ইস্কুলবেলার গল্প করা হয় না কতদিন! সেই যে কিন্ডারগার্টেনের ঘর জুড়ে বিছানাপাতা ক্লাস, দুপুরের টিফিন আর খেলার পরে ঘুমের ক্লাস, এই গল্প করতে করতে হাত থেকে সুতো উড়ে গেছে বাতাসে। সেই সুতোটায় আটকানো লালনীল ঘুড়িগুলো এখন ভেসে বেড়াচ্ছে ছুটির বিকেলের আকাশে। এখন কী করে নামাই তাদের, এতখানি শূন্য পাড়ি দিয়ে কেমন করে ধরে আনি?
কিন্ডারগার্টেনের দুটো বছর কেমন ফুরফুর করে কেটে গেল। কত গল্প কত খেলা আর আর তার সাথে কিছু লেখা আর পড়া। কিন্ডারগার্টেনে দিব্যি আমরা বাংলা অঙ্কের সঙ্গে ইংরেজীও শিখতাম । কী সুন্দর বাংলা- ইংরেজী মেশানো মজার ছড়া আর ছবিওয়ালা বই ছিলো, মজা করে করে শেখা হতো কাকে কী বলে। একটা ছবি মনে পড়ে, এক চালাক বানর বসে আছে ঘোড়ার পিঠে, সামনে এক গাধা, বানর তাকে বলছে সে বনে যাচ্ছে মধু খেতে, গাধাও যেন যায়।
"Donkey কে কহিছে Monkey
এসো মোর সনে,
Pony চেপে Honey খেতে
যাবো আমি বনে।"
সুন্দর সব রঙীন পরিপাটী ছবিওয়ালা বই, যত্ন করে পড়ান দিদিমণিরা, ধৈর্য ধরে শেখান মায়ের মতন স্নেহে ও যত্নে। শিশুদের শিখতে আর কী লাগে?
তারপরে ক্লাস ওয়ান থেকে সব বদলে গেল, ক্লাসে কেঠো কেঠো বেঞ্চ পাতা, ইংরেজী বাদ। বাকী যা সব পড়া হবে তার জন্য সরকারী বই আসে, সেই বই সেলাই খুলে লড়লড় করছে, কোনো কোনোটা ময়লা আর ছেড়া, সবচেয়ে খারাপ হলো বই ভর্তি পেন্সিলের লেখা, আগেকার ছাত্রগণের শূন্যস্থান পূরণ বা প্রশ্নের উত্তর এইসব। সেগুলো ইরেজার দিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে হয়। সারা ক্লাসে শুরুর দিকে কেবল বই মোছাই হয়। আর সবচেয়ে দুঃখদায়ক হলো দিদিমণিরা একেবারেই সেই কেজি ক্লাসের শিক্ষাব্রতী দিদিমণিদের মতন না। দায়সারা পড়ানো। কিন্ডারগার্টেনের পরে ঠিক যেন গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে একেবারে মিলিটারি সরকারে এসে পড়লাম আমরা।
বইগুলোও সব কেমন যেন, ছবি নেই রঙ নেই। সহজপাঠ বলে যে বাংলা বই সেই বইয়ে অদ্ভুত হিজিবিজি টাইপ ছবি সব, একটুও মন টানে না, ইচ্ছেই করে না একবারের বেশী দু'বার ওগুলো খুলতে। গল্প ছড়া সবই কেমন একটা অচেনারকমের আড়ষ্ট। সরকারী অঙ্কের বই নবগণিত মুকুল, সেও ভালো লাগে না। এইসবই হয়তো ভালো লাগতে পারতো যদি শিক্ষিকারা একটু কল্পনা একটু সৃষ্টিশীলতা দিয়ে ক্লাসগুলো উপভোগ্য করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দুঃখের কথা সেরকম কিছুই দেখা গেল না।
এদিকে আবার ওদিক নেই সেদিক আছে দিদিমণিদের, একেক জন দিদিমণির ছেলে বা মেয়ে ও সেসময় পড়ত আমাদের সাথে, তারা তো দিব্যি বাকী দিদিমণিদের ফেভারিট। নিজের মায়ের কাছে পরীক্ষা দিলে তো অবশ্যই পঞ্চাশে পঞ্চাশ বা একশোতে একশো। সে নাহয় হলো, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই নিজের বাবার কাছে ( যদিও যুধিষ্ঠির জানতো না যে প্রশ্নকারী ওর বাবা, যক্ষ বা বক রূপে ধর্ম ছিলেন হ্রদের তীরে ) মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ১০০ তে ১০০ পেয়ে গেল, আর আমরা তো সামান্য মনুষ্য। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ট্রীটমেন্টটাই খারাপ লাগতো, ছোটোরা এসব বুঝতে পারে না তা তো না, বরং ছোটোবেলা এসব জিনিস আরো বেশী ভালো করে বোঝা যায়।
এভাবে গেল আরো দুটো বছর, তারপরে ক্লাস থ্রীতে দেখা পেলাম আশ্চর্য সেই মায়াভরা চোখের দিদিমণির। মানুষই যে ম্যাজিক করতে পারে, যন্ত্রপাতি বইপত্তর টাকাকড়ি এসব যে বস্তুমাত্র, সেই ধারণা সারাজীবনের মত আমার হলো ক্লাস থ্রীর ক্লাস-টিচার এই দিদিমণির জন্য। মানুষের প্রেরণাই জাগিয়ে তুলতে পারে স্ফুটনোন্মুখ মনের কলিগুলিকে। ওনার হয়তো আজ সেসব কিছুই মনে নেই। উনি জানতেনও না ছোট্টো একটা মেয়ে প্রত্যেকটা দিন সকালে চোখ মেলেই মনে করতো তার মুখ, ইস্কুলে গেলেই তার দেখা পাবে সেটা ভেবেই খুশি খুশি লাগতো সেই মেয়ের।
তখন সহজপাঠের ঝামেলাও আর ছিলো না, কিশলয়ের বাংলা গল্প আর ছড়া/কবিতা, নবগণিতমুকুলের অঙ্ক, আর বাকী বাড়তি যা কিছু, সব তার ভালো লাগতে থাকলো কেবল দিদিমণির পড়ানো ভেবেই, এমন সুন্দর ছিলো তার পড়ানো। সেই দিদিমণিই তার প্রথম গুরু। যিনি জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দিয়ে মনের চোখ খুলে দেন তিনিই তো গুরু। পরের পর্বে এই দিদিমণিকে নিয়ে আরো কথা হবে।
( সম্ভবতঃ চলবে )
মন্তব্য
আমি! পছন্দনীয় ব্যাটায় ডিনারের নেমন্তন্নে গেছে শুনলাম... যাও যাও বাপু, আঙুলই চাটো, বুড়ো আঙুল!
এঃ, সরকারি বইগুলোর সেই বেজুত হাল... ঠিক্কইছেন!
সেই ম্যাডাম যেমন পড়াতেন, তেমনি করেই আপনি এখন পড়ান তো?
ছন্দ নিমন্তন্নে গেছে? হি হি
আহা, সেই ম্যাডামের ব্যাপার এপিক লেভেলের, আমি সামান্য মানুষ।
কিন্তু সরকারী দুঃখ তুমিও পেয়েছিলে নাকি?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সে আর বলতে! নার্সারির কথা কিছু মনে নেই, তারপর চার বছর পড়লাম পাশের পাড়ার ছোট্ট পেরাইভেট ইস্কুলে, ইংলিশ মিডিয়াম। সেখান থেকে গেলাম কলকেতার নামী সরকারি ইস্কুল, হেয়ার স্কুলে। তা তখন বাংলা মিডিয়াম ইস্কুলে বামফ্রন্ট সরকার ক্লাস ফাইভে ইংরাজি শেখানো শুরু করাতেন, আমাকে আবার নতুন করে এবিসিডি-তে পেন্সিল বোলানো শেখাতে লাগলেন ম্যডামেরা। আমি তো হেসেই বাঁচি না!
আরে তুমি আর কত হেসেছ? কবরে পাশ ফিরে শুয়ে হেসে কুটিপাটি হয়ে গেছেন ডেভিড হেয়ার সাহেব!
তবে চারটে বছর পেরাইভেটে পড়ে রক্ষা পেয়ে গেছ সেই সরকারী সহজপাঠ আর রবার ঘষে ধাতস্থ করা নবগণিতমুকুল থেকে।
কিন্তু হেয়ারে ম্যাডাম কী করে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সহজপাঠ, নবগণিতমুকুল তো আমিও পড়েছি...
প্রাথমিকে তো ম্যাডামই বেশি থাকতেন, ছেলেদের ইস্কুলেও!
বাহ! নিজেরা নিজেরা খুব আড্ডা হচ্ছে দেখি!
এমন জম্পেশ লেখাটা চট করেই শেষ হয়ে গেল?
আরেকটা কথা - ছবি ছাড়া বই আমারো বিচ্ছিরি লাগে।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
কেন, আপনিও আসেন না, আড্ডা দেন।
আচ্ছা, সহজপাঠের ছবিগুলো কি নন্দলাল বসুর আঁকা? (প্রশ্নটা যে আপনাকেই করলাম তা নয়, তবে আপনার কথায় মনে হল)
হ্যাঁ, ওগুলো নন্দলাল বসুরই আঁকা।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আবার রাত দুটোয় পোস্ট ! অনেকগুলো বড় বড় দীর্ঘশ্বাস আগে ফেলে নি...
লেখা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম এরকম স্বপ্নের মত কিন্ডারগার্টেন কোথায় পাওয়া যায় ? আমি তো পাইনি।
আরেকটা কথা না বললেই নয়, কালো কালো অক্ষরে সোনালি মায়া জড়িয়ে মিশিয়ে কিকরে লিখতে হয় তা কেউ আপনার লেখা দেখে শিখতেই পারে।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আরে আমার এখানে তো তোমার রাত দু'টায় ফটফটা রোদ, দিনের বেলা। পৃথিবীটা গোল কিনা!
আর, কিন্ডারগার্টেনের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় আমরা খুবই সৌভাগ্যের মধ্যে ছিলাম, ওরকম
আদর্শ শিশুশিক্ষা প্রধানত সম্ভব হয়েছিলো ঐ দু' তিনজন দিদিমণির জন্য। ওরকম শিক্ষিকা বিরল। অতটা কোয়ালিফিকেশন থাকতে যায়ও না অনেকে কিন্ডারগার্টেনে পড়াতে। ওনারা গেছিলেন, কারণ অর্থ বা সামাজিক স্নবারির চেয়ে ওনারা কাজটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কাজটাকে ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালে স্কুল ম্যাগাজিনে ওনাদের লেখা পড়ে আরো ভালো করে সেটা বুঝতে পারি। বইপত্র ওনারা যা সিলেক্ট করতেন, খুব ভালো চয়েজ ছিলো। আলাদা করে খবরও নিতেন কে কেমন শিখছে।
কালো অক্ষরে সোনালি মায়া শুনে টুনে একদম কান বেগুণী হয়ে গেল।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
শেষটা আপনিও আমার বিপক্ষে গেলেন দিদি... বেছে বেছে যেদিন আমি থাকি না সেদিনই ইস্কুলবেলা বা উপকথার পোস্ট...
(তবে কবজি ডুবিয়ে খেয়েছি, কৌস্তুভের কপালে তো তা জোটে নি - পোলাও, টুনা মাছের কোপ্তা, ভেড়ার ঝাল ঝাল রেজালা, মুরগীর কী যেন একটা, মিষ্টি মিষ্টি করে রাঁধা চিংড়ি, চমৎকার দু'খানা পিঠে, পায়েস, গাজরের হালুয়া, দারুণ একখানা সব্জী... )
দ্যাখেন তুলিদি, এর পরেও যদি পোলাটাকে সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসাবে আলুকাবলি দইবড়া এসব দিতে যান, তাহলে কিন্তু হরতাল ডাকুম কইলাম!
আজকে ওকে কীসের পুরস্কার? আজকে তো সেই আমাদের খাওয়াবে! নোট করে রাখো, ধরতে পারলেই ভালো দেখে কোনো মিশরীয় রেস্টুরেন্টে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার জরিমানা আগে আদায় শেষ করি, তারপরে নাহয় খাওয়ানো যাবে...
দিদিমণিরা মাইর দেয় নাই?
...........................
Every Picture Tells a Story
কিন্ডারগার্টেনের দিদিমণিরা একেবারেই মারধোর করতেন না। তবে প্রাইমারিতে দেখতাম দুষ্টু ছেলেমেয়েদের মারধোরের সিস্টেম ছিলো। তবে সেটাও নির্ভর করতো দিদিমণির নিজের উপর। কেউ কেউ শুধু বকতেন, তাতেই কাজ হতো। কেউ কেউ মারতেন, কাজ কিসুই হতো না। আসলে ব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ, সকলেই গুরু বা শিক্ষক হতে পারেন না, সেটা সাধনার ব্যাপার।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় একটা open অনুরোধ। পশ্চিমবঙ্গের স্কুল পর্যায়ের বাংলা সাহিত্যের বই আর ইতিহাসের বই খুঁজছি - একেবারেই ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে। কারো কোনো লিঙ্ক জানা থাকলে একটু জানাবেন। কেন্দ্রে বা রাজ্যে সরকার পাল্টানোর সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের বইয়ের কনটেন্ট পালটে যায় কিনা সেটাও জানতে আগ্রহী।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ পান্ডব। আমিও সন্ধান নেবো, ব্যক্তিগতভাবে বন্ধু পরিজনদের কাছ থেকে ( বন্ধুদের অনেকে এখন ওখানে স্কুলে পড়ায়, সম্প্রতি ফেসবুকে আবার যোগাযোগ হয়েছে ) আর অনলাইনেও।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
স্কুলবেলার গল্পগুলো খুব ভালো লাগে তুলিদি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও খুব মধুর, আপনার লিখাগুলো আমাকে ও সেই স্কুল বেলায় নিয়ে যায়।
ধন্যবাদ বন্দনা। আপনিও লিখতে শুরু করে দিন সেসব, খুব ভালো হবে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার সব ভাল খালি কম কম লেখেন এইটা খারাপ এই লেখা এইখানে শেষ করার কোন মানে হয়!? ;->আপনর সব ভল খলি কম কম লেখেন এইট খরপ এই লেখ এইখনে শেষ করর কোন মনে হয়!? ;->
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
মর্ম, লেখা শেষ না তো! এ তো ধারাবাহিক।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
থ্যাংকু।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন