অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেক-২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৯/২০১৩ - ৬:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বঃ অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেক-১

(বিশেষ সতর্কীকরনঃ এটি বর্ননা সহ অসঃখ্য ছবিযুক্ত বৃহত পোষ্ট। নিজ দায়িত্বে পড়বেন আর বোর হবেন- অচিন পাখি)

পুনে হিলে জমজমাট ঠান্ডায় ধ্বলাগিরির দুর্দান্ত ভিউ দেখে আর ঠান্ডার সাথে কসরৎ করে ছবিটবি তুলে ফের ঘোড়েপানি ফিরে আসলাম। চটজলদি নাস্তা সেরে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে আবার যাত্রা, আজকের প্ল্যান তাদাপানি পর্যন্ত যাওয়া, মাঝখানে ছোট ছোট তিনটি গ্রাম পড়বে। পথ চলা তিন হাজার মিটারের অধিক উচু অসাধারন সুন্দর দিউরালী পাস দিয়ে। এক পাশে আকাশ ছোয়া পর্বতমালা, অন্য পাশে সবুজে ছাওয়া পাহাড়ী ঢাল নেমে গেছে কয়েক হাজার ফিট, এক অন্যভুবনের দৃশ্য। চারিদিক একদম বিরান ভুমি, জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই আশে পাশে। যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি ধ্বলাগিরি রেঞ্জ দূরে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, অন্নপুর্না কাছে আসছে। প্রকৃতি ও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিলো, ওকে আর রডোড্রেনডন বনে প্রবেশ করলাম। বনের চলার পথটা বেশ চড়াই উৎরাই হলেও আমরা মুলত নামছি। চলার গতি তাই দ্রুত। দুপুর নাগাদ এসে পৌছলাম ২৯০০ মিটার উচ্চতায় দিউরালী গ্রাম। গ্রাম বললে অবশ্য বেশী বলা হয়, তিন চারটি টি হাউস আর আর গরম কাপড় ও কিছু স্যুভেনিরের পসরা নিয়ে কয়েকটি দোকান। দ্রুত লাঞ্চ সেরে নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম, পথ অনেক বাকি এখনো। পথ গেছে একদম গভীর বনের মধ্যে দিয়ে। সুর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকেনা কোথাও কোথাও, এমন ঘন বন। কখনো কখনো শ খানেক ফুট নামছি, খানিক পরেই আবার উঠছি। চারপাশে রঙের বাহার ও চোখে পড়ার মতো। দুপাশের গিরিখাত সরু হতে হতে প্রায়ই আকাশ ঢেকে দিচ্ছিলো। সগর্জনে বয়ে চলা ফেনিল ঝর্নার শব্দ, পাখির কলতান, বানরের দলের এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফা লাফি, পাতায় পাতায় রঙের মেলা, হঠাৎ হঠাৎ গাছ গাছালির ফাক দিয়ে তুষারাবৃত পর্বতমালার উকি দিয়েই মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে অসাধারন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলেও বনের কোন শেষ দেখা যাচ্ছিলনা। ঠান্ডাও বাড়ছে ধীরে ধীরে, গাইডের পরামর্শ মত তাই তাদাপানি পৌছানোর চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে কোথাও রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত হলো।

১। দিউরালী পাসে আমি ও আমার সহযাত্রী (পেছনে ধ্বলাগিরি)-
ABC Trek_Oct-Nov2012 521E
P1090015
২। দিউরালী পাস-
P1090024
৩। প্লেন উড়ছে পায়ের নীচে
A small plane coming from Jomson flying below me . . .
৪। ওক আর পাইনের ফাকে এভাবেই উকি দিচ্ছিলো পর্বতশৃঙ্গ-
P1090070
P1090066
৫। ওক বনের ভিতর দিয়ে পথ চলা-
P1090050
৬। দিউরালী গ্রাম-
P1090071
P1090076
৭। আবার পথ চলা-
P1090088
P1090104
P1090102
P1090100
P1090149
৮। একটু বিশ্রাম-
P1090129
৯। বনের ভিতর রঙের খেলা-
P1090127
Forest with every color one can imagine . . .

সুয্যি মামা যখন ডুবি ডুবি তখন পৌছলাম সরু এক ট্রেইলের মাথায় অতলস্পর্শী খাদের পাশে ভুতুড়ে গ্রাম বানথাটি, একদম অন্নপুর্না সাউথ পিকের লাগোয়া। ৩১৮০ মিটার উচ্চতায় এই জায়গাটি কে গ্রাম বললে অতিরঞ্জিত হয়, একটি মাত্র টি হাউস, আর থাকার ব্যাবস্থাও খুব বেসিক। উচ্চতা আর অন্নপুর্না সাউথের একদম লাগোয়া হওয়াতেই বোধহয় জায়গাটি খুব ঠান্ডা, লজের মালকিন (সেখানে মহিলারাই মুলত ব্যাবসাপাতি পরিচালনা করে) জানালো শীতকালে ফুটখানেক বরফে ঢেকে যায় ট্রেইলটি। নিচে গভীর খাদ, ঘন বনে আচ্ছাদিত। বিবি (বলবাহাদুর, আমাদের গাইড) জানালো এই বনে বাঘ আছে, হিমালয়ান কালো ভালুক সহ আরো অনেক বন্যপ্রানী আছে। ভাগ্যিস বনের ভিতর দিয়ে পথ চলার সময় জানতাম না, দলছুট হয়ে অনেক সময়ই একা একা হেটেছি। পুরো লজে আমরা আর চীনের সাংহাই থেকে আসা এক চায়নিজ দম্পতি আর এই দু দলের গাইড পোর্টার ছাড়া আর কেউ নেই। বাকি ট্রেকাররা ইতিমধ্যে তাদাপানি পৌছে গেছে। রাতের খাবার সেরে ডাইনিং রুমে মাটির ফায়ারপ্লেসের আরামদায়ক উষ্ণতায় চাইনিজ দম্পতির সাথে আলাপ করার ব্যার্থ চেষ্টা হলো দু পক্ষ থেকেই। প্রায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বার্তা বলার মতো অবস্থা। ইয়েস, নো, ভেরি গুড ছাড়া আর কোন ইংরেজী শব্দ জানা নেই দুজনের কারোরই। যাই জিজ্ঞেস করি উত্তরে শুধু হাসি আর ইয়েস ইয়েস।

১০। বানথাটি-
P1090185
১১। চাইনিজ ট্রেকার দম্পতি-
P1090182
১২। বানথাটি থেকে গোধুলীর আলোয় অন্নপুর্না সাউথ পিক-
P1090210
১৩। দুর্দান্ত ক্লাইম্বার এই গ্রে লেঙ্গুরের দেখা পেলাম বানথাটিতে-
P1090237

ডিনার সেরে আটটার মধ্যে ঘুম। সারারাত হাওয়ার দাপাদাপি আর ফাক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়া ঠান্ডায় ভালো ঘুম হলনা। খুব ভোরে উঠে ব্রেকফাষ্ট সেরে চাইনিজ দম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার যাত্রা। ওরা যাবে ঘান্দরুক, এটি আরেকটি ট্রেকিং ডেষ্টিনেশন। এবার গভীর বনের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ নিচে নামা, খুব খাড়া ট্রেইল। ঘন্টাখানেক চলার পর ২৬৩০ মিটার উচ্চতায় তাদাপানি পৌছালাম। প্রায় ৫০০ মিটার মত নামা হয়েছে। তাদাপানি বেশ বড় সেটেলমেন্ট। অনেকগুলি টি হাউস রয়েছে এখানে। মান ও অনেক উন্নত। স্যুভেনির শপ, গ্রোসারি আর ফোনের দোকান ও আছে। সোলার প্যানেলে বিদ্যুতের ব্যাবস্থা আছে অধিকাংশ লজে। ২০০ রুপিতে হট শাওয়ারের ব্যাবস্থা আছে। আউটডোর এন্টেনা দিয়ে সিগন্যাল এম্পলিফাই করে ফোন করার ব্যাবস্থা। প্রতি মিনিট ১০০ রুপি। দু’জনেই বাসায় কথা বললাম, ভয়েস কোয়ালিটি খুবই পুওর, কোন রকমে জানাতে পারলাম ভালো আছি। তাদাপানি থেকে অন্নপুর্না রেঞ্জের একাংশের অসাধারন ক্লোজ ভিউ পাওয়া যায়। বিশ্রাম, ফটুক তোলা আর চারপাশের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করার জন্য অল্প কিছুক্ষন যাত্রাবিরতি। তারপর আবার পথ চলা। আরো প্রায় চারশ মিটার নামতে হবে, তবে বনের ভিতর দিয়ে নয়, পাহাড়ের গা বেয়ে সরু ট্রেইল ধরে। কিছুক্ষন চলার পর চুইলি নামে একটি চমৎকার উপত্যাকায় পৌছলাম। মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের মাথা কেউ যেন স্লাইস করে কেটে নিয়েছে। সামনে সবুজ পাহাড়ের পিছনে ফিশ টেইলের সুচালো চূড়া সকালের নরম রোদে ঝিকমিক করছে, উপত্যাকার ঢালে ধাপ কেটে যবের চাষ করা হয়েছে। পাকা যবের শিষ বাতাসে দুলছে আর সোনালী আভা ছড়াচ্ছে। উপত্যাকার ঢাল ক্রমশঃ নিচে নেমে খরস্রোতা মোদীখোলা নদীর সাথে মিশেছে। অদূরে পাহাড়ের গায়ে জলপ্রপাত দেখা যাচ্ছে। চুইলির মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিছুক্ষন থামতেই হলো, সঙ্গে ক্যান্ডি ব্রেক। চুইলি থেকে আবার উপরে উঠা, পথে পড়লো, এখানেই আবার দেখা হলো জাপানী দাদুদের দলটার সাথে। চমরং আর খুব বেশি দূরে নয়। গুরজুং পার হয়ে কিছুক্ষন পর বায়ে বাক নিতেই আমাদেরকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে অন্নপুর্না রেঞ্জের অনেক গুলো চূড়া ঝিকেয়ে উঠলো দল বেধে। মুগ্ধ হতে হতে রীতিমত ক্লান্ত আমরা। প্রকৃতি একেক বার একেক রকম বৈচিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে। অবশেষে যখন চমরং পৌছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা।

১৪। বানথাটি থেকে তাদাপানির পথে (গাছের ফাকে ফিশ টেইল)-
P1090138
১৫। চাইনিজদের সাথে আবার দেখা গভীর বনে (তাদাপানির পথে)-
P1090157
১৬। গিরিখাদের ভিতর দিয়ে পথ চলা (তাদাপানির পথে)-
P1090172
১৭। গভীর বনে পথ চলা (তাদাপানির পথে)-
P1090290
১৮। তাদাপানির দোকানিরা-
P1090253
১৯। চুইলি উপত্যাকা-
P1090303
২০। চুইলি থেকে মোদীখোলা নদী-
P1090302
২১। চুইলি উপত্যাকা-
P1090323
২২। চুইলি উপত্যাকা ঢালু হয়ে নেমে গেছে মোদীখোলা নদীতে-
P1090321
২৩। চুইলি থেকে চমরংয়ের পথে আমি-
ABC Trek_Oct-Nov2012 815n
ABC Trek_Oct-Nov2012 791

চমরং দুর্দান্ত জায়গা। চমৎকার সব টি-হাউস, দোকানপাট, বরফ ঢাকা চুড়াগুলোর ভুবন ভুলানো দৃশ্য, গভীর গিরিখাত, মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। অনেকে ফেদি থেকে শুধু চমরং পর্যন্ত ট্রেক করে ফিরে যায়। সবচেয়ে চমৎকার ভিউ পাওয়া যে লজ থেকে আমরা সেখানেই উঠলাম। অবশ্য সব গুলো লজ ই চমৎকার ভিউ দেয়, জায়গাটিই এমন। পুরো টি-হাউস গম গম করছে বিভিন্ন দেশের ট্রেকারে। নানা দেশের নানা ভাষার কিচিরমিচিরে জগাখিচুরি অবস্থা। ঢুকেই ডিনারের জন্য অর্ডার করে নিজেদের রুমে গিয়ে বিছানায় ঝাপিয়ে পড়লাম। রুমের সামনে টানা বারান্দা, সামনে সগর্বে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে ফিশ টেইল আর গ্লেসিয়ার ডোম আরেক পাশে অন্নপুর্না সাউথ পিক ও হিমচুলি। গিরিখাতে মাঝে মাঝেই ঘন মেঘ বাতাসের ধাক্কায় মোচড় খেতে খেতে হারিয়ে যাচ্ছে সামনে। ডিনারে আবার দেখা হলো এমিরেটস্‌ এর পাইলট রাজন দার সাথে। বেশ ভালো আড্ডা হলো। পরিচয় হলো মাতৃস্থানীয় এক সিঙ্গাপুরী ভদ্রমহিলার সাথে। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। ডিনারের পর বেশ জম্পেশ আড্ডা হলো তাঁর সাথে। একাই এসেছেন বেস ক্যাম্প ট্রেক করতে। সাউথ আমেরিকাতে আন্দিজ পর্বতমালায় ও ট্রেকিং করেছেন। ভাবলাম আমাদের দেশের কথা। এ বয়সে আমাদের মা বোন’রা দাদী নানী হয়ে যায় আর নাতী নাতনী সামলানোই বাকী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। আড্ডার এক পর্যায়ে আমাদের কে মাউন্টেন সিকনেসের ব্যাপারে অনেক উপদেশ দিলেন। যদিও আমরা এ ব্যাপারে তাত্ত্বিক ভাবে হাফেজ হয়ে গেছি দেশ থেকেই আর হিমালয়ান ট্রেকিংয়েও নতুন নই তবুও তাঁর আন্তরিকতা ছুয়ে গেলো। আইপ্যাড, ফোন, ক্যামেরা সব চার্জ দেয়া হলো ঘন্টাপ্রতি ঠিক মনে নেই, ষাট কি আশি রুপি হবে হয়তো। রাতে বেশ ভালো ঘুম হলো। আগের ব্যাবস্থাগুলোর তুলনায় রীতিমত ফাইভষ্টার হোটেলে আছি মনে হলো।

২৪। চমরং এ-
ABC Trek_Oct-Nov2012 882k
ABC Trek_Oct-Nov2012 885
২৫। চমরংয়ে টি-হাউস-
P1090873
২৬। আমাদের টিম-
P1090884

চমরং থেকে সামনের পথে কোন মিনারেল ওয়াটার বিক্রি নিষিদ্ধ। সবাইকে যার নিজস্ব বোতল বইতে হবে আর বিভিন্ন পয়েন্টে ফিল্টার করা ঝর্নার পানি দিয়ে রিফিল করে নিতে হবে। লিটার প্রতি ১০০ রুপি। ভালো ব্যাবস্থা বলতেই হয়। প্লাষ্টিকের আগ্রাসন ও ঠেকানো গেল আবার স্থানীয় পাহাড়ী আদিবাসীদের সাস্‌টেনেবল ইনকামের ও ব্যাবস্থা হলো। আরেকটা ব্যাপার, এখানে টি-হাউস, লজ এগুলো কেবলমাত্র স্থানীয় অধিবাসীরাই করতে পারবে, বাইরে থেকে কেউ এসে নয়, স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন যেন ঘটে। সকালে উঠে ব্রেকফাষ্ট সেরে গোছগাছ করে রওনা হলাম। রাতের গম গম করা লজ ইতিমধ্যেই খালি। সবাই ভোরে ভোরে রওনা হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারের নির্দেশ ৯০০০ হাজার ফিটের পর থেকে বেসক্যাম্প পর্যন্ত সকাল আর রাতে একটি করে ৫০০ মি.গ্রা. অ্যাসিটাজোলামাইড ট্যাবলেট খেয়ে নিতে, এটি উচ্চতার সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে কিন্তু মাউন্টেন সিকনেসে অলরেডি আক্রান্ত হয়ে গেলে তা কাজে লাগবেনা, লো অল্টিচ্যুডে নেমে যাওয়াই তখন একমাত্র সমাধান। নেপালে এই ট্যাবলেট ডায়ামক্স নামে বিক্রি হয়। পোখারা থেকে নিতে ভুলে গেছি তাই চমরং এর স্থানীয় এবং একমাত্র ডিস্পেন্সারী থেকে কিনে নিলাম যদিও শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়নি কারন উচ্চতাজনিত কোন সমস্যা অনুভব করিনি। চমরং থেকে আবার জান বের করে দেয়া পাথুরে ধাপের শুরু। হাজার খানেক খাড়া ধাপ পেরিয়ে অতিক্রম করলাম তিলচে গ্রাম। আমাদের প্ল্যান চমরং থেকে দিন শেষে ব্যাম্বু নাম জায়গায় পৌছানো এবং সেখানে রাত্রি যাপন। কিন্তু তার আগে অত্যন্ত কষ্টকর জায়গা সিনুয়া অতিক্রম করতে হবে সামনে। উরু আর হাটুর ব্যাপক পরীক্ষা নিয়ে সিনুয়া পার হলাম। জান বের হয়ে গেল একদম। সিনুয়াতে পরিচয় হলো আইবিএমের ইঞ্জিনিয়ার এক ভারতীয় বাঙ্গালীর সাথে। কোন গাইড ছাড়া একাই বেসক্যাম্প গিয়ে ফিরছে। মনে মনে তারিফ করছিলাম তাঁর স্পিরিটের, কিন্তু তাঁরপর সে যা বললো তাতে পদধুলি নিতে ইচ্ছে করলো। মাস খানেক আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে বা হাটুর নিচ থেকে হাড় বিচ্ছিরি ভাবে ফ্র্যাকচার হয় যা ফেলে দিয়ে টাইটানিয়াম রড লাগাতে হয়েছে। রি-হ্যাব শেষ করে কতখানি ফিট তা পরীক্ষা করতে এসেছে বেস ক্যাম্পে একদম একাই। হ্যাটস্‌ অফ মামা। সিনুয়া থেকে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত ওপরে ডিম ছাড়া কোন প্রানীজ প্রোটিন নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কেউ যদি চিকেন, বিফ বা পর্ক নিয়ে সিনুয়া অতিক্রম করে ওপরে যায় তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এ সংক্রান্ত সতর্কবানী দেয়া আছে জায়গায় জায়গায়।

২৭। মিনারেল ওয়াটার নিষিদ্ধ এলাকা শুরু-
P1090885
২৮। সিনুয়ার পথে-
P1090345
P1090347
২৯। হাজার খানেক সিড়ি ভেঙ্গে কান্ত-
P1090864
৩০। মাংসজাত খাবারের নিষিদ্ধ এলাকা শুরু-
P1090809

যা হোক সিনুয়া থেকে রাস্তা মোটামুটি সহজ। চড়াই উৎরাই কম। চারপাশে বাশবন ঘেরা ব্যাম্বুতে পৌছে গেলাম বিকেল নাগাদ। কিন্তু দিনের আলো আরো আছে, যথেষ্ট ক্লান্ত ও হইনি, তাই টানতে থাকলাম। সন্ধ্যা নাগাদ পৌছেলাম দোবান, বেশ ক’টি টি-হাউস নিয়ে জায়গাটি। নানা দেশের ট্রেকারে উপচে পড়ছে চারপাশ, ইউরোপিয়ানরাই সংখ্যাগুরু। আমাদের গাইড গেল থাকার জায়গায় বন্দোবস্ত করতে কিন্তু দুঃসংবাদ আসলো কোন রুম খালি নেই, এমন কি গাইড পোর্টারদের থাকার ঢালাও জায়গাগুলি ও ভর্তি হয়ে গেছে। ডাইনিং এ ফায়ারপ্লেসের আশপাশ ও বুক। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আর সামনে যাওয়ার মত শারিরিক অবস্থা নেই মোটেও আর ঠান্ডাও পড়ছে সেরকম। দু’টা নর্থফেস তাবু খাটানো আছে দেখলাম সামনের খালি জায়গায়। জানা গেলো ওগুলো পোর্টারদের জন্য। অনেক সাদা চামড়া ট্রেকার ও জায়গা পাচ্ছেনা। পুল মার্কেট, তাই টি-হাউসের মালিকরা বেশ ভাবের উপর আছে। ধরেই নিয়েছিলাম এত ওয়েষ্টার্ন ট্যুরিষ্টদের ভিড়ে আমাদের কেস টিকবেনা। কিন্তু বিবি আর খাড়কা জি মানে আমাদের পোর্টারের তৎপরতায় বাকি পোর্টাররা একটা তাবু আমাদের জন্য ছেড়ে দিলো। ওরা এক তাবুতেই চাপাচাপি করে থাকবে। তাড়াতাড়ি তাবুর দখল নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অনেককেই দেখলাম জায়গা না পেয়ে অন্ধকারেই সামনের গন্তব্যে রওনা হতে। জিনিসপত্র যখন গোছগাছ করছি তখন বিবি জানালো আরো দুই বাংলাদেশী ট্রেকার আমাদের খোজ করছে। খুবই অবাক হলাম। কারন পুরো ট্রেকে যেখানেই থেমেছি বাংলাদেশী শুনে সবাই প্রথমে খুব অবাক হয়েছে তারপর আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছে, বাংলাদেশ থেকে নাকি ট্রেকার আসেই না। এই দুই বাংলাদেশী তরুন যেখানেই থেমেছে শুনতে শুনতে এসে ছে যে সামনে আরো দুই বাংলাদেশী আছে, একজনের বেশ দাড়িওয়ালা (আমার সঙ্গী)। বলতেই খুব আপ্লুত হলাম হিমালয়ের এই গহীন কোনে দেশি ট্রেকারের দেখা পেয়ে। ওরাও জায়গা না পেয়ে কি করবে ভাবছিলো। আমরা তাদেরকে আমাদের সাথেই তাবু শেয়ার করতে আমন্ত্রন জানালাম। দুজনের তাবুতে চারজন, সাথে চারটি বড় হ্যাভারসেক। মোটামুটি স্কিন টাইট অবস্থা। সুস্থির হয়ে তারপর এদের বৃত্তান্ত শুনলাম। দুইজনই সদ্য পাশা করা স্থপতি। ঢাকার একটি ফার্মে কাজ করে। ফার্ম থেকে ওদেরকে পোখারা পাঠিয়েছে হিল রিসোর্টের উপর হাতে কলমে আইডিয়া নিতে। দেশে ফিরে ওরা সিলেট আর হিল ট্র্যাক্টে রিসোর্টের কাজ করবে। ওরা রিসোর্ট দেখার কাজ দু’দিনেই সেরে অফিসকে না জানিয়েই ঝটিকা বেসক্যাম্প ট্রেকে চলে এসেছে। ওরা এসেছে শর্টকাট রোড ধরে। বেশ জম্পেশ আড্ডা হলো চারজন মিলে। ওদের হাতে সময় কম তাই খুব ভোরে রওনা হবে। সবাই তাই দ্রুত ডিনার সেরে তাবুতে ঠাসাঠাসি করে যার যার ডাউন স্লিপিংব্যাগে আশ্রয় নিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল ঢুকে পড়বো অন্নপুর্নার কোলে, গন্তব্য এমবিসি মানে মাচাপুছরে বেস ক্যাম্প। আর তাঁর পরেই আমাদের শেষ লক্ষ্য অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প . . আগামী পর্বে সমাপ্য।

৩১। সিনুয়া থেকে ব্যাম্বু যাওয়ার পথে -
P1090879
P1090409
৩২। লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে-
P1090424
৩৩। অবশেষে দোবান-
P1090413
৩৪। তাবুর দখল নেয়া হল-
ABC Trek_Oct-Nov2012 1037

আমার অন্যান্য লেখা-
জাঙ্গল ট্রেকিং- রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রানী অভয়ারন্য
সান্দাকফু ট্রেক-১
সান্দাকফু ট্রেক-2
আজকের ভমিকম্প বৃত্তান্ত


মন্তব্য

তাসনীম এর ছবি

আপাতত ছবিগুলো দেখেই মুগ্ধতা জানায়ে গেলাম।

লেখা পড়ার জন্য ফিরে আসবো।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অচিন পাখি  এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

চরম উদাস এর ছবি

হাততালি
অসাধারণ

অচিন পাখি  এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বর্ননা সহ অসংখ্য ছবিযুক্ত বৃহত পোষ্ট নিজ দায়িত্বে পড়ে মুগ্ধ হলাম চলুক

অচিন পাখি  এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক
সবাই দেখি ফটুশপ খুলে বসছে ওঁয়া ওঁয়া

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অচিন পাখি  এর ছবি

দেঁতো হাসি

এক লহমা এর ছবি

লেখা পড়ে তারপর যাত্রার কল্পনা করেই ক্লান্ত হয়েই গেলাম। কি করে পারেন আপনারা! আপনারা অসাধারণ!
একের পর এক দুর্দান্ত ছবি। লেখাও চমৎকার। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

পিয়াল এর ছবি

এক কথায় দুর্দান্ত।
মনে হচ্ছে আপনি শীঘ্রই সচলে " এক ঘরমে দো পীর" পরিস্থিতি তৈরি করবেন, পাঠকদের জন্য সুখবর।

শাব্দিক এর ছবি

অপূর্ব চলুক চলুক চলুক

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ছবি দেখেই অন্নপুর্ণা বেস ক্যাম্পে যাওয়ার প্রেমে পড়ে গেলাম।অনেক অনেক সুন্দর জায়গা,ছবিগুলো ও দারুন হয়েছে।

আমি দুইবার কেওকারাডং ও জাদিপাই ঝর্ণা এবং একবার তাজিংডং গিযেছে,তাই বলা যায় ট্রেকিং করার অল্প বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে।প্রথমবার রাতের অন্ধকারে কেওকারাডং থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নেমেছি।সেই অভিজ্ঞতা ভয়ংকর ছিলো।আমার জন্যে অন্নপূর্না ট্রেকিং করা কতোটা সহনীয় হবে সেটা জানতে চাইছিলাম?আর আপনারা কয়জন গেছেন,খরচ কেমন পড়েছে জনপ্রতি জানালে যাওয়ার চিন্তাটা বাস্তোবায়ন করতে চাইবো।ভালোথাকবেন।

মাসুদ সজীব

অচিন পাখি  এর ছবি

খরচের বিস্তারিত আগামী পর্বে দিব। ধন্যবাদ

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আসলেই প্রেমে পড়ে যাবার মত সুন্দর। ছবিগুলো দারুণ হয়েছে হাততালি

অচিন পাখি  এর ছবি

ধন্যবাদ।

সালেহীন এর ছবি

অসম্ভব সুন্দর ছবিগুলো। অসাধারন লেখা। কুরবানি ঈদ এর পরদিন আমরা যাব। তবে Poon Hill পর্যন্ত। আমরা শুধু গাইড নিতে চাইছি। প্রতিদিন ২০ USD করে শুধু গাইড চার্জ দিতে হবে বলছে এক এজেন্সি, থাকা খাওয়া, TIMS, ACAP, Transport(Pokhara To Nayapul) আমদের। ব্যাপারটা কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়? আপনাদের ক্ষেত্রে কেমন খরচ হয়েচে তা লিখলে আমাদের মত নবিশদের সুবিধা হত। আপনি যে গাইড নিয়ে গিয়েছেন তার কোন email id পেতে পারি?

অচিন পাখি  এর ছবি

আমার গাইড খরচ ছিল প্রতিদিন ১২০০ টাকা। সে হিসেবে ঠিক আছে মনে হয়। আপনি পুনেহিল গেলে আপনার রুট হবে নয়াপুল, টিকেধুংগা/উল্লেরী (প্রথম রাত), ঘোরেপানি (দ্বিতীয় রাত), তাদাপানি (তৃতীয় রাত), ঘান্দ্রুক (চতুর্থ রাত), নয়াপুল, পোখরা। তিনবেলা খাবার/পানি প্রতিদিন ১৫০০ টাকা ম্যাক্স। আমার পরিচিত গাইড আছে, ফোন নম্বর দিতে পারি, ইমেইল নেই। আপনি চাইলে আমি পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। বিস্তারিত জানতে আমার আমার ইমেইল:

। ধন্যবাদ।

সালেহীন এর ছবি

ধন্যবাদ। আমি আপনাকে ইমেইল করব।

তারিক এর ছবি

ওই যে বললেন, শীতকালে ফুটখানেক বরফে ঢেকে যায় বানথাটি, সেই বানথাটি বা বানথান্তি থেকে '৯৩ সালে দুই জার্মান বন্ধুসহ ফিরে এসেছিলাম ওই মরার বরফের কারণে। বিরেথান্থী, পেধি, লাংদ্রুক, গাংদ্রুক, বানথান্তি, তাতপানি, ঘোরেপানি, পুনহিল হয়ে জমসন পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা ছিল । কিন্তু হায়, ভুল সময়ে গিয়েছিলাম।

ছবিগুলো দেখে মন ভরে গেল। ধন্যবাদ।

এস এম নিয়াজ মাওলা  এর ছবি

বিশাল লেখা, কিন্তু অসাধারণ সব ছবি-
শুধু দেখেই গেলাম! কবে যে যাবো!

-নিয়াজ

মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম এর ছবি

অসাধারণ। লেখাগুলো ছবি হয়ে গেছে। আর ছবিগুলোও বলে গেল অনেক কথা। আমরা যারা ভ্রমণতিয়াসী, অথচ ফুরসত নেই ভ্রমণের, তাদের এছাড়া আর কী করা! বলা যায় না , যে কোন সময় গাট্টি পেটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি। ইট পাথরের দুনিয়াদারি আর ভাল লাগে না। ওঁয়া ওঁয়া

মেঘলা আকাশ এর ছবি

অসাধারণ। অসাধারণ। অসাধারণ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।