রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ; সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতির পৌরাণিক রূপরেখা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৪/২০১১ - ৩:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কয়েকদিন আগে নাট্যকর্মীদের একটা রবীন্দ্রমন্থন আড্ডা গড়াতে গড়াতে এসে পড়ে গান্ধারীর আবেদন- কর্ণ-কুন্তী সংবাদ আর বিদায় অভিশাপ; তিনটি কাব্যনাটিকায়। তিনটাই রবীন্দ্রনাথের মহাভারত পুনর্লেখন কিংবা পুনর্পাঠ। আমি ভাবার চেষ্টা করি রবীন্দ্রনাথ কি এই তিনটা কাহিনীর বাইরে মহাভারতের আর কোনো কাহিনী পুনর্লেখন করেছেন? মনে করতে পারি না। বারবার মনে হয় উপনিষদ আর মহাভারত থেকে অসংখ্য রসদ নেয়া রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের এই তিনটি কাহিনী শুধু পুনর্লেখন করেছেন। কেন?

ফিরে এসে তিনটি কাব্যনাটিকা আবার পড়ি। নতুন করে গান্ধারীর আবেদন পড়ে বিরক্তি লাগে। গান্ধারীর মতো একজন গৃহবধূকে দিয়ে তিনি শাশ্বত কল্যাণ কামনার আদর্শ তৈরি করতে চেয়েছেন। স্বামী অন্ধ বলে নিজের চোখ বেঁধে রাখা আর ছেলেদের অভিশাপ দিয়ে হাহুতাশ করা ছাড়া মহাকর্মময় মহাভারতে যার অন্য কিছু করার নেই তাকে এই কাহিনীতে বেশি বেশি মূল্য দিয়ে মহাভারতের পটভূমিটাকেই তিনি অর্থহীন করে দিয়েছেন। রাজনীতির মহাকর্মযজ্ঞে এরকম ফেচুৎকান্না অসহ্য লাগে;

গান্ধারীর আবেদন পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপর থেকে আস্থা উঠে যায়। দুর্যোধনের মতো বহুমাত্রিক একটা চরিত্রকে তিনি ওখানে বাংলা সিনেমার ভিলেনপুত্র বানিয়ে দিয়েছেন। কর্ণ-কুন্তী সংবাদে আমি কর্ণ সম্পর্কে তার লাইনগুলো আবার খেয়াল করি। নাহ। কর্ণকে কোথাও ক্ষুণ্ন করেননি তিনি। যদিও কর্ণ আর কুন্তীর সাক্ষাতের সবচে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অংশগুলো তিনি পাশ কেটে যান। রাজনৈতিকভাবে তরল চরিত্রের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের কাছে এতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু... কিন্তু... কুন্তীকে তিনি কী বানিয়েছে এখানে? স্রেফ একজন মা?

মহাভরতে আগাগোড়া সক্রিয় রাজনৈতিক চরিত্র একটাই আছে। সে হচ্ছে কুন্তী। কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে শত্রু সেনাপতি কর্ণের সাথে কুন্তী দেখা করতে আসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। নিজের মাতৃপরিচয় জাহির করার জন্য নয় কিংবা কান্নাকাটি করার জন্য নয়। সে আসে শত্রুশক্তি ক্ষয় করে পাণ্ডবদের জয় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। নিজের মাতৃপরিচয়কে কয়েন করে কুন্তী আসে শত্রু সেনাপতিকে স্বপক্ষ ত্যাগ করার লোভনীয় প্রস্তাব দিতে; কর্ণ যদি কুরুপক্ষ ত্যাগ করে তবে বড়োভাই হিসেবে যুধিষ্ঠিরের বদলা সে হবে রাজা; তার সাথে দ্রৌপদীরও স্বামী হবে সে। এই ছিল কর্ণের কাছে কুন্তীর প্রথম প্রস্তাব। রবীন্দ্রনাথ এই প্রস্তাবটা ঠিকই রেখেছেন এখানে। কিন্তু কর্ণ যখন এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তখন কুন্তী চালে তার দ্বিতীয় গুটি। কর্ণকে নিবীর্য করার জন্য মাতৃপরিচয় ভাঙিয়ে সে খুলে নিয়ে যায় কর্ণের রক্ষাকবচ; যে কবচ থাকলে কর্ণকে হত্যা করা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। তার উপরে সেই সাক্ষাতে কুন্তী নিশ্চিত করে অর্জুন ছাড়া অন্য কোনো পাণ্ডবকেই হত্যা করবে না কর্ণ। এবং তারও উপরে কর্ণকে সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যাদের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করবে তারা সকলেই তার নিজের ছোট ভাই। কিন্তু কুন্তী ভুলেও অন্য পাণ্ডবদের জানায় না যে কর্ণ তাদের বড়ো ভাই। ফলে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অর্জুন জানে কর্ণ শুধুই এক শত্রু। আর কর্ণ জানে অর্জুন হলো শত্রুপক্ষে থাকা তার সহোদর ছোটভাই...

রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের মোড় ঘোরানো সাক্ষাৎকারের এই অংশটা কেটে দেন। কেটে দিয়ে রাজনৈতিক কুন্তীকে বানিয়ে দেন আঁচলে অশ্রুমোছা নিতান্ত এক মা। ধুত্তুরি। রবীন্দ্রনাথের মতো তরল রাজনৈতিক চরিত্রের লোকের কাছে রাজনীতি খুঁজতে যাওয়াই অনর্থক...

তৃতীয় কাব্যনাটিকা বিদায় অভিশাপ। মহাভারতের কচ ও দেবযানীর পাল্টাপাল্টি জঘন্য অভিশাপের কাহিনীকে তিনি বেশ পুতুপুতু প্রেমের একখান কাহিনী বানিয়েছেন। ওটা থেকে নতুন কিছু আবিষ্কারের নেই জেনেও একবার ঢু মেরে একটু টাসকি খেলাম...

আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মহাভারতের কচ ও দেবযানীকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কাব্য নাটিকাটিতে ভাষা আর উপস্থাপনা ছাড়া মূল কাহিনী থেকে কোনো তফাত নেই। মূল কাহিনীটা যেমন পৌরাণিক দুই পরাশক্তি দেবতা ও দানবের লাগাতার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে; এখানেও তাই; দানবদের কুলগুরু শুক্রাচার্য মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা জানেন বলে দেবতা-দানব যুদ্ধে যত দানব মারা যায় সবাইকে তিনি আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। অন্যদিকে এই প্রকৌশলের অভাবে প্রতিটি যুদ্ধেই দেবতাদের সৈন্যসংখ্যা কমতে কমতে তারা দুর্বল হতে থাকে। এই অবস্থায় দেবতাদের কুলগুরু বৃহস্পতি নিজের ছেলে কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান যে করেই হোক এই বিদ্যা কিংবা প্রকৌশল আয়ত্ব করে আসার জন্য। অসম্ভবকে সম্ভব করার মিশনে ছেলেকে পাঠানোর আগে তিনি জানিয়ে দেন যে শুক্রাচার্যের একমাত্র কন্যা দেবযানীকে যদি বশ না করা যায় তাহলে শত্রুদের কুলগুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে অন্য কোনো উপায়ে এই গুপ্তবিদ্যা আদায় করা সম্ভব না কারো পক্ষে...

দেবতাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কঠিন পণ করে শুক্রাচার্যের আশ্রমে পৌঁছাবার আগেই কচ জানতো যে স্বাভাবিক নিয়মে শত্রু কুলগুরু শুক্রাচার্য তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন না। তাই প্রথম থেকেই সে আশ্রয় নেয় কৌশল কিংবা ছলনার। শুক্রাচার্যের সাথে সে দেখা না করে সে নিজের রূপ আর গুণ দিয়ে মুগ্ধ করে দেবযানীকে। তারপর নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কামনা করে দেবযানীর সাহায্য...

নির্জন বনে সাধক কন্যা দেবযানী কচের মতো একজন সঙ্গী পেয়ে কোনোভাবেই তাকে হারাতে চায় না। তাই সে পিতার কাছে আব্দার করে কচকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। আগেই কন্যার আব্দার রক্ষার প্রতিজ্ঞা করে শুক্রাচার্য বাধ্য হন শত্রুপক্ষের একজন প্রতিনিধিকে নিজের আস্তানায় শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে...

কচের প্রথম উদ্দেশ্য সফল হবার পরে সে এগিয়ে যেতে থাকে তার দূর লক্ষ্যের দিকে। সে জানে দেবযানী ছাড়া তার পক্ষে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব না কোনোভাবেই। তাই সব সময়ই সে দেবযানীকে সন্তুষ্ট রাখে। দেবযানী তার কাছ থেকে যে আচরণ আশা করে সেই আচরণই সে করে দেবযানীর সাথে। দিনের পর দিন কখনও গান গেয়ে- কখনও নেচে- কখনো তার প্রিয় হরিণকে যত্ন করে- কখনও পূজার ফুল তুলে দিয়ে সর্বক্ষণই সে দখল করে রাখে সরল ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর মন

দিন যায়। কিশোর কচ আর কিশোরী দেবযানী পা দেয় যৌবনে। দিনে দিনে কচের সাথে দেবযানীর বন্ধুত্ব পরিণত হয় প্রেমে। কচও টের পায় দেবযানীর পরিবর্তন। কিন্তু মুহূর্তের জন্য সে ভোলে না তার প্রতিজ্ঞার কথা। মুহূর্তে জন্যও ভোলে না তার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্যের কথা। তাই কচ আরও প্রশ্রয় দেয় দেবযানীকে। কারণ সে জানে দেবযানীকে ছাড়া তার এই উদ্দেশ্য উদ্ধারের আর কোনো বিকল্প নেই। তার এই মিশন সফল হতে পারে একমাত্র দেবযানীকে যদি অস্ত্র হিসেবে শুক্রাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়...

সাধারণ দানবরা টের পায় কচের মূল উদ্দেশ্য। তারা জানে কচ এখানে কী চায়। তাই তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে শত্রুদের হাতে তাদের গুপ্তকৌশল পাচার ঠেকাতে। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ কৌশল বড়ো বেশি গতানুগতিক আর প্রথাগত। তারা কচকে হত্যা করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যার অধিকারী শুক্রাচার্যের একমাত্র মেয়ে যাকে ভালোবাসে সেই কচকে হত্যা করে কোনো প্রতিরোধই তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে যতবারই তারা কচকে হত্যা করে ততবারই দেবযানীর আব্দারে শুক্রাচার্য তাকে বাঁচিয়ে তোলেন। বারবার ভিন্নভিন্নভাবে কচকে তারা হত্যা করে তার দেহখণ্ড ছড়িয়ে রাখে বিভিন্নভাবে। কিন্তু বারবার একই উপসংহার। ভালোবাসার জন্য দেবযানীর কান্নায় শুক্রাচার্য তাকে আবার বাঁচিয়ে তোলেন। দানবরা আর কোনো বিকল্প খোঁজে না কিংবা খুঁজে পায় না। তারা শুধুই সাধারণ শত্রুকে প্রতিরোধ করার উপযোগী হত্যার বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে বিশেষায়িত শত্রু কচের বিরুদ্ধে। আর এরই ধারাবাহিকতায় তারা নিজেরাই ডেকে আনে নিজেদের চূড়ান্ত বিপদ...

দানবগুরু শুক্রাচার্য পছন্দ করতেন মদের সাথে ঘিয়ে ভুনা মাংস খেতে। দানবরা ভাবল কচকে মেরে যদি তার মাংস রান্না করে স্বয়ং গুরুদেব শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দেয়া যায় তবে উদ্দেশ্য সফল। কারণ তখনও যদি শুক্রাচার্য কচকে বাঁচিয়ে তুলতে চান তবে কচ যখন তার পেট ফুঁড়ে বের হয়ে আসবে তখন অনিবার্যভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে গুরু শুক্রাচার্যকে। শুক্রাচার্য কন্যাকে যতই ভালোবাসেন; ভালোবাসার জন্য নিশ্চয়ই তিনি আত্মহত্যার মতো মহাপাতকি সিদ্ধান্ত নেবেন না কিংবা মেয়ের পক্ষেও কি আর তখন সম্ভব হবে পিতাকে আত্মহত্যায় অনুরোধ করা?

যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। দানবরা কচকে হত্যা করে তার মাংস রান্না করে মদ খাওয়ার সময় দানবগুরু শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিলো। মৃত কচ এখন শুক্রাচার্যের পেটে। নিজেদের প্রতিরোধ কৌশলে মুগ্ধ হয়ে তারা এবার নিশ্চিন্ত হলো। অন্য দিকে দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন শুক্রাচার্য। কন্যা দেবযানীকে এবার তিনি তার অক্ষমতার কথা বললেন- কচ বাঁচলে তিনি মরবেন। তিনি বাঁচলে কচ হজম হয়ে যাবে তার পেটে। কন্যার প্রতি ভালোবাসায় পিতা শুক্রাচার্য আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে দেবযানীকে জিজ্ঞেস করলেন- পিতা না বন্ধু। কাকে চাও তুমি?

দীর্ঘদিন কচের সান্নিধ্যে থাকা দেবযানী যেন এবার কচের ভাষাতেই কথা বলে উঠে। স্নেহান্ধ পিতার কাছে এবার সে উত্থাপন করে কঠিন এক আব্দার- বন্ধু এবং পিতা দুজনকেই চাই আমি...

একমাত্র কন্যার এমন আব্দারে মহাচিন্তিত শুক্রাচার্য। এ অসম্ভব। মৃতকে জীবিত করার বিদ্যা শুক্রাচার্য ছাড়া আর কেউ জানে না। কচকে তিনি জীবিত করতে পারেন। কিন্তু কচ যখন বেঁচে তার পেট চিরে বের হয়ে আসবে তখন তার নিজেকে মরতে হবে। পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই যে শুক্রাচার্যকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারে...

এমন পরিস্থিতিরই অপেক্ষায় ছিল কচ। সমস্যা সমাধানে যখন হিমশিম খাচ্ছেন দানবগুরু শুক্রাচার্য তখন তার পেটের ভেতর থেকে দেবযানীকে শুনিয়ে কচ তার মোক্ষম প্রস্তাবটা পেশ করে- গুরুদেব। মন্ত্রটা আমাকে শিখিয়ে দিন। তাহলে আমি বের হয়ে আপনাকে আবার বাঁচিয়ে তুলব...

কচের এই প্রস্তাবটা দেবযানীর জন্য আকর্ষণীয়। তার প্রেমিকও বাঁচে; পিতাও বাঁচেন। কচের মুখ থেকে এই উপায় জেনে বাস্তবায়নের জন্য জেদ ধরে দেবযানী। নিরুপায় পিতা শুক্রাচার্য দ্বিধায় পড়েন। অতক্ষণ দেবযানীর জন্য যা ছিল বন্ধু কিংবা পিতাকে বেছে নেয়ার পরীক্ষা এখন তা রূপান্তরিত হয়েছে শুক্রাচার্যের জন্য গুপ্ত মন্ত্রের রক্ষা না কন্যার আব্দার রক্ষার পরীক্ষায়। কন্যার আব্দার রক্ষা করলে তার অমূল্য মন্ত্র হাতছাড়া হয়। আর মন্ত্র রক্ষা করলে রক্ষা করা সম্ভব না একমাত্র কন্যার আব্দার...

কন্যা বোঝে না রাজনীতি। দেবযানী বুঝতে চায় না দেব-দানবের সংঘাতের কূট কৌশল। তার কাছে একটা মন্ত্রের চেয়ে তার আব্দারের মূল্য অনেক বেশি। সে পিতাকেও চায়- তার প্রেমিককেও চায়...

কন্যার আব্দার আর কান্নার কাছে পরাজিত হয় শুক্রাচার্যের দানবকুলকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা এবং অরক্ষিত হয়ে পড়ে তার রক্ষাকবচ...

পেটের ভেতরে থাকা কচকে তিনি শিখিয়ে দেন মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার গোপন মন্ত্র। তারপর কচকে বাঁচিয়ে তোলেন তিনি। কচ বের হয়ে এসে মৃত শুক্রাচার্যকে বাঁচিয়ে তুলে পরীক্ষা করে নেয় তার সদ্যশেখা মন্ত্রের কার্যকারিতা। পিতা ও প্রেমিক দুজনকেই আবার জীবিত দেখার আনন্দে যখন দেবযানী আবার উৎফুল্ল ঠিক তখনই কচের মুখ থেকে সে শুনতে পায়- বিদায় দেবযানী...

কচের মিশন শেষ। কচ ফিরে যাচ্ছে। অতদিন দেবযানীকে তার প্রয়োজন ছিল মিশন সফল করার জন্য। তাই সর্বক্ষণ দেবযানীকে সন্তুষ্ট রেখেছে সে। এখন মিশন শেষ। দেবযানী তার কাছে এখন যে কোনো এক সাধারণ দানবকন্যা। ফিরে যাবার আগে তাকে বড়োজোর গুপ্তকৌশল উদ্ধারে সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ দেয়া যায়। কিন্তু দেবযানীর কাছে কচ ভালোবাসার মানুষ। ধন্যবাদ কিংবা কৃতজ্ঞতা পাওয়ার লোভে নয়; দেবযানী যা কিছু করেছে সব করেছে তাকে ভালোবেসে...

ঘটনার এই পর্যন্ত মহাভারত আর রবীন্দ্রনাথের কাহিনী একেবারে একই সূতায় গাঁথা। যদিও রবীন্দ্রনাথ কাহিনীর অনেকগুলো ঘটনা এখানে উল্লেখ করেননি কিংবা ছোট করে বলেছেন এবং তার কাহিনীটা শুরু করেছেন কচের বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে। তবুও কাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ড কোথাও পরিবর্তন করেননি তিনি। কিন্তু দেবযানীকে কেন কচের পক্ষে প্রেমিকা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব না সেই যুক্তিতে এসে রবীন্দ্রনাথ আলাদা হয়ে যান মহাভারত থেকে। মহাভারতের কচ যুক্তি দেখায়- শাস্ত্রমতে গুরুর কন্যা মাতৃ এবং ভগিনিতুল্য। শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণের সন্তান হয়ে সেই শাস্ত্রবিধান অমান্য করে দেবযানীকে তার পক্ষে প্রেমিকা হিসেবে ভাবা কিংবা বিয়ে করা পাপাচার। কচ সেটা পরে না বলেই কোনোদিনও দেবযানীর দিকে গুরুকন্যা ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টিতে তাকায়নি...

দেবযানীর কষ্ট যত বড়োই হোক না কেন; মহাভারতের সমাজবাস্তবতায় কচের যুক্তি অমোঘ এবং অখণ্ডনীয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কচের মুখ থেকে একটিও যুক্তি উত্থাপন না করে কচকে করে তোলেন সর্বসাম্প্রতিক এক রাজনৈতিক মিশনারির প্রতীক...

দেবযানী যখন কচ আর দেবযানীর বিভিন্ন আনন্দময় মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে প্রমাণ করতে চায়; হয় কচ তাকে ভালোবাসতো না হয় সে ভালোবাসার অভিনয় করেছে তার সাথে; তখন রবীন্দ্রনাথের কচ দেবযানীর একটাও যুক্তি খণ্ডন করে না কিংবা সে একটাও যুক্তি উপস্থাপন করে না দেবযানীকে গ্রহণ করতে না পারার কারণ হিসেবে। বরং সে পেশাদার কূটনীতিকের মতো অন্য সব কিছুর সাথে দেবযানীকেও ঘুরে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানায়- ধন্যবাদ জানায় আর জানায় যে সবার সাথে দেবযানীর কথাও তার মনে থাকবে আজীবন। আর ঠিক এইখানেই রবীন্দ্রনাথের কচ মহাভারতের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে হয়ে উঠে বিশ্বরাজনীতির সকল মিশনারির এক অনন্য প্রতিনিধি: কচের মিশনটা ছিল যেকোনো কৌশলে বিদ্যাটা হস্তগত করা; তার জন্য যা যা দরকার সবই করেছে কচ। এখন তার পরবর্তী লক্ষ্য হস্তগত প্রযুক্তিটা নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া। দেবযানী ছিল এই মিশনের একমাত্র প্রশস্ত সড়ক। যখন প্রয়োজন ছিল তখন এই পথ ধরে সে তার লক্ষ্যের কাছে পোঁছেছে। এখন প্রয়োজন শেষ; পথকে পথের জায়গাতেই ফেলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ...

ঘটনার এইখানে এসে মহাভারত এবং রবীন্দ্রনাথ; দুই দেবযানীই কচকে এই বলে অভিশাপ দেয় যে- যে মন্ত্রের লোভে দেবযানীকে কচ অবহেলা করল সেই মন্ত্র সে প্রয়োগ করতে পারবে না কোথাও...

দেবযানীর অভিশাপ শুনে মহাভারতের কচ দেবযানীকেও পাল্টা একটা অভিশাপ দিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে অতি সাধারণ একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হিসেবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কচকে নিয়ে যান বৈশ্বিক রাজনীতির আরেকটি উচ্চ স্তরে...। রবীন্দ্রনাথের কচ এখানে কোনো পাল্টা অভিশাপ দেয় না দেবযানীকে। রাজনৈতিক মিশন নিয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের কচ এখানে কোথাও কূটনৈতিক শিষ্টাচার হারায় না। অভিশাপের উত্তরেও সে কূটনৈতিক ধন্যবাদ জানায় আর দেবযানীর জন্য শুভকামনা করে। কারণ সে জানে সরল এই দানবকন্যার অভিশাপ তার অর্জিত অস্ত্রের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। এই বিদ্যার অমোঘ প্রয়োগক্ষমতা সে একটু আগেই শুক্রাচার্যকে বাঁচানোর মধ্য দিয়েই পরীক্ষা করে নিয়েছে। এই প্রকৌশল সে নিজে প্রয়োগ করতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। বিদ্যালয় খুলে সে শতশত দেবতা শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে দেবে এই বিদ্যা। তারা প্রয়োগ করবে এই বিদ্যা দেবতা দানবের যুদ্ধে...। অস্ত্রটা হস্তগত করাই ছিল তার মিশনের উদ্দেশ্য। সেই অস্ত্র কে ব্যবহার করবে তার চেয়ে বড়ো হলো হস্তগত হওয়া অস্ত্রটার কার্যকারিতা। কারণ সে জানে অস্ত্র যদি কার্যকর আর অমোঘ হয় তবে যে কোনো শিশুর হাতেও তা সমান বিপজ্জনক আর শক্তিশালী...

নতুন করে পড়তে গিয়ে মনে হয় মহাভারতের এই কাহিনীকে বাইরের দিক থেকে হুবহু এক রেখেও রবীন্দ্রনাথ অদ্ভুত কৌশলে কাহিনীটাকে বানিয়ে তুলেছেন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সকল সময়ের জন্য সাম্প্রতিক একটা প্রতীক কাহিনী; যেখানে বিদ্যা ছিনতাইয়ের কাহিনী দিয়ে তিনি বলে যান যে কোনো দেশে কিংবা সমাজের মানুষকে হাত করে আর তাদের ভুলের সুযোগ নিয়ে অস্ত্র কিংবা সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার চিরন্তন এক রাজনৈতিক কৌশলের কাহিনী। যা যেমন ছিল পৌরাণিক যুগে- ঠিক অবিকল আছে বর্তমান যুগেও...

ইউরোপের মানুষ যখন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছায়; তখন আশ্রয়হীন বিদেশিদের বন্ধু ভেবে নিজেরা শ্রম দিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে দিয়েছিল আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা। তাদেরকে দিয়েছিল আশ্রয়- খাদ্য আর সহযোগিতা। কিন্তু আজ? আজ ক্ষয় হতে হতে- মরতে মরতে রেড ইন্ডিয়ানরা নিজেদের ভূমিতে প্রায় সংরক্ষিত ঘেরের মধ্যে বন্দি...

ব্রিটিশ ডাক্তার গ্যাব্রিয়েল ব্রাউন যখন জাহানারাকে চিকিৎসা করে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সারিয়ে তুললেন তখন ভারত সম্রাট শাহজাহান প্রিয় কন্যার রোগমুক্তির প্রতিদান স্বরূপ ডাক্তার ব্রাউনের অনুরোধে তার জাতি ব্রিটিশকে অনুমতি দিলেন কলকাতার কাছে একটি কুঠি নির্মাণের আর সমস্ত ব্রিটিশ জাতির জন্য বিনা শুল্কে সারা ভারত জুড়ে বাণিজ্য পরিচালনার অধিকার। বিনা শুল্কে বাণিজ্যের সুযোগে ফুলে ফেঁপে উঠল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একটা কুঠি নির্মাণের অনুমতি পেয়ে ধীরে ধীরে সারা ভারত জুড়ে তারা তৈরি করল দুর্ভেদ্য দুর্গ... আর তারই ধারাবাহিকতায় এলো পলাশির যুদ্ধ- দুশো বছরের শোষণ....

আফ্রিকার কিশোরদেরকে চকলেট আর মজাদার খাবারের লোভ দেখিয়ে ব্যাডেন পাওয়েল তৈরি করলেন তার স্কাউট বাহিনী। কিশোররা বন্ধু ব্যাডেন পাওয়েলের কাছ থেকে আরো চকলেট পাবার আশায় তাকে এনে দিতে
লাগল আফ্রিকানদের ভেতরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ... এবং তারপর? তারপর আফ্রিকার বাকি খবর সকলেরই জানা...

বেলফোর ঘোষণার সূত্র ধরে মুসার জন্মস্থানে যখন ইহুদিরা আসতে শুরু করল তখন ফিলিস্তিনের লোকজন তাদের স্বাগত জানাল একই প্রপিতামহ ইব্রাহিমের উত্তরসূরি হবার আত্মীয়তার সূত্র ধরে। আগত ইহুদিদের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফিলিস্তিনিরা তৈরি করে দিলো ঘরবাড়ি- রাস্তাঘাট আরো কত কি। কিন্তু তারপর? তারপর দশকের পর দশক ধরে ইসরাইলি আগ্রাসনে নিজেদের মাটিতে নিজেরা কোণঠাসা হয়ে ফিলিস্তিনিরা পৌঁছে গেছে প্রায় নির্বাসনের কাছাকাছি... দশকের পর দশক ধরে তারা যুদ্ধ করে যাচ্ছে বহিরাগতদের হাত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য...

সিকিমের রাজা পাল্ডেন তার ছোট স্বাধীন দেশটির নিরাপত্তার ভার তুলে দিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী পরাক্রমশালী দেশ ভারতের হাতে। এর প্রতিদানে সিকিমের প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জিকে হাত করে ভারতীয়রা দখল করে নিল পুরো দেশটাকেই। আর তারপর? ১৯৭৫ সাল থেকে স্বাধীন দেশ সিকিম পরিণত হলো ভারতের একটি প্রদেশে....

ইরাক যুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমেরিকাকে আহ্বান করে নিজের দেশ নিয়ে এলো সৌদি আরব। কত বছর হলো? কেউ কি জানে মিত্র বাহিনীর হাত থেকে কবে মুক্তি পাবে তারা?

কেউ কি জানে বর্তমানের ইরাক কিংবা আফগান জনগণ কবে রেহাই পাবে আমেরিকান মিত্র বাহিনীর নির্যাতন- শাসন আর শোষণ থেকে?

বিশ্ব রাজনীতিতে এরকম ঘটনা শত শত। যেখানে দেশের ভেতরের লোভাতুর এজেন্টদের তৎপরতা- জনগণের দূরদর্শিতার অভাব আর প্রথাগত প্রতিরোধের পদ্ধতিগত ভুলের কারণেই দেশটা এক সময় বেদখল হয়ে যায়। পাচার হয়ে যায় দেশের সম্পদ। পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে এমন কোনো বিদেশি আগ্রাসনের নজির নেই যেখানে বুঝে কিংবা না বুঝে ভেতর থেকে কেউ না কেউ আগ্রাসীকে সহায়তা করেনি। কোনো দেশকে জয় কিংবা তার সম্পদে ভাগ বসানোর জন্য আগ্রাসীদের সব সময়ই প্রয়োজন পড়েছে দেশের ভেতরে থাকা এক বা একাধিক দেবযানী; যারা সরল কিংবা মোহান্ধ কোনো বৈদেশীকতার কাছে। বরাবরই আগ্রাসীরা ব্যবহার করেছে দানব সন্তানদের মতো কিছু আত্মঘাতী ভুলের সুযোগ...

আজ আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে উদারভাবে সহায়তা গ্রহণ করছে বিভিন্ন পরাশক্তির কাছ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ আগে একবার বৈদেশিক সাহায্যে ওসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে বের হয়ে এসে পেয়েছিল দীর্ঘ মেয়াদের স্বৈরশাসন। আজ তারা এগিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের দিকে। কিন্তু কেউ কি জানে মধ্যপ্রাচ্যে তারা এবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও মিত্রবাহিনীর হাত থেকে কি রক্ষা করতে পারবে তাদের মাটির নিচের তরল সোনা? নাকি একদিন তাদের সবাইকেও বরণ করে নিতে হবে দেবযানীর পরিণতি? একদিন কি তারাও নিজেদেরকে আবিষ্কার করবে পরিত্যক্ত? উচ্ছিষ্ট?

এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। কিন্তু প্রশ্নগুলো চিহ্নিত করা যায় রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কবিতার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে ভ্রমণ করলে। যে ভ্রমণ আমাদেরকে পৌরাণিক যুগ থেকে একই রাস্তা ধরে নিয়ে আসে অতি সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটে...
২০১১.০৪.১২ মঙ্গলবার


মন্তব্য

সাফি এর ছবি

গুল্লি এরকম তুলনা আগে চিন্তা করিনাই। অসাধারন

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমিও করি নাই। কইরলাম মাত্র সেদিন

নৈষাদ এর ছবি

ভাল লাগল।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

মনগ্রাহী বিশ্লেষণ খুব ভালো লাগলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইটা হঠাৎ করেই করা। রবীন্দ্রনাথ আর পড়ব না বলেও মাঝে মাঝে মনে হয় আবার পড়ি। তখন নতুন একেকটা জিনিস চোখে পড়ে

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

“মধ্যপথে কেড়েছেন মন
রবীন্দ্র ঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি-”।
[কবিতার সাথে গেরস্থালি, শামসুর রাহমান]

তবু আমি কি কখনো হবো না অবধারিত ধাবমান, সেই বিশাল বৃত্তের দিকে? নিজেকে প্রশ্ন করেছি বহুবার, মেলেনি উত্তর।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

বাহ্, চমৎকার! অনেকদিন পর চমৎকার একটা বিশ্লেষণ পড়লাম।
বিদায় অভিশাপ আর বর্তমানের মধ্যপ্রাচ্য সংকট বা বৈশ্বিক রাজনীতির ক্থটকৌশলের মিল নিয়ে লেখাটা অসাধারণ লাগল।যদিও শুরুটা খুব ভাল লাগছিল না হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আপনার কথায় শুরুটা বদলে দিলাম

রোকসানা রশীদ এর ছবি

'বিদায় অভিশাপ' আমার অসম্ভব প্রিয় একটা কাব্যনাটক, এইটা নিয়ে আমার মধ্যে যথেষ্ট অবসেশানও কাজ করে, কারন ছোটবেলা থেকে কবিতাটা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি! এটা আমার বাবার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা, এবং দীর্ঘকবিতা হওয়া স্বত্তেও বেশিরভাগ লাইনই তার মুখস্ত!
এরপর বড় হওয়ার পর যখন অর্থ বুঝলাম (ছোটবেলায় মনে হতো, এটা বাংলা ভাষা??) তখন এর রোম্যান্টিক এপিলটাই বেশি টানতো। তারপর আমার বাবার কাছে শুনেছি যে মহাভারতে নাকি দুইজনই দুইজনকে অভিশাপ দেয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কচের প্রতি বায়াসড আচরন করেছে!
আপনার লেখাটা খুব ভালো লাগলো! কমপ্যারিজন গুলাও অসাধারন!! উত্তম জাঝা!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার কাছেও এটা রোমান্টিকই মনে হতো। মাত্র কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে অন্য কিছু

guest_writer এর ছবি

মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। অসংখ্য ধন্যবাদ এই সুখপাঠ্য লেখাটির জন্য।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

কালামিয়া এর ছবি

চলুক
ইরাক যুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমেরিকাকে আহ্বান করে নিজের দেশ নিয়ে এলো সৌদি আরব। কত বছর হলো? কেউ কি জানে মিত্র বাহিনীর হাত থেকে কবে মুক্তি পাবে তারা?

২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল সেই কবে এখনও মিত্র বাহিনীর ঘাটি সরেনি জর্মান বা জাপান থেকে। সরবে তারও কোন আলামত নাই। আর সৌদিত দুই দিন আগের ঘটনা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জার্মান এবং জাপানের বিষয়টা একটু আলাদা। আমেরিকা এখানে দখলদার। জাপান র্জামান দখল করে তারা আছে। কিন্তু সৌদিতে এসেছে আমন্ত্রণে। বন্ধু হিসেবে।

হিমু এর ছবি

সৌদি আরব কি আদৌ চায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে যাক? মানে এমন কোনো বিবৃতি বা ই্ঙ্গিত কি তারা দিয়েছে এর মধ্যে?

হাসিব এর ছবি

সৌদি আরব বলতে যদি সৌদি সরকার বোঝানো হয় তাহলে বলতে হবে আমেরিকানরা সেখানে স্বাগত। আর সৌদি আরব বলতে সৌদি জনগণ বোঝানো হলে উত্তরটা বের করা মুশকিল। কারণ এর বিপক্ষে মত থাকলেও কল্লা হারানোর ঝুকি নিতে কেউ রাজি না।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জোববা ছোট হতে হতে যতক্ষণ পর্যন্ত না নেংটি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে ততক্ষণ সৌদিরা ইংগিত দেয়া তো দূরের কথা ইংগিত দেবার কথা ভাবতে পারবে বলে মনে হয় না

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জোব্বা ছোট হতে হতে যতক্ষণ পর্যন্ত না নেংটিতে এসে ঠেকে ততক্ষণ পর্যন্ত সৌদিরা বিষয়টা বুঝতে পারবে বলেই মনে হয় না; ইংগিত দেয়া তো দূরের কথা

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ইন্টারেস্টিং!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তারাপ কোয়াস এর ছবি

কচ ও যে পাল্টা অভিশাপ দিছে সেইটা মহাভারত না পড়লে হয়তো জানাই হতো না! আপনার বিশ্লেষণ চমৎকার লাগলো। চলুক


love the life you live. live the life you love.

রোকসানা রশীদ এর ছবি

২০০ বছর ধরে ছলাকলা করে যখন কোনরকমে ধন্যবাদ জানিয়ে কচ বিদায় নিতে যায়, কচকে তখন দেবযানী অভিশাপ দেয়, এই বিদ্যা সে কাজে লাগাতে পারবে না, আর ক্ষেপে গিয়ে কচও অভিশাপ দেয়, যুগে যুগে এভাবেই মানুষ একের পর এক দেবযানীর হৃদয়কে হরন করবে, এবং পরবর্তীতে তা ভেঙ্গে দিয়ে চলে যাবে!!! আমি এরকমই জানি ঘটনা টা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ! দাঁড়িওয়ালা শয়তানটাকে কোন্‌ ক্ষেত্রে যে অস্বীকার করা যায় সেটা ভেবে পাই না। ব্যাটা এতো বিষয়ে এতো কিছু লিখেছে যে ভাবাই যায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বাকি জীবনের জন্য পাঠ্য তালিকা থেকে ঠাকুরপোকে একেবারেই বাদ্দিয়ে রেখেছিলাম
কিন্তু আবারও জোব্বাদাড়ি নিয়ে মগজে ঢুকে গেলো

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কচের অভিশাপ কিন্তু এটা ছিল না
কচের অভিশাপ ছিল- দেবযানী ব্রাহ্মণকন্যা হলেও কোনো ব্রাহ্মণের সাথে তার বিয়ে হবে না। তার বিয়ে হবে নিচুজাত ক্ষত্রিয়ের সাথে

guesr_writer rajkonya এর ছবি

বৃহস্পতিরর পুত্র কচকে দেবতারা মর্ত্যে পাঠালো সঞ্জিবনী শক্তি আয়ত্ত করার বিদ্যা জানার জন্য। গুরুগৃহে গুরুর (শুক্র) মেয়ে দেবজানির সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হল। যে বিদ্যা শেখার জন্য কচ পৃথিবীতে এসেছিলা সেটাও আয়ত্ত হল। এবার তার ফিরে যাবার পালা। দেবজানি তাকে অভিশাপ দিলেন,

এই মোর অভিশাপ— যে বিদ্যার তরে
মোরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ— তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ;''

''

উত্তরে কচ স্মিত হেসে বলল,

''আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।'''

---

এইটুকু জেনে বাকিটা জানার জন্য প্রাণ আইঘাঁই করছিল। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম আপনার লেখাটা। রোকসানা রশীদের কথাটাও তো মনে হচ্ছে ঠিক। অনেকেই আসবে দেবজানির কাছে, আর তারা ভেঙ্গে দিয়ে যাবে, ওর হৃদয়। কিন্তু হৃদয় ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত তো কচের দেওয়া বর,

''আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।'''

---
ঠিকই আছে। রবিদা ভুল বলেন নি।

কিন্তু তারপরে কি হলো? দেবজানি কি শেষপর্যন্ত নিচুজাত ক্ষত্রিয় কাউকেই বিয়ে করলেন?

এসেছিলাম, কচ আর দেবজানির কাহিনি শুনতে। শুনতে শুনতে আরো অনেক কিছুই জানতে পারলাম। অনেক দিন পরে একটা পোস্ট পরে সত্যিই অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ লীলেন ভাই।

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

দেবযানী যখন কচ আর দেবযানীর বিভিন্ন আনন্দময় মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে প্রমাণ করতে চায়; হয় কচ তাকে ভালোবাসতো না হয় সে ভালোবাসার অভিনয় করেছে তার সাথে; তখন রবীন্দ্রনাথের কচ দেবযানীর একটাও যুক্তি খণ্ডন করে না কিংবা সে একটাও যুক্তি উপস্থাপন করে না দেবযানীকে গ্রহণ করতে না পারার কারণ হিসেবে। বরং সে পেশাদার কূটনীতিকের মতো অন্য সব কিছুর সাথে দেবযানীকেও ঘুরে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানায়- ধন্যবাদ জানায় আর জানায় যে সবার সাথে দেবযানীর কথাও তার মনে থাকবে আজীবন। আর ঠিক এইখানেই রবীন্দ্রনাথের কচ মহাভারতের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে হয়ে উঠে বিশ্বরাজনীতির সকল মিশনারির এক অনন্য প্রতিনিধি: কচের মিশনটা ছিল যেকোনো কৌশলে বিদ্যাটা হস্তগত করা; তার জন্য যা যা দরকার সবই করেছে কচ।

লেখাটা পড়ে এটাও মনে হলো যুগ যুগ ধরে মানুষ শুধু গোষ্ঠী, জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যই এই সব ছলাকলার আশ্রয় নেয়নি বরং তার ব্যক্তিজীবনেও তা একই ভাবে প্রয়োগ করে এসেছে। এখনও করছ্।ে বলা যায়, মিশন সফল করতে মানুষ প্রয়োজনে অনেক নীচেও নামতে পারে। পৌরাণিক কাহিনী হোক বা বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হোক সব জায়গায় মানুষ একই কৌশল অবলম্বন করে ,শুধু ফর্ম হয়তো আলাদা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। ঠিকৈ কৈছেন

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

কোথা থেকে কী খুঁজে কীভাবে এসে এইটা পড়া হলো কতদিন পরে!!

'বিদায় অভিশাপ' নিয়ে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনাটা পড়ে আমিও মুর্শেদ ভাইয়ের মতন করেই বলতে যাচ্ছিলাম 'ইন্টারেস্টিং', কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়ে মনে হলো ওতে কুলাবে না... এখন বলবো, চরম!!
পাঁচটা তারা দিয়ে গেলাম অনেকদিন পরে কোন লেখায়।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দারুণ তো হাততালি

[আমিও তো এদ্দিন বিদায় অভিশাপরে রোমান্টিকই ভাবতাম... গেল আমার রোমান্টিসিজম ইয়ে, মানে... ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বেশিরভাগ জিনিসই পয়লা থাকে রোমান্টিক পরে হয়ে যায় সিলেটিভাষায় মুরান্টিক (মুরা মানে মোচড়; আর মুরান্টিক মানে মোচড়ান্তিক...)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।