে পার করাও সম্ভব না। হাতিরে পার করতে হইলে সেই যুগে বাঁশ আর কলাগাছ দিয়া বিশাল ভেলার কোনো বিকল্প আছিল বইলা মনে হয় না আমার। সেইটা বানাইতে হইত প্রচুর সময় নিয়া এবং নদী পার হইতে হইত আরো বেশি ধীরে; ঝড়-বাদলা দেইখা...

বলা হইছে ভগদত্ত কুরুযুদ্ধে অংশ নিছে এক অক্ষৌহিণী সৈনিক নিয়া। এক অক্ষৌহিণী মানে হইল ১ লক্ষ ৯ হাজার সাড়ে তিনশো পায়দল সৈনিকের লগে ২১ হাজার ৮৭০টা কইরা রথ আর হাতি এবং ৬৫ হাজার ৬১০টা ঘোড়া। তো এইবার একেকটা হাতির লগে দুইজন কইরা মাহুত আর রথে কমপক্ষে একজন কইরা সারথি আর জোগানদার কামলা যোগ কইরা গুইনা দেখেন মোট পাব্লিক কত হইতে পারে এক অক্ষৌহিণী সৈনিকের ভিতর; এবং সেই বিশাল বাহিনীরে সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা নিয়া যাইতে কত বছর লাগতে পারে? তো একজন রাজা; যার নিজের আছে বিশাল একখান রাজ্য; সে কেমনে কথায় কথায় গিয়া আসাম থাইকা অত বড়ো বাহিনী নিয়া হরিয়ানা হাজির হয়? তার উপরে আবার বিবাহ-শাদির সম্বন্ধ পাতায়? কেমনে সম্ভব? কেমনে সম্ভব গুজরাট থাইকা আসামে আইসা কৃষ্ণের পক্ষে ভগদত্তের বাপেরে মাইরা ফালানো?

মহাভারতের লগে ভগদত্তরে জুইড়া দেওয়ার কারিগরি ইতিহাস অন্য আরেকটা জায়গার ইতিহাস খুঁজলে বোধ হয় পাইলেও পাওয়া যাইতে পারে। ভগদত্ত প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকের পোলা; যারে বামুন ঘরানার সাহিত্যে কইত নরক রাজ্য। সেই নরক রাজ্য যখন চতুর্থ শতকে বর্মন রাজ বংশের শাসনামলে প্রাগজ্যোতিষপুর নাম পাল্টাইয়া হইল কামরূপ; তখন বর্মন রাজারা দেশের মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া আর বৈষ্ণব ধর্ম প্রতিষ্ঠার লাইগা মগধ সাম্রাজ্য থাইকা কামরূপে আমদানি করছিল ব্যাপক ব্রাহ্মণ। বামুনরা কিন্তু সহজে কামরূপে আসতে চাইত না। তারা বাংলারে কইত পক্ষী জাতীয় মানুষের দেশ আর কামরূপরে কইত নরক। কোনো বামুন এই দিকে আসলে ফিরা যাইবার সময় তারে প্রায়শ্চিত্ত কইরা ঢুকতে হইত নিজের সমাজে। তো দেশ আর আত্মীয়-স্বজন ছাইড়া যেই সব বামুন সেই নরক রাজ্যে আসতে রাজি হইত তারা মূলত আছিল নিজেগো অঞ্চলে খাইতে না পাওয়া কিংবা পতিত কিংবা আকাম কইরা পলাইয়া থাকা বামুনের দল। কালে কালে তাই পতিত আর অকর্মা মানুষগো সর্বশেষ ঠিকানা হিসাবে নরক হইয়া উঠে সকলের ধর্মীয় গন্তব্যের নাম...

তো সেই নরকে কিংবা কামরূপে কিংবা আসামে-সিলেটে যে বামুনরা আসলো; মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দিলো; সেইটার প্রভাব কিন্তু এখনো রইয়া গেছে সিলেটি আর অহোমিয়া ভাষার শব্দে আর উচ্চারণে। এই ভাষাগুলায় সংস্কৃত শব্দবাহুল্য; দীর্ঘ ক্রিয়াপদ আর উচ্চারণ এখনো বহন করে সেই ভাট বামুনগো অবদানের চিহ্ন। কিন্তু একবারও কি ভাইবা দেখা যায় না যে ৩৫০ থাইকা ৬৫০ সাল পর্যন্ত শাসন করা বর্মন রাজারা খালি নরকরে প্রাগজ্যোতিষপুর থাইকা কামরূপ বানাইয়া শিক্ষিত আর বৈষ্ণব করার পিছনেই পুরা ইনভেস্টমেন্ট খরচা করে নাই; বরং নতুন কামরূপের ঐতিহ্য নির্মাণেও তারা ইনভেস্টমেন্টের একটা বিশাল অংশ খরচা করছে?

ভিন্ন সমাজে এইরকম আরেকখান উদাহরণ দেখার লাইগা এইবার একটু ভার্জিলের ইনিড মহাকাব্যখানের শানেনুজুল স্মরণ কইরা নেন। গোত্র-পরিচয়হীন অক্টাভিওন যখন অগস্টাস সিজার হইয়া জুলিয়াস সিজারের উত্তরাধিকার হইলেন; তখন তার মা আতিয়া বালবা কবি ভার্জিলরে দায়িত্ব দিলেন পোলার একখান ঐতিহ্যময় বংশকাহিনি বানাইয়া দিতে...

তো সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়া ভার্জিল হোমারের ইলিয়াড থাইকা ট্রয় যুদ্ধের সূত্র ধইরা একখান চরিত্র বাইর করলেন- ইনিয়াস। তারপর তিনি লিখতে থাকলেন ইনিড। কাহিনি বানাইয়া কইয়া দিলেন যে ট্রোজান রাজ বংশের পোলা ইনিয়াস ট্রয় থাইকা পলাইয়া আইসা প্রতিষ্ঠা করছেন রোমান জাতির। মানে তিনি রোমান জাতির পিতা। তো যাই হউক ভার্জিল ইনিয়াসরে দিয়া রোমান জাতিটাতি প্রতিষ্ঠা করার পর কইলেন যে আতিয়াপুত্র অক্টাভিওন; মানে অগস্টাস সিজার হইলেন সেই মহান ইনিয়াসের বংশধর; মানে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান...

তো কি এমনো হইতে পারে যে কামরূপের বর্মন রাজারা নিজেগো বৈষ্ণব ঘরানায় ঐতিহ্যশালী করার ইচ্ছায় সংস্কৃত পণ্ডিতগো পয়সা-পাতি দিছে মহাভারতে তাগোরে ঢুকাইয়া দিবার লাইগা? হইলে হইতে পারে সেই সব পেইড কবিরাই ছক কইরা কৃষ্ণরে দিয়া ভগদত্তের বাপ নরকরে হত্যা করাইয়া কৃষ্ণের নাম ধইরা নিজেগো দেশ থাইকা পয়লা নরকের গন্ধ ছাড়ায়; তারপর কুরুযুদ্ধের মাঠে নিয়া কৃষ্ণ আর অর্জুনের হাতে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তরে মারে; তারপর শুরু করে বর্মন রাজ বংশের অধীনে বামুন প্রভাবিত বৈষ্ণব ঘরানার নয়া কামরূপ...

মহাভারতের স্বর্গও কিন্তু বর্তমানের স্বর্গ না। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ হিসাব কইরা অতুল সুর কন মহাভারতের স্বর্গ হইল মূলত হিমালয়ের উত্তর অংশ যেইখানে আছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নগর আর রাজধানী অমরাবতী। যাই হউক মহাভারতের পুরা ভূগোলই কিন্তু এইরকম ব্যাপক ক্রিয়েটিভিটিতে ভরা...

ভীমের পোলা ঘটোৎকচরে নিয়াও বেশ আউলাঝাড়া কাহিনি আছে। মহাভারতে সে গোঁয়ার; মহাভারতের কবিরা তারে পুরা রাক্ষসও বানাইয়া থুইছেন। কিন্তু মহাভারতের ইন্দোনেশিয়ান কাহিনিগুলায় সে আবার অন্যরকম হিরো। আমার হিসাবে মহাভারতে যত উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চ সংস্কৃতির চরিত্র আছে তাগো মাঝে মনে হয় ঘটোৎকচ পয়লা সারির একজন...

সেই সময় গুণী কইন্যাগো লাইগা বহু স্বয়ংবরা প্রচলিত আছিল; কিন্তু সেই সব স্বয়ংবরায় পাত্ররা কইন্যা জয় করত নিজের শানশওকত কিংবা বাহাদুরি দেখাইয়া। ঘটোৎকচও বিবাহ করছে স্বয়ংবরার আসর জিতা; কিন্তু সেইটা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা। এই রকম বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা আমি দ্বিতীয়টা পাই নাই কোথাও। যদিও স্বয়ংবরায় বুদ্ধি পরীক্ষার প্রশ্নগুলা আমি উদ্ধার করতে পারি নাই; সবখানেই বলা হইছে অহিলাবতী স্বয়ং কিছু কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছে পাত্রগো আর সেই সব কঠিন কঠিন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়া ঘটা তারে জিতা নিছে। কিন্তু এতে অন্তত তার বুদ্ধির একটা ঝিলিক পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিষয়টা হইতাছে মহাভারতে যেইখানে সকলেই নিজের পোলাপানগো বীর আর যোদ্ধা বানাইবার লাইগা অস্থির সেইখানে ঘটোৎকচ পড়ালেখা শিখাইয়া নিজের ছোট পোলারে বানাইতে চায় ঋষি। তার ছোট পোলা বর্বরীক ঋষি হয়ও। রাজস্থানে এক নামে আর নেপালে আরেক নামে বর্বরীকের মন্দিরও আছে...

এইটা কেমনে সম্ভব? একটা মানুষের ঐতিহ্যে যদি শিক্ষা-সংস্কৃতি আর বুদ্ধিচর্চার অস্তিত্ব না থাকে তবে হিড়িম্বার পোলা কেমনে বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরায় গিয়া নাগরাজ মুরুর মাইয়া অহিলাবতীরে বিয়া করে আর নাতি হয় ঋষি? মূলত আদিবাসী মানুষগুলারে বড়ো বেশি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হইছে মহাভারতে; যার প্রমাণ এই ঘটোৎকচ...

অবশ্য ঘটোৎকচের বৌ নিয়া কিছু ভিন্ন মত আছে। কোনো সূত্রে অহিলাবতী যাদব বংশজাত। কোনো সূত্রে কয় সে নাগ বংশজাত। ঘটোৎকচের আরেক বৌয়ের সন্ধান পাওয়া যায় ভার্গবী নামে। কোনো সূত্রে দেখা যায় ভার্গবী যাদব বংশজাত; আবার কোনো সূত্র বলে ভার্গবী হইল অর্জুনের মাইয়া; সুভদ্রা গর্ভজাত। অবশ্য নেপালে যারা ইয়ালাম্বর নামে বর্বরীকের পূজা করে আর বলে যে সেই হইল নেপালি প্রথম কিরাত রাজা; তারা আবার ঘটোৎকচরেও কিরাত বানাইয়া ফালায়। কিরাতরা আবার অন্য কোথাও দানব নামে পরিচিত আর বৈশিষ্ট্যে মঙ্গোলয়েড গোত্রজাত। সেই ক্ষেত্রে কিন্তু মহাভারতের অস্ট্রিক গোত্রজাত ঘটোৎকচের লগে দুই কাহিনির একটা প্যাঁচ লাইগা যায়...

এক কাহিনি বলে ঘটোৎকচের পোলা বর্বরীক কৃষ্ণের সামনে আত্মবলিদান দেয় আর অর্জুনের পোলা ইরাবান মরে কুরুযুদ্ধে। কিন্তু অন্য কাহিনি বলে যুদ্ধের আগে আত্মবলিদান দেয় অর্জুনের পোলা ইরাবান। যারা দ্বিতীয় কাহিনি বিশ্বাস করে তারা আবার ইরাবানরে দেবতা ইরাবৎ কইয়া পূজাও করে...

আমার অভাজনের মহাভারতের কাহিনিতে আমি হিড়িম্বারে সাঁওতাল কইন্যাই কইছি; ঘটার বৌ অহিলাবতীর লাইগা বাইছা নিছি নাগ বংশের পরিচয়...

শিখণ্ডীরে অনেকেই হিজড়া কন; কিন্তু এই বিবাহিত ব্যাডার রীতিমতো পোলাপান আছে। মনে লয় ভীষ্মের মরণরে মহান বানাইতে গিয়া অম্বার পুনর্জন্ম-টুনর্জন্ম জুইড়া দিয়া শিখণ্ডীরে ছাইয়া বানাইয়া থুইছে কবিরা। আর ভীষ্ম যে হিজড়া দেখলে অস্ত্র ছাইড়া দেন সেইটাও কিন্তু পুরা ভুয়া। কারণ শিখণ্ডী তার লগে সাত নম্বর আর নয় নম্বর দিনেও যুদ্ধ করছে; কিন্তু তখন তো তিনি তারে দেইখা কুফা কইয়া অস্ত্র ছাড়েন নাই। তাইলে দশ নম্বর দিনে আইসা হঠাৎ শিখণ্ডীরে দেইখা ভীষ্ম অস্ত্র ছাইড়া দিবার নাটক করলেন ক্যান?

মহাভারতের মহাভজঘট ০৫: জাতিবংশ ঘরবাড়ি পোশাক
মহাভারতের মহাভজঘট ০৪: অস্ত্রপাতি আর যুদ্ধ
মহাভারতের মহাভজঘট ০৩: সংখ্যা ও বয়স
মহাভারতের মহাভজঘট ০২: কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
মহাভারতের মহাভজঘট ০১: ঘটনাকাল


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘটারেতো আমি ভাবতাম, আমগো এদিকের বুঝি। মানে বড় বড় রাজ্য শাসনের সময় আমাদের পুরা অঞ্চল ছিল, প্রান্ত রাষ্ট্র। এমনকি অশোকের সময়ও আমরা প্রান্ত রাষ্ট্রই ছিলাম বোধ হয়। সেখানে কী কী জানি সূত্র ছিল। গুপ্তদের সময় আবার এইসব প্রান্তরাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ প্রতিনিধী পাঠানো হইছিল। আর্যদের রাজ্য বিস্তার আর নানা কারণে সম্ভবত আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি এইরকম প্রান্তের দিকে চইলা আসে যাগোরে আবার তারা রাক্ষস, দাস, অসুর ইত্যাদি কইতো।---

একটু একটু পড়ছিলাম, ছিঁড়া-খোঁড়া, সব মনেও নাই। সবতো প্যাচ লাইগা গেলো লীলেনদা। ভুগোলের অবস্থা দেইখাতো চোখ গোল হইয়া গেছে।

স্বয়ম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কোনটা প্রান্ত আর কোনটা কেন্দ্র সেইটা ঠিক করব কেডায়?

অতিথি লেখক এর ছবি

অশোকের রাজ্য বিবরণীতে, আমগোরে প্রান্ত হিসাবে উল্লেখ করছে সম্ভবত। অবশ্যই তাগো হিসাবে এই প্রান্ত ধারণা।

স্বয়ম

আরাফ  এর ছবি

চলুক খুব ভালো। অনেক তথ্যবহুল। আপনার বইটা পড়ার ইচ্ছা আছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লিখেছেন।অনেক কিছু জানতে পারলাম এখান থেকে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

লীনেন দা, মগধ নিয়া সমস্যায় কি সবাই পড়ে? আফনে ও পড়লেন। ঘটোতকোচ ও তার সন্তান বর্বরীক কিন্তু শিক্ষিত আছিলো তবে মহাভারতের কবি তাদের ততো একটা গুনগান করে নাই জাতিগত ভাবে অনেক কিছু বিবেচনা করা হইতো বিধায় এটা করে নাই।তবে আমার মতে দ্রৌপদী বাঙ্গালী কইন্যা নয় আর বাংলাও অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পরে নাই।মনিপুর ব্যপারটা আর একটু ভাইংগা কইবেন? এটা নিয়া খটকা আছে।

-------------
রাধাকান্ত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার হিসাবে মহাভারতে সম্ভবত প্রায় অবিকৃত চরিত্র ভীম; কালা পেটলা ট্যারাচোখ গোঁয়ার দেইখা তার উপর কেউ দেবত্ব চাপাইতে রাজি হয় নাই; হিরোও বানাইতে চায় নাই। আর বাকিরা তো পুরাই অবহেলিত ঘৃণিত

০২
দ্রৌপদীরে আমারও বাঙাল মনে হয় না; অঙ্গ রাজ্যও বাংলার কাছাকাছি মনে হয় না। সেই যুগে দিল্লি বইসা বাংলা শাসন করার মেকানিজম আবিষ্কার হইবার কোনো প্রমাণ নাই

০৩
একই নামের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা কিন্তু সারা ভারতে প্রচুর। মহাভারতের মণিপুর বোধহয় অন্য কোনো মণিপুর; কোনোভাবেই বর্তমান মণিপুর রাজ্য না। এইটা রাজশেখর বসুরও মতামত

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

মহাকাব্যের স্থান কাল পাত্র-পাত্রী এইসবের বাস্তবভিত্তিক হিসাবনিকাশ করতে গেলে হিসাব মিলানো শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। যাই হোক, হাতীর নদী পারাপার বোধ হয় অতটা জটিল ব্যাপার নয়। যদি এত জটিলই হতো, তাহলে ভারতীয় রাজা-রাজরাদের সেনাবাহিনীতে হস্তী বাহিনী বলে কিছু থাকত না। বিশেষতঃ ছোটবড় অগণিত নদীর দেশ বাংলার রাজাদের হস্তী বাহিনী পোষা অসম্ভব হয়ে পরতো। মাহুত উপবিষ্ট অবস্থায় হাতীর সাঁতারের একটা দৃশ্য নিচের লিঙ্কে দেখা যেতে পারে।

https://www.youtube.com/watch?v=ywXYfLFapLY

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আপনার হিসাবে তো মনে হচ্ছে হাতি নদী পার করা তেমন একটা জটিল না; কিন্তু পদ্মার মতো বড়ো নদী পার করার কী ব্যবস্থা এখনো প্রশ্ন আমার মাথায়

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইয়ে, মানে... শিখণ্ডীর এই পারিবারিক কাহিনি তো জানা ছিল না অ্যাঁ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কার পরিবারের খবর কে রাখে

এক লহমা এর ছবি

আয়, হায়, কত প্রশ্ন, আর কত কম উত্তর! চিন্তিত হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার প্রশ্নগুলার উত্তর দিব কেডায়

অতিথি লেখক এর ছবি

লীনেন দা আপনি তো ব্যসাসনে বসে আছেন তাইলে প্রশ্ন শুনবেন আর খালি উওর দিবেন । আপনার তো প্রশ্ন থাকা চলবো না!!!!

-----------
রাধাকান্ত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

গীতা নিয়া বয়ান করলে না এইটা ব্যাসাসন হইত। মহাভারত বয়ানকাররে তো কয় সৌতি বা সূত। সৌতিরা তো ব্যাখ্যা দেয় না; খালি বয়ান করে

তাহসিন রেজা এর ছবি

লীলেন্দা, আপনার অসাধারণ "অভাজনের মহাভারত" পড়লাম। খুব ভালো লেগেছে। কয়েকটা জায়গায় তো একেবারে আমার মনের ভেতর গেঁথে গেছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

মন মাঝি এর ছবি

তো কি এমনো হইতে পারে যে কামরূপের বর্মন রাজারা নিজেগো বৈষ্ণব ঘরানায় ঐতিহ্যশালী করার ইচ্ছায় সংস্কৃত পণ্ডিতগো পয়সা-পাতি দিছে মহাভারতে তাগোরে ঢুকাইয়া দিবার লাইগা?

হে বঙ্গব্যাস লীলেনদেব, আপনিও আমারে আপনার মহাভারতে ঢুকাই দ্যান না?! আমিও কুরক্ষেত্র, গান্ধার, তক্ষশীলায় গেছি কিন্তুক। হাছাই কইতাছি। এখন কোনমতে একটা কাল-যান আমদানি করেন আর আমারে সেটায় চড়ায় দ্যান, তাইলেই হবে। যেমনে হোক একটা কিছু ব্যবস্থা করেন। অনেক অনেক পয়সা-পাতি দিমুনে!!

****************************************

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আইসেন তাইলে টেকাপয়সার ডিল নিয়া কথা কই;
আমি কুন্তীরে নিয়া একটা নাটক লিখব আর ঘটোৎকচরে নিয়া একটা উপন্যাস
মানে সেইসব রচনায় মহাভারতের বড়ো বড়ো সব কিছুই আইসা যাইব
০২

তো এখন কথা হইল কোনপক্ষে ঢুকামু? পাণ্ডবপক্ষে ঢোকাইলে হইবেন পাতি বীর
আর কুরুপক্ষে ঢুকাইলে হইবেন হিরো;

০৩
টেকা পয়সার আলাপ চলতে থাকুক। আর পাশাপাশি আপনে আপনার নিজের নাম আর বাপের নামটা ঠিক কইরা ফালান (মানে মহাভারতীয় নাম; এইসব বাঙাল মাঝিটাঝি ওইখানে চলব না; প্রতিটা নামে অবশ্যই কমপক্ষে একটা যুক্তাক্ষর থাকতে হইব)। মহাভারতে আপনে কার লগে মারামারি করতে চান; কত নম্বর দিতে মরতে চান; কৃষ্ণের লগে আপনার বংশের/আপনের শত্রুতার কারণ কী (মানে সে আপনের বান্ধবী তুইলা নিছে নাকি বাপরে মাইরা ফালাইছে ইত্যাদি) বিস্তারিত লেইখা আমারে জানান

০৪
চাহিদা অনুযায়ী চরিত্র বণ্টন হইবে; চরিত্র অনুযায়ী মূল্য নির্ধরিত হইবে

মন মাঝি এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি চলুক

****************************************

ময়ুখ কিরীটি এর ছবি

ভূগোলের গোলকত্বের ব্যাখ্যায় চক্ষুই গোল হয়ে গেছে......ভূগোল নিয়ে আসলেই ভজঘট আছে মহাভারতে......অভাজনদার বিশ্লেষণ চরম হয়েছে......হাতি-ঘোড়া পারাপার না হয় অজানাই থাকল- তাতে কুরুক্ষেত্রের মাহাত্ম্য বাড়ে বই কমে না খাইছে
কোথায় যেন পড়েছিলাম একসাথে তিন তীর ছুঁড়তে পারা "বর্বরীক" যুদ্ধ করলে নাকি কেউ আর জিততেই পারত না.....মাকে দেয়া প্রতিজ্ঞানুসারে তার সর্বদা দুর্বল পক্ষের সাথে যুদ্ধ করার পণ ছিল....সে যে পক্ষে যাবে বাকি পক্ষ আপনাতেই দুর্বল হয়ে পড়ত এবং এরকম চক্রাকারে চলতে থাকলে সে ছাড়া কেউ নাকি বাঁচত না শেষমেষ.......তাই কৃষ্ণের কথায় সে বলিদান দেয় এবং কাটা মাথায় সমস্ত যুদ্ধ অবলোকন করে......কৃষ্ণের এই কান্ড দেখে নাকি পান্ডবরা আফসোস করেছিল? অ্যাঁ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। এই বর্বরীকের ঘটনা বইয়ে রাখছি তো;

অজ্ঞাতনামা আগুন্তক  এর ছবি

পড়ছি অনেকদিন ধরে, ভাল লাগছে। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাস্য ছিল।শুধুই কৌতূহল। মহাভারতে ইন্দনেশিয়া, ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত কিভাবে, কোন সূত্রে ? অনেক ধন্যবাদ ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সূত্র মানে কী সেইটা তো মাথার উপর দিয়া গেলো;
তয় ইন্দোনেশিয়ান/জাভান সংস্কৃতির উপর মহাভারত এর প্রভাব বিশাল। জাভান মহাভারতের কাহিনিগুলা একটু অন্যরকম (ঘটোৎকচ সেখানে অন্যতম প্রধান নায়ক)

০২
ভৌগলিকভাবে এইসব জায়গার অভিবাসন/ যাতায়াত তো অসম্ভব হইবার কথা না (আগের যুগেও হইতে পারে/পরেও হইতে পারে)
যদ্দুর মনে হয় মহাভারতে থাইল্যান্ড/শ্যাম দেশের উল্লেখ আছে। ইন্দোনেশিয়া/জাভা বা ভিয়েতনামের সরাসরি উল্লেখ নাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।