পর্ব-২। কাঞ্চনজংঘা, দার্জিলিং এ সূর্যোদয় আর সুন্দরীদের ছবি

মুস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন মুস্তাফিজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১১/২০০৮ - ১১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

http://www.sachalayatan.com/mustafiz/19895 "> পর্ব ১

দূর্মূল্য আর ভীড়ের ঠেলায় এক হোটেলে জায়গা হয়নি আমাদের, তিন হোটেলে ভাগাভাগি করে থেকেছি, আমরা ছিলাম এক সিকিমিজের হোটেলে, ওদের পারিবারিক ব্যবসা। হাসিখুশি পুরো পরিবার এই হোটেলের পিছনে সময় দেয়। বাংলা বলতে পারে এবং ভালোই পারে। রাতের খাবারে বেশ ঝাল, জিজ্ঞেস করাতে বল্লো ‘তোমরা তো ঝাল পছন্দ করো তাছাড়া ঠান্ডাতে ঝাল ভালোই লাগবে’, খাবারটা মন্দ না। আমার রুম নাম্বার ২২, ছোট্টো (১০x১২ ফিট হবে) ২ বেড, রুমে টিভি আছে, একটা কাবার্ড, ছোট্টো একটা টেবিল তাতে পানির জগ, দুটো গ্লাস পিরিচ দিয়ে ঢাকা, একটা এশট্রে, একটা ড্রয়ার লক ছাড়া, এটাচ্চড বাথরুম, টাইলস বসানো, তাতে গীজার, গীজার এর সুইচ আবার ম্যানেজার এর কাছে। সবচাইতে ভালো দিক বিশাল জানালা, পর্দা সরালেই আকাশ, আবহাওয়া ভালো থাকলে এখান থেকেই কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা দেখা যাবার কথা, রাত নেমে এলেও তাকিয়ে থাকলাম অনেক্ষন, দেখা গেলো না। রুম ভাড়া ১২০০ রুপী, সাথে ১০% ট্যাক্স, অন্য সময় হলে ৪০০ টাকার বেশী হতোনা। নীচে নেমে গাড়ীর খোজঁ নিলাম, ভোরে টাইগার হিল যেতে হবে, দার্জিলিং এর অন্যতম আকর্ষন সূর্যোদয় দেখতে। গাড়ী ভাড়া শুনে মাথা খারাপ হবার যোগাড়, গতবার গিয়েছিলাম ৫০০ রুপীতে এখন চাচ্ছে ২২০০!! চারগূনের ও বেশী, বলে কী!! গুর্খাল্যান্ড আন্দোলনের মজা টের পাচ্ছি আমরা। ভাবলাম একদিন পর যাই, হয়তো কমতে পারে। সবাইকে ডেকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে অন্য পোগ্রাম ঠিক করলাম, কাল আমরা সূর্যোদয় দেখবো তবে অবজারভেটরী হিল থেকে, এটাও কম কিসে, ভীড় কম আর আমার ধারনা টাইগার হিল থেকে এখানকার সৌন্দর্য্য ওনেক বেশী।

সবকিছু ঠিক করে মল্‌ এ গেলাম, ওরা বলে ম্যাল্‌, দার্জিলিং এর প্রাণ, সেদিন উৎসব চলছে, চত্বরে গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে, আমরা যাবার পরপরই শেষ হলো, রাত তখন ৯টা ৪-৫হাজার লোক মলে, মতো, দার্জিলিং ঘুমিয়ে যায় আরো আগে, এবারে ব্যাতিক্রম। উঠে খুব ভোরে, রাত সাতটায় অবশ্যই সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সবাইকে প্রথমদিন বাইরে বেশি ঘোরাঘূরি না করবার উপদেশ দিয়ে ফিরে এলাম, গরম পানিতে গোসল, এক কাপ চা আর জম্পেশ একটা ঘুম, রাত সাড়ে নয়, চা এখন না পাবারই কথা।

আগেই জানিয়েছি দার্জিলিং শহর উত্তর দক্ষিনে মেলানো, রাস্তা গুলোও উত্তর দক্ষিনে, মূল শহর পশ্চিমের ঢালে, বড় রাস্তা গূলোও এদিকে, মল্‌ কে যদি কেন্দ্র ধরি সবার উপরে মল রোড, এর নীচে লাদেন লা রোড, রবার্টসন রোড, তার নীচে এইচ ডি লামা রোড, তারও নীচে হিল কার্ট রোড। আর পূব দিকে মল থেকে ডান দিকে নেমে গেছে সি আর দাস (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন) রোড, নেহেরু রোড সহ আরো কিছু, মল সহ পুবের এ রাস্তা গুলোয় গাড়ী চলা নিষেধ, শুধু মাত্র উইন্ডমেয়ার হোটেল, জিমখানা ক্লাব আর সরকারী কিছু অফিসের গাড়ী চলে, রাজবভনও সেদিকে, টুরিস্টরা কমই যায় ওদিকে। ভালো কিছু স্কুল আছে। খাড়া ঢালু বলে আড়াআড়ি রাস্তা নেই, বড় রাস্তা গুলো অনেক দূর যেয়ে ঘুরে মিশেছে, তাই বলে হেঁটে নামা যাবেনা তেমন না, উপর থেকে নীচে নামার ছোটো খাটো সরু পথ মেলা, কেউ যদি এই অলিগলি গুলো চেনে তার জন্য বেড়ানো খুব সহজ। আমাদের হোটেল ছিলো এইচ ডি লামা রোডে, কেউ কেউ ছিলো এইচ ডি লামা রোডের শুরুতে যেখানে এ রাস্তা মিশেছে সেই রবার্টসন রোডে।

রাতে গোসলের পর চা পাইনি, ঘুমানোর আগে এক কাপ কফি অনেক পুরনো অভ্যাস আমার, সেটাও হলোনা, বাতি নিবিয়ে জানালা খুলে দিলাম, দার্জিলিং তখন ঘুমাচ্ছে, উৎসবের আমেজ কেটে গেলেও কিছু মাতালের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। ঠান্ডা বাতাস টের পাচ্ছি, তারপরও তাকিয়ে আছি যদি মেঘের ওপারে কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা দেখা যায়! আমার রুমে ছিলেন জুবায়ের ভাই, ততক্ষণে নাক ডাকাচ্ছেন, অগত্যা শুয়ে পরলাম।

শেষ রাতে ঘুম ভাংলো, রুম বয় ডেকে দেবার আগেই, জুবায়েরও উঠে বাথরুমে, সেখান থেকে বের হয়ে অন্যদের ডাকতে গেলে তৈরী হয়ে নিলাম আমি। সবাই নীচে শুধু একজন ছাড়া, ওর জন্য আরো পনরো মিনিট অপেক্ষা। রাস্তা তখনো অন্ধকার, মাঝে মাঝে গাড়ী যাচ্ছে, সবই টাইগার হিলের দিকে, আমরা অন্য পথের যাত্রী। আমরা যাবো অবজারভেটরী হিলে, রবার্টসন রোড ধরে অল্পকিছু যেয়ে ছোট্ট একটু পাহাড় বেয়ে উঠে যাবো মল রোডে, সেখান থেকে পূবে কিছুদূর এগুলেই চৌরাস্তা, মলের প্রাণ। ভোর তখন সাড়ে চার।

সরু মল রোডে কিছুক্ষন হাঁটার পরই খোলা বিশাল চত্তর, দার্জিলিং এর হার্ট। পাহাড়ী জায়গায় এত উপরে এমন খোলা চত্বর খুব কমই চোখে পড়বে, চত্বরে ঢুকতেই হাতের ডানে বেলেভ্যু হোটেল, হোটেলের নীচ তলায় টুরিস্ট আর এয়ার লাইন্স্‌ অফিস, সামনে ছোট্ট ফোয়ারা, সম্ভবতঃ দার্জিলিং এ একমাত্র। হাতের বামে সাংগরীলা হোটেল পেরিয়ে লিকার শপ, বুটিক, চমৎকার একটি বইয়ের দোকান, হোটেল শ্যালে আর কফি শপ, এখানে লাল রঙ এর একটি পোস্টবক্সে চোখ আটকাতে পারে, অনেক পূরনো, বৃটিশদের সময়কার, উলটো দিকে চত্বরের ওপারে সারি সারি বেঞ্চ পাতা, সারাদিন টুরিস্ট আর স্থানীয়দের আড্ডার জায়গা। প্রচুর কবুতর নামে এখানে, দুবেলা খাবার দেয় অনেকে। চত্বরের উত্তরে অঙ্কবিদ ভানুভক্তের মূর্তি, এর পেছনেই মূল অবজারভেটরী হিল। মলকে ঘিরে অবজারভেটরী হিলের চারদিকে রাস্তা আছে, হাঁটা পথ, এই ভোরে স্থানীয়রা এসেছে, ব্যায়াম এর জন্য, বেশীর ভাগ দৌড়াচ্ছে, ষাট এর উপরে একজনকে দেখেছি আটবার এই পাহাড় ঘুরে আসতে, পাহাড়ের উত্তরে যোগব্যায়াম আর স্কিপিং চলে দেখেছি।

Infront of Mohakal temple

অবজারভেটরী হিলের চূড়ায় মহাকাল মন্দির, ভারতের অন্যান্ন মন্দিরের মত প্রচুর বানর আশেপাশে, দেখতে শান্ত হলেও প্রায়ই দলবেধেঁ টুরিস্টদের উত্তক্ত করে। দুবছর আগে একবার এপথ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ রেলিং থেকে একটা লাফ দিয়ে নামলো, আমার বাম দিকে এসে দাতঁ খিঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, আরএকটা চলে এলো ডানে, ভেংচি দিয়ে চিৎকার করতে থাকলো, প্রথমে হাসছিলাম, আস্তে আস্তে হাসি ভয়ে পরিনত হলো যখন দেখলাম ওদের সংখ্যা বাড়ছে, দুটো থেকে ছয়, তারপর আট, দশ, বারো..., একটা দূটো আবার কাপড় ধরে টানছিল..., যাক্‌ সে কথা। আমরা হাঁটছি হিলের ডান দিকের রাস্তা ধরে, আমাদের ডান দিকের আকাশ কমলা রঙ ছড়াচ্ছে, তুলি দিয়ে উত্তর দক্ষিনে টানা লাল, কমলা আর সোনা রঙের ছটা, নীচে মেঘের সমূদ্র, ফেনা হয়ে ভাসছে, নীলাভ সাদা মাঝে মাঝে কালো কালো পাহাড়ের ছায়া, অদ্ভুত রকমের সুন্দর, সবাই দাঁড়িয়ে গেলো থমকে, ছবি তোলা শুরূ হলো, আমি জানি আর কি অপেক্ষায় আছে আমাদের জন্য, তাড়াদিলাম সবাইকে যেনো দেরী না হয়। ভোর দেখেই বুঝলাম অনেকবারের মত এবারেও দার্জিলিং আমাদের বিমূখ করবেনা তার অপরুপ সৌন্দর্য থেকে। খুশীমনে এসে পৌঁছালাম হিলের উত্তর প্রান্তে শেষ মাথায়। দূরে আবছা ভাবে দেখা যায় কালো একটা চাদর মূড়ীদিয়ে তখনও ঘুমে কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা।

কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা শব্দটি এসেছে নেপালী “Kang-chen-zod-nga” শব্দটি থেকে, যার মানে ‘বরফের মাঝে পাঁচটি মূল্যবান সম্পদ’। ঘুরে বেড়ানো, ব্যবসা যে কারনেই এদিকে আসা হোক না কেউ কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা থেকে চোখ এড়িয়ে থাকতে পারবেনা, সে অপার মহিমায় তার অপরুপ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। এটাকে শুধুমাত্র সৌন্দর্য বললে ভুল হবে এখানে অপার্থিব আর আধ্যাতিক কিছুও খুঁজে পাওয়া যাবে। শুধু মাত্র সৌন্দর্য অবলোকনের মাঝেই তা সীমাবদ্ধ থাকেনা মনের উপরও প্রভাব ফেলে। সদ্য ঘুম থেকে জেগেউঠা কাঞ্চঞ্জঙ্ঘার বিশালত্ব আর সৌন্দর্য অনুভবে মনে কবিত্ব ভাব নিয়ে কাউকে কবি হতে হয়না, রবীন্দ্রনাথ হতে হয়না, এই বিশালত্বের মাঝে নিজের ক্ষুদ্রতার তুলনায় ঐসব মহামানবরা নিজের রক্তে যে তোলপাড় অনুভব করতেন তার কিছুটা ছোঁয়া এই সুন্দর ভোরে সংক্রামিত হতে থাকলো আমাদের মাঝেও। চারদিক নিশ্চুপ হয়ে আছে, জানিনা কেউ কথা বললেও কেন যেনো বলছি ফিসফিস করে, মোটামুটি জনা বিশেক সপ্নাতুর মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছি, ডান চোখ পূবে আর বাম চোখ উত্তরে কাঞ্চঞ্জঙ্ঘায় পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃংগের দিকে যার উপর এখনও কোনো মানুষের পায়ের ছোঁয়া পড়েনি।

KanchanjanghaKanchanjangha

সূর্য ততক্ষণে আরো রঙ ছড়িয়েছে, এখনো সে দিগন্তের ওপারে, আলো ঠিকরে আসছে উপরের মেঘে, কমলা থেকে আস্তে আস্তে লাল রূপ নিচ্ছে, এমন সময় সবার মিলিত কন্ঠের আহ্‌ শব্দ, রঙ লেগেছে কাঞ্চঞ্জঙ্ঘায়, ঘুম ভাংছে দেবীর।

রঙ লাগলো প্রথমে পাচঁ চূড়ার উঁচুটাতে, হালকা গোলাপি মিষ্টি রঙ, তা একটু গাঢ় হয়েই কমলা হয়ে গেলো, পাশাপাশি অন্য গুলোতেও রঙ লাগা শুরু হয়েছে, ছায়া ছায়া ভাব থেকে গোলাপি তারপর কমলা, সেখান থেকে সোনা রঙ, লজ্জ্বা ভেঙ্গে দেবীর আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠতে সময় লাগলো মাত্র চার মিনিটের মত, এ সময়টুকুর বর্ননা ভাষায় দেবার ক্ষমতা আমার নেই।

Lights on face

সূর্য ততক্ষণে উঁকি দিতে শুরু করেছে, প্রকৃতি ভাংতে শুরু করেছে তার নিঃশব্দতা, কথা বার্তা শুরু হয়ে গেলো আমাদের মাঝেও, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলছে, সূর্য মনে হয় আমাদের মনের কথা পড়তে পেড়েছিলো, পূর্ণরূপে সেদিন ধরা দিলো সবার ক্যামেরায়।

Sunrise seen from observatory hill, Darjeeling

সূর্যের তাপে নীচের মেঘের সমুদ্র আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগলো, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা এরইমাঝে সাদা শাড়ী পালটে নিয়েছে। আর কিছুক্ষণের ভেতর হারিয়ে যাবে হয়তো মেঘের রাজ্যে।

Gurkhaland

ভোর হয়ে এলো অশান্ত গুরখাল্যান্ডে।

মনে পড়লো রাতে চা না খাবার কথা, মলের দোকান গুলো এতক্ষণে নিশ্চয় খুলে গেছে।

আনন্দ নিয়ে ফিরছি, আমরা যেখানে দাড়িঁয়েছিলাম তার নীচে তিব্বতীদের একটা স্কুল আছে। সেখান থেকে মাইল খানিক নেমে গেলে তিব্বতীদের বস্তি, ওরা বলে রিফিওজি সেন্টার, ৫৪ সালের দিকে চীন থেকে চলে আসে ওরা, ওখানে যাবার রাস্তা গাড়ী ঘোরা পথে ছয় কিমি.। সেখান থেকে আরো দু কিমি. দূরে একটা রেসকোর্স আছে, বিশ্বের সবচাইতে ছোটো রেসকোর্স, এখন খালি, জায়গাটার নাম লাবাং, আর্মিরা ব্যবহার করে। আমাদের পেছনে মহাকাল মন্দিরের পাহাড়, উঠতে গেলে অনেকদূর খাড়া রাস্তায় যেতে হয় বলে পূজা দেবার জন্য ওরা নীচে জায়গা করেছে, পাহাড়ের ছোট্ট একটা খোঁপে কয়েকটি ছবি, সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া, এই ভোরে প্রণাম করতে দেখলাম অনেককে। এই পাহাড়কে ডানে রেখে মলের দিকে যাচ্ছি, আমাদের বায়ে একটু নীচে সি আর দাস রোড, তারপর পাহাড় নেমে গেছে খাড়া। টাইগার হিল চোখে পড়বে এখান থেকে। আগে একবার বৃষ্টির সময় চমৎকার রংধনু দেখেছিলাম এখানে পাহাড়ের নীচে।

Don't don't throw me awayWalking at mall

মল এখন শান্ত, হালকা মিষ্টি রোদে আমরা ছাড়াও জনা বিশেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে। অনেকেই জ্যাকেট খুলে বসেছি, ছবি দেখা হচ্ছে সবার, আলোচনা হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে। আর চলছে চা, পর পর তিন কাপ নিয়েছি আমি। হঠাৎ দেখলাম বয়স্কা একজন আস্তে আস্তে ছাতায় ভর দিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন চত্ত্বরের মাঝে, এক এক করে অনেকগুলো কবুতর এসে জড়ো হলো আশেপাশে, ছোট্ট একটা সাদা থলে থেকে গম বের করে খাওয়ালেন, খাওয়ানো শেষ হলে আবার আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলেন। বিকেলে আবার দেখেছিলাম উনাকে খাওয়াতে। বৌদ্ব ধর্মে আছে ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’, আমাদের সামনে একটা কুকুর শুয়েছিলো, লোম ঊঠা কালো রঙের, শরীরে ঘা, খেয়াল করে দেখলাম ওটার জীব নেই, দূর্ঘন্ধ ছড়াচ্ছে, এক জন এসে ওটার সারাশরীর ডলে দিয়ে গেলেন। আমরা উঠলাম, হেঁটে হেঁটে নামছি, হোটেলে ফিরে নাস্তা সেরে আবারো বের হবো, শুনলাম নাস্তা হতে আরো দেরী, ঘড়িতে সময় সোয়া সাত, বসে না থেকে ওদের নিয়ে বের হলাম, হোটেল থেকে কিছুদূর যেয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নীচের রাস্তায়, বাজার আর বাসস্ট্যান্ড এখানে। সবাই ছবি তোলা শুরু করলো। দোকান পাটের ঝাঁপ খুলতে শুরু হয়েছে, মুটেদের ব্যস্ততাও বেড়েছে, ওরা মালটানে পিঠের উপর ফেলে, বোঝাটা আবার দড়ি দিয়ে মাথার সাথে আটকানো। কয়েকজনকে দেখলাম গাড়ী দরদাম করতে, দালাল দের পাল্লায় পড়েছে বোধহয়, সূর্যের আলো চেহারার বিষন্নতা ঢাকতে পারেনি। একপাশে কয়েকজন মুটে বসে জটলা করছে, ডাকের অপেক্ষায়। আমার সামনে এক ফলের দোকানী একটা পঁচা কলা ছুড়ে মারলো, দূর থেকে তা অনেক্ষণ পর্যবেক্ষনের পর তুলে নিয়ে খেয়ে নিলো এক ভ্যাগাবন্ড। ক্ষুধা পেয়েছে আমারো, সবাইকে ডেকে নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। এখন সকাল।

Darjeeling labour Darjeeling bus stand
Vagabond @ darjeeling Busy Mall

হোটেলে নাস্তা মোটামুটি মানের। আমরা ক’জন ছাড়া যারা হোটেলেই ছিলো তারা তৈরী হয়েই ছিলো, আমাদের নাস্তা শেষ হতেই বেরুলাম, এবারের গন্তব্য গঙ্গামায়া পার্ক আর রক গার্ডেন, যাবার পথে পিস প্যাগোডা হয়ে যাবে গাড়ী। গঙ্গামায়া পার্ক সুন্দর জায়গা, মোটামুটি প্রাকৃতিক, তুলনায় রক গার্ডেন পুরোটাই মানুষের তৈরী। এখানে পিস প্যাগোডা নিয়ে কিছু কথা বলি, যারা জানেনা তাঁদের জন্য। মহাত্মা গান্ধীর বন্ধু বলে পরিচিত বৌদ্ব ধর্মের’ নিপ্পনজান মায়োজি’ ধারার অনূসারী এক জাপানী নাম তার নিকিতাসু ফুজি (১৮৮৫-১৯৮৫) বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্টার লক্ষ্যে এর উদ্দ্যোক্তা তিনিই। মহাত্মা গান্ধীর সাথে তাঁর দেখা ১৯৩১ সালে, এর পরই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্টার লক্ষ্যে তিনি কিছু করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন । ১৯৪৭ সালে প্রথম দুটো পিস প্যাগোডার কাজ শুরু হয় জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ৮০টি প্যাগোডার কাজ সম্পন্ন হয়েছে যার মাঝে ভারতে আছে পাঁচটি। দার্জিলিং এরটা ১৯৭২এ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৯৯২ সালে। ৯৪ফুট উঁচু আর ৭৫ ফুট ডায়া এ প্যাগোডা আরো অনেক প্যাগোডার মতো একই ডিজাইনের। প্যাগোডার একদম উপরে আটটি বিশাল টেরাকোটার কাজ আছে যা সবার দৃষ্টি কাড়বেই।

যথারীতি আবারো গাড়ীর জন্য অপেক্ষায় আমরা, অপেক্ষা যখন অসহনীয় হয়ে উঠলো সিদ্বান্ত পাল্টালাম আমি। সাথে আমাদের সব ছবিয়ালরা। গাড়ীর জন্য অপেক্ষায় না থেকে হেঁটে ঘুরবো, তাতে ছবি তোলা, আড্ডা মারা আর ঘুরে বেড়ানোও হবে। সরে গেলাম দল থেকে। আমরা নয় জন।
যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় দেড়শো মিটার নীচে বাস স্ট্যান্ডে নেমে এলাম, স্ট্যান্ডের নীচে ‘লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেন’ ওদিকে না গিয়ে হাঁটা দিলাম হিমালয়ান মাউন্টেনারিং ইন্সটিটিউট আর চিড়িয়াখানার দিকে। আমাদের যেতে হবে প্রায় তিন কিমি., ঢালু রাস্তা সুতরাং কষ্ট তেমন হবেনা, ফিরে আসবো অন্যপথে আবারো সেই মল্‌ হয়ে। সাড়ে চার ঘন্টা লাগবে আশা করি।

Red Panda Snowy Leopard

জু এর পুরো নাম ‘পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলোজিক্যাল পার্ক’, ভারতের অন্যতম এই বন্যপ্রাণী আশ্রম ১৯৫৮ সালে তৈরী, অবলুপ্ত প্রায় অনেক প্রজাতির আশ্রয় স্থল এটা, সাইবেরিয়ান টাইগার, লাল পান্ডা, হিমালয়ান কালো ভালুক এমনকি তিব্বতীয়ান নেকড়ের দেখা মিলবে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে খাঁজ কেটে তৈরী এই চিড়িয়াখানা। পাহাড়ের স্থানীয় নাম ‘জহর পর্বত’। এই পাহাড়েই চিড়িয়াখানার একটু উপরে হিমালয়ান মাউন্টেনারিং ইন্সটিটিউট সংক্ষেপে এইচ, এম, আই। ১৯৫৩ সালে তেংজিং এর এভারেস্ট বিজয় দ্বারা অনূপ্রাণিত হয়ে ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ১৯৫৪ সালে এর ভিত্তি স্থাপন হয়। যদিও প্রথম এটা একটু দূরে লাবাং রোডের একটা বাড়ীতে (রয় ভিলা) ছিলো এবং ১৯৫৭ সালে বর্তমান স্থানে নিয়ে আসা হয়। তেংজিং নোরগে ছিলেন এর প্রথম ফিল্ড ইন্সট্রাক্টর। এই ‘জহর পর্বত’এর একটু নীচে বিশাল এক পাথর আছে, এই ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা রক ক্লাইম্বিং শেখার জন্য এটা ব্যবহার করে, এর নাম ‘তেংজিং রক’। একই পাহাড়ের উত্তর মাথায় একসময় দার্জিলিং এর অন্যতম আকর্ষন ‘রোপওয়ে’ ছিলো, ৫ কিমি লম্বা এ রোপওয়ে দিয়ে দার্জিলিং থেকে সিংলা বাজার পর্যন্ত যাওয়া যেতো। নীচে অসম্ভব সুন্দর রঞ্জিত নদী আর উপত্যকা যার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। এক দূর্ঘটনার পর থেকে এটা বন্ধ আছে। তবে এ সৌন্দর্য কিছুটা উপভোগ করা যায় জহর পর্বতের ঢালে চা বাগান থেকে। দার্জিলিং শহরের পুরোটাই এখান থেকে দেখা যায় এবং সম্ভবতঃ সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য এখান থেকেই মিলবে। আমরা যাবার পথে এখানে একটু দাড়িয়েছিলাম, রোদ, মেঘ আর ছায়ার খেলায় সবাই বেশ ছবি তুলেছে, ওরা আবার এসেছিলো রাতের শোভা তুলতে।

এইচ, এম, আই আর চিড়িয়াখানায় ঢুকতে টিকিট লাগে, দুটো টিকিট একসাথে কাটতে হয়। এইচ, এম, আই তে একটা ডরমেটরী আছে, খুবই কম টাকায় থাকা যায় (সম্ভবতঃ ২৫ রূপী জনপ্রতি), আমরা বাঙ্গালিরা পারবোনা, উপরে নিচে উঠানামা করতেই চারবার ক্ষুধা পাবে আমাদের, এছাড়া এখানে সীট পাওয়াটাও দুস্কর। কষ্ট করে চিড়িয়াখানায় ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যাবে সবার, অল্প জায়গায় এত সুন্দর ভাবে সাজানো আর এতো অদেখা জীব, আমাদের সবাই মন ভরে ছবি তুললো এখানে। সাথে সাথে এইচ, এম, আইতেও ঘোরা হলো। তেংজিং এর কবর এখানে, কবরের পাশে হাস্যোজ্জ্বল গর্বিত তেংজিং এর বিশাল মূর্তী। নয় জন একসাথে ছবি তুললাম এর নীচে। পাশের কাফেটেরিয়াতে চা, কফি খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম আমরা। অন্য রাস্তায়, জহর পর্বত ঘুরে রাজ ভবনের (গভর্নর হাউস) পাশ দিয়ে মল্‌এ উঠবো।

দার্জিলিং এ হিউমিডিটি কম ফলে ঘাম হয়না, রোদের তেজ ও কম ছিলো সেদিন, কিন্তু অনেক্ষণ হাঁটার ফলে গরম লাগা শুরু হয়েছে, সবাই গরম কাপড় খুলে হাঁটছি, ভালোই লাগছে। গঙ্গামায়া যাবার কথা ছিলো বলে একজন সেন্ডেল পড়ে পরে এসেছে, ওর মনেহয় সমস্যা হচ্ছে কিছুটা, আবার ওর সাথে ক্যামেরা নাই বলে আমাদের অনেককিছুই ওর হাতে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে ছোট্টো একটা দোকানে মোমো বিক্রি হচ্ছে দেখে বসে পড়লাম। মোমো নেপালীদের প্রিয় খাবার, এক ধরনের ডাম্পলিং, মাংশ বা ভেজ, দুটোই পাওয়া যায়, এখানে ছিলো ভেজ। দোকানে যা ছিলো আমরা নয় জনে সাবার করে ফেল্‌লাম, আরো ছিলো আলুর দম্‌, একটু অন্য ধরনের, সেটাও খাওয়া হলো, এরপর চা। বিল্‌ দিলো অপু। আসলে ও আমার একটা লেন্স ধার নিয়েছিলো বলে খাওয়ালো। একটু হাঁটা, আবার একটু দাঁড়িয়ে ছবি তোলা এই করতে করতে চলে এলাম মল্‌এ। রোদে ঝকঝক করছে মল্‌ তারপরও লোকজন প্রচুর, একটা বেঞ্চ খালি পেয়ে বসলাম আমরা, চা হলো আবারো। সবাই বেশ কিছু ছবি তুলেছে এখানে, ভালোই এসেছে।
এখান থেকে হোটেলে যাবো, গোসল আর দুপুরের খাবার, সবাই পরিশ্রান্ত।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই, লেখার মাঝে প্যারাব্রেক ব্যবহার না করলে লেখা অনেকসময় দেখাতে পারে না ব্রাউজার। প্যারা করে দিলাম।

আপনি চাইলে বিবিকোড ব্যবহার করতে পারেন লিঙ্কের জন্যে। ট্যাগ হচ্ছে [url] আর [/ url]। কিংবা কম্পোজ টেক্সট বক্সের ওপরে লিঙ্ক বাটনে আলগোছে একটা চাপ দিলেই লিঙ্ক ইনসার্ট করার ফর্মটা চলে আসবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ, শিখলাম (ওসব আবার কম বুঝি)। পরের বার চেষ্টা করব।

...........................
Every Picture Tells a Story

কনফুসিয়াস এর ছবি

কাঞ্‌চনজংঘা-র নামের রহস্য বোঝা গেলো! জাস্ট দুর্দান্ত!
তুহাইলে সোনা মন হইও, আমি তাঁকে বলি কাঞ্‌চন।
-----------------------------------
তুমি যা জিনিস গুরু আমি জানি, আর কেউ জানে না

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জাঝা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রাফি এর ছবি

দারুণ লেখা আর অদ্ভূত সুন্দর সব ছবি...।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

কীর্তিনাশা এর ছবি

দার্জিলিং যামু টেহা দেন।
ওঁয়া ওঁয়া
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মুস্তাফিজ এর ছবি

মার্চ/এপ্রিলে চলেন যাই

...........................
Every Picture Tells a Story

বিপ্লব রহমান এর ছবি

যে রকম লেখা, সেই রকম ছবি। লেখা ও ছবিতে (বিপ্লব)
---
স্যার, পরের পর্ব জলদি নামান প্লিজ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মুস্তাফিজ এর ছবি

সেইরকম মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

...........................
Every Picture Tells a Story

মুশফিকা মুমু এর ছবি

পরিক্খার জন্য লেখা পরে পড়ব, কিন্তু ছবি দেখে কমেন্ট না করে পারলাম না। আপনিতো দারুন ছবি তোলেন, একদম 'প্রো'। খুব সুন্দর হাসি ছবির জন্য *****
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ, যা দেখেছি তাই তুলেছি, আসলে ওরাই বেশী দারুন ছিলো

...........................
Every Picture Tells a Story

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এত্তো এত্তো অদ্ভুত সুন্দর !
কবে যাবো কে জানে...মন খারাপ

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ধুসর গোধূলি এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দূর্দান্ত!!!

খেকশিয়াল এর ছবি

আমরা তো পেইলিং থিকা দার্জিলিং পুরা ট্যুরে মোমো খাইতেই আছিলাম .. খাইতেই আছিলাম .. খাইতেই আছিলাম .. দেঁতো হাসি

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

রায়হান আবীর এর ছবি

ভ্রমণ করছি আপনার সাথে...

=============================

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।