কওমী মাদ্রাসায় আমার কয়েকটা দিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৮/০২/২০১১ - ১১:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার কওমী মাদ্রাসায় পড়ার অভিজ্ঞতা আপনাদের শোনাই। এইটা অবশ্য অনেক আগের কথা। কওমী মাদ্রাসায় ক'দিন পড়েই সেখানকার পাট চুকিয়ে ফেরত আসি স্কুলে। তখন অনেক ছোট ছিলাম বলে সবকিছু বুঝতে শিখিনি। কিন্তু এখন মনে হয় এইটা খুব মূল্যবান একটা অভিজ্ঞতা ছিল, যা আমাকে সমাজের একটা অংশকে ভালোভাবে চিনতে শিখিয়েছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে জঙ্গী বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ না, কিছু অসহায়, নিগৃহীত মানুষকে দেখি।

আমার গল্পের শুরু অনেক আগে। আমার দাদী প্রচন্ড ধার্মিক ছিলেন। আমাকে খুব আদর করতেন। ভালোবাসা বা ধর্মীয়, কিংবা আমার আগের বোনটার মরে যাওয়া, যে কারনেই হোক আমাকে হাফেয বানানোর মানত করলেন। আমার জন্মের পর দাদী বেচেছিলেন খুব কম। কিন্তু সেই মানত পুরো করতেই আমার কওমী মাদ্রাসায় যাওয়া।

বাবা-মা চাইছিলেন আমি অন্তত স্কুলের কিছু পড়া শিখি। হাফেযি শেষ করে যেন স্কুলে ফিরে আসতে পারি। তাই প্রথমে স্কুলেই ভর্তি হলাম। আমার বড় ভাই আবার ফি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হত। সেই পরিবারের ছেলে আমি, নিশ্চয়ই ভালো করব - টিচারদের এমনই ধারনা ছিল। আমি ফার্স্ট হতাম না, কিন্তু খুব একটা খারাপও হতো না রেজাল্ট। ক্লাস ফাইভে ওঠার পর বাবা-মা ভাবলেন আমি এখন একা থাকার মত বড় হয়েছি, তাই আমাকে মাদ্রাসায় দেয়া হলো। চট্টগ্রামের একটা কওমী মাদ্রাসায় একদিন বাবার সাথে আমি গিয়ে হাজির হলাম। আমার সাথে একটা চাটাই, তোষক, বালিশ, কুরআন শরীফ, একটা কাঠের রেহাল আর একটা ছোট ট্রাঙ্কে বাকি সব জিনিষ।

আমার জায়গা হলো মাদ্রাসার দোতলায়। বিশাল বড় রুমের একপাশে একটা বিছানা, হুজুরের জন্য। আর বাকিটা জুড়ে সারি সারি চাটাই বিছানো, একেকটা একেক জনের বিছানা। আমার জায়গা হলো হুজুরের বিছানার কাছাকাছি একটা জায়গায়। আমি নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য হুজুর আমার একজন সঙ্গী বা মেনটর টাইপের একজনকে ঠিক করে দিলেন। মাদ্রাসায় খাবারের আয়োজন হতো দু'বেলা - দুপুরে আর রাতে। কিছু ছাত্র যারা খুব গরীব তারা ফ্রি খেতো, ওইটাকে বলা হতো লিল্লাহ বোর্ডিং। আর একরকম ছিল যারা মাসে ২০০ না ৩০০ টাকা দিতো। লিল্লাহ বোর্ডিং আর তাদের খাবার একই ছিল। আর অল্প ক'জন তারা স্পেশাল মেনুর জন্য ৪৫০ টাকা দিতো মাসে। আমি ছিলাম এই দলে। আমাদের খাবার একই ছিল, ডিম ভাজি বাড়তি ছিল যতদুর মনে পরে। কমন ছিল ঝোল করে রান্না করা সবজি আর শুটকী মাছ ওয়ালা প্রচন্ড ঝাল টকটকে লাল হয়ে থাকা একটা তরকারি। হুজুরদের খাবার ছিল স্পেশাল মেনুর মতই।

মাদ্রাসায় আরো অনেকগুলো রুমে বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্ররা থাকতো। অনেক ছোট বাচ্চাও ছিল। আমার রুমেই একটা ছেলে ছিল যার পাগড়ি পাওয়ার কথা ছিল সে বছরই। পাগড়ি পড়িয়ে দেয়াটা হচ্ছে অনেকটা কনভোকেশন করে গ্র্যাজুয়েশনের মত। ও এসেছিল খুব ছোট থাকতে। ওর মা মরার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করল। সংসারে ওর জায়গা হলো না। আমার সঙ্গী ছিল যেই ছেলেটা, ওর নাম একদম মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ে ওর সাথে খুব ভালো সময় কাটতো। আরো অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। একটা ছেলে অনেক বছর লাগছিল শেষ করতে, ওর নাকি সমস্যা ছিল ও বাসায় গেলে টিভি দেখে।

মাদ্রাসায় রুটিন ছিল যতটা মনে পড়ে এইরকম। ফজরের আগে উঠতে হবে। অজু-ইস্তেনজা (টয়লেট) সেরে মসজিদে নামাজে যেতে হবে। নামাজ সেরে পড়তে বসা। সকাল ৭ টা পর্যন্ত। এরপর নাস্তা। সবাই, হুজুরও, আগের রাতের পান্তা ভাত খেয়ে নাস্তা সারতেন। আমি অবশ্য দোকান থেকে পরোটা বা নান এনে খেতাম। এরপর আবার পড়া, সকাল ১০/১১ টা পর্যন্ত। তারপর হচ্ছে ১ ঘন্টা বাধ্যতামুলক ঘুম। ঘুম না এলেও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে হবে। এরপর আমরা পুকুরে গোসল করতে যেতাম সবাই মিলে। আমি সাতার জানতাম না, তাই কিনারেই ঘুরাঘুরি করতাম। অনেক হই হল্লা করে ফেরত আসতাম। দুপুরের খাবারটা জোহরের আগেই ছিল মনে হয়। জোহরের থেকে আসর পর্যন্ত পড়াশোনা। বিকেলটা ছিল খুব ভালো। আমরা একটু দুরের একটা মাঠে খেলতে যেতাম। খেলার সরন্জাম তেমন কিছু ছিল না। যতদুর মনে পড়ে একটা টেনিস বল ছিল, তাই দিয়ে বোমবাস্টিং খেলেছিলাম একবার। সন্ধ্যের আগেই অবশ্য ফিরতে হতো।

সন্ধ্যের পরের সময়টাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে খারাপ। (ক্রমশ)

আতিক
atiq(ডট)atiq_atiq(ডট)yahoo(ডট)com


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায়..........

সাফি এর ছবি

লেখাটা আরেকটু বড় হলেও পারতো। বেশ আগ্রহ জাগানিয়া বিষয়।

সচলে স্বাগতম

অতিথি লেখক এর ছবি

সময়ের একটু স্বল্পতা ছিল, সেজন‌্যই একটু ছোট হল। তবে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াবার চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ।

-আতিক

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব তাড়াতাড়িই পরের পর্ব দেয়ার চেষ্টা করব।
-আতিক

তাসনীম এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা পড়তে বসে খেয়াল করলাম, মাদ্রাসায় পড়ার অভিজ্ঞতা আগে কখনও শুনিনি। পরের কিস্তি দিতে দেরী করেন না। -রু

কৌস্তুভ এর ছবি

হুমম, চালান আপনার সিরিজ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে, চালিয়ে যান। কালই বাকিটুকু লিখে ফেলুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

স্মৃতিচারণ ভালো লেগেছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

-অতীত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যদি ভুল জেনে না থাকি তাহলে বছর তিনেক আলিয়া মাদ্রাসায় পড়া একজন সচল আছেন। আপনার লেখাটা তার চোখে পড়লে তার মন্তব্য আশা করছি। তাহলে আপনার অভিজ্ঞতার সাথে তার অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দুই ধরনের মাদ্রাসার ভেতরকার পার্থক্যটা বোঝা যেতো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায়

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি সন্ধ্যা এর ছবি

একেবারেই অজানা একটি বিষয় নিয়ে লেখা, অভিনন্দন।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পর্বটা আরেকটু বড় হলে ভালো হতো। তবে আপনি যে মানতের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছেন সেজন্য অভিনন্দন। মাদ্রাসায় পড়ানোর মানত করে কিছু বাবামা সন্তানের ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়েছে সেরকম কিছু সন্তানকে প্রত্যক্ষ্য করার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার।

পরের পর্বে আরো বিস্তারিত শোনার অপেক্ষায়? কোন মাদ্রাসায় পড়েছিলেন? হাটহাজারী না জিরি?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সামনে বসে গল্প শোনার মতো সহজ আপনার বলার ভঙ্গি। ভালো লাগছে পড়তে...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

লিখুন। ভাল লাগছে পড়তে।

নাশতারান এর ছবি

সচলে স্বাগতম!

লেখার ভঙ্গি পছন্দ হয়েছে, বিষয়ও ইন্টারেস্টিং। পরের পর্ব জলদি দেবেন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ভালো লেগেছে। পরের পর্ব ঝাড়েন তাড়াতাড়ি। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তিকর ধারণা আছে। আশাকরি আপনার লেখা থেকে কিছুটা হলেও ক্লিয়ার হওয়া যাবে। ধন্যবাদ।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি কিভাবে আবার স্কুলে ফিরে গেলেন সেটাত জানালেন না?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই শেষ করেন। অসাধারন!

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

খুব ভাল লেগেছে । লিখতে থাকুন ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

দ্বিতীয় পর্ব পোস্ট করেছি। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ - উৎসাহ দেয়ার জন্য, পরের পর্বের প্রতীক্ষায় থাকার জন্য।
-আতিক

দাদারাকিব এর ছবি

কওমী মাদ্রাসার জীবন সম্পকে আরও জ়ানার আগ্রহ যাগছে। পরের অংশ কবে পাব?

আলামিন এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন আপনি। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।