বাস কথন -০২

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ০৩/০১/২০১৮ - ১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৯.

বাংলাদেশে অফিসে প্রবেশের সময় দুটি — সরকারী অফিসে সকাল নয়টায়, বেসরকারী অফিস আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সকাল দশটায়। অতএব সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত বাসযাত্রীরা ক্রমাগত বলতে থাকেন, “ড্রাইভার সাহেব! তাড়াতাড়ি যান অফিস টাইম”! এই কথাগুলো বলার সুযোগ পেতে হলে আপনাকে আগে বাসে উঠতে হবে। অফিস টাইমে বাসে উঠতে পারাটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার — বিশেষত যাদেরকে কোন রুটের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে বাসে উঠতে হয়। যেমন, আপনি যদি মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল যেতে জিগাতলা বা তার পরের কোন বাস স্টপ থেকে উঠতে চান তাহলে অফিস টাইমে আপনার কপালে লবডঙ্কা! সব বাস মোটামুটি ফিজিক্যাল-শঙ্কর বড়জোর পনেরো নাম্বার থেকে ভরে, দরোজা-জানালা বন্ধ করে সাঁই সাঁই করে ছুটতে থাকে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা’টা আসে যখন দেখা যায় সব স্টপে থামে এমন লোকাল বাসগুলো আর বিআরটিসি বাসগুলো বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অফিস বাস হিসেবে ভাড়া খাটছে। লোকাল বাসগুলোকে নিয়ে আমার বলার কিছু নেই — ওগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন জিনিস, সুতরাং লাভের জন্য ওরা ভাড়া খাটবে। কিন্তু বিআরটিসি তো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান! তারা কেন জনসাধারণকে দুর্ভোগের মধ্যে রেখে বেশি লাভের ব্যবসায়তে যাবে?

১০.

ঢাকা মহানগরে চলাচল করে এমন একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের বাসগুলোর আচরণ খুবই ব্যতিক্রমী। তারা কোন ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করেন না, যথেচ্ছ গতিতে যান, যখন খুশি উলটো রাস্তায় যান, কাউকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছে হলে বাস দিয়ে ধাক্কা দেয়া থেকে শুরু করে বাস থেকে নেমে পিটানো পর্যন্ত সব কিছু করেন। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় লেখা হয় বটে কিন্তু উনারা এসব ফালতু বিষয় গায়ে মাখেন না। এসব খবর পড়ে উনাদের কিছু প্রাক্তনী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সী থেকে পৃথিবীর মাটিতে পড়ে বলেন এমনতরো ঘটনা নাকি কোন আমলে ঘটতো না, এমনতরো অসৈরণ কিছু তারা কস্মিনকালেও শোনেননি। আগের কথা বলতে পারবো না, তবে গত চার দশক ধরে অমন ঘটনা আমি বহুবার ঘটতে দেখেছি, ঘটতে শুনেছি। অল্প কিছু দিন আগে একবার আমাদের বাস ওই বিশেষ প্রতিষ্ঠানের একটি বাসকে ওভারটেক করার মতো দুঃসাহস দেখানোয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে আমাদের বাসটিকে পেছন থেকে ভীমবেগে ধাক্কা মেরে রোড ডিভাইডারের সাথে লাগিয়ে দেয়। ট্রাফিক পুলিশরা জানেন এক্ষেত্রে আইনী ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদেরকে কী পরিমাণ দুর্ভোগের সিরিজ পোহাতে হবে। তাই ভিক্টিম আর ট্রাফিক পুলিশ উভয়কে কিল খেয়ে কিল হজম করতে হয়।

(মহাকবি আবু’ল কাসিম ফিরদাউসী তুসি নাকি গয্‌নভী সুলতান ইয়ামিন উদ্‌ দৌলা আবুল কাসিম মাহ্‌মুদকে লিখেছিলেন, নিম গাছের গোড়ায় যতই মধু ঢালা হোক সেটাতে কখনো আমের মতো মিষ্টি ফল ফলবে না। আমরা জানি, পাকা আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানানো যায় কিন্তু পাকা নিমফল দিয়ে কোন সত্ত্বই বানানো যাবে না। সেটা গাছে থাকতেও অখাদ্য, গাছ থেকে ঝরে পড়লেও অখাদ্য।)

১১.

বাস যেমন তেমন হোক তাতে আসন থাকবেই, কিন্তু আসন থাকলেই তাতে বসা যাবে এমনটা নয়। সরু আসন, পা রাখার জায়গা নেই এমন আসন, ছেঁড়া আসন, ভাঙা আসন, চোখা টিনের কোন বের হয়ে থাকা আসন, অতি নিচু আসন, ইঞ্জিনের ওপর পাতা উত্তপ্ত আসন, ময়লা (বিশেষত বমি) মাখানো আসন — সর্ব প্রকার আসন ঢাকার বাসগুলোতে মেলে, একটু বেশি পরিমাণেই মেলে — শুধু স্বাভাবিক-পরিষ্কার-আরামদায়ক আসন ছাড়া। বিআরটিসি’র কোন কোন বাসে এমন আসনও আছে যেখানে পিঁড়ির মতো উবু হয়ে বসতে হয়। বাসে আসন রেখেই বাস কোম্পানী যাত্রীসাধারণের বিরাট উপকার করে রেখেছে, তাই তাদের উচিত কোন অভিযোগ না করে অমন সব আসনে সোনামুখ করে বসে থাকা। একই কথা প্রযোজ্য কাচভাঙা, আটকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে থাকা, মাঝপথে আটকে থাকা, বিপদজনক ভাবে ভাঙা কাচ বা ফ্রেম নিয়ে উঁচিয়ে থাকা জানালা; কখনো না ঘোরা অথবা বিকট শব্দে ঘোরা পাখা; বাতিবিহীন বা ঝাপসা আলোর বাতির ক্ষেত্রে। কিছু অবুঝ যাত্রী এগুলো নিয়ে খামোখা ঊচ্চকণ্ঠে অভিযোগ করেন। কেন করেন? কার কাছে করেন? কার এতো সময় আছে এসব শোনার!

১২.

লাইনে দাঁড়িয়ে উঠতে হয় এমন অল্প কিছু বাস কোম্পানী ছাড়া আর বাকি সব কোম্পানীর বাসে যাত্রীদেরকে দৌড়ে উঠতে হয়, বিশেষত রুটের দুই প্রান্ত ছাড়া অন্য সব স্টপের। অফিস টাইমে (শুরু ও শেষে) রুটের দুই প্রান্তেও যাত্রীদেরকে দৌড়ে বাসে উঠতে হয়। এর সাথে অবধারিতভাবে আছে ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি। নারী, বয়স্ক, শিশু, অসুস্থদের পক্ষে এভাবে বাসে ওঠা অসম্ভব। অথচ একই রুটে চলা সব বাস কোম্পানীর বাসের জন্য অভিন্ন টিকিট, টিকিট কাউন্টার, যাত্রীদের কিউ করে বাসে ওঠার ব্যবস্থা করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেহেতু যাত্রীরা কোন সমিতি/ইউনিয়ন/পার্টি/অ্যাসোসিয়েশন গঠন করতে পারেন না, তাই তাদের পক্ষে বলার কেউ নেই। এসব নিয়ে মিডিয়াতে খবর হলে বা কেউ লিখলেও বাস কোম্পানীগুলোর তাতে কিছু যায় আসে না। তাই তারা এব্যাপারে কিছুই করার কথা ভাবে না। নির্বিঘ্নে বাসে উঠতে পারাটা বোধ করি মানুষের কোন প্রকার অধিকারের আওতায় পড়ে না। তাই যারা মানুষের অধিকার নিয়ে বলতে বলতে গলায় আর লিখতে লিখতে কী-বোর্ডে রক্ত তোলেন তারা এসব সিলেবাসের বাইরের জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান না।

১৩.

জন্মসূত্রে, অসুস্থতাবশত, দুর্ঘটনাবশত যারা আর দশজন মানুষের মতো উঁচু জায়গায় উঠানামা করতে বা সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না ঢাকা শহরের বাসগুলো তাদের জন্য না। এখানে বাসে উঠতে গেলে ভূমি থেকে ১-৩ ফুট উঁচু প্রথম ধাপসহ কমপক্ষে আরও তিনটি ধাপ উঠতে হবে। বিআরটিসি’র কিছু বাসে প্রথম ধাপটা বড়, চওড়া বটে তারপর যেই কে সেই। যারা হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন ঢাকা শহরের বাসগুলো তাদের জন্য না। কোথাও এমন একটা বাস স্ট্যান্ড নেই যেখান থেকে হুইলচেয়ার চালিয়ে বাসে ওঠা যাবে। যারা ক্রাচ বা ফ্রেম ব্যবহার করেন তারা বহু কষ্টে বাসে উঠতে পারলেও দুই সারি আসনের মাঝখান দিয়ে যেতে পারবেন না। বেসরকারী বাস কোম্পানীগুলোর বাসগুলো তো বটেই খোদ রাষ্ট্রীয় পরিবহন প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি’র বাসের গঠনগত চিত্রটাও একই প্রকার। শারিরীক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের নাম ভাঙিয়ে খাওয়া এনজিওগুলোর কেউও এটা নিয়ে অভিযোগ করেন না বা সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন না।

১৪.

(ক)
ঢাকার বাসে ভিখিরী উঠা একটা অতি পরিচিত দৃশ্য। এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা। তারপরে আছেন হৃদরোগী, কিডনী রোগী, অঙ্গহানি হওয়া, পোড়া-ঝলসানো, অস্বাভাবিক অঙ্গের সাহায্যপ্রার্থীরা। রোগী ভিখিরীরা এক্সরে প্লেট, ল্যাব রিপোর্ট, পত্রিকার কাটিং ইত্যাদি পলিথিন কাগজে মুড়ে বা ল্যামিনেট করে প্রদর্শন করে নিজেদের দাবীর যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন — যাত্রীরা সেসব তথ্য-প্রমাণের ব্যাপারে নির্বিকার থাকেন।

(খ)
উরু পর্যন্ত দু’পা নেই এমন ভিখিরীরা কী বিপদজনকভাবে ট্রাফিক সিগন্যালে থামা দুই বাসের মাঝখান দিয়ে চলাচল করেন এবং বাসে উঠানামা করেন সেটা না দেখলে বোঝা সম্ভব না। কেউ কেউ কাঠের পাটাতনে বিয়ারিং লাগিয়ে গাড়ী বানিয়ে সাঁই সাঁই করে প্রায় বাসের তলা দিয়ে ছোটেন। এদেরকে এমন বিপদজনক জায়গা থেকে সরানোর কথা বোধ করি কেউ ভাবেন না।

(গ)
বাচ্চা মেয়ে লজেন্সের প্যাকেট নিয়ে বাসে উঠে, সাথে এক তাড়া ছোট আবেদনপত্র — কম্পিউটার কম্পোজ করা। আবেদনকারীভেদে সেই আবেদনপত্রের কনটেন্ট মোটামুটি অভিন্ন। মেয়ে বাসে উঠেই নিঃশব্দে সব যাত্রীকে একটা করে আবেদনপত্র ধরিয়ে দেয় সাথে একটা লজেন্স। বাসের শেষ মাথা থেকে ফেরার পথে আবেদনপত্র, লজেন্স বিক্রির টাকা এবং বিক্রি না হওয়া লজেন্স নিয়ে ফেরে।

(ঘ)
বাসে গান গেয়ে সাহায্য চান বা গান শোনানোর মূল্য দাবী করেন এমন জনের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। কারণ, বাসের যাত্রীদের একাংশ এখন গান শুনলে বিরক্ত হন; বেশরিয়তী কাজকারবারের জন্য অনেকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনাও করেন। বাসে শোনা গানের মধ্যে দুজনের কথা খুব মনে পড়ে। বছর তিনেক আগে এক রাতে বাসে এক তরুণের গান শুনেছিলাম। দোতারা বাজিয়ে তিনি রাধার বিরহের গান গাইছিলেন।

আমার বন্ধু দয়াময়
তোমারে দেখিবার মনে লয়
তোমারে না দেখলে রাধার
জীবন কেমনে রয় বন্ধু রে

দেশে তখন নাস্তিক-বিধর্মী কতলের জোয়ার চলছে। গায়কের নিরাপত্তা নিয়ে আমি কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম। কামনা করি তিনি এবং তার গান দুটোই নিরাপদ থাকুক, সচল থাকুক। আরেক জনকে দেখেছি অল্প কিছু দিন আগে। একতারা বাজিয়ে মালেক সাঁই-এর গান গেয়ে শোনান।

আমার তো আর কেহ নাই
আছেন শুধু মালেক সাঁই
তুমি বিনে এই অধমেরে
তরাইবার কেহ নাই

ইনিও বয়সে তরুণ, তবে গলার কাজ চমৎকার। তবে এই দুজনের গানকে ছাপিয়ে যায় এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীর গান যিনি বাসে না উঠে জানালার পাশ দিয়ে ধীরে হেঁটে যেতেন। অদ্ভূত হাহাকারেভরা তার কণ্ঠের করুণ সুরে জ্যামে স্থবির হয়ে থাকা রাস্তার আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যেতো —

মাটির দেহ পিঞ্জিরা, হাসিয়া খেলিয়া
একদিন তো যাইবে পাখি উড়িয়া, উড়িয়া
মায়ার বাঁধন ছিঁড়িয়া, হাসিয়া খেলিয়া
একদিন তো যাইবে পাখি উড়িয়া, উড়িয়া

(ঙ)
মধ্য ত্রিশের এক নারী। পরনে টপস্‌ আর লম্বা স্কার্ট। কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। পরিধেয় আর ঝোলা এখন একটু ময়লা হলেও বোঝা যায় সেগুলো দামী। বাসযাত্রীর কানের কাছে এসে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, “দশটা টাকা হবে”? যাত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। কেউ কেউ দশ টাকা বের করে দেন। কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে পাঁচ টাকা? তাও নেই”! আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তিনি কি জলচারী নাকি আকাশচারী — বুঝতে পারি না। তবে তার মুখ ও শরীরে অমিতাচারের ছাপ বোঝা যায়।

১৫.

যে আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়নি সেই আমলে কিছু সচল ঢাকার বাসে-অটোরিক্‌শায়-রিক্‌শায় “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই” লেখা স্টিকার সাঁটাতেন। “যুদ্ধপাপীদের বিচার চাই” লেখা একটা স্টিকার আনিস ভাই ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। এখন বাসে সাঁটানো যেসব স্টিকার চোখে পড়ে তার মধ্যে ‘অমুক বাবা’, ‘তমুক মা’, ‘সমুক পীর’, ‘নমুক সাধক’-দের বিজ্ঞাপন বেশি। এরা স্বামী-স্ত্রী’র অমিল দূর করা, মনের মানুষকে কাছে পাওয়া, ব্যবসায় উন্নতি, পাওনা টাকা উদ্ধার, ঋণের হাত থেকে পরিত্রাণ, শত্রুর বিনাশ, বন্ধুত্ব লাভ, চাকুরী লাভ, বিদেশ যাত্রা, কালের দৃষ্টি (?!?) থেকে পরিত্রাণ, দৈব অর্থ লাভ, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো, বিয়ে হওয়া, সন্তানের অমঙ্গল দূর করা জাতীয় সেবা দিয়ে থাকেন। বিনা অপারেশনে অর্শ্ব-ভগন্দর সারানো, সাত দিনে বিশেষ দুর্বলতা দূর করা, কারো ক্ষুদ্র-শিথিল কিছু দীর্ঘ ও কঠিন করা, কারো শিথিল-ধ্বসে পড়া কিছু উন্নত ও দৃঢ় করা, HBsAg নিগেটিভ করা, ক্যান্সার-হাঁপানী-ডায়াবেটিস-পুরনো আমাশয়-এলার্জী-বাত সারানোর মতো চিকিৎসার জন্য ইউনানী/হেকিমী, আয়ুর্বেদীয়/কবিরাজী, হোমিওপ্যাথি ছাড়াও স্বপ্নেপ্রাপ্ত ঔষধ, কামরুপ-কামাখ্যার যাদু-টোনা-বান, পানিপড়া-তেলপড়া-ডিমপড়া-চালপড়া-আয়নাপড়া, জ্বীন তদবীর, কালী সাধনা, তান্ত্রিক সাধনা ইত্যাদির বয়ান থাকে। এর বাইরে পার্টটাইম চাকুরীতে নিয়োগের স্থায়ী বিজ্ঞাপন দেখা যায়। একটা বিজ্ঞাপন দেখি যেখানে পড়াশোনায় বিরতিপরাদেরকে আবার পড়াশোনায় ফেরত আসার আহ্বান আছে। তারা ঊচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পরীক্ষা প্রাইভেটে দেবার ব্যবস্থা করেন, অল্পস্বল্প কোচিংও করান। বিজ্ঞাপনটির একটা কথা খুব মনে ধরেছে — “পরীক্ষা দিলেও সময় যাবে, না দিলেও সময় যাবে। অতএব সময় নষ্ট না করে পরীক্ষা দিন, ইনশাল্লাহ্‌ পাশ করবেন”।

১৬.

(ক)
পানি, জ্যুস, এনার্জি ড্রিংক, মাঠা (ঘোল), শশা, আমড়া, বরই, পেয়ারা, পটেটো চিপস্‌, পপ্‌কর্ন, রিং চিপস্‌, বুট (ছোলা) ভাজা, মটর ভাজা, বাদাম ভাজা (খোসাসহ এবং খোসা ছাড়া), চানাচুর (প্যাকেট করা, কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ-মশলা দিয়ে বানানো এবং ঘটিগরম), ঝালমুড়ি, তিলের খাজা, আচার, আইসক্রীম, ক্যান্ডি-লজেন্স ............ বাসে বিক্রি করা খাবারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সেগুলোর মান বাজারের সবচে’ নিম্নমানের, পরিমাণ মূল্যের তুলনায় কম। এক কালে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাসে বিক্রিকরা খাবারের আইটেমে পরিবর্তন আসতো, এখন এমনটা খুব কম হয়। ঘোরতর শীতকালেও জ্যামে আটকালে পিঁজরাপোলের মতো বাসে থাকা যাত্রীরা ঘামে ভিজে জবজবে হন। সুতরাং তখনও ঠাণ্ডা পানি, শশা বা মাঠা’র ক্রেতার অভাব হয় না। আমার ব্যক্তিগত ভূয়োদর্শন হচ্ছে, বাংলাদেশে কখনো কোন কারণে কোন একটা কিছু (বিশেষত খাবার) জনপ্রিয় হলে সেটা রাস্তাঘাটেবাসেট্রেনেলঞ্চে সর্বত্র পাওয়া যেতে থাকে। তারপর একসময় দুম্‌ করে সেটা নাই হয়ে যায়। গত পাঁচ-ছয় দশকে বাসে বিক্রি হওয়া দ্রব্যাদির কালানুক্রমিক তালিকা করতে পারলে আমাদের রুচি-অভ্যাস-সামর্থ্য-স্বাস্থ্যের পরিবর্তনের একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যেতো।

(খ)
রুমাল, চুল বাঁধার ব্যান্ড, ক্লিপ, সেফটিপিন, সূঁচ, সূঁচে সুতো লাগানোর ডিভাইস, বলপেন, টুথব্রাশ, দাঁতের মাজন, ইঁদুর মারার বিষ, অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটের সাইজের ন্যাপথালিন, ডিজিটাল তসবিহ্‌, মোবাইল কাভার, ম্যাজিক লাইটার (তেল-গ্যাস-ব্যাটারিবিহীন), সবজী-ফল কাটাকুটি করার যন্ত্রপাতি ............ ইত্যাদি হচ্ছে বাসে এখন বিক্রি হচ্ছে এমনসব পণ্য। সময়ের সাথে সাথে এগুলো পালটে যাবে। যেমন পালটে যাবে এগুলো বিক্রি করার সময় বিক্রেতার ব্যবহৃত ভাষা, আবেদনের কায়দা, বিশেষায়িত শব্দগুলো। সবজী কেটে দেখিয়ে দেয়া, ছোট গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন জ্বালিয়ে দেখানোর মতো ব্যবহারিক উদাহরণ দেবার কায়দাগুলোও একসময় পালটে যাবে। তবে বাসে বা অন্য যানবাহনে উঠে এমন কাজের/অকাজের/আজব/মজার জিনিসগুলো অভিনব সব ভাষায় আর বিচিত্র সব কায়দায় বিক্রি করার ব্যাপারটা সব সময়েই যাত্রীদের কাছে মহানগরীতে বাসভ্রমণের একঘেঁয়েমীতে একটু অন্য আবহ এনে দেবে।

(গ)
দৈনিক পত্রিকা, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নামাজ শিক্ষা, পাঞ্জ সুরা, ৫০০ শব্দের মাধ্যমে বা সাত দিনে ইংরেজী শিখুন, গণিত-পদার্থ-রসায়ণের সকল ফর্মুলা (বিক্রেতার ভাষায় ত্রিশ টাকায় একটা আস্ত কোচিং সেন্টার), গাছগাছড়ার মাধ্যমে চিকিৎসা, জমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের সহজ ভাষ্য, ঢাকা মহানগরীর ম্যাপ, বাংলাদেশের ম্যাপ, ড্যাপের ম্যাপ, বার্ষিক সাধারণ ছুটিসম্বলিত ক্যালেন্ডার, ছোট শিশুদের জন্য বড় বড় ছবিসম্বলিত বর্ণমালার বই ............ নাহ্‌, এখানে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক-গানের বইয়ের বেইল নাই। কোন কোন ট্রাফিক সিগন্যালে বাইরে থেকে বাসের জানালা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ঝড়তোলা বইগুলো (ইংলিশে অথবা বাংলায় অনুদিত) বা তার সাথে একটু ইয়ে নামের বই (যথা, ‘রবি ও রাণুর আদরের দাগ’, ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’, ‘কাদম্বরী দেবীর স্যুইসাইড নোট’) বা বিতর্কিত বই (যথা আব্দুল করিম খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’) পলিথিনে মুড়ে পিনআপ ম্যাগাজিনের কায়দায় বিক্রি করা হয়। এককালে বাসে সাপ্তাহিক/পাক্ষিক ম্যাগাজিন, বিশেষত রাজনৈতিক, সিনে ও স্পোর্টস ম্যাগাজিন বিক্রি করা হতো। এখন বাসের ভেতরে বা বাইরে বাংলাদেশে ম্যাগাজিনের বাজার মোটামুটি নাই হয়ে গেছে। যারা ম্যাগাজিনের সম্পাদক-প্রদায়ক হতে পারতেন তারা বোধকরি বড় দৈনিকের ছোট কলাম লেখক, টেলিভিশনে নানা রকমের টক্‌ শো’র উপস্থাপক আর বাঁধা বক্তা হয়ে গেছেন। এক কালে সাম্প্রতিক সময়ে আলোড়নতোলা কোন ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা গীতিকবিতার বই বাসে বিক্রি হতে দেখা যেতো। এই প্রকার গীতিকবিতার একটা বিশেষ নাম আছে সেটা আজ আর মনে পড়ছে না। লোকসাহিত্যের অনেক কিছুর মতো এই প্রকার কবিতাও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

৯.
ছাত্রাবস্থায় বেকায়দা মোড়ের কাছে বাসা হওয়াতে ঢাবির বাসে চড়তে ইচ্ছে করেনি কোনদিন। উলটো দিকে রিক্সা করে কয়েকটা স্টপ পার হয়ে তারপর বাস ধরতে হতো।

১০.
আইন মানা, প্রয়োগ দুই দিক থেকেই ঝামেলাগুলো সহজিকরণ না করা গেলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে। ঢাকা শহরের যেকোন ব্যস্ত মোড়ের ওভারব্রিজে ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকলে এরকম বাসে বাসে লড়াই চোখে পড়বে।

১১.
একটু লম্বা লোকেদের জন্য ঢাকার পরিবহন দুঃস্বপ্নের মতো। পিড়িতে বসার মতো বসা, ঘাড় কাত করে বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা - দুর্গতির তালিকা শেষ হবে না। আরেক জিনিস দেখায় যায় মহাসড়কের বাসগুলোতে। এরা বাস আধুনিকায়ন করতে বাজেটের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন লাইটিং-এর পিছনে। রাতের ভ্রমণে এরকম তীব্র আলোয় একটু চোখ বুজবেন সে উপায় নেই।

১২.
লাইন একটা ভ্রান্ত ধারণার নাম। লাইন থাকে ঠিক। সেই লাইন ভেঙ্গে যাওয়াও খুব নিয়মিত ঘটনা।

১৩.
শারীরিক/মানসিক অক্ষমতায় ভোগা মানুষদের জন্য বাংলাদেশ নয় এটাই সত্য।

১৪।
এগুলো একসময় থাকবে না। ভিডিও ডকুমেন্টেশন করে ফেলে দরকার।

১৫.
এইসব লিফলেট ইত্যাদি ছাপাতে টাকা লাগে। এদের ব্যবসা না থাকলে এভাবে বছরের পর বছর এরা বিজ্ঞাপনের জন্য এতো টাকা ব্যয় করতে পারতো না।
আমাদের স্টিকারগুলো কি আছে দুই একটা অবশিষ্ট?

১৬.

বাংলাদেশে কখনো কোন কারণে কোন একটা কিছু (বিশেষত খাবার) জনপ্রিয় হলে সেটা রাস্তাঘাটেবাসেট্রেনেলঞ্চে সর্বত্র পাওয়া যেতে থাকে। তারপর একসময় দুম্‌ করে সেটা নাই হয়ে যায়।

এরকম কি হতে পারে যে এসব বাজারজাতকরণের পেছনে বড় ব্যবসায়ীরা আছেন? তারাই অলিগোপলি বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করেন এরকম?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

৯.
বেশিরভাগ মোড়ই বেকায়দা মোড়।

১০.
এটা বাসে বাসে লড়াইয়ের ব্যাপার নয়। ঐ ব্যাপারটা পরের পর্বে আসবে। এখানকার ব্যাপারটা এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রতিষ্ঠানের বাসের আচরণ নিয়ে।

১১.
লম্বা লোক, মোটা লোক, নারী লোক, কচি লোক, বৃদ্ধ লোক - এদের সবার জন্য ঢাকার পরিবহনগুলোর গঠন ও প্রকরণ দুঃস্বপ্ন বিশেষ। বাসের আসন ও যাত্রীসুবিধার ক্বাষেত্সরে ঢাকার কোম্পানীগুলোর অভিধানে মেরামত, পুনর্নির্মাণ, পুনর্স্থাপন, সংযোজন ইত্যাদি অদরকারী শব্দগুলো বাদ দেয়া হয়েছে।

১২.
লাইন ভাঙে - কথা সত্য। তবে লাইন থাকলে এখনকার যে অমানবিক ব্যবস্থা তার কিছুটা লাঘব হবে।

১৩.
চরম সত্য।

১৪.
এমন অনেক কিছু থাকবে না। ভিডিও ডকুমেন্টেশন কে করবে? করলে পরে সেগুলো কারো সিন্দুকে থেকে যে পঁচবে না তার নিশ্চয়তা কী? ডিএফপি, বিটিভি, ন্যাশনাল আর্কাইভে অনেক কিছু আছে। কিন্তু কী কী আছে সেটাই যদি আপনি না জানেন তাহলে কোথায় গিয়ে কী খুঁজবেন? তাছাড়া সরকারী ছুটির দিন বাদে সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটার মধ্যে সশরীরে গিয়ে কয়েকটা ফর্ম ফিলআপ করে অতি অল্প কিছু জিনিস অ্যাক্সেস করার তেল কতোজন রাখেন?

১৫.
কিছু ব্যবসা তো হয়ই। তবে আমার অবজারভেশন হচ্ছে প্রতিনিয়ত এই কুদরতী কারখানাগুলো পালটায়। মানে আগেরগুলো ঝাড়েবংশে শেষ হয়, নতুন লট বাজারে নামে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অন্য অনেক ইন্ডাস্ট্রিতে একই প্রকার ঘটনা দেখেছি।

আমি গরুখোঁজা দিলে দুয়েকটা পেলে পেতে পারি। পেলে স্ক্যান করে এখানে তুলে দেবো। মূল কাজটা যারা করেছিলেন তাদের প্রায় সবাই মহাসাগর পাড়ি দিয়েছেন। আর একজন ভবসাগর পাড়ি দিয়েছেন।

১৬.
আপনার প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ এবং না। কেন হ্যাঁ, কেন না সেটা নিয়ে এখানে মহাভারত লিখতে ইচ্ছে করছে না। কেউ বাংলাদেশে বিপণন ও বিপণনকৌশল নিয়ে লিখলে সেখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
(দোকানদারী করে খাই। বেশি চাপাচাপি করলে ঝোলার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।)


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

ডকুমেন্টেশন গবেষকরা করবেন, ছাত্রছাত্রীরা করবেন। এটা করাই তাদের কাজ। কোন ফান্ডিং ছাড়াই ঢাকা শহরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে অনেক বিশ্বমানের পেপার নামানো সম্ভব।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিশ্বমানের পেপার নামানোর জন্য মাথা এবং মানসিকতা লাগে। এখানে মাথার হয়তো অভাব নেই, মানসিকতার অভাব আছে। যে কারণেই হোক বাংলাদেশে গবেষণাকর্ম কখনো গুরুত্ব বা মনোযোগ বা জনপ্রিয়তা পায়নি। গবেষণার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে আগ্রহী লোকও খুব কম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

সরু আসন, পা রাখার জায়গা নেই এমন আসন, ছেঁড়া আসন, ভাঙা আসন, চোখা টিনের কোন বের হয়ে থাকা আসন, অতি নিচু আসন, ইঞ্জিনের ওপর পাতা উত্তপ্ত আসন, ময়লা (বিশেষত বমি) মাখানো আসন — সর্ব প্রকার আসন ঢাকার বাসগুলোতে মেলে, একটু বেশি পরিমাণেই মেলে — শুধু স্বাভাবিক-পরিষ্কার-আরামদায়ক আসন ছাড়া। বিআরটিসি’র কোন কোন বাসে এমন আসনও আছে যেখানে পিঁড়ির মতো উবু হয়ে বসতে হয়। বাসে আসন রেখেই বাস কোম্পানী যাত্রীসাধারণের বিরাট উপকার করে রেখেছে, তাই তাদের উচিত কোন অভিযোগ না করে অমন সব আসনে সোনামুখ করে বসে থাকা।

লম্বা মানুষের জন্য বাসের সীট গুলো শাস্তি স্বরুপ ! আর মহিলাদের জন্য নির্ধারিত চালক সাহেবের পাশের লম্বাটে সিটে আর উল্টো দিকের গিয়ারের সংলগ্ন সিটে বসলে গন্তব্যে নামার জন্য ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে হয় করুন দশা। পায়ের প্যাচে পা !
এ্যানি মাসুদ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢাকার বাসের সিটে বসা একটা ব্যাপার, সেখান থেকে উঠাও একটা ব্যাপার। ঠিক কায়দা না জানলে আঘাত পাওয়া, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমে ভেবেছিলাম গীতিকবিতাগুলোকে হয়তো টেলিগ্রাম বলতো। পরে মনে পড়লো টেলিগ্রাম সে অন্য জিনিস, এখন যাকে বেকিং নিউজ বলে সেই ধাঁচের খবর নিয়ে একপাতার একটি কাগজ।আশির দশকের তুমুল আলোচিত এক হত্যাকাণ্ড নিয়ে গীতিকবিতা বিক্রি হতো বাসে, একটি চরণ মনে আছে, 'আপন চাচার প্রেমে পড়ে / স্বামী মেরে বস্তায় ভরে'।

সে আমলে ঢাকার শীতকাল ছিল রূপকথার মতো। সকাল নয়টা দশটা অবধি ছোপ ছোপ কুয়াশায় তলিয়ে থাকতো শহর। বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখে পড়তো দূরে, অনেক দূরে দুটি আলোক বিন্দু। সে আলোর বিন্দু বড় হতে হতে একটা সময় আমার কিশোর চোখে ধরা পড়তো, আরে এ যে আস্ত একটা বাস!

---মোখলেস হোসেন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দুয়েক জন বলেছিলেন গীতিকবিতাগুলোকে নাকি 'বৈঠকী গান' বলা হয়। এটা ঠিক না। বৈঠকী গান ভিন্ন জিনিস। এইসব গীতিকবিতার বড় অংশই ছিল চাঞ্চল্যকর সব হত্যাকাণ্ড আর পরকীয়া নিয়ে। নীহার বানু হত্যা, সালেহা হত্যা, জিয়া হত্যা, শারমীন রীমা হত্যা, নিদারাবাদ হত্যা, খেজুরখালি হত্যা, শ্বশুর-ভাসুর-চাচা শ্বশুর এক নারীর চার দোসর, ক্বাবা ছুঁয়ে শপথ করার পরেও পাওনা টাকা না দেয়ায় সাপ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আমার একটা গানের লাইন মনে আছে,

মোসলেম উদ্দিন কমিশনার
মারলো তারে এরশাদ সিকদার

রাত দশটার পরে কুয়াশায় ঢাকা রাস্তায় কাকলী মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময় অন্ধকারের বুক চিরে খল্লা মাছের দু'চোখের মতো দুটো হেড লাইট এগিয়ে আসতো। বাস কাছে আসতে হাতের প্রবল ইশারাকে উপেক্ষা করে, উপরের অর্ধাংশ কালো না করা হেড লাইটে দু'চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে চলে যেতো। কেন চলে যেত? কেন থামতো না?

Why she had to go
I don't know
She wouldn't say


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার পর্যবেক্ষণ, ধারাবাহিকটাতে বর্তমান ‘ছবি’টা চমৎকার ভাবে উঠে আসছে। নিশ্চিত ভাবে আগামী দশকে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হবে।

মিরপুর রোডের ধানমন্ডি পুরানো ৩০ পার হয়ে প্রায়ই দেখতাম বাস থামাত রাস্তার মধ্যখানে। লোকজন বাস থেকে নেমে বা’দিকে চলাচলকরা গাড়িগুলোর মধ্যদিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড় দিত।

বাসের ‘বায়ে চাপানো’ ব্যাপারটা বিখ্যাত। হঠাৎ বায়ে চাপানো, ভাগ্য ভাল থাকলে দেখতে পাবেন শেষ মুহূর্তে ‘কন্ডাক্টারের’ হাত দিয়ে দেয়া ‘ইন্ডিকেটর’। প্রচন্ড ভীড়ে একদিন সাত মসজিদ রোডে ভীড়ের মধ্যে একটা গাড়ি পাশে দাঁড় করা হল। ঢাকা শহরে ‘ম্যাডামরা’ (অনেকক্ষেত্রে সাহেবরাও) সাধারনত নিজে পিছনের দরজা খোলে গাড়ি থেকে নামেন না, চালক এসে দরজা খোলে দিতে হয়। তা চালক বা’দিকে এসে দরজা খোলছে ম্যাডামের জন্য। এদিকে বাস বায়ে ‘চাপিয়ে’ গাড়ির ডানে ‘ঘষা’ দিয়ে দিব্যি চালিয়ে চলে যাচ্ছে। চালক দৌড়ে এসে চিৎকার করায়, ‘কন্ডাক্টর’ হাসে, যেন কিছুই হয়নি।

বিশেষ প্রতিষ্ঠানে বাসগুলির পুরাই ‘পরাবস্তব’। একদিন দেখলাম মিরপুর রোডের ধানমন্ডি সাত নম্বরের কাছে হঠাৎ করে উলটা রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল। ঠিক রাস্তায় আসা এক ভদ্রলোকের গাড়ি সামনাসামনি হওয়ায় কয়েকজন নেমে গিয়ে গালাগালি...গাড়িতে ‘মৃদু লাথি’।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নিশ্চিত ভাবে আগামী দশকে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হবে

- কোন সন্দেহ নেই। আশি বা নব্বইয়ের দশকের চিত্রটা যদি আঁকতে পারতাম তাহলে গত চল্লিশ বছরের পরিবর্তনটা বোঝা যেতো। কিন্তু এই ডকুমেন্টেশনের কাজ করতে ইচ্ছে করে না।

বাস থামানো, বাঁয়ে চাপানো, যাত্রী নামানো ইত্যাদি নিয়ে পরের পর্বে লেখার ইচ্ছে রাখি।

বিশেষ প্রতিষ্ঠানের সাথে এখন বিশিষ্ট জনরাও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ ক্ষমতাকাঠামো বা কর্তৃত্বকাঠামো সংশ্লিষ্ট না হলে ঢাকার রাস্তায় ক্ষমতাবান-কর্তৃত্ববানদের ধমক-গালি-ঘষা-চড়-লাথি তার নির্বন্ধে অবধারিত।

প্রগতির ধ্বজাধারী এক পরিবারের গাড়ি চালানোর জন্য নতুন চালক নিয়োগ করা হয়েছে। প্রথম দিনেই চালককে ডেকে বয়ান করা হলো, "শোন অমুক, এই পরিবারের যে-ই হোক তাকে গাড়িতে উঠানো নামানোর দায়িত্ব তোমার"। এই কথার মানে হচ্ছে, গাড়িতে উঠা এবং নামার সময় প্রতি বারই চালককে নিজের জায়গা থেকে এসে গাড়ির দরজা খুলতে হবে বা বন্ধ করতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি থেকে একটা ছোটপত্রিকা বের হয় ৯ বছর ধরে, নাম ট্রৈনিক। লোকাল ট্রেন যাঁদের নিত্য বাহন, তাঁদের লেখা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে। ৯ বছর ধরে প্রকাশ হলেও আমি জানতে পেরেছি মাত্র কিছুদিন আগে। একটা সংখ্যা পড়েই মুগ্ধ! শুধু ট্রেন জার্নিকে কেন্দ্র করেই যে একটি এরকম সমৃদ্ধ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হতে পারে আমার জ্ঞানে ছিলো না।

ঢাকার বাস না হোক, রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা নিয়েও চমৎকার কাজ হতে পারে। কিন্তু আমরা শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মজা নিয়েই খুশি।

ট্রৈনিকের চলতি সংখ্যা: https://drive.google.com/file/d/1s321Wv2-Z1GlPPr0CYR06q4NWgILmb6t/view

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢাকার রাস্তায় চলাচল নিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠার বই লেখা সম্ভব। ঢাকার রাস্তায় হাঁটাহাটি নিয়ে পোস্ট দেবেন নাকি?

অটঃ ট্রৈনিকের লিঙ্কে ঘাপলা আছে। শুধু শুরুর কয়েকটা পৃষ্ঠা আসে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দেবো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অপেক্ষায় নাজির!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

নিচে চলবে টলবে কিছু লেখা নাই, পর্ব আরো আসবে আশা রাখি।

বাসের পাশাপাশি কাউন্টার ইত্যাদি নিয়াও লেখেন। সবই আসুক। এখনো কাঠের চিকন একটা টেবিলে কয়বাণ্ডিল টিকেট সহকারে কাউন্টার সাজায়ে ছোকরা কেউ বসেতো না? পাশাপাশি ৩/৪টা টেবিল, আবাবিল অনাবিল ছালছাবিল।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অন্তত আরও একটা পর্ব লেখার আশা রাখি।

কাউন্টারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করায় ধন্যবাদ। এই প্রসঙ্গটা পরের পর্বে যোগ করার চেষ্টা করবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

চলতে থাকুক। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঝোলায় জিনিসপাতি যত দিন থাকবে ততদিন সিরিজটা চালাবো। তবে রাবারের মতো অযথা টানবো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

কালের নিখুঁত চিত্রগাঁথা। যদিও কালের সেই ব্যাপ্তিটা বেশ কয়েকযুগ আগে থেকে শুরু, আর এর কিছুটা ভাগীদার আমাদের রেলযাত্রা এবং তার আবহ।

বাসে আরও একটি অতি গুরুত্বপুর্ন মিনি বিজ্ঞাপন প্রায়শই চোখে পড়ে- "পার্টটাইম-ফুলটাইম চাকুরী"। আকর্ষনীয় বেতন ও সুযোগ সুবিধার নিশ্চয়তা সম্বলিত এই বিজ্ঞাপন দেখে আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাদের ছোটবেলায় বাসের রাস্তাঘাট খুব সুবিধার ছিল না। কোথাও যেতে ফেরীতে ওঠা প্রায় অবধারিত ছিল। এইজন্য ট্রেন ছিল পছন্দনীয় মাধ্যম। কলেজ জীবনেও সকাল ছয়টা পঞ্চাশের লোকাল ধরে চাষাড়া থেকে কমলাপুর আসতাম। সেই ট্রেনের গল্পটা আবার একটু অন্য রকম।

চাকুরীর এই বিজ্ঞাপনটার কথা ১৫-নং পয়েন্টে একটু বলেছি। বিজ্ঞাপনটাতে দেখবেন কাঙ্খিত যোগ্যতা চাওয়া এইচএসসি/ডিগ্রী/মাস্টার্স। যে পদের জন্য এইচএসসি যথেষ্ট সেখানে মাস্টার্স চাওয়া হয় কেন? অথবা যে পদের জন্য মাস্টার্স প্রয়োজন সেখানে এইচএসসি দিয়ে কী করে চলবে? বেতনের জায়গায় লেখা - পার্টটাইম-৮,৫০০ (আলোচনা সাপেক্ষ), ফুলটাইম-১৬,৫০০ (আলোচনা সাপেক্ষ)। যদি বেতনের অঙ্কই উল্লেখ করা হয় তাহলে আলোচনার সুযোগটা কোথায়? বুলেট পয়েন্ট দিয়ে লেখা থাকে "ছাত্রী/গৃহিনীরা আবেদন করতে পারবেন"। বিশেষ করে ছাত্রী/গৃহিনীদের কথা বলা কেন? এসব বিজ্ঞাপনদাতাদের ব্যাপারে পুলিশী তদন্ত হওয়া উচিত। চাকুরী দেবার নাম করে টাকা হাতিয়ে নেয়া বা যৌন হয়রানীর কথা কখনো সখনো পত্রিকায় আসে বটে তবে সেটা পানির ওপর ভেসে থাকা আইসবার্গের ডগাটাও না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাসে যে সকল সমস্যা কিংবা অসুবিধা সমূহ রয়েছে, তার অনেকগুলিই ট্রেনের ক্ষেত্রেও রয়েছে, অনেক আগে থেকেই। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কিংবা যৌবনে সে সকল আর সমস্যা বলে মনে হয় নি, অবচেতনভাবে মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক।

ছাত্রী/গৃহিনীদের চাকুরীর ব্যাপারে যে আশঙ্কার উল্লেখ করেছেন, তা মোটেই অমূলক নয়।

মন মাঝি এর ছবি

বাসে যে সকল সমস্যা কিংবা অসুবিধা সমূহ রয়েছে, তার অনেকগুলিই ট্রেনের ক্ষেত্রেও রয়েছে, অনেক আগে থেকেই।

১। ট্রেনে ফেরি পার হওয়া বা ফেরিঘাটের জ্যামে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার অবর্ণণিয় যন্ত্রণা নেই (আগেকার বাসের মতো) । এটা কিন্তু বিশাল পার্থক্য।
২। আর শুধু অসুবিধা কেন, সুবিধার কথাও বলুন। আমি ট্রেনফ্যান, তাই এটার কথাই বলি। বিশেষ করে লং-ডিস্ট্যান্সে। বাসে নির্দিষ্ট সিটের নির্ধারিত চিপার মধ্যে হাত-পা মুড়ে গুটিসুটি মারা কুকড়ানো মমির মতো দীর্ঘসময় ধরে হাত-পায়ে খিল ধরানো, ক্লস্ট্রোফোবিক, দমবন্ধ এবং চরম বোরিং বন্দীত্বের বদলে ট্রেনে হাত-পায়ের খিল ছাড়ানো বা খেলানোর, হাঁটা-চলার, বোরডম দূর করার, রিল্যাক্স করার, ধূমপায়ীদের জন্য ধূমপানের, চা-পায়ীদের চা-পানের, ক্ষুধার্তদের জন্য সিটে বসে খাদ্যগ্রহণের বা ইচ্ছে হলে আলাদা ডাইনিং-কারে গিয়ে পানাহার করা এবং একঘেয়েমি দুর করার, নিদ্রাকাতরদের জন্য শয্যাগ্রহণের, চলন্ত অবস্থায় বাথরুমে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার, বাইরের দৃশ্য উপভোগের, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদির - একটা বিরাট পরিসর ও সুযোগ রয়েছে। বাসে এর কণামাত্রও নাই, বরং ঠিক উল্টোটা আছে। উপরন্তু, ট্রেনযাত্রার একটা "ইভেননেস" বা মসৃনতা আছে; বাসযাত্রার মতো আকস্মিক উত্থান-পতন-মোচড়, ড্রাইভারের খামখেয়ালি, চুল-খাঁড়া করানো স্পীডিং বা অন্য বাসের সাথে বিপজ্জনক কম্পিটিশন, রাস্তা খারাপ থাকার দরুন তীব্র জার্কিং, এ্যক্সিডেন্টের হার - কিছুই নাই প্রায়। সুতরা পার্থক্য সুবিশাল!
আমি একবাক্যে তাই ট্রেনভক্ত। যেখানে ট্রেনে যাওয়া সম্ভব, আমি সেখানে বাস নয়, গাড়ি নয়, প্লেন নয়, বরং ট্রেনেই যাই। জয়তু ট্রেন! হাসি

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমিও ট্রেনের ভক্ত। ট্রেন ভ্রমণের জন্য আমার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ সেরা। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ট্রেন যোগাযোগের প্রধানতম উপায় ছিল, তাই একটা সমৃদ্ধ ট্রেন-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। আমি খুব খুব অল্প কিছু দেশ দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতায় ভারতের ট্রেন অত বিলাসবহুল না হলেও তার যাত্রা নানা বিচিত্র ইভেন্টে পরিপূর্ণ - এর তুলনা নেই। তবে প্রত্যেক প্রকার যানের নিজস্ব কিছু চার্ম আছে। সেগুলোতে ভ্রমণের আনন্দ এবং ঝামেলা ভিন্ন।

ট্রেনে ফেরী পার হবার ব্যাপার কিন্তু বাংলাদেশেও ছিল। বাহাদুরাবাদ-জগন্নাথগঞ্জ ট্রেনফেরী পার হননি কখনো? সে আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! যমুনা নদীর উপর সেতু হয়ে সেই মজাটা গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

১। ভারতে আমি ২০০৫ সালে কলকাতা থেকে দিল্লী গিয়েছিলাম একবার রাজধানী এক্সপ্রেসে। কাজে যাচ্ছিলাম এবং দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত ছিলাম, তাই একঘেয়ে ভ্রমণটা ঠিকই ছিল অনেক সময় লাগা (১৭ ঘন্টা) ছাড়া। ইভেন্টলেস মসৃন যাত্রা। কিন্তু এমনিতে ট্রেনভ্রমণ আমার যে কারনে ভাল লাগে, সেই হিসেবে যাত্রাটা ভাল লাগার মতো ছিল না। সম্পূর্ণ এয়ারকন্ডিশন্ড, বাইরের প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ইন্সুলেটেড, ঘটনাবিহীণ, মসৃন, নিরুপদ্রব অভ্যন্তরীণ পরিবেশ - প্রায় প্লেনের কাছাকাছি বোধহয় বলা যায়। সিটেই খাবার দিয়ে যাচ্ছিল এক-দুই ঘন্টা পর পর। এক কথায় নিরেস কেঠো-কেজো প্রয়োজনে চমৎকার, কিন্তু ভ্রমনান্দের বিচারে একেবারেই বোরিং। আমার উপরের মন্তব্যে বলা ট্রেনযাত্রার বৈশিষ্ট্যগুলির অনেকগুলিই ছিল না।
ট্রেনের সবচেয়ে বড় যে ৪টি আকর্ষণ আমার কাছে (অন্তত আমাদের দেশে): নড়াচড়া-চলাফেরার জন্য বিস্তীর্ণ পরিসর (কেবিন/কম্পার্টমেন্টের ভিতর, সাইডের প্যাসেজ, দুই কম্পার্টমেন্ট/বগির মধ্যবর্তী স্থান, ডাইনিং কার) এবং "স্পেশাসনেসের" অনুভূতি, বাইরের ধাবমান আলো-বাতাস-দৃশ্য ও প্রকৃতিকে শুধু চোখ দিয়ে নয় - বরং সর্বাঙ্গে অনুভব করার ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ, নতুন মানুষজনের সাথে আলাপ করার সুযোগ ও পরিবেশ, এবং দল বেঁধে গেলে সেই দলবদ্ধতাকে জমাটি ভাবে সাপোর্ট করার পরিবেশ। এর প্রায় কোনোটাই রাজধানী এক্সপ্রেসে ছিল না। এই ট্রেন সুপরিসর হলেও কেন জানি আমাকে "স্পেশাসনেসের" অনুভূতি দেয়নি, বরং খানিকটা ক্লস্ট্রোফোবিক লেগেছে! সম্ভবত আরেকটু কমদামি ট্রেনে গেলে বোধহয় অন্য পরিবেশ পেতাম। জানি না। তবে দেশের বাইরে মিশরে এই জিনিস একটুখানি পেয়েছিলাম কায়রো থেকে লুক্সোর যাওয়ার পথে।

২। তবে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা হচ্ছে করাচি থেকে আফগান সীমান্তের কাছাকাছি পর্যন্ত দুর্গম ও সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতের গা বেয়ে যাওয়া ট্রেনযাত্রা। তবে এটা স্মরণীয় সম্পূর্ণ ভিন্ন কারনে, উপরে বলা কোনো কারনে নয়।

৩। এই মাসে শীত থাকতে-থাকতেই উত্তরবঙ্গ তথা পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা যাওয়ার ইচ্ছা আছে। দু'টো ট্রেন ও রুট আছে দেখছি। একটা "দুরন্ত এক্সপ্রেসে" দিনাজপুর গিয়ে সেখান থেকে সম্ভবত বাসে ১-২ ঘন্টার দূরত্বে পঞ্চগড়, অন্যটা সম্ভবত "নীলসাগর এক্সপ্রেসে" নীলফামারীর ডোমার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে বাসে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে পঞ্চগড়। কোনটা বেশি ইন্টারেস্টিং হবে বলতে পারেন?

৪। ওরে বাবা, "ট্রেনফেরী" আবার কি চীজ??!! পার হওয়া, এমনকি চোখে দেখাও দূরে থাকে, আমি এমনকি এটা কল্পনাও করতে পারছি না! এটা ক্যামনে সম্ভব? হা হা হা!!! একটু বর্ণনা করবেন? নেটে কোনো ছবি আছে এর?!

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ডোমারের রুটটা তুলনামূলকভাবে অপ্রচলিত হলেও ভ্রমণের জন্য আমার মতে এটাই উত্তম। তবে বাসে নয়, ডোমার থেকে একটা অটো নিয়ে বাংলার একটু অন্যরকম রুপ দেখতে দেখতে ধীরে সুস্থে পঞ্চগড়ের দিকে রওনা হতে পারতেন, কিন্তু নীলসাগর এক্সপ্রেস সন্ধ্যার পড়ে ডোমারে পৌঁছবে বলে ব্যাপারটি সুবিধাজনক হবে না। ফিরতি ট্রেনটির সময়সূচী আরও বেশী অসুবিধাজনক। দিনাজপুরের ট্রেনটির নাম "দ্রুতযান", লেট না হলে এটিও শেষ বিকেলে দিনাজপুর পৌঁছবে। পরিস্থিতির বিচারে এটায় যাওয়া ছাড়া উপায় দেখি না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। ট্রেনের/স্টিমারের দরজাবন্ধ কেবিন বা ক্যুপেতে ভ্রমণ করা আর প্লেনে ভ্রমণ করা সমান। ভারতে ট্রেনভ্রমণের ক্ষেত্রে যদি দূরপাল্লা হয় তাহলে থ্রি-টায়ার জুতসই, তবে সাথে আবহাওয়াটাও জুতসই হতে হবে; স্বল্পপাল্লায় কপালে বসার জায়গা পাওয়াটাই যথেষ্ট। শতাব্দী-রাজধানী-দুরন্ত দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।

২। একবার ট্রেনে করে পার্বতীপুর থেকে ভেড়ামারা গিয়েছিলাম (ট্রেনের নাম মনে নেই) - জীবনে এতো ইভেন্টফুল-কাম-আনন্দময় ট্রেনভ্রমণ কখনো করিনি। আরেকবার ট্রেনে করে সিলেট থেকে ঢাকা ফিরছিলাম, সম্ভবত পারাবত এক্সপ্রেসে - জীবনে এতো ইভেন্টফুল-কাম-ভয়ঙ্কর ট্রেনভ্রমণ কখনো করিনি।

৪। একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। বাংলাদেশে যে ট্রেন ফেরী ছিল সেটাতে আস্ত ট্রেন উঠতো না। ট্রেন যমুনা পাড়ে এসে থামতো, যাত্রীরা বউ-বাটা-বলসাবান নিয়ে ছুটে রেলওয়ের স্টীমারে উঠতেন, ঐপাড়ে পরবর্তী ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতো। স্টীমার থেকে আবার ছুটে সেই ট্রেনে। স্টীমারে উঠলে সবার ব্যাপক খিদে পেয়ে যেতো। আর ফেরীর খাবার যে খায়নি তাকে তার স্বাদ বোঝানো যাবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আরে! আরে!! আমার গায়ে ট্রেন বিদ্বেষী ট্যাগ লাগানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে কেন? চিন্তিত প্রথমেই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

আসলে আমি যেটা বুঝাতে চেয়েছি তা হল- বাস কথনে যে সকল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে, দুঃখজনক ভাবে তার অনেকগুলিই ট্রেনের ক্ষেত্রেও রয়ে গেছে, অনেক আগে থেকেই। তাই, নবীন যুবাদের কেউ যেন আবার ভেবে না বসেন যে এ সকল সমস্যায় ইদানিং কালের বাসেরই একচেটিয়া অধিকার, এ ভাবনা থেকেই কথাগুলো বলা।

গত সপ্তাহেই সপরিবারে ট্রেনযাত্রা করে এলাম উত্তরবঙ্গ থেকে। এটা হতে পারতো স্বপ্নময় একটি যাত্রা, কিন্তু নানা জনে নানা ভাবে বিঘ্ন ঘটিয়ে সে স্বপ্নকে প্রায় দুঃস্বপ্নে পরিণত করে দিয়েছেন। কিঞ্চিৎ বর্ননা দেই-

অগ্রিম টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি আগামী সাতদিনের সকল শ্রেণীর সকল টিকিট ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে ম্যানেজের রাস্তায় হাঁটতে হল, এবং বলাইবাহুল্য এতে কাজ হল। সকাল সাড়ে নয়টায় ট্রেন আসবে, সুতরাং একটু আগেভাগেই স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম, পাছে না আবার ট্রেন ফেল করি। স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেনের খবর নেই, লেট! অনেক গবেষণা করে একটা বসার স্থান আবিস্কার করা গেল, তবে, সহযাত্রীদের ভিড় ছাড়াও পরিপার্শ্বের নোংরা আবর্জনা, হকার, ভিখারি, সন্দেহজনক মানুষজন, কুকুর, বিড়াল, ছাগল ইত্যাদি নানা অনভিপ্রেত জিনিস আমাদের অপেক্ষার প্রহরগুলো দুর্বিসহ করে তুলতে লাগলো। অবশেষে অনেক বিলম্বে ট্রেন আসিল। আমাদের বগীটি ট্রেনের সামনের দিকে, নাকি পিছনের দিকে থাকবে, এ বিষয়ে নানা জনকে জিজ্ঞেস করেও সন্তোষজনক কোন দিক নির্দেশনা না পেয়ে অগত্যা প্লাটফর্মের মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু বগীটি একেবারে শেষের দিকে, প্লাটফর্মের বাইরে এসে দাঁড়ালো। দৌড়াদৌড়ি করে বগীর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেখি যুগপতভাবে একদল মানুষ নামতে চেষ্টা করছে এবং অন্যদল ওঠার জন্য ঠ্যালাঠেলি করছে। একটা অমানুষিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কোনরকমে ট্রেনে উঠতে না উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ভিড় ঠেলে আমাদের আসন পর্যন্ত পৌঁছে দেখি তার দুইটিতে অন্য লোক বসে আছেন। তাঁদের সবিনয়ে আসন দুটি খালি করে দিতে অনুরোধ জানানো হলে তাঁরা উল্টো জানালেন যে সেগুলো তাদেরই সিট। বহু কষ্টে টিকিট পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আসন উদ্ধার করা গেল, তবে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তারই মধ্য দিয়ে হকার ও ভিখারিদের অবিরাম চলাচল অব্যাহত রইল। আরও অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু সেসব বলে আর সুধী সমাজের বিরাগভাজন হতে চাচ্ছি না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চাষাড়া রেলস্টেশনে দেখতাম একটা লোহার ফ্রেমে অনেকগুলো আঙটা লাগানো থাকতো। সেই আঙটাগুলোতে একটা একটা করে লাল রঙ করা লোহার বালতি ঝোলানো থাকতো। কোন বালতিতে লেখা থাকতো 'বালি', কোনটাতে 'পানি'। বালি বা পানি লেখা থাকলেও বালতিগুলোতে কখনো ঐসব বস্তু দেখিনি - দেখা সম্ভব ছিল না। কারণ, বালতিগুলো প্রতি বছর রঙ করা হলেও সেগুলোর কোন তলা ছিল না। ঐ আমলে রেলওয়ের অবস্থা বোঝানোর জন্য এই ছোট উদাহরণটা যথেষ্ট।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার এই চমকপ্রদ সিরিজের পুরোটাই আমার জন্য শিক্ষামূলক। ঢাকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। এবার সেটা মনে হয় অনেকটা পুরন হয়ে যাবে। আমি সবগুলো পর্ব পড়ার সাথে সাথে মন্তব্যসহকারে কপি করে রাখবো ভাবছি। অনেকদিন পর প্রত্যক্ষ জনস্বার্থ বিষয়ক একটা সিরিজ চালু হলো সচলে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সিরিজটা আসলেই 'ব্লগরব্লগর', এখানে জনস্বার্থ রক্ষার কোন ব্যাপার নেই। ঢাকার বাস কথনের সাথে আপনার মহানগরের বাস কথন খুব বেশি পার্থক্যপূর্ণ হবার কথা না। এখানে রাস্তাগুলো সমতলভূমিতে নির্মিত, গাছপালা কম আর লোকসংখ্যা অনেক বেশি।

এই প্রকার অভিজ্ঞতাগুলো সময়ের সাথে একটু একটু করে পালটায়। কোন কোনটা এক সময় 'নাই' হয়ে যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।