পাখির পায়ে Flag পরানোর গল্প

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শনি, ২৯/০৩/২০১৪ - ২:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

912592_10151876532911653_1361431717_n

পাখির পায়ের রিঙ লাগানোর কারণ, পদ্ধতি ও বিশেষ করে বাংলাদেশে তা শুরুর ইতিহাস অল্প করে লিখেছিলাম কাপ্তাইয়ের এই পোস্টে। কিন্তু রিঙ শুধু নয়, পরিযায়ী পাখির চলাচলে পথ জানার জন্য আরেকটি অপেক্ষাকৃত সহজ উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছেন পক্ষীবিশারদেরা, তা হচ্ছে পাখির পায়ে Flag (Flag এর বাংলা পতাকা, নিশান, ঝান্ডা, কেতন অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু কোনটা শব্দচয়ন সম্পূর্ণ নিখুঁত হবে সেটি ঠিক করতে না পারাই আপাতত পতাকাই ব্যবহার করলাম। কারো কোন মতামত থাকলে মন্তব্যে জানিয়েন)। প্রতিটি রিঙে যেমন আলাদা আলাদা সংখ্যা খোদাই থাকে করা থাকে, যার ফলে পাখিটি কবে কোথায় রিঙ করা হয়েছিল ইত্যাদি পর্যাপ্ত তথ্য জানা যায়, তেমন পতাকায় লেখা সংখ্যা থেকেই পাখিটি সম্পর্ক জানা যায় কিন্তু রিঙ দেখা জন্য পাখিটিকে যেমন আবার জালে আটকাতে হয়, পতাকার ক্ষেত্রে সেটি হবার দরকার নেই, দূরবীন বা টেলিস্কোপ দিয়েই বোঝা সম্ভব কোন অঞ্চলে পাখিটির পায়ে পতাকা পরানো হয়েছিল, কবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই পাখি পর্যবেক্ষকরাও দূর থেকে দেখেই মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, যে কারণে পাখির পায়ে পতাকা লাগানোর গুরুত্ব অপরিসীম।

1483627_10151876533221653_1565496027_n

পাখির পায়ে লাগানোর পতাকা তৈরি করা হয় Darvic নামে এক বস্তু দিয়ে, সেটাকে কেটে ইচ্ছে মত আকার দেওয়া যায়, তবে জিনিসটি বড়ই ব্যয়বহুল, বাংলাদেশের জন্য মাত্র ২০০ পাখির পায়ের দেবার মত যে পতাকা আনা হয়েছে পোল্যান্ড থেকে তার খরচ পড়েছে তিরিশ হাজার টাকা ! অবশ্য বাংলাদেশে পাখির পায়ে পতাকা লাগানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে রিঙ করবার সাথে সাথেই, কারণ ২০১০ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে রিঙ ক্যাম্প পরিচালনার সময় সাথে কিছু পতাকা নিয়েই এসেছিলেন প্রফেসর ফিলিপ রাউন্ড, আশা ছিল মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান (Spoonbilled Sandpiper)জালে ধরা পরলেই পায়ে পতাকা আটকে দিবেন।

10168346_10151879297401653_1013958076_n

উল্লেখ্য যে পাখির কে পায়ে রিঙ পরানো হয় এবং অন্য পায়ে পতাকা আটকানো হয়, এবং এগুলো নিয়ে উড়তে বা বাকী জীবন কাঁটাতে পাখির কোনরকম সমস্যা হয় না। যদিও সেবার চামচঠুঁটো বাটান হাতে ধরা না দেওয়ায় পতাকা ব্যবহার করা হয় নি। কিন্তু পতাকা ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়ার যাবতীয় কার্যক্রম চলতে থাকে এবং East Asian Australasian Flyway Partnership (EAAFP) থেকে বাংলাদেশের জন্য বার্ড ফ্ল্যাগের রঙ ঠিক করে দেওয়া হয় হলুদ, তবে দুইটা হলুদ উপর-নিচ বরাবর। একটা হলুদ পতাকা আবার অস্ট্রেলিয়ার চিহ্ন, উল্লেখ্য যে সব দেশের আলাদা আলাদা রঙে বা চিহ্নের পতাকা আছে।

1543068_10151876532896653_1982237015_n

এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত হাতিয়ার দমার চরের একটি বিশেষ অঞ্চলে ফ্ল্যাগ এবং রিঙ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে যোগ দিয়েছিলেন সামিউল মোহসানিনসহ দুই ব্রিটিশ পাখিবিশারদ বিল জোন্স এবং স্টিভেন।

10151658_10151879296881653_73462699_n

974283_10151879296266653_478650444_n

পাঁচ রাত সেই জোয়ার-ভাটার রাজ্যে জাল পেতে কিছু সৈকতপাখি ধরতে সক্ষম হয়ে বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী যাবতীয় মাপজোক নেওয়ার পরে রিঙ এবং পতাকা লাগানো হয়। প্রথম বারের মত বাংলাদেশের চিহ্ন সম্বলিত পতাকা নিয়ে উড়ে চলে যায় একটু বুনো পাখি, বিশ্বের যে প্রান্তেই সে যাক সঠিক মানুষের চোখে পড়লেই হয়ত জানান দেবে পলি মাটির গন্ধের কথা। পরের মাসেই মার্চের ১৩ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত আরেকটি এমন ক্যাম্পে অংশ নেন সামিউল এবং বায়েজিদ।

1608455_10151876532741653_1350934381_n

10150822_10151876533336653_521473479_n

শেষ হিসাব অনুযায়ী ৯ প্রজাতির ২৭টি সৈকতপাখির পায়ের পতাকা লাগানো হয়েছে, যাদের মধ্যে আছে টেরেক বাটান (Terek Sandpiper), গুলিন্দা বাটান (Curlew Sandpiper), পাতি লালপা (Common Redshank), লালঘাড় চাপাখি (Red-Necked Stint), ছোট চাপাখি (Little Stint), টেমিঙ্কের চাপাখি (Temmincks Stint), ছোট নথজিরিয়া (Little Ringed Plover ) ইত্যাদি। তবে সেই ক্যাম্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অতি বিপন্ন পাখি দেশী গাঙচষা ধরে রিঙ পরানো, যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সম্ভব হয় নি। মুশকিল হচ্ছে বিশ্বব্যপী বিলুপ্তির সম্মুখীন এই পাখিটি দিনে এক জায়গায় ঝাঁক বেঁধে বিশ্রাম করে, রাতে অন্য জায়গায়। দমার চরে এই বছরই আমরা হাজার খানেকের উপরে দেশী গাঙচষা দেখলেও (সাড়া পৃথিবীতেই আছে ৫০০০) তাদের রাত্রিকালীন আশ্রয়ের সন্ধান পেতে সক্ষম হই নি।

10149383_10151876533256653_552180050_n

কিন্তু নিশ্চয়ই শীঘ্রই দেশী গাঙচষা ধরা পরবে আমাদের জালে, বলা যায় না হয়তো তার শরীর স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন করার মাধ্যমে জানা যাবে অজানা তথ্য, যার ফলে হয়ত প্রজাতিটিকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব বিলুপ্তি করালগ্রাস থেকে, এমন আশাবাদই ব্যক্ত করলেন তরুণ গবেষক সামিউল মোহসানিন, উল্লেখ্য প্রায় এক যুগ ধরেই সামিউল বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের একজন সদস্য, তখন থেকেই নিয়মিত প্রকৃতিতে যেয়ে পাখি দেখার এবং তথ্য সংগ্রহ করা তার নেশা হয়ে দাড়ায়। তার একটি স্বপ্ন ছিল ”Stregthening Regional Co-operation for Wildlife Protection” প্রজেক্টের অধীনে ”Globally Threatened Waterbird Conservation in the Coastal Area of Bangladesh” নিয়ে দেশে কাজ করা। অবশেষে বাংলাদেশ বন বিভাগের অর্থায়নে দুই বছর ব্যপী এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এই বছরের মার্চে, যার সাথে সর্বতো ভাবে যুক্ত আছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং নেকম (Nature Conservation Management )।

10151484_10151876533111653_1243628710_n

আমি সামিউলের চোখে স্বপ্ন দেখি পাখপাখালি ভরা এক বাংলাদেশের, যেখানের তরুণ প্রজন্ম বুনোপাখির ধোঁয়া ওঠা মাংস চোষার চেয়ে বেশী পছন্দ করবে বনেবাদাড়ে প্রকৃতির মাঝে যেয়ে পাখি দেখতে, তাদের নিয়ে গবেষণা করতে। এই তরুণদের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।

10154599_10151879298656653_1147941515_n

(এই বিষয়ে বিশদ জানতে হলে http://www.eaaflyway.net এবং http://www.eaaflyway.net/the-flyway এই দুটি ওয়েবপেজ দেখতে পারেন।

পোস্টে ব্যবহৃত সমস্ত ছবি সামিউলের সংগ্রহ থেকে পাওয়া, কোথাও ব্যবহার করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। )


মন্তব্য

তাহসিন রেজা এর ছবি

স্বপ্ন দেখি পাখপাখালি ভরা এক বাংলাদেশের হাসি

এই স্বপ্ন আমিও দেখি হাসি বার্ড রিংগিং ব্যাপারটাতে আগ্রহ জন্মালো।

শুভকামনা অণুদা ।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তারেক অণু এর ছবি

আগ্রহ যথেষ্ট নয়, অংশ গ্রহণ করুন, অন্যদের জানান।

তাহসিন রেজা এর ছবি

অংশগ্রহণ করতে চাই হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তারেক অণু এর ছবি
সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দুর্দান্ত! হাততালি
সামিউল সাহেবের জন্য শুভকামনা

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

পুলাডা কাজের আছে

এক লহমা এর ছবি

খুব ভালো লাগল। সংশ্লিষ্ট সব্বাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

তোমাকেও দাদা

অতিথি লেখক এর ছবি

জানাই ছিলোনা এতো কাহিনী! দুর্দান্ত একটি পোস্ট।
চলুক

-দেব প্রসাদ দেবু

তারেক অণু এর ছবি

হ, পোলাপান অনেক কাজ করছে

মইনুল রাজু এর ছবি

এই জাতীয় একটা লেখার অপেক্ষায় ছিলাম। নিজে এখন বিস্তারিত খুঁজে বের করার আগ্রহ পাচ্ছি। ওয়েস্ট প্যাসিফিক ফ্লাইওয়ে নিয়েও বিস্তারিত দেখতে হবে, এই রুটটা দেখলাম একেবারে প্যাসিফিক এর ঠিক মাঝ বরারবর। কি করে যে ওরা ঠিক মাঝপথটা খুঁজে বের করে।
ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

তারেক অণু এর ছবি

লেখা দেন, পাখির সাথে উড়ে উড়ে

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

পোস্টের ব্যাপারে কিছু বলার নাই, আপনের ব্যাপারে বলার আছে, আপনের পায়ে দুইটা রিং কিংবা পতাকা পরানোর কাম। চোখ টিপি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক দুইটাতে হবেনা... তবু শুরু হোক... ভুটাইলাম শয়তানী হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

এহ অ্যাঁ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

পায়ে নাহোক - হাতে হোক, দুইটা না হোক - একটা হোক!! আমরা একটু দাওয়াতও খেয়ে আসি!!

হেহেহে

____________________________

তারেক অণু এর ছবি

ন এ আকারে না !

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হৈ হৈ হৈ হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

খুব কম মানুষই যা করে আনন্দ পায় সেটা করার সুযোগ পায়। আপনি অনেক ভাগ্যবান। ভালো থাকুন, আপনার লেখাগুলো এ বিষয়ক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই।

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ পিপিদা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।