রেলগাড়ি ঝমাঝম

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১১/০৯/২০১৬ - ২:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম – ছোটবেলায় একটা ছড়ার বইয়ে পড়েছিলাম। সেই কবেকার স্মৃতির সামনে ভুরু কুঁচকে আজও ভাবি কেনইবা রেলগাড়ি আর পা’ইবা পিছলাবে কেন, আর পা যদি পিছলে যায়ই তবে আলুর দম নামক খাদ্যবস্তুতে রূপান্তরের রহস্যটা কি। শৈশবের এই রেলগাড়ি-আলুরদম রহস্যের ভেদ আজও হয়নি। থাক রহস্যের কথা বরং রেলগাড়িটাই চলুক। রেলগাড়ি নিয়ে মানুষের উৎসাহটা মনে হয় সব সময়ই ছিল। সত্যজিৎ রায়ের (নাকি বিভূতিভূষন বলবো) পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গা থেকে শুরু করে আজকের মহাকাশভ্রমনের যুগ অবধি রেলগাড়ি সম্পর্কে উৎসাহটা একেবারে নেই হয়ে যায়নি। প্রায় রেললাইনের পাশেই বাড়ি। আরেকটু কম বয়সে রেলগাড়ির শব্দ পাওয়া মাত্র ছুটে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানোর একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত আমাদের। একটু বড় বয়সে দেখতাম প্রতিবেশিদের সাত বছরের ছেলেটাও এই রেলগাড়ির শব্দ পাওয়া মাত্রই নাওয়া খাওয়া ফেলে রেলগাড়ি দেখতে ছুটে আসছে। একটা ধাতব অজগরতুল্য দীর্ঘ বাহনের পেটে চেপে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে, দৃশ্যটায় বিস্ময় থাকতেই পারে। তার উপর এই বিশেষ জনপরিবহনটি অন্যান্য যানবাহনের মত সাধারন রাস্তায় চলেনা, কাঠের স্লিপারের ওপর লোহা বসিয়ে যে রাস্তা তৈরী করা হয় তাতে রেলগাড়ি ছাড়া আর কারো চড়া নিষেধ। সুতরাং রেলগাড়ি জিনিসটাকে রাস্তার আর কয়টা চাকাওয়ালা গাড়ির সঙ্গে এক পদে ফেলে বিচারের প্রশ্নই ওঠেনা। রেলগাড়ি বা ট্রেনে ভ্রমনেরও আলাদা একটা স্বাদ আছে। বাইরে থেকে দর্শকের দৃষ্টিতে রেলগাড়ি দেখার যে মোহমুগ্ধকর ব্যাপারটা আছে, রেলগাড়ির পেটে চেপে ভ্রমনের অভিজ্ঞতাটাও অন্যরকম। রেলগাড়িতে ভ্রমন করার সময় যেভাবে রেলগাড়ির ভেতরেই হেঁটে চলে ফিরে বেড়ানো যায় এই স্বাধীনতা আর কোথায়। তারপর অবিকল সমাজের মতই রেলগাড়িতেও রয়েছে শ্রেণী বিভাগ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণী গুলো সমাজের শ্রেণী ভেদের কথা ভেবেই নিশ্চয়ই সৃষ্টি হয়েছিল। এখন ঠিক সে গোত্রের শ্রেণী সংগ্রাম রেলগাড়ির কামরায় কামরায় দেখা না গেলেও অস্বীকার করা যাবেনা যে আমাদের রেলগাড়ি শ্রেণীহীন সাম্যের স্টেশনে এখনও ঠিক পৌঁছায়নি। সে না পৌঁছাক তবু রেলগাড়ি রেলগাড়িই থাকবে। আর কাছ থেকে রেলগাড়ির ধাতব ঝন-ঝনাৎ আর ঘটাং ঘটাং শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিলেও কুয়াশামোড়া রাতের মাঠ পেরিয়ে বহু দূর থেকে অদ্ভুত একটা গুড়গুড় শব্দে ঘুমোতে যাওয়া শিশুদের মনে এনে দেবে অন্য একটা আমেজ। আর এসবের জন্যই বুঝি রিকশার ছবিতে বিষয় হিসেবে রেলগাড়ি এসেছে অন্য যানবাহনের তুলনায় অনেক বেশি হারে। রেলগাড়ির রোমান্টিকতা জনমনে একটা দাগ কেটেছে বলেই বোধহয় রিকশার শিল্পীরাও রেলগাড়ির আকর্ষন এড়াতে পারেননি। সস্তায় এবং প্রায়ই বিনা টিকেটে রেলভ্রমনের সুযোগের কারনেই সম্ভবত রেলগাড়ির জনপ্রিয়তা। এখন অনেক ক্ষেত্রেই বিনা টিকেটে ভ্রমনের সুযোগ কমে আসলেও একেবারে নির্মূল হয়তো হয়ে যায়নি। অনেকদিন থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষের যাতায়াতের সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে এই যন্ত্রদানবকে পাওয়াই হয়তো মানুষের মনকে রেলগাড়ির দিকে টেনেছে। স্পোর্টসকার, বাস, ট্রাক, জাহাজ, হেলিকপ্টার রিকশার ছবিতে বহুদিন থেকেই বিষয় হয়ে আসছে। তবে রাজশাহীর রিকশার ছবিতে রেলগাড়ির একটা আধিপত্য আছেই। গ্রামের কুড়ে ঘর গুলোকে পাশে রেখে রেলগাড়ি ছুটছে। কখনও গাছপালা আর দূরের উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক খাম্বা পিছে ফেলে, কখনও নদীর ওপর সেতুর ওপর দিয়ে ছুটছে রেলগাড়ি। ছবিতে ছবিতে রেলগাড়ির চেহারারও রকমফের চোখে পড়বার মত। কোনটা অজগরের মসৃণ শরীরের কথা মনে করিয়ে দেয়, কোনটার বগি গুলো দেখলে মনে হয় এই বুঝি উল্টে পড়লো লাইন থেকে। কিছু ছবিতে আবার পরিপ্রেক্ষিত ঠিক রেখেই আঁকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সামনের ইঞ্জিনটাকে বড় করে আঁকা হলেও পেছনের বগি গুলো ক্রমশঃ ছোট হতে থেকেছে। রেলগাড়ির যে ছবি গুলো এখন রাজশাহীর রিকশায় আঁকা হচ্ছে এখানে তারই কয়েকটা দেওয়া হলো।









রিকশার ছবি নিয়ে অন্যান্য লেখা :
টিনের ক্যানভাস
মুজাহিদের টিনের ক্যানভাস
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে ধর্মীয় মোটিফ
হোয়াট শর্ট অব আর্ট ইজ রিকশা আর্ট
রিকশার ছবি : ঐতিহ্যে ফেরা, না ফেরা
টিনক্যানভাসের এক বিস্মৃতপ্রায় শিল্প
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে চিত্রতারকারা


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সোহেল ভাই, পোস্টের একদম শুরুতে যদি কোনো ছবি গুঁজে দেন, তাহলে তার কোডে Width আর Height "100%" করে দেবেন, তাহলে ছবিটা আর নীড়পাতায় পোস্টের সীমানা ভাঙবে না। কোডটা তখন এমন দেখাবে:

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু ভাই, এর পর থেকে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখবো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছুদিন সচলায়তনে আসা হয় নি। আটকে ছিলাম পেশাগত অচলায়তনে। অনেক লেখাই পড়তে পারিনি। আপনার এই লেখাটির শিরোনাম দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। আপাতত পেশার হেঁটোয় কণ্টক মুণ্ডুতে কণ্টক / সোহেল ইমামের লেখায় সময় করিলাম বণ্টক। লেখা আর ছবি দুটোই ভালো লেগেছে সোহেল ইমাম।
--মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

হাসি ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। আপনার লেখার পরের কিস্তির জন্য কিন্তু অনেকদিন অপেক্ষা করছি। সময় সুযোগ করে উপন্যাসটার আরো কয়টা পাতা আমাদের পড়তে দেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মাসুদ সজীব এর ছবি

রেলগাড়ি আমার জীবনের অসম্ভব সব ভালোলাগার স্মৃতি হয়ে আছে, ছাত্রজীবন থেকে বাংলাদেশে চাকরি জীবনের প্রায় পুরোটাই আমার রেলগাড়িতে কেটেছে। এই লেখা সেই স্মৃতির জানালা আজ আবার খুলে দিয়েছে। মন খারাপ

ছবিগুলো সত্যি দারুণ হয়েছে, আপনার অল্পকথায় না বলা অনেক কথার পোষ্ট টাও চলুক

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

কেমন আছেন সোহেল ভাই? লিখা পড়ে ভালো লাগলো।

অবিকল সমাজের মতই রেলগাড়িতেও রয়েছে শ্রেণী বিভাগ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণী গুলো সমাজের শ্রেণী ভেদের কথা ভেবেই নিশ্চয়ই সৃষ্টি হয়েছিল।

এ্যানি মাসুদ

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আর আপনার লেখা কিন্তু অনেকদিন হয় দেখছিনা। আমাদের কথা ভেবে কী-বোর্ডে একটু ঠুক ঠাক করে দেখেননা কি হয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সোহেল ইমাম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রূপক ভাই। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

নৌকার পরে রেলগাড়িই বোধহয় আমাদের লোক সংস্কৃতির অংশ হয়েছে উত্তরের গরুগাড়ি বাদে

সোহেল ইমাম এর ছবি

হ্যাঁ ঠিক তাই। ধন্যবাদ লীলেন ভাই পড়ার জন্য, মন্তব্যের জন্যও।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

রিক্সার ক্যানভাস নিয়ে চলতে থাকা আপনার এই সিরিজটা এককথায় অসাধারণ। খুব ভাল লাগে। চলতে থাকুক রিক্সা গাড়ি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

বেশ উপভোগ করছি আপনার এই সিরিজটি

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

দারুণ!

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ সাদিয়া আপা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ ঈয়াসীন ভাই। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

অদ্ভুত শোনালে-ও আমি এখনো কখনো ট্রেনে ছড়ি নাই। মন খারাপ

ছবিগুলো দারুণ, রিকশার ছবিশিল্প ব্যাপারটি দারুণ লাগতো।

সোহেল ইমাম এর ছবি

সত্যিই অদ্ভুত তো!! অ্যাঁ আশরাফ ভাই তাহলেতো একটা ট্রেন ভ্রমনের প্রথম অভিজ্ঞতার বর্ণনা আমাদের কপালে ঝুলতে লাগলো। লেখাটা পড়ার ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।