সহজিয়া রামায়ণ ২

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শনি, ১৯/০৩/২০১৬ - ৩:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রামবিহীন অযোধ্যায় থাকনে বুকের পাটা নাই লক্ষ্মণের; পিটাইয়া তক্তা বানাইয়া ফালাইব ভরত। তাই সেও বিশ্বামিত্রের লগে রামের পিছু লয়। আর অবধারিতভাবেই রাজপুত্রগো পিছে যায় তাগো দেহরক্ষক আর রাজকীয় সেনার সশস্ত্র একটা দল...

রাজপুত্রগো নিয়া ক্রমশ উত্তরে ভাটির দিকে হাঁটতে থাকেন বিশ্বামিত্র। হাঁটতে হাঁটতে পয়লা রাত্তিরে তারা থামলেন সরযু নদীর তীরে। খড় ঘাসের বিছানায় ঘুমাইয়া বেশ মজাই পায় রাজার পোলারা। দ্বিতীয় রাত্তির তারা থাকে সরযু-জাহ্নবী নদীর সংযোগে অঙ্গদেশের এক ঋষিগো আশ্রমে। তার পরের দিন ক্রমাগত আগাইতে আগাইতে একটা জায়গায় আইসা উঠলেন নৌকায়...

জীবনে পয়লাবারের মতো নৌকায় উঠল রাম। এত বড়ো নদীও তার অভিজ্ঞতায় নতুন। সে অবাক হইয়া বিশ্বামিত্ররে জিগায়- যে পানি আমরা পার হইয়া যাইতাছি এই ভয়ঙ্কর শব্দটা কি সেই জলেরই গুরুদেব?

নৌকার আইলসা সময়ে উজান দেশের রাজপুত্ররে নদীর পাঠ দেন বিশ্বামিত্র- জলেরই শব্দ; তয় স্রোতের না; জলে-জলে সংর্ঘষের। ...মানস সরোবরের নাম তো শুনছ তাই না? সেই মানস সরোবর থাইকা তোমাগো অযোধ্যার দিকে যে নদীখান নাইমা আসছে সেইটা হইল সরযূ বা ঘর্ঘরা নদী। সেই নদী এইখানে আইসা জাহ্নবী নদীর লগে মিশছে। তো দুই দিকের দুই নদীর স্রোত এক লগে মিলার সংঘর্ষেই এই বিশাল শব্দটা হইতাছে। বুঝছ?

নদীর দক্ষিণ তীরে নাইমা তারা উপস্থিত হইলেন এক বনের নিকট। এই জায়গাখান তাড়কা নামে এক আদিবাসী বিধবার জায়গা। তার স্বামী সুন্দ এর আগে অগস্ত গোত্রের ব্রাহ্মণগো হাতে মরছে। এখন সে এইখানে একলা থাকে। বিশ্বামিত্র আগে এই জায়গা দখল করতে আসলে তাড়কা তার সঙ্গীসাথী নিয়া ঢিল মাইরা খেদাইয়া দিছিল বিশ্বামিত্র আর তার শিষ্যগো। বিশ্বামিত্র আবার ফিরা আসছেন দেইখা তাড়কা আবার শুরু করে এদিক সেইদিন হাউ কাউ কইরা মানুষ ডাকা আর দুই হাতে ঢিল মারা। কিন্তু এইবার তো বিশ্বামিত্র নিয়া আসছেন তীরন্দাজ সেনাবাহিনি...

তাড়কার ঢিল খাইয়া রাম বিশ্বামিত্রের দিকে হা কইরা তাকাইয়া থাকে। সে যুদ্ধ করার যেইসব নিয়ম শিখছে তাতে নারী জাতির উপর অস্ত্র তোলা বারণ। রামের প্রশ্নবোধক মুখ দেইখা বিশ্বামিত্র কন- দুশ্চিন্তা কইর না। তুমি আসছ ব্রাহ্মণের সেবা করতে। ব্রাহ্মণের উপকারের নিমিত্তে নারীজাতির উপর অস্ত্র চালাইলে সেইটা পাপ হয় না। তুমি তীর চালাও...

রাম তবুও দ্বিধা করে। বিশ্বামিত্র তারে মনে করাইয়া দেন যে রাজা দশরথ সকলের সামনে তারে কইয়া দিছেন যাতে সে বিশ্বামিত্রের সকল কথা শোনে...

রাম কয়- হ। বাবায় অবশ্য সেইটা কইয়া দিছেন। তো ঠিকাছে; আপনে যখন কইছেন তখন আর তীর চালাইতে কোনো অসুবিধা নাই...

তাড়কা মারে ঢিল আর রাম-লক্ষ্মণ মারে তীর। তাড়কা মরে। বিশ্বামিত্র কন- এইডা আছিল একটা রাক্ষুসি। এরে মাইরা বহুত পুণ্য সঞ্চয় করছ তুমি...

বিশ্বামিত্র সেইখানেই থাইকা জায়গার দখল পোক্ত করেন। আশপাশের আদিবাসীরা তাড়কার মরণ আর বিশ্বামিত্রের লগে সেনা সৈনিক দেইখা আইসা বিশ্বামিত্রের পায়ে সারেন্ডার করে- এখন থাইকা আপনে যা কন; সেইমতোই চলব আমরা। আমাগো মাইরেন না ঋষি...

পরদিন বনের আরো গভীরে ঢোকেন বিশ্বামিত্র। এই জায়গাটাতে তিনি একখান স্থায়ী তপোবন তৈয়ারি করতে চাইয়া পারেন নাই। এই জায়গাটার মালিক তাড়কাপুত্র মারীচ আর সুবাহু নামের আরেক বনবাসী মানুষ। জায়গাটাতে আগে থাইকাই বিশ্বামিত্রের শিষ্যরা ঘাপটি দিয়া আছিল। বিশ্বামিত্র এইখানে আইসাই কথা নাই বার্তা নাই বন্ধ কইরা দিলেন কথা বলা। রাম তিনারে প্রশ্ন করে কিন্তু তিনি উত্তর দেন না। তার শিষ্যরা কয়- গুরুদেব যজ্ঞের দীক্ষা নিয়া ফালাইছেন। এখন থাইকা ছয়দিন তিনি মৌনব্রত পালন করবেন। এখন তোমাগো দায়িত্ব হইল এই কয়দিন আশ্রম পাহারা দেওয়া....

জঙ্গলের গভীরে বইলা পয়লা পাঁচদিন বিশ্বামিত্রের উপস্থিতি টের পায় নাই বনবাসীরা। কিন্তু ছয় নম্বর দিন যজ্ঞের বেদিতে আগুন জ¦ইলা উঠতেই তারা টের পায় বিশ্বামিত্র ফিরা আসছে আবার। তারাও লাঠিসোঁটা নিয়া হই হই কইরা তাইড়া আসে বিশ্বামিত্ররে খেদাইতে। কিন্তু এইবার তো ব্রাহ্মণ বিশ্বামিত্রের পাহারায় বাহিনি নিয়া আছে ক্ষত্রিয় রাজপুত্র রাম। রাম বাহিনির তীর খাইয়া মরে মারীচ; মরে সুবাহু আর মরে তাগো দলের আরো বহুত মানুষ...

যজ্ঞ শেষ কইরা জায়গাটার দখল পোক্ত কইরা ফালান বিশ্বামিত্র। সেইখানে নিজের আশ্রমের পত্তন কইরা নাম দেন- সিদ্ধাশ্রম। এইবার সত্যি সত্যি সিদ্ধি পাইতে শুরু করছেন বিশ্বামিত্র...

বিশ্বামিত্র দশরথের কাছ থিকা রামরে নিয়া আসছিলেন মারীচ আর সুবাহুরে মারার লাইগা। সেই কামতো শেষ। তাই পরের দিন সকালে রাম জিগায়- এখন কী করব আমরা?

বিশ্বামিত্র রামরে ছাড়ত চান না। তিনি কন- মিথিলার রাজা জনক একটা যজ্ঞ করবেন। আমরা সকলেই সেইখানে যাব। আমাগো লগে তোমরাও চলো। সেইখানে গেলে একটা অদ্ভুত ধনুক দেখতে পাবা। ওইটা শৈবধনু। ধনুকটা রাজা জনকের পূর্ব পুরুষের হাত বদল হইয়া এখন রাজা জনকের হাতে আছে...

রাজা জনকের যজ্ঞে বিশ্বামিত্র নিমন্ত্রিতও না; নিয়োজিত পুরোহিতও না। যজ্ঞের সংবাদ পাইয়া সাধারণ বামুনরা যেমন যজ্ঞে গিয়া উপস্থিত হয় তিনিও সেইরকম যাবেন দান দক্ষিণার আশায়। কিন্তু রাম লক্ষ্মণের দিকে তাকাইয়া মুহূর্তে তার মাথায় অন্য চিন্তা খেইলা যায়। এই রকম একটা রাজকীয় বাহিনি লগে নিয়া যদি জনকের দেশে উপস্থিত হইতে পারেন তবে নিশ্চয়ই তিনি সকলের বিশেষ নজর পাইবেন...

বিশ্বামিত্রের প্রস্তাবে রাজবাড়ি ছাইড়া পয়লাবারের মতো স্বাধীন ঘুরুন্তির সুযোগ পাওয়া রাজপুত্রের মনে হয়- যাই না। দেইখা আসি নতুন দেশ...

আরো উত্তরে ক্রমাগত ভাটির দিকে চলতে থাকেন বিশ্বামিত্র। পয়লা সন্ধ্যায় থামেন শোণ নদের তীরে। রাম জিগায়- এইটা কোন দেশ গুরুদেব? বিশ্বামিত্র কন এই দেশটার নাম গিরিব্রজ। এইটা আমার বাপের দিকের আত্মীয় বসু বংশের দখলে আছে। আমার বংশটা পরিচিত কুশ নামে এক পূর্বপুরুষ রাজার নামে। যার লাইগা লোকজন আমারে কৌশিক কইয়া ডাকে। রাজা কুশের চাইর পুত্রের মাঝে একজন আছিলেন বসু। এই দেশটা সেই বসুর বংশই শাসন করেন। আর আমার বংশটা আসছে কুশ রাজার আরেক পোলা কুশনাভ থাইকা। কুশনাভ আমার ঠাকুরর্দা। আমার বাপের নাম গাধী। আমরা দুই ভাই-বইন। আমার বড়ো বইন সত্যবতী। তিনার বিবাহ হইছে ঋচীক গোত্রের এক ব্রাহ্মণের লগে। আমার বইন এখন বিধবা। আমি এখন আমার সেই বইনের বাড়িতেই থাকি...

পরের দিন তারা আইসা পৌঁছাইন জাহ্নবী তীরে। নদী নিয়া রামের বিস্ময় কাটে না। রাম জিগায়- গুরুদেব গঙ্গা নাকি খুব বড়ো নদী। তো গঙ্গা সম্পর্কে আমারে কিছু কন....

বিশ্বামিত্র কন- দুইটা ভিন্ন নদীর স্রোত এক লগে মিল্লা জন্ম হইছে গঙ্গার। অথবা কইতে পারো দুই দুইটা নদী আইসা শেষ হইছে গঙ্গার গহ্বরে। তার মধ্যে একটা নদী কিন্তু তোমার এক পূর্ব পুরুষের নামে। সেইটা কি জানো? ভগিরথী। গঙ্গা নদীটা গঙ্গা নামে পরিচিত হইছে যেইখানে আইসা ভগিরথী নদীটা অলকানন্দা নদীর সাথে মিশছে সেইখান থাইকা। বহুত পুরানা কথা সেইসব; কেউ কেউ কয় ভগিরথীর তীর জুইড়া ভগিরথের রাজত্ব আছিল দেইখা সেইটার নাম হইছে ভগিরথী। আবার কেউ কেউ কয় দেশে খরার প্রকোপ আছিল দেইখা রাজা ভগিরথ হিমালয়ের গোমুখ থাইকা ছড়াইন্না ছিটাইন্না স্রোতরে দীর্ঘ খাল কাইট্টা নিজের দেশের উপর দিয়া এক স্রোতে প্রবাহিত করাইয়া আইনা অলকানন্দায় ফালান। সেইটাই কালে কালে নদীতে পরিণত হয়। আমরা যে জাহ্নবী ফালাইয়া আসছি সেইটাও কিন্তু মূলত ভগিরথীর অংশ। ভগিরথীর ভাঙনে জহ্নু নামের এক মুনির আশ্রম তলাইয়া গেছিল দেইখা মুনিরে সম্মান দিয়া ওই অংশটারে মাইনসে জাহ্নবী কইয়া ডাকে। তো যাই হউক। রাস্তায় রাস্তায় আরো বহুত নাম নিয়া এই গঙ্গা নদীই কিন্তু শেষমেশ গিয়া সমুদ্রে পড়ে...

পরদিন বিশ্বামিত্র দলবল নিয়া গঙ্গা পার হইয়া উত্তর তীরে নামেন। রাম জিগায়- এইটা কোন দেশ?

বিশ্বামিত্র কন- এই দেশের নাম বিশালা। এই দেশের রাজার নাম সুমতি। তার সাথে আমার কিছু পূর্ব যোগাযোগ আছে। আইজ আমরা এইখানেই থাকব। বিশালার সীমা অতিক্রম করলেই আমরা পৌঁছাইয়া যাব রাজা জনকের মিথিলা দেশ...

বিশ্বামিত্র আর দলবলরে বিশালার রাজা সুমতি বেশ খাতির যত্নই করেন। বিশ্বামিত্রের লগে রাজা দশরথের পোলাগো দেইখা বেশ অবাকও হইছেন তিনি। বিশালায় একদিন থাইকা পরের দিন বিশ্বামিত্র পা দেন মিথিলার সীমানায়। তবে সরাসরি লোকালয়ে যান না তিনি। নগরের বাইরে ঋষি গৌতমের আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হন। ঋষি গৌতমের লগে তার জানাশোনা আছে। রাজপুত্রগো নিয়া নগরে ঢোকার আগে নগরের হাল হকিকত একটু বুইঝা নেওয়া দরকার...

কিন্তু গৌতমের আশ্রমে পা দিয়া বিশ্বামিত্র একটু অবাক হন। ঘরে ঋষির বৌ অহল্যা ছাড়া আর কেউ নাই। আশ্রমের অবস্থা যাচ্ছেতাই। ঋষি নাই; শিষ্যও নাই। আশ্রমের যত্নও নাই...

ঋষি গৌতম নিজের বৌরে তার সাবেক প্রেমিকের লগে ঘরের ভিতর হাতে নাতে ধইরা ফালাইছিলেন। বৌয়ের প্রেমিকের অণ্ডকোষ থেঁৎলাইয়া দিবার পরও তার রাগ কমে নাই। পরে তিনি ঘরবাড়ি আর বৌরে ছাইড়া বনে চইলা গেছেন। এখন বাড়িতে তার বৌ অহল্যা কোনোমতে অনাহারে অর্ধাহারে একলাই বসবাস করে...

বিশ্বামিত্ররে পাইয়া অহল্যা নিরালায় তারে তার দুঃখের কথা কয়। মুহূর্তে বিশ্বামিত্রের মাথায় খেইলা যায় নতুন এক চিন্তার ছক। গৌতম আর অহল্যার বড়োপোলা শতানন্দ মিথিলায় পুরোহিতের চাকরি করে। বাপ-মায়ের মইদ্যে মিটমাট কইরা গিয়া সেই সংবাদ তারে দিতে পারলে নিশ্চয়ই সে খুশি হইয়া মিথিলায় বিশ্বামিত্ররে বহুত সহায়তা করবে। বিশেষত রাজা জনকের নিকট বিশ্বামিত্রের প্রশংসা কইরা যদি ঠিকমতো পরিচয়টাও করাইয়া দেয় তাতেও বহুত কিছু হয়...

গৌতমের লগে কথা কইতে বিশ্বামিত্র নিজে যান না। রামেরে পাঠান- ঋষি গৌতম পত্নীর উপর রাগ কইরা বনবাসী হইছেন। তিনারে গিয়া অনুনয় কইরা ঘরে ফিরাইয়া আনো রাম। এইটা খুব পুণ্যের কাম...

রাম গিয়া গৌতমরে অনুনয় করে- আমরা আপনের ঘরে অতিথি হইছি ঋষি। আপনে ঘরে চলেন...

গৌতম অবাক হইলেও দুইটা কারণে রামের লগে তর্ক করেন না। এক হইল এই পোলাটা তার নিজের পোলার থাইকাও বয়সে ছোট। এমন বাচ্চা মানুষের লগে নিজের বৌয়ের পরকীয়া নিয়া কথা বলতে তার বাঁধে। দ্বিতীয়ত এই পোলাটা বাপের অবর্তমানে হইব অযোধ্যার রাজা। এইরকম একটা ভবিষ্যৎ রাজার লগে রাগটাগ না দেখাইয়া লাইন ঘাট তৈরি রাখতে পারলে ভবিষ্যতে নিজের পোলাপানের চাকরি বাকরির একটা ব্যবস্থা হয়...

গৌতম ফিরা আসেন ঘরে। রামের বাহিনি আর বিশ্বামিত্রের শিষ্যরা মিলা আশ্রমটারে আবার প্রাণবন্ত কইরা তোলে হাতে হাতে। গৌতমপুত্র শতানন্দের বিষয়ে বাপ মায়ের কাছ থিকা আরো সংবাদ টংবাদ নিয়া পরের সকালে বিশ্বামিত্র রওয়ান দেন মিথিলা নগরে...

এক চক্কর রাজা জনকের যজ্ঞক্ষেত্র পরিদর্শন কইরা গিয়া একটা নির্জন জায়গায় ডেরা পাতেন বিশ্বামিত্র। এইরকম রাজকীয় বাহিনি নিয়া কোনো ঋষির আগমণ আশা করে নাই কেউ। সকলেরই চোখ পড়ে বিশ্বামিত্রের উপর। বিশ্বামিত্র এর মাঝেই সংবাদ পৌঁছাইয়া দিছেন শতানন্দের কানে। গৌতমের পুত্র শতানন্দ সত্যি সত্যি খুশি হইছে বাপ মায়ের মিটমাটের সংবাদে। সেই খুশিতে বিশ্বামিত্রের আগমণরে বেশ বড়ো কইরাই সে পৌঁছাইয়া দেয় রাজা জনকের কানে। শতানন্দের বর্ণনা শুইনা বিকাল বেলা বিশ্বামিত্রের লগে দেখা করতে হাজির হন স্বয়ং রাজা জনক। কিন্তু ঋষির লগে রাজকীয় বাহিনি আর রাজপুত্রগো দেইখা তিনি অবাক- এরা কারা ঋষি?

বিশ্বামিত্র রাম লক্ষ্মণরে পরিচয় করাইয়া দিলেও রাজা জনকের বিস্ময় কাটে না। সাধারণত যজ্ঞে নিমন্ত্রণ ছাড়া রাজা কিংবা রাজপুত্রেরা আসে না। আর ঋষিগো লগে রাজপুত্রগো দেশ ভ্রমণ এইটাও সম্পূর্ণ এক নতুন বিষয়...

রাজা জনকের বিস্ময়ের সামনে গৌতমপুত্র শতানন্দ বক বক কইরা কইয়া যাইতে থাকে বিশ্বামিত্র মাহাত্ম; তিনার ইতিহাস- জীবনী...। শতানন্দ কয়- ইনি কিন্তু জন্মাইছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা হইয়া। তারপর নিজের সাধনায় এখন এক উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণ। তারপর রাম লক্ষ্মণের দিকে ফিরা কয়- তোমাগো ভাগ্য ভালো যে এমন রাজর্ষির লগে দেশ ভ্রমণের সুযোগ হইছে। ইনি যেমন রাজনীতি আর ভূগোল জানেন; তেমনি জানেন শাস্ত্র। এক মানুষের মাঝে এই দুই গুণ কিন্তু আর কোথাও পাইবা না...

বিশ্বামিত্র সম্পর্কে কথার খই ছোটায় গৌতমপুত্র শতানন্দ- ইনি আগে ক্ষত্রিয় থাকলেও কিন্তু ব্রাহ্মণগো লগে তাগো পরিবারের সম্বন্ধ আছিল বহু আগেই থাইকাই। ঋচীক গোত্রের এক ব্রাহ্মণের লগে তার বড়ো বইন সত্যবতীর বিবাহ হইছে। তো সেইখানেও এক কাহিনি আছে। একবার হইল কি; অম্বরিষ নামের এক রাজা যজ্ঞের ঘোড়া ছাইড়া দিবার পর যজ্ঞের সময় দেখা গেলো তার ঘোড়া আর পাওয়া যাইতাছে না। তখন তার পুরোহিত কইল- যজ্ঞের ঘোড়া খুঁইজা না পাওয়ার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত হইল ঘোড়ার বদলা যজ্ঞে নরবলি দেওয়া। তো রাজা নরবলির লাইগা মানুষ খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে গিয়া হাজির হইলেন বিশ্বামিত্রের বইনের বাড়ি। তিন পোলা নিয়া তাগো সংসারে আছিল বহুত টানাটানি। অম্বরিষ বলির লাইগা মানুষ কিনতে চান শুইনা বইনের স্বামী ঋচীক কইলেন বড়ো পোলাটারে আমি বেচুম না। বিশ্বামিত্রের বইন কইলেন ছোট পোলাটা আমার আদরের। আমি বেচুম না। পরে দুইজনে শল্লা কইরা বেশ কিছু গরুর বিনিময়ে মাইজা পোলাটারে বিক্রি কইরা দিলেন অম্বরিষের কাছে। ওই পোলাটার নাম আছিল শুনঃশেপ...

রাজা অম্বরিষ যখন বলি দিবার লাইগা শুনঃশেপরে বাইন্ধা নিয়া যাইতেছিল তখন সে রাস্তায় দেইখা ফালায় বিশ্বামিত্ররে। কয়- মামাগো বাপ মা দুইজনে গরু নিয়া আমারে বিক্রি কইরা দিছে নরবলির পশু বানাইয়া। আমারে বাঁচাও মামা। তুমি ছাড়া মোর কেউ নাই....

ভাগিনার আকুতি শুইনা বিশ্বামিত্র পয়লা চিন্তা করলেন রাজা অম্বরিষরে আক্রমণ কইরা ভাগিনারে ছাড়ান। পরে সেইটা ভালো বুদ্ধি হইব না দেইখা তিনি তারে অন্য বুদ্ধি দিয়া কৌশলে বাঁচাইয়া দিলেন। এক অর্থে কিন্তু কওয়া যায় যে যজ্ঞে নরবলি দিবার নিয়ম রহিতও করছেন এই বিশ্বামিত্র...

শতানন্দের মুখে বিশ্বামিত্রের অনর্গল কাহিনি শুইনা রাজা জনকের মাথা আউলা হইয়া উঠে। নিশ্চয়ই ইনি একটু বিশেষ কিসিমের ঋষি। না হইলে বডিগার্ড হিসাবে কি আর রাজপুত্র নিয়া চলাফিরা করেন?

রাজা জনক আরেকবার বিশ্বামিত্ররে পেন্নাম কইরা কন- আমি ধইন্য হইছি আপনার আগমণে জনাব। এখন সইন্ধ্যা হইয়া যাইতাছে; আপনেরা আরাম করেন। কাইল সকালে আমি আবার আইসা আপনের চরণধুলা নিমু...

পরদিন সকালে জনক বিশ্বামিত্রের ডেরায় গিয়া ভদ্রতা করেন- জনাব কিছু লাগলে বলেন...

বিশ্বামিত্র কন আপনের কাছে নাকি এক আশ্চর্য ধনুক আছে। সেই ধনুকটা এই দুই রাজপুত্ররে যদি দেখান...

জনক কন- ধনুকটা শৈবধনু। আমার পূর্বপুরুষের হাত বদল হইয়া উত্তারাধিকারসূত্রে আমার কাছে আছে। তয় একটা সমস্যা আছে ঋষি। আমি ঠিক কইরা রাখছি আমার বড়ো মাইয়া সীতার বিবাহ দিমু কোনো বীরের লগে। আর সেই বীরত্বের পরীক্ষা হইব এই ধনুক দিয়া। যে এই ধনুকে ছিলা পরাইতে পারব তার লগেই বিবাহ হইব মাইয়ার...

বিশ্বামিত্র কন- অসুবিধা কী? আমার লগে যে দুই রাজপুত্র আছে তারাও তো ফেলনা না। তাগো মইদ্যে একজন রাজা দশরথের বড়ো পোলা- রাম। আপনি যদি চান তবে তারা ধনুকটায় ছিলা পরানোর চেষ্টাও করব। আর যদি মহাদেবের আশীর্বাদ থাকে তো হইলে হইতেও পারে যে আপনি এগো মদ্যেই আপনার মাইয়ার জামাইও পাইয়া যাইতে পারেন....

রাজা জনক ধনুকখান আনান। বিশ্বামিত্র রামেরে কন- একবার চেষ্টা কইরা দেখবা নাকি?

পুরাইন্না ধনুক। ঘুণে খাওয়া। কোনকালে রাজা জনকের পূর্ব পুরুষ দেবরাতরতে এই ধনুক উপহার দিছিলেন এক ব্রাহ্মণ। তো ব্রাহ্মণগো স্বভাবই এই; তারা কাউরে নগণ্য কিছু দান করলেও তার লগে শিব-নারায়ণের কাহিনি যুক্ত কইরা সেইটারে মহান কইরা তোলেন। দেবরাতরে এই ধনুক দিবার সময় সেই ব্রাহ্মণ কইয়া দিছিলেন স্বয়ং মহাদেব নাকি এইটা ব্যবহার করছিলেন তার পয়লা শ্বশুর দক্ষের লগে যুদ্ধ করতে গিয়া। তো সেই ধনুকখান বংশের আশীর্বাদ হিসাবে এইভাবেই থাইকা গেছে জনক পরিবারে। কেউ ব্যবহার করে নাই। কিন্তু মানুষে ব্যবহার না করলেও ঘুণ পোকারা ঠিকই তা ব্যবহার করছে। তো রাম গিয়া সেই ধনুকে ছিলা পরাইয়া পরীক্ষা করার লাইগা যেই দিছে টান অমনি ঘুণে ধরা ধনুকটা মটাৎ কইরা গেলো ভাইঙা...

আশপাশের লোকজন যায় ঘাবড়াইয়া-শিবের আশীর্বাদী ধনুক ভাইঙা গেছে; কী হইব এখন?

বিশ্বামিত্র কন- মহাদেবের ধনুক তো আর মহাদেবের ইচ্ছা ছাড়া ভাঙে নাই। যেহেতু রাজা জনক সিদ্ধান্ত নিছেন যে এই ধনুক দিয়াই নির্বাচিত হইব তিনার বড়ো কইন্যা সীতার বর; সেহেতু রামের হাতে ধনুকটা ভাইঙা স্বয়ং মহাদেব সিদ্ধান্ত জানাইয়া দিছেন যে রামের পরীক্ষা পাশের মাধ্যমে জনক কইন্যার পাত্র সন্ধান পরীক্ষাটা সমাপ্ত হইয়া গেছে আইজ। আর কারো এই পরীক্ষায় অংশ নিবার দরকার নাই তাই মহাদেবের ধনুক মহাদেবের ইচ্ছাতেই ভাইঙা গেছে...

জনক থতমত খাইয়া গেছিলেন ঘটনায়। যে ধনুকের উপর অত ভরসা কইরা ঘোষণাটা দিয়া রাখছিলেন সেইটা যে ভিতরে ভিতরে ঘুণে খাইয়া পইচা আছে সেইাতো ভাবেন নাই। কপাল ভালো যে তিনি মাইয়ার বিবাহের লাইগা আলাদা কোনো অনুষ্ঠান করেন নাই। না হইলে সেই অনুষ্ঠানে যদি ধনুকটা যেনতেন কারো হাতে ভাইঙা যাইত তয় শরমের সীমা থাকত না। একদিকে ভালোই হইছে; সকলেই যখন যজ্ঞ নিয়া ব্যস্ত তখন মাঠের এক কোণায় নিরিবিলি এক রাজপুত্রের হাতে ধনুকটা ভাইঙা শরমের হাত থাইকা রাজারে বাঁচাইয়া দিছে। কিন্তু এখন আর ফিরার উপায় নাই। অবশ্য দরকারও নাই। কারণ রাম রাজা দশরথের বড়ো পোলা; বাপের পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার। নিরিবলি মাঠের কোণায় মাইয়ার লাইগা পাত্র ভালোই পাইছেন তিনি। বহুত ভালো...

জনক সংবাদ পাঠান অযোধ্যায় রাজা দশরথের কাছে- মহাদেবের ইচ্ছায় মহাদেবের ধনুক ভাইঙা আপনার বড়োপুত্র রাম আমার বড়ো কইন্যা সীতার পাত্র হিসাবে নির্বাচিত হইছেন। সেই অলৌকিক কাণ্ডের সাক্ষী আরো বহুত মানুষের লগে আছিলেন স্বয়ং ঋষি বিশ্বামিত্র...

পোলাপাইনের বিয়া-শাদির আলাপ তো আগেই শুরু হইছিল অযোধ্যায়। এর মাঝে এই প্রস্তাবটা বেশ ভালো। এইটার লগে একটা ভালো কাহিনি আছে। বীরত্ব কাহিনি যেমন আছে তেমনি স্বয়ং মহাদেরবর নাম যুক্ত আছে এই কাহিনিতে। তো ভবিষ্যৎ রাজার লাইগা এইটা একটা দারুণ কাহিনি। বিশ্বামিত্রের লগে পোলারে যাইতে দেওয়া ভালোই হইছে বলা যায়...

রাজা দশরথ রাজি। রাজায় যেহেতু রাজি সেহেতু চাকরিজীবী পুরোহিতগোও কোনো আপত্তি নাই। রাজা খালি প্রস্তাব স্বীকারই করেন নাই; পাত্র মিত্র আমাত্য পুরোহিত আর বাকি পোলাপান নিয়া স্বয়ং চাইর দিনের রাস্তা ভাইঙা আইসা উপস্থিত হইয়া যান ভাটির দেশ মিথিলায়...

রাজা জনক অতটা আশা করেন নাই। দশরথ যে সংবাদ শুইনা একেবারে বরযাত্রী হইয়া আইসা পড়বেন সেইটাতো আর ভাবেন নাই। যাই হউক; অসুবিধা নাই। যজ্ঞের লাইগা তো এমনিতেই অতিথি সামলাইবার আয়োজন আছে। এখন এক আয়োজনে মাইয়ার বিবাহও সাইরা ফালান যাবে...

তিনি দশরথরে কন- আমি দুই দিক দিয়া সৌভাগ্যবান। আপনাগো আগমনে আমার কইন্যার বিবাহ যেমন গৌরাবন্বিত হইব তেমনি আপনাগো পাইয়া আমার যজ্ঞখানও হইব স্মরণীয়। তো মহারাজ; কাইল সকালে যজ্ঞ শেষ হইবার পর আপনে ঋষি আর ব্রাহ্মণগো লগে বইসা যেই তারিখ ঠিক করবেন সেই তারিখেই বিবাহের আয়োজন করব আমি....

দশরথ কন- কইন্যা দান করবেন আপনে আর গ্রহণ করব আমি। তাই দাতা হিসাবে আপনারই অধিকার হইল কবে কেমনে দান করবেন সেইটা ঠিক করা। আমি এখন আসছি বরের পিতা হিসাবে আপনের অতিথি হইয়া। আপনি যেমনে রাখবেন; তেমনি থাকব। যখন যা করতে বলবেন তখন তা করব...

রাজা দশরথের যেহেতু দুই পোলা মিথিলায় উপস্থিত। আর রাজা জনকের যেহেতু মাইয়াও দুইটা; সীতা আর ঊর্মিলা। সেহেতু ঠিক হইল একই আয়োজনে দশরথের দুই পোলার লগে রাজা জনকের দুই মাইয়ার বিবাহ হইব। রামের লগে সীতার আর লক্ষ্মণের লগে ঊর্মিলার...

রাজা জনকের যজ্ঞ চাপা পইড়া গেলো। পর দিন সকালে জনক পুরোহিত শতানন্দরে পাঠাইলেন তার ছোট ভাই আর রাজ্যের সেনাপাতি কুশধ্বজরে নিয়া আসতে। কুশধ্বজ রাজ্যের নতুন দখল করা জায়গা সাংকাশ্যা নিয়ন্ত্রণের লাইগা সেইখানেই থাকেন। যজ্ঞে তিনি যোগ না দিলেও জনকের মনে হইল দুই দুইটা মাইয়ার বিবাহের অনুষ্ঠানে একমাত্র ছোটভাই থাকব না সেইটা কেমনে হয়। কুশধ্বজ আসার পর শুরু হইল বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা। এর পয়লা ধাপ হইল পাত্র পাত্রীর বংশ বর্ণনা কইরা বিবাহের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দান। সেইটা আবার পয়লা করতে হয় পাত্রপক্ষ থাইকা...

রাজা দশরথের পক্ষে তার কূল বর্ণনা কইরা জনকের কাছে রাম আর লক্ষ্মণের লাইগা সীতা আর ঊর্মিলা সম্বন্ধ প্রার্থনা করলেন পুরোহিত বশিষ্ঠ। পাত্রীপক্ষে রাজা জনক নিজেই নিজের বংশের বর্ণনা দিলেন- আমারে সকলে রাজা জনক কইয়া জানলেও জনক কিন্তু আমার বংশের নাম। আমার নাম সীরধ্বজ। আমরা দুই ভাই। আমার ছোটভাই আর রাজ্যের সেনাপতির নাম কুশধ্বজ...

জনক রাজা সীরধ্বজ নিজের মুখে নিজের কূল বর্ণনা কইরা রামের লাইগা সীতা আর লক্ষ্মণের লাইগা ঊর্মিলার সম্বন্ধে সম্মতি দিয়া কন- এইবার তবে পাত্রপিতা কন্যাপণের বিষয়টা সাব্যস্ত করেন। তারপর বিবাহের অনুষ্ঠানটা হইব আইজ থাইকা তিন নম্বর দিন...

বিশ্বামিত্র উইঠা খাড়ান- আমার একটা কথা আছে। মানে একটা প্রস্তাব। রাজা দশরথের দুই পুত্রের লগে যখন আপনের দুই মাইয়ার সম্বন্ধে আপনি মত দিছেন তখন আমি কই কি; জনক বংশের লগে রঘুবংশের সম্বন্ধটা আরো পোক্ত করতে তো কোনো অসুবিধা নাই। আপনের যেমন দুই কইন্যা আছে; তেমনি আপনার ছোটভাই কুশধ্বজেরও তো দুইটা বিবাহ উপযুক্ত কইন্যা আছে। আর রাজা দশরথের লগে তার আরো দুই পুত্রও এখন মিথিলায় মিথিলায় উপস্থিত

একটু থাইমা; কাউরে কিছু না জিগাইয়া বিশ্বামিত্র নিজেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব কইরা বসেন- আমি দশরথপুত্র ভরত আর শত্রুঘ্নের লাইগা আপনের ভাই কুশধ্বজের দুই কইন্যার সম্বন্ধ প্রার্থনা করতাছি রাজা জনক...। বিবাহ যখন হইব; রাজা দশরথের চাইর পুত্রের বিবাহই না হয় হইল একই সাথে একই দিনে; একই পরিবারে। বিশেষত যেহেতু এই চাইর পুত্র জন্মাইছেও মাত্র খণ্টাখানেকের ব্যবধানে একই দিনে...

জনক রাজি হইয়া গেলেন। দশরথ আপত্তি করলেন না। পরের দিন দশরথ চাইর পুত্রের লাইগাই সোনারুপা আর গরু দিয়া কইন্যাপণ শোধ দিলেন। আর ঠিক তখনই দৌড়াইতে দৌড়াইতে সেইখানে আইসা উপস্থিত হইল ভরতের মামা কেকয় রাজপুত্র যুধাজিৎ- ভরতরে তার নানা দেখতে চান; তারে নিয়া যাইবার লাইগা জরুরি ভিত্তিতে আমারে পাঠাইছেন তিনি...

দশরথ যে রামের বিবাহ ঠিক কইরা ফালাইছেন জনক রাজার মাইয়ার লগে সেই সংবাদটা পৌঁছাইয়া গেছিল ভরতের নানাবাড়ি কেকয় দেশে। রাজপুত্রগো বিবাহের লগে ভবিষ্যতের বহুত সম্পর্ক আছে। সেই কারণেই কেকয় রাজা নিজের পোলারে পাঠাইছিলেন নাতি ভরতরে তার কাছে নিয়া যাইতে। কিছু শলা পরামর্শ আছে তার...

যুধাজিৎ অযোধ্যায় গিয়া যখন শুলন যে ভরতও বাপের লগে মিথিলায় গেছে তখন সে দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইসা উপস্থিত মিথিলায়। কিন্তু একটু বেশি দেরি হইয়া গেছে। ভরত এখন আর শুধু ভাইয়ের বৈরাত নাই; সে নিজেই এখন মিথিলায় বিবাহের বর...

শালারে দেইখা রাজা দশরথ কন- আইসা যখন পড়ছ তখন থাকো। ভাগিনাগো বিবাহ খাও। কোনো পোলারই মামাবাড়ির কাউরে নিমন্ত্রণ দিতে পারি নাই। তুমি যখন একমাত্র মামা এইখানে আইসা পড়ছো; থাকো। বিবাহের পর না হয় নতুন বৌ নিয়াই ভরত নানাবাড়ি যাবে...

যুধাজিৎও বুইঝা ফালায় এখন আর কিছু করার নাই। খালি দেরিই হয় নাই; ভরতের ভবিষ্যতেও একটা কাঁটা ঢুইকা গেছে। যেইখানে রাম আর লক্ষ্মণের বিবাহ ঠিক হইছে রাজ কইন্যাগো লগে; সেইখানে ভরতের বিবাহ হইতাছে সেনাপতির মাইয়ার লগে। মানে রাজা জনকের অবর্তমানে মিথিলার রাজা হইবার পথটাও বন্ধ ভরতের। জনক মইরা গেলে অর্ধেক রাজ্য পাইব রাম আর অর্ধেক পাইব লক্ষ্মণ...

ভরত রামের থাইকা মাত্র ঘণ্টা খানেকের ছোট। এই এক ঘণ্টার লাইগা বাপের রাজ্যে অধিকার হারাইছে সে। কিন্তু অন্তত দশরথ যদি রাজা জনকের দুই মাইয়ার একটার লগেও ভরতের বিবাহ ঠিক করতেন তবুও একটা আশা থাকত। ভবিষ্যতে অন্তত মিথিলার অর্ধেক রাজ্যের রাজা হইবার পথ খোলা থাকতো ভরতের। কিন্তু এখন আর করার কিছু নাই। ভাগিনার লাইগা যা করার করা লাগবে পরে...

বিবাহের অনুষ্ঠানটা হইল যজ্ঞক্ষেত্রেই। পাত্রপক্ষে পৌরহিত্ব করলেন বশিষ্ঠ। পাত্রীপক্ষে যোগ দিলেন গৌতমী ব্রাহ্মণ শতানন্দ। আর তাগো মাঝখানে নিজে থাইকাই ধীরে সুস্থে গিয়া পুরোহিতের কাতারে বসলেন বিশ্বামিত্র। আইজ আর বশিষ্ঠ কিংবা গৌতমী ব্রাহ্মণের লগে একই অনুষ্ঠানে পৌরহিত্বে বিশ্বামিত্রের বিরোধিতা করল না কেউ...

বিবাহ শেষ হইল পাত্র আর পাত্রীগো আগুনের চারইরপাশে তিনটা কইরা চক্কর দিবার মাধ্যমে। রামের লগে সীতা। লক্ষ্মণের লগে ঊর্মিলা। ভরতের সাথে কুশধ্বজ কন্যা মাণ্ডবী আর শত্রুঘ্নর লগে শ্রুতকীর্তি...

ঋষি বিশ্বামিত্র; বশিষ্ঠ আর গৌতমী ব্রাহ্মণগো লগে এক কাতারে পৌরহিত্ব করছেন দুই রাজ পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে। সেই ঘটনা দেখছে রাজা জনকের যজ্ঞে আসা সকল অতিথি আর ব্রাহ্মণ সমাজ। দেখছে দুই রাজবাড়ির মানুষ। দান দক্ষিণা কিছুই নেন না তিনি। সব কিছু শিষ্যগো মাঝে বিলাইয়া দিয়া উজান দেশের লগে কৃষিজ ভাটির দেশরে এক সূত্রে গাঁইথা পরদিন ভোরে মিথিলা ছাড়নে বিশ্বামিত্র। এখন আর তার লগে কোনো রাজকীয় বাহিনি নাই। এখন তার লগে শুধুই তার অর্জিত ব্রাহ্মণত্বের অহংকার...

রাজা জনক কইন্যাগো লগে কাপড়চোপড়; গরু বাছুর হাতি ঘোড়া; দাস দাসী প্রচুর উপহার দিলেন। চাইর পুত্রবধূ নিয়া রাজা দশরথ রওয়ানা দিলেন অযোধ্যায়। এমন সময় সামনে আইসা পথ আগলায় এক কুড়ালি বামুন। কুড়ালি বামুনরা সকলেই তাগো ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা জমদগ্নির পোলা পরশুরামের নামে নিজেগো পরশুরাম বইলা পরিচয় দেয়। এরা যাগযজ্ঞ বা পুরুতগিরি করে না। এগো মইদ্যে যারা পদের বামুন তারা অস্ত্র শিক্ষার ইস্কুল চালায়; আর যারা তেমন পদের না তারা কান্ধে কুড়াল আর হাতে ধনুক নিয়া এদিক সেদিক ঘুইরা বেড়ায় আর রাস্তায় কোনো রাজা বা রাজপুত্র পাইলে তারে অস্ত্র কিংবা মল্লযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেয়। প্রতিযোগীরে হারাইতে পারলে বিনিময়ে এরা বহুত টেকা পয়সা উপহার পায়। আর নিজে হাইরা গেলেও এগো কোনো লস নাই। খালি প্রতিযোগীর কাছে নতি স্বীকার কইরা ব্রাহ্মণ হিসাবে আশীর্বাদ দিয়া অন্য দিকে পা বাড়াইলেই হয়....

তো এই কুড়ালি বরযাত্রী বাহিনির সামনে আইসা হম্বি তম্বি করে- মুই পরশুরাম। ভৃগুনন্দন ঋচীকের পোতা আর জমদগ্নির পোলা পরশুরাম মুই...

এই পর্যন্ত কইয়া পরশুরামের কীর্তি বর্ণাইতে থাকে কুড়ালি বামুন। তারপরে রামের দিকে আগাইয়া গিয়া কয়- তুই জানস বিশ্বকর্মা নিজের হাতে মাত্র দুইখান ধনুক বানাইছিলেন? তার একখান বিষ্ণুর লাইগা আর একখান মহাদেবের লাইগা। তো তুই নাকি মহাদেবের ধনুকখান ভাইঙা ফালাইছস। কিন্তু এতে খুশি হইবার কিছু নাই। বিশ্বকর্মার তৈয়ারি অন্য ধনুকখান কিন্তু এখনো মোর কাছে আছে। এই দেখ। এইটা বিষ্ণুর ধনুক। বিষ্ণু ভৃগুমুনীর মাইয়ার জামাই আছিলেন জানস তো? সেই সূত্রে ঋচীক আছিলেন নারায়ণের শালা। তো বিষ্ণু তার ধনুকখান শালা ঋচীকরে দান করেন। সেইটা ঋচীক থাইকা আসে জমদগ্নির হাতে। আর জমদগ্নি থাইকা আসে মুই পরশুরামের হাতে...

রাম কিছু কয় না। কুড়ালির হাতের ধনুকখান দেখে। ধনুক কতটা শক্ত হইব তা নির্ভর করে ধনুকধারী কতটা শক্তিশালি তার উপর। এইরকম উপাসি বামুনের ধনুক যে রামের লাইগা কিছুই না সেইটা সে বোঝে। সে জানে হম্বিতম্বি আর ভণিতা শেষ হইলে কুড়ালি তারে তার ধনুকে গুণ পরাইয়া কম্পিটিশন করতে কইব। ঠিক তাই হয়। নিজের ভড়ং শেষ কইরা কুড়ালি কয়- এইবার আমার এই ধনুক দিয়া তুই তোর বীরত্ব দেখা...

রাজা দশরথ একটু বিরক্ত হন; কিছুটা ঘাবড়ানও। যদি কোনো কারণে রাম ধনুকটা দিয়া কিছু করতে না পারে তবে নয়া বৌর সামনে মান ইজ্জতের বিষয়। তিনি গিয়া কুড়ালিরে কন- আপনে বহুত বড়ো যোদ্ধা কোনো সন্দেহ নাই। আমার পোলাটারে ক্ষমা করেন। তার বিনিময়ে টেকা পয়সা গরু বাছুর যা চান আমি আপনেরে তা দিমু...

নতুন বৌ আর তিন তিনটা ছোট ভাইর বৌর সামনে বাপের এমন কথায় রামের সম্মানে লাগে। সে আস্তে কইরা কুড়ালিরে কয়- আপনে বহুত বড়ো মান্যিগণ্যি মানুষ। কিন্তু আমারে বেশি অবহেলা কইরেন না। আমি যখন শৈবধনু ভাঙতে পারছি তখন নারায়ণ ধনুতেও ছিলা পরাইতে পারব...

রামের আত্মবিশ্বস দেইখা দশরথ মনে মনে খুশি হন। তিনি পরিষ্কার বোঝেন কুড়ালি যদি রামরে মল্লযুদ্ধ করতে কয় তবে এই বামুন রামের কাছে এক মিনিটও টিকতে পারব না। তবে কুড়ালি পয়লা তার ধনুকটাই আগাইয়া দেয়...

রাম একটানে ধনুকে ছিলা পরাইয়া তীর লাগায়। ধনুকে ছিলা পরাইতে পারলে নিয়ম হইল একটা তীর মারতে হইব। সত্যি সত্যি যুদ্ধে যে তীর শত্রুর বুকে মারা হয় সেইটা এইরকম খেলা খেলা যুদ্ধে একটা অপশন রাইখা প্রতিদ্বন্দীরে জিগাইতে হয়। বিশেষত প্রতিদ্বন্দী যখন বামুন। রাম তীরটা কুড়ালির দিকে ধরে- আপনে পূজনীয় ব্রাহ্মণ...

রামের জীবনের পয়লা নিজস্ব গৌরবগুলা বিশ্বমিত্রের হাত হইয়া আসা। অতদিন সে খালি আছিল রাজা দশরথের পোলা। বিশ্বামিত্রের লগে ঘর ছাড়ার পরেই তার নিজস্ব গৌরব সংগ্রহের শুরু। কুড়ালির দিকে তীর ধইরা রামের মনে হয় বিশ্বামিত্রের লাইগা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। সে একটু থাইমা কুড়ালিরে কয়- আপনে ব্রাহ্মণ; কিন্তু তার থিকাও বড়ো কথা হইল কথা আপনের কূলের ঠাকুর্দা বংশের লগে আমার গুরু বিশ্বামিত্রের আত্মীয়তা আছে। গুরুর বইনের বিবাহ হইছে ঋচীক গোত্রের ব্রাহ্মণের লগে। সেই কারণে আপনের হত্য করলে আমার গুরুর প্রতি অন্যায় হয়। তো এইবার এইবার আপনেই কন; তীরটা আপনার পায়ে মারব না মাথায়?

বামুন যদি পায়ের অপশন বাইছা নেয় তবে তীরটা কিন্তু সত্যি সত্যি পায়েই মারতে হইব। কারণ পায়ের সামনে মাটিতে মারলে আবার সেইটা গুরুপ্রণাম হইয়া যায়...

রামের কথায় কুড়ালি বামুন হাউমাউ কইরা উঠে- আমি ভিক্ষা কইরা খাই বাপ। তুমি আমার পায়ে তীর মারলে আমি হাঁইটা চইলা ভিক্ষা করতে পারব না। তুমি তীরটা আমার মাথায় মারো...

মাথায় মারাটা প্রতীকী। ক্ষত্রিয়র পক্ষে বামুনরে কওয়া যায় না যে আপনে হাইরা গেছেন; এখন আমার কাছে নতি স্বীকার করেন। আর বামুনও সরাসরি ক্ষত্রিয়ের কাছে মাথা নুয়াইতে পারে না। তাই এইটাই হইল সব থিকা ভালো উপায়। রাম কুড়ালির মাথার উচ্চতা বরাবর তীরটা ধরব আর সেইটা থাইকা বাঁচার লাইগা কুড়ালি বামুন হাঁটু গাইড়া বা মাথা ঝুকাইয়া তীর থাইকা মাথা বাচাইবেন। এতে রামের কাছে তার মাথা নোয়ানোও হবে আবার বামুনের মাথার মর্যাদাও থাকবে...

রাম তীরটা কুড়ালির মাথা বরাবর ধরে। বামুন মাথা ঝুঁকাইয়া উপর দিয়া তীর যাইবার নিরাপদ জায়গা তৈরি কইরা দেয়। রাম তীরটা ছাড়ে। তারপর চুপচাপ ধনুক ফালাইয়া কুড়াল গুটাইয়া রামেরে মুখস্থ আশীর্বাদ কইরা কুড়ালি পা বাড়ায় অন্য পথে...

অযোধ্যায় চাইর চাইরটা নতুন রাজপুত্রবধূ নিয়া অনুষ্ঠানাদি শেষ হইবার পর অবস্থা স্বাভাবিক হইলে ভরতের মামা ভরত আর তার বৌরে নিয়া রওয়ানা দেয় নানাবাড়ি; কেকয় দেশে। লগে শত্রুঘ্রও বৌ নিয়া যায় ভরতের লগে। আর তখনই রাজা দশরথের মনে হয় এইটাই সুযোগ রামেরে যুবরাজ হিসাবে অভিষিক্ত কইরা ফালানোর। দরকার পড়লে নিজে রিটায়ার যাইয়া রামেরে রাজাও কইরা ফালান যায়। যাতে নানাবাড়ি থাইকা সিংহাসন দখলের ঘিরিঙ্গি বুদ্ধি নিয়া ফিরা আইসা ভরত দেখে সেই সিংহাসনখান আর বাপের সিংহাসন নাই। সেইটা অলরেডি এখন ভাইয়ের...
২০১৬.০৩.১১ শুক্রবার

নোট: এই গল্পের ঘটনা-পরম্পরার লাইগা রাজশেখর বসুর রামায়ণ অনুসরণ করা হইছে

সহজিয়া রামায়ণ ১
.....

রামায়ণের শোলক সন্ধান ২: সীতার সতীত্ব পরীক্ষা

রামায়ণের শোলক সন্ধান ১: সীতা কার মেয়ে?


মন্তব্য

পরিবেশবাদী ঈগল এর ছবি

উত্তম জাঝা!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

চিন্তিত

সোহেল ইমাম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। চিন্তারই বিষয়

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে লীলেন। যদিও সহজিয়া কী কারণে সেটা বুঝতে পারছিনা।

--মোখলেস হোসেন।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সহজিয়া যে কেন সেইটার উত্তর দিতে গেলে তো পুস্তকের ভূমিকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ লীলেন। খুব চেনা একটি কাহিনীকে অচেনা ঢঙে উপস্থাপন করা কঠিন কাজ। সহজিয়া রামায়ণ তাই সহজ নয়। লেখকের জন্য তো বটেই। পাঠকের জন্যও না। সুপাঠ্য (লেখকের গুন) সে মানতেই হচ্ছে, কিন্তু সুপাচ্য নয়। কথাটা নেতিবাচক অর্থে বলিনি।
----মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

রামায়নে এত জটিল কেনু? চিন্তিত

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

রামায়ণরে জটিল কইলে মহাভারত কী?

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

মেঘলা মানুষ এর ছবি

বিশ্বামিত্র সেই রকম একটা চরিত্র!
কুড়ালি বামুনের লম্ফঝম্প মজা লাগছে!

শুভেচ্ছা !

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। কুড়ালিরা একটু ভিন্ন জাতের বামুন

তাহসিন রেজা এর ছবি

পড়ছি...

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আইচ্ছা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ধুত। রামায়ন হল প্রাগৈতিহাসিক টেলিফোন গাইড। মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হাসিব এর ছবি
  • একটা লোকের নাম কেন গাধী হবে!
  • আমার ধারণা এইসব রাজা রাজড়াদের সাথে আজকালের ডিসিদের মিল আছে। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজে যদি ২/৩ দিন হেঁটে যাওয়া যায় তার মানে ওগুলো ছোট ছোট জেলা সাইজের ছিল। এখন জেলাগুলোর রাজা হল ডিসিরা। উদাহরণটা এরকম হতে পারে - ফরিদপুর রাজ্য থেকে চারদিন হেঁটে খুলনা রাজ্যে ডিসি সাহেবের গমন।
মাহবুব লীলেন এর ছবি

রাজ্যগুলার সাইজ কিন্তু আরো ছোট ছিল। বহু ক্ষেত্রে একেকটা ইউনিয়ন পরিষদ এর থেক্ওে ছোট সাইজ। আর বড়ো হলে বড়োজোর উপজেলা সাইজ। প্রশাসন ব্যবস্থার আকার দেখলেই বোঝা যায় তাদের সাইজ কত বড়ো হতে পারে

০২
রাজাদের আকার বর্তমানের গ্রামবুড়া বা মোড়ল থেকে বেশি বড়ো ছিল বলে মনে হয় না। আবার গোত্রপ্রধানদেররকেও বলা হতো রাজা। যেমন জেলে রাজা; মূলত জেলে গ্রামের মোড়ল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।