অভিযান

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৪/২০১১ - ৭:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১। ডক্টর জীশান আমাদের যখন ডাকিয়ে পাঠালেন তখন বিকালবেলা। আমি, অঞ্জলি, সোমক আর জর্জ মিলে এক বিশেষ ধরনের শৈবালের নমুনা সংগ্রহ করছিলাম এক সরু খাঁড়ির প্রান্ত থেকে। এই শৈবাল ও খুব ইন্টারেস্টিং বেশ কদিন ধরে এই নতুন ধরনের শৈবাল নিয়ে পড়ে আছি আমরা কজন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে এর সালোকসংশ্লেষক্ষমতা চেনাজানা অন্য উদ্ভিদদের তুলনায় অনেকটাই বেশী, শুধু সূর্যালোকে না, আমরা কৃত্রিম জোরালো আলোয় এমনকি মৃদু আলোতেও পরীক্ষা করে দেখেছি, সেসব ক্ষেত্রেও এরা সালোকসংশ্লেষ করে গেছে, কার্বনডায়োক্সাইড থেকে অক্সিজেন ছেঁকে বার করে গেছে অবিশ্বাস্য দক্ষতায়।

কিন্তু ডক্টর জীশানের ডাক বলে কথা! কাজ বন্ধ করে জিনিসপত্র গোটাতে হলো তখনি। জীশানের তাঁবুতে ঢুকে দেখি উনি খুব উত্তেজিত, একদম উত্তেজনায় মুখ লাল চোখ চকচক করছে। যেন আর তর সইতে পারছিলেন না, তক্ষুনি না বললে নয়। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেও হলো না, উজল স্বচ্ছ ফাইবারে তৈরী টেস্ট টিউব উপরে তুলে ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন উনি, টেস্ট টিউবের মধ্যে রঙীন তরল।

জীশানের বক্তব্য শুনে আর অনুবীক্ষণে চাক্ষুষ দেখে আমরা চারজনেই হাঁ। কিছু করার নেই, এমন জিনিস কোনোভাবেই আমরা কেউই এক্সপেক্ট করিনি আর করবোই বা কীভাবে? এধরনের ব্যাপার যে আদৌ সম্ভব তা ই তো জানা ছিলো না! শুধু আমাদের না, এই ফিল্ডের কারুরই না। এটা এতটাই প্রচলিত ধারণাবিরোধী যে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, প্রবল ও প্রচন্ড বিরোধীতা করবে, সেইজন্যেই ডক্টর জীশান এত প্রচন্ড তড়িঘড়ি করে আমাদের ডাকলেন।

অথচ যদি এ সত্য হয়, যদি বারে বারে সম্ভব হয় দেখানো, তাহলে প্রাণসৃষ্টির রহস্যের পর্দা আরেকটু উঠে যাবে। সরু পরীক্ষানলের রঙীন তরল এক অদ্ভুত ধরনের স্পোর, যা বিভাজিত হয়ে নতুন নতুন স্পোর তৈরী করছে, এরা রেপ্লিকেট করতে পারে অথচ বিন্দুমাত্র ডিএনে নেই এতে। ডক্টর জীশান নানাভাবে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করে দেখেছেন, যে চেনা ডিএনে আমাদের পৃথিবীর সম্পূর্ণ জীবজগতের মূলাধার, সেই ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড নেই এদের, এমনকি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডও নেই, সেও পরীক্ষা করেছেন। অথচ অনুবীক্ষণে দেখা যাচ্ছে এরা রেপ্লিকেট করছে! এ যদি প্রাণ হয়, তবে চেনা পার্থিব প্রাণ এ নয়, কিন্তু তাহলে কী? কোথা থেকে এলো?

আমাদের সংগৃহীত ধূলার একটি প্যাকেট থেকে পাওয়া বস্তু পুষ্টিতরলে দেওয়ামাত্র এ জিনিস উনি পেয়েছেন। সে ধূলা কি তাহলে উল্কাখন্ড থেকে এসেছে? এ প্রাণ ভিন্নজগতের প্রাণকণা?

বিস্ময়ে উত্তেজনায় অদ্ভুত ভয়ে আমরা নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকি ডক্টর জীশানের দিকে! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সত্যি তো এ জিনিস মানুষকে জানাতেই হবে অথচ এতে যে আলোড়ন উঠবে সেই প্রচন্ড ঝড় আমাদের সমস্ত মানসিক স্থৈর্য্য ধৈর্য্য ও শক্তি নষ্ট করে দিতে পারে। তবু উপায় নেই, আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।

খানিকক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকার পর ডক্টর জীশানই আমাদের বললেন শৈবাল স্যাম্পল সংগ্রহে ফিরে যেতে, কারণ এখন এখানে থেকে বা এখনি একটা হৈচৈ উঠিয়ে কোনো কাজের কাজ হবে না। পুরো পরীক্ষাটা আবার উনি করবেন, সেই বিশেষ প্যাকেট উনি সীল করে রেখেছেন, সেই খুলে আবার আরেকটু বস্তু নিয়ে নতুন পুষ্টিতরলপূর্ণ ডিশে দিয়ে দেখবেন সেখানেও আরো এরকম প্রাণকণা আছে কিনা! তাছাড়া এই পুরো ব্যাপারটার খুব গুছিয়ে ডকুমেন্টেশান ও প্রয়োজন। আপাতত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ শেষ হলে উনি লেখার সময় আমাদের সাহায্য প্রয়োজন হলে ডাকবেন। তাছাড়াও উনি চারজনকেই কড়ার করিয়ে নিলেন যেন এই বিষয়ে কাউকে কিছু না বলি বা নিজেদের মধ্যেও এখন বেশী আলোচনা না করি।

আমরা সম্মত হয়ে স্বপ্নাহতের মতন বেরিয়ে আসি, স্লথ পায়ে ফিরে যাই আমাদের শৈবালখাঁড়ির কাছে। সেখানে ফিরেও বহুক্ষণ কাজ শুরু করতে পারিনা, চুপচাপ বসে থাকি চারজন। সুন্দর দিন,ঝলমলে সুর্য, নীল আকাশ, সবই আমাদের চোখের সামনে, অথচ যেন কিছুই নেই, আমরা চারজন বসে আছি নীরব চারটি পাথরের মূর্তির মতন।

২।
কেটে গেছে বেশ কদিন, আমাদের রুটিন কাজ, স্যাম্পল তোলা, পরীক্ষাগারে পাঠানো-এইসবই হয়েছে, দিনের শেষে আগুনের চারপাশে গল্পগাছা খাওয়াদাওয়া-যেমন হয়। ডক্টর জীশান সেদিনের ঐ জিনিস দেখানোর পরে একদম চুপচাপ আছেন কদিন, একবার আড়ালে জানতে চেয়েছিলাম কদ্দুর কী হলো, উনি খুব আস্তে আস্তে শুধু বলেছেন উনি আরো নানাভাবে পরীক্ষা করে চলেছেন, মোটামুটি একই মূল ফল পাচ্ছেন, ওদের মধ্যে ডিএনে নেই আর ওরা রেপ্লিকেট করে চলেছে। উনি এই ব্যাপারে এখন আর কিছু প্রকাশ করতে চান না। আগামী সপ্তাহ থেকে উনি লেখা শুরু করবেন, তখন আমাদের আউটডোর ফিল্টওয়ার্ক শিফট পাল্টিয়ে ওনার ল্যাবে নেবেন যাতে লেখার ব্যাপারে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। ইতিমধ্যে অবশ্য আমাদের রুটিন কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা রাজী হয়ে কাজ চালিয়ে গেছি। আজকে অবশ্য একটু অন্যখানে যাওয়া, দুপুরে বড়পা বদ্বীপের সেই ফসিল পদচিহ্ন দেখতে যাবো আমরা। ডক্টর জীশান যদিও একবার দেখে এসেছেন ইতিমধ্যে, উনিও আবার যাবেন আমাদের সঙ্গে।

নৌকা ভিড়লো পাড়ে, আমরা কজন এক এক করে নামলাম। ক্যামেরা ইত্যাদি রেডি করে আনা হয়েছে, ঐ পায়ের ছাপের ছবি তুলবার জন্য। ছাপের প্লাস্টারকাস্টও তুলে নেওয়া হবে। আগের দলেরাও এসব করেছে, তবু আবার করা হবে! কয়েক কোটি বছর আগে যারা পৃথিবীতে চলেফিরে বেড়াতো তাদের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন তো এলেবেলে ব্যাপার না, এর মর্যাদা অনেক।

এবড়োখেবড়ো শিলাময় ভূমি, পলি জমে জমে কোটি কোটি বছরে শক্ত শিলা হয়ে গেছে। বাদামী ধূসর শিলাগাত্রে বিরাট বিরাট পায়ের ছাপ, একেকটা দুই আড়াই ফুট লম্বা, ফুটখানেক চওড়া। দ্রুত দৌড়াচ্ছিলো হয়তো সে ঐ কোটি বছরের আগের কর্দমাক্ত ভূমির উপর দিয়ে, সামান্যতম ধারনাও ছিলো না, এই ভূমি পাথুরে হয়ে গিয়ে ঐ চিহ্ন ধরে রাখবে অতি সুদূর ভবিষ্যত্কালের প্রাণীদের বিস্ময়বিষ্ফারিত চোখের সামনে প্রকাশিত হবার জন্য। সেই প্রাণী তার সঙ্গীসাথী সহ কবে নি:শেষে ধুয়েমুছে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে ...

আজ আবার মেঘলা। মেঘময় আকাশের নীচে দিগন্তলীন মহাসমুদ্র পারে দাঁড়িয়ে ঐ বিলুপ্ত বিশালকায়ের পদচিহ্নের ছবি তুলতে তুলতে মনের মধ্যে অদ্ভুত অনুভব হয়, মনে হয় আজ থেকে কোটি বছর পরে আমাদের কণামাত্র চিহ্ন কোথাও থাকবে না।

নাকি থাকবে? অন্য কোনো রূপে? "নতুন নামে ডাকবে মোরে/বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে/আসবো যাবো চিরকালের সেই আমি ... " ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে আসি, ডক্টর জীশান প্লাস্টারকাস্ট তুলবেন, সাহায্য করতে এগিয়ে যাই।

প্লাস্টারকাস্ট তোলা শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি নামলো, তাড়াহুড়ো করে জিনিসপত্র মুড়ে দৌড় দিয়ে নৌকায়। ছইয়ের মধ্য বসে বসে বৃষ্টি দেখা, সাদা হয়ে বৃষ্টি নেমেছে, হলদে রেনকোটে মোড়া বোটচালক জশ আর ইয়ন। এরা দুজনেও নৌবাহিনীর। ডক্টর জীশান বৃষ্টি টিষ্টি দেখছেন না, উনি ব্যস্ত কি একটা হিসাবে। নৌকার একদম ভেতরে বসে ছোট্টো নোটবই খুলে খুবই মগ্ন হয়ে আঁক কষছেন। উনি এরকমই, কাজই ওনার সব কিছু।

৩।
ফিরে এসে দেখি এদিকে এত বৃষ্টি নেই, টিপ টিপ করে পড়ছে। জিনিসপত্র ঢাকাঢুকি দিয়ে জীশানের তাঁবুতে তুলে দিয়ে ফিরে আসছি, উনি আমাদের চারজনকে চায়ের নেমন্তন্ন করলেন। আমরা তো অবাক, থেকে গেলাম। উনি নিজেই স্টোভে চা বানালেন, পকোড়ার সরঞ্জাম বার করে দিলেন- অঞ্জলি ভেজে দিলো-তারপরে মস্ত খবরের কাগজের উপরে মুড়ি ঢেলে, পকোড়া নিয়ে চা খেতে খেতে ডক্টর জীশান আমাদের বললেন ওনার অল্পবয়সের এক কৌতূহলকর গল্প।

পকোড়ায় কামড় দিয়ে আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে জীশান বলছেন, " তখন আমি বাইশতেইশের জোয়ান, সবে পাশ করে বেরিয়েছি, সামনে পৃথিবীটা পড়ে আছে যেন এক রহস্যময়ী রাজকুমারী, ধরা দিতে দিতেও দেয় না, জাগনডাঙা ভাঙনডাঙা পার করে জুড়নপুর পার করে কোথায় কোন্ রহস্যময় রাত্রিনগরীর দিকে টেনে নিয়ে যায়, পথের মাঝ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় কোনো ঈশারা না রেখে। এবারে বার করো খুঁজে কতো খুঁজবে। জানি সে আছে কোথাও সেই রহস্যপুরীর মধ্যে, আমার গিয়ে তার ঘুমভাঙাবার অপেক্ষা, কিন্তু সে বড়ো সোজা নয়। তবু কিন্তু আমার তাতে আরো বেশী আনন্দ হতো, দিনগুলো মনে হতো কী আশ্চর্য সব সম্ভাবনায় ভরা, কী যে সম্ভব আর কি যে অসম্ভব তার মধ্যের কোনো ভাগরেখা চোখে পড়তো না। "

আমরা বিস্ময়ে চোখগুলো এতখানি করে ডক্টর জীশানের গল্প শুনছি, এমন কবির মতন করে যে উনি গল্প বলতে পারেন, তা কে জানতো!

"ফিল্ডওয়ার্ক করতে আমাদের দল সেবার গেছে দক্ষিণ মহাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে, সে এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা, তোমাদের মধ্যে যারা গেছো তারা তো জানোই। সেসময় যেন আরো সুন্দর ছিলো, তাছাড়া তখন আমাদের নবীন চোখ, যা দেখি তাই এমনির চেয়ে বেশী সুন্দর লাগে। বেশ অনেকগুলো অতি সুন্দর হ্রদ সে অঞ্চলে, নানা উচ্চতায়, একেবারে সমুদ্রসমতল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ক্রমোচ্চ উপত্যকায় উপত্যকায় হ্রদগুলো। মাঝামাঝি উচ্চতার এক হ্রদের তীরে অতি সুন্দর বনভূমিতে আমাদের তাঁবু পড়লো।

দলে আমরা নিজেরা দশজন, দুজন বাদে সকলেই আমরা সহপাঠী, ঐ দুজন আমাদের সঙ্গে সদ্য যোগ দিয়েছিল দক্ষিণ মহাদেশ থেকে এসে, ওরাও সদ্য পাশ করে এসেছে সেখান থেকে। আমাদের ভাষা শিখে নিতে একটু অসুবিধে ওদের হচ্ছিলো, আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করছিলাম, ভাষার প্রতিবন্ধক সত্বেও সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো।

তাঁবুটাবু গাঁড়া হয়ে গেলে পরেরদিনের কাজ শুরুর জন্য আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে রাখছি, সেই দুজন বললো এই অঞ্চলে একটি পরিত্যক্ত নগরী আছে, গভীর বনের ভিতর লুকানো। খুব কম লোকে জানে তার কথা। তবে কেউই জানেনা সেই নগরী কাদের ছিলো, কেন পরিত্যক্ত হলো আর কবে পরিত্যক্ত হলো। আমরা তো শুনে লাফিয়ে উঠি, বলো কী? তোমরা জানো নাকি সেই রহস্যনগরী কোথায়?

তারা আমাদের উত্তেজনা দেখে হাসে, ওরা জানে, গেছেও দু'দুবার। ওদের খুব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে দুইবারেই। তবে সেসব বেশ কিছুকাল আগের কথা, তখন ওরা বছর সতেরোর ছোকরাছুকরি, সে বয়েসে অজানার প্রতি টান থাকে তাই সামান্য সামান্য যোগসূত্র অনুসরন করে করেই গিয়ে পৌঁছেছিলো সেখানে, রাত্রি হয়ে যাওয়ায় থেকেও গেছিলো, পরদিন ফিরে আসে।

বলতে বলতে লিও আর ইরিনা হাসছিলো, ওখানে যাওয়া আর রাত কাটানো ওদের জীবনের মধ্যে ও যোগসূত্র তৈরী করে দিয়েছিলো। বিয়ের পরেও ওরা তাই ওখানে আবার গেছিলো, এক রাত্রি আবার থাকতে। ওদের কাছে আমরা এসব শুনে অধীর, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো যে আমরা পরদিন সকালেই রওনা হবো সেই জনহীন পরিত্যক্ত নগরী দেখতে। "

আমাদের চোখ ইয়া বড় করে খোলা, জোরে জোরে শ্বাস নিই, উৎকর্ণ হয়ে বলি, "তারপর কী হলো?"

ড: জীশান হাসেন, কফির কাপে চুমুক দেন, একটা পকোড়া তুলে নিয়ে আয়েস করে পকোড়ায় কামড় দেন। আমরা কৌতূহলে প্রায় ফেটে পড়ছি ততক্ষণে। পকোড়া খাওয়া শেষ করে উনি আবার বলতে থাকেন, " তারপরে যা ভাবা সেই কাজ। আমরা তাঁবুতাঁবা গুটিয়ে জিনিসপত্র বেঁধেছেদে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সেই রহস্যনগরীর দিকে। ভেবে দ্যাখো, সেই দুজন বন্ধু ছাড়া আর কারুর কোনো ধারণাই নেই কোথায় সেই নগরী বা আদৌ আছে কিনা এমন কিছু। তারা দু'জন যে আমাদের টোপ দিয়ে বিপদের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তবু আমাদের কারুর মনেই কোনো বাধোবাধো ঠেকলো না, অনায়াসে আমরা চললাম। আহা, কী সব দিন ছিল!" উনি থেমে আবার কফির কাপে চুমুক দেন।

আমি থাকতে পারি না, " তারপর?"

" তারপরে আমরা সারাদিন পথ চলি, কোথাও বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে শুঁড়িপথ, বড় বড় শক্ত শক্ত লতা ঝুলছে গাছ থেকে, দড়ির মতন মোটা। কখনো ঝোপঝাড় এত ঘন যে একপা এগোবার সাধ্য নেই, যন্ত্র দিয়ে ঝোপঝাড় কেটে ফেলে তবে এগোনো যায়। তারপর আছে সাপের ভয়, বুনো জন্তুজানোয়ারের ভয়। বেশ কয়েকজনের উৎসাহ তখন কমে আসতে শুরু করেছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে তারা সন্দেহও প্রকাশ করতে শুরু করেছে যে ব্যাপারটা ধোঁকাবাজি ও হতে পারে। আমারও তখন কেমন কেমন লাগতে শুরু করেছে। কেবল লিও আর ইরিনা নির্বিকার, একইরকম হাসিখুশী। ওরা বলে যে জায়গাটা বেশ দূর, গিয়ে পৌঁছাতে বিকাল পার হয়ে সন্ধ্যা হবে। দুপুরে লাঞ্চের জন্য থামা হলো। ছোটো এক নদীর ধারে মস্ত এক গাছের ছায়ায় বসে খাবারদাবারের বাক্সগুলো খোলা হলো। গরম করতে গেলে আগুনটাগুন জ্বালার হ্যাপা আছে, তাই ঠান্ডা খাবারই খাওয়া শুরু হলো, এত পরিশ্রমে সকলের খিদে যা পেয়েছিল সে আর বলার না! সেই খিদের গুণেই সব খাবার খুব ভালো লাগলো।

খেয়েদয়ে আর দেরি নয়, চটপট জিনিসপত্র বেঁধেছেদে আবার চলা। কখনো লতাপাতা গাছগাছড়া কেটে কোনোরকমে বানানো শুঁড়িপথে প্রায় হামাগুঁড়ি দিয়ে চলা। কখনো জলাজমিনে হাঁফ ধরা গুমোট, শত শত কীটপতঙ্গ ছেঁকে ধরে তাদের রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীদের, সেসব তাড়িয়ে চলা। কখনো সমতল ছেড়ে পাহাড়ী জমিন উঠে গেছে উপরে, সেই কঠিন চড়াই ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠা।

লিও আর ইরিনা আমাদের আগে আগে চলেছে। ক্লান্তি সত্ত্বেও এখন আর কেউ ফিরে যাবার কথা বলছে না। লিও আর ইরিনা যেন তাদের অদম্য উৎসাহের দড়িতে বেঁধে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সম্মোহিতের মতন আমরা এগোচ্ছি।

শেষ বিকালে একটা জংলা জায়গা পার হয়ে একটা খোলা মাঠের মতন দেখা দিলো। মাঠের অন্যধারে নীলাভ সবুজ এক পাহাড়। সেই পাহাড়ে এসে পড়েছে বেলাশেষের আলো। ভারী মনোরম দৃশ্য। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে এসে দেখতে পাওয়া গেল সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা সিঁড়ি।

(চলবে মনে হয় হাসি )


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

নাহ, আপনার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে আর কিচ্ছু বলবো না মন খারাপ

কিন্তু দিদি, সুতো যে একের পর এক ছেড়েই চলেছেন, এখন তো লেজমুড়ো খুঁজে বের করা সমস্যা...

তুলিরেখা এর ছবি

আহা ভাই সুতো কেন? এগুলো চাউমিং, নুডলস, স্প্যাঘেটী। হাসি অবরে সবরে খিদে পেলে খানিক জল দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে সস দিয়ে মেরে দেয়া যায়। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ami bangali এর ছবি

চালিয়ে জান। লেখাটা ভাল হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ ভায়া। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

যেন কৈশোরবেলায় ফিরে গেলাম পড়তে পড়তে। খাইছে চলুক। হাসি

মুস্তাফিজ এর ছবি

কুটুমবাড়ি কী জিশান হয়ে গেলেন?

...........................
Every Picture Tells a Story

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

না, লিউ

মুস্তাফিজ এর ছবি

গল্প পছন্দ হয়েছে। চালিয়ে যান।

...........................
Every Picture Tells a Story

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

কুটুমবাড়ি, কৈশোরে ফিরে গেলেন? জিভ কাটেন ক্যা? দুষ্ট ছিলেন নাকি???? চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

কিন্তু তারপর কী হলো?

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

আচ্ছা, প্রথমে লগ ইন না করেই মন্তব্য করে ফেলছিলাম ... খাইছে

কিন্তু, তারপর কী হলো??

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

তুলিরেখা এর ছবি

সিঙ্গেল নাই হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

এইডা কি হইলো দিদি? মাঝখানে ঝুলায়া রাখলেন? খেলুম না। তাড়াতাড়ি পোষ্ট দেন। গল্পটা ভালো লাগতেছে, একের পর এক প্যাঁচ।

তুলিরেখা এর ছবি

এ আর কী প্যাঁচ দেখলেন? এরপরে ভুত আইবো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি1 এর ছবি

তাপ্পর তাপ্পর চিন্তিত এমন জায়গায় এসে ব্রেক কষতে আছে?

তুলিরেখা এর ছবি

কইলেই হইলো? আহা বেরেক না কইষা যাই কই? যাওয়ার সিঙ্গেল নাই তো! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ভালো লেগেছে তুলিআপু। হাসি

রিসার্চকর্ম জটিল কর্ম,
করিলো ঝাঝরা চিত্ত-মর্ম।।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

হাসিব এর ছবি
কৌস্তুভ এর ছবি

এতগুলো সিরিজ আধখাপচা করে ছেড়ে রাখার জন্য আপনার তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হবে... আর জরিমানা হিসাবে সবাইকে মুর্গ মুসল্লম খাওয়াতে হবে। এসব থেকে বাঁচতে চাইলে জলদি পরের পর্বগুলো দ্যান।

তুলিরেখা এর ছবি

তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাসির ঘোষণা হবার সাথে সাথেই দেখবেন আমি ফুড়ুৎ! তিব্বতে! সেই ডায়মন্ডহারবার রাণাঘাট তিব্বত! সিধে রাস্তা সোয়া ঘন্টার পথ! সেখানে দেখবেন বইসা বইসা তিব্বতী মোরগপোলাউ খাইতাছি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বুড়ো হয়েও খোকার ঔৎসুক্য নিয়ে লেখাটি পড়লাম। মাথায় প্যাঁচ লাগাতে ভালোই হলো, মেয়েকে বলবো মাথার পাকা চুল বেছে দেবার সময় প্যাচগুলোও একটু খুলে দিতে। লেখা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে যাক। ভালো থাকবেন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তুলিরেখা এর ছবি

প্যাঁচ লেগেছে তো খোলারই জন্য। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মেহবুবা জুবায়ের এর ছবি

দুর! এইখানে থামলা?

--------------------------------------------------------------------------------

তুলিরেখা এর ছবি

থামি নাই, বিরতি নিছি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।