শতবর্ষ আগে বরিশালের (বাকেরগঞ্জ) বন্যপ্রাণী

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বুধ, ১৬/০৯/২০১৫ - ১০:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জেমস চার্লস জ্যাক ১৯১৮ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) জেলার বিস্তারিত বর্ননা BENGAL DISTRICT GAZETTEERS, BAKARGANJ এ লিপিবদ্ধ করেন। বাকেরগঞ্জ জেলার তৎকালীন আয়তন ছিল ৪৮৯১ বর্গমাইল। বর্তমান পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালি এবং বরিশাল জেলা তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ ছিল। এই অংশে সেই সময়কালীন বাকেরগঞ্জ জেলার যেসব প্রাণী পাওয়া যেত তার বর্ণনা অনুবাদ করা হয়েছে। -

অতীতে বাকেরগঞ্জে বৃহাদাকৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঘন বসতি ছিল। কিছুকাল পুর্বেও গৌরনদীতে বাঘের এমন আনাগোনা ছিল যে সেগুলো মারার জন্য বিশেষ পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করতে হয়েছিল। উত্তর-পুর্বের জলাভূমিতে বিরাট বুনো মহিষের পাল অবাধে ঘুরে বেড়াত। পরবর্তি সময়ে বাঘেরা জেলার আরও দক্ষিণে চলে যায় এবং সেখান থেকে তাদের ধারাবাহিক ভাবে ফাঁদ পেতে মেরে ফেলা হয়েছে। এখনকার হিসাবমতে (১৯১৮) সাহাবাজপুরে (বর্তমানের ভোলা) কোন বাঘ নেই, যদিও ৪০ বছর আগে এখানেই অসংখ্য বাঘের দেখা মিলত। সুন্দরবন এবং সম্ভবত বলেশ্বর নদীর আশেপাশে প্রচুর গণ্ডারের দেখা মিললেও অনেক বছর যাবত কোন গণ্ডার দেখতে পাওয়া যায়নি।

সুন্দরবন, মেঘনা মোহনার দ্বীপ এবং ভান্ডারিয়ার বিলগুলো বাদ দিলে অন্য সব জায়গাগুলো জলাভূমিগুলো থেকে বুনো মহিষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চিত্রা হরিণ প্রচুর মেলে সুন্দরবন এবং সাহাবাজপুর দ্বীপে। জলাহরিণ বা বারশিঙ্গা দেখা যায় ভান্ডারিয়ার বিলে। সুন্দরবনে মায়াহরিণও দেখা যায়।

চিতাবাঘের দেখা মেলে জেলার সর্বত্রই এমনকি বরিশাল শহরেও। আরও যেসব প্রাণী জেলার সর্বত্রই পাওয়া যায় সেগুলোর মাঝে রয়েছে শিয়াল, বনকুকুর , সজারু, ভোঁদড়, বেজি, ইঁদুর, বনবিড়াল, খাটাশ, কয়েক প্রজাতির বাদুড় এবং নদীতে শুশুক। শাহবাজপুর দ্বীপের সবখানেই ভোঁদড় এবং বুনোশুয়োরের দেখা মেলে। ফলখেকো-বাদুড় জেলার দক্ষিণে চোখে পড়ে, এছাড়াও অন্য বাদুড় (Scarlet-bat)এখানে আছে।

এই জেলায় শিকারের উপযোগী পাখি খুব একটা মেলে না, চ্যাগাদের মাত্র কয়েক জায়গায় দেখা যায়, হাঁসেরা এত দক্ষিণে খুব একটা দেখা দেয় না, যদিও শাহবাজপুরে রাজহাঁসে ঝাঁক নামে, আর সেখানে নানা জাতের জিরিয়া, বিশেষত প্রশান্ত-সোনাজিরিয়া অনেক দেখা যায়।

(জে সি জ্যাক জলজ এবং শিকারের উপযোগী পাখি মিলিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলাতে মোট ১২৭ প্রজাতির পাখির কথা উল্লেখ করেছেন যার মাঝে ৭১ প্রজাতি জলজ পাখি এবং অন্যান্য পাখি ৫৬ প্রজাতির।

এই অংশে মূলত সেই পাখিগুলোর ইংরেজি নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে বিশেষ কোন তথ্য ছাড়াই, এবং সেই নামগুলোর অধিকাংশই গত ১০০ বছরে পরিবর্তিত হয়েছে। যেহেতু বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া নেই সাথে তাই আন্দাজের উপরে ইংরেজি নামের তালিকা থেকে ১২৭টি পাখির স্রেফ বাংলা নামের তালিকা দিয়ে পাঠকের বোঝা বাড়াতে চাইলাম না এ যাত্রা। )

বাকেরগঞ্জ হল মাছের ভান্ডার। এখানকার প্রাপ্ত মাছকে উৎস অনুযায়ী ৪ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমনঃ ১। লোনাপানির মাছঃ কোরাল, ইলিশ, ভোল, খারসু, মেঈড, তাড়িয়া, তোপসে ২। স্বাদুপানির মাছঃ রুই, কাতল, আইড়, পাঙ্গাশ, ধাইন, চিতল, কান-মাগুর, মৃগয়া, শিলং, রীতা, চাপিলা, গাংকাই, কাজলই, নান্দু, বাছা, পোয়া, ভাটা, তুলাডান্ডি, ফাইসা, গালিসা, টেংরা, কাচকি, বাউস, সাপলাপাতা। ৩। আবদ্ধ পানির মাছঃ বাইন, বাইলা, ফলি, পাবদা, ভেদা, বাতাসি, টাতকিনি, কাকিলা, চেলা, দাকিনা, মালিন্ধা, পুঁটি। ৪। বিলের মাছঃ কই, মাগুর, শিং, গজার, খইলসা, চ্যাং, শোল।

নদীতে প্রায়ই সাগর থেকে আসা হাঙর দেখা যায়। ১৮৭০-৭১ সালে সাহাবাজপুরে ৪৮ ফিট লম্বা হাঙর ধরা পড়ে, সেটাকে পরে বরিশালে প্রদর্শন করা হয়।

অন্যান্য জলজ প্রাণীর মাঝে রয়েছে মানুষখেকো মিঠা পানির কুমির , মেছো-কুমীর বা ঘড়িয়াল, গুইসাপ, তক্ষক, লম্বা এবং ছোট লেজের গিরগিটি, অজগর, রাজগোক্ষুর, শঙ্খিনী বা কালাচ সাপ, ধামান বা রাজসাপ, শাখামুটি সাপ, পানি সাপ, ঢোড়া সাপ, ৩ ফিট লম্বা সবুজ গ্রাস স্নেক (grass snake)। এছাড়াও অনেক লোনা এবং স্বাদু পানির সাপ রয়েছে যেগুলো যথাযথভাবে লিস্টে উল্লেখ করা হয়নি।

প্রসঙ্গতঃ অন্য প্রাণী কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন দুই ফিট লম্বা দুর্গন্ধযুক্ত চিংড়ি, চামুয়া চিংড়ি যা খাওয়া যায়না। সাধারণত দুই ধরনের কাকড়া দেখা যায়, লাল রঙের যা সুন্দরবনের সৈকতে দেখা যায়, এবং কালচে বর্ণের যাদেরকে গাছে দেখা যায়। এছাড়াও স্থলচর কাঁকড়া এবং বিছা আছে।

উভচরদের মধ্যে আছে কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ ইত্যাদি।

নানা ধরনের কীটপতঙ্গ পাওয়া যায় যাদের মধ্যে প্রজাপতি, মথ, কালো ও সাদা পিপীলিকা, মশা, ঝিঁঝিঁ, তেলাপোকা, শতপদী, মাছি, বিটল, ফড়িঙ, মৌমাছি, বোলতা ইত্যাদি প্রধান।

(আমরা চাই এভাবেই দেশের প্রতিটি জনপদের হারিয়ে যাওয়া কাহিনী উঠে আসুক নতুন প্রজন্মের কাছে। আপনি কি দায়িত্ব নেবেন যে অঞ্চলে আছেন অন্তত সেখানের গল্প শোনানোর? এই আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন ফেসবুকের বন্ধু নাজমুল হক রাসেল, তিনি নিজেই বাকেরগঞ্জের (বরিশালের) দুষ্প্রাপ্য গ্যাজটরটি জোগাড় করে এর বুনো পশু-পাখির অংশটি প্রায় সম্পূর্ণই বাংলা করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন যেন তাঁর কাজ মনমত হলে প্রকাশ করি সচলায়তনে। এমনটি আপনিও করুন না, তাহলে খুব দ্রুত আমাদের অজানা অতীত জানা হয়ে উঠবে শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নয়, আমাদের প্রজন্মের কাছেও!!!

নাজমুল হক রাসেলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আবারও। )

অন্য জেলার বুনোপ্রাণীর ইতিহাস-

ঢাকা

রাজশাহী

খুলনা

ময়মনসিংহ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সাপলাপাতা মাছের কথা আগে শুনিনি। আর প্রশান্ত সোনা-জিরিয়া নামটা বেশ লাগল, যদিও এর কথাও শুনিনি।
আবারো ধন্যবাদ অণু ভাই।
।।।।।।।
অনিত্র

তারেক অণু এর ছবি

শাপলাপাতা মাছে আসলে এক ধরনের রে, অনেকে শঙ্কর মাছ বলে।

হাসিব এর ছবি

সিরিজটা একটা বই আকারে দেওয়া যায় কিনা দেখেন। কাগুজে বই ছাপানোর মতো সাইজ না হলে ইবুকের কথা ভাবতে পারেন।

তারেক অণু এর ছবি

আগে গ্যাজেটিয়ারগুলো সংগ্রহ হোক, আসলে সবগুলোর সব অংশই বাংলা করা গেলে কাজের কাজ হয়। প্রাণী যেমন আমরা করছি, কেউ যদি স্থানীয় মানুষের জীবন, পেশা, জলবায়ু ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়েও ভাগ ভাগ করে, খুব ভাল হত।

আয়নামতি এর ছবি

দারুণ একটা কাজ হচ্ছে অণুদা। চলুক

চ্যাগার

পাখি? এর ইংরেজি নাম কী?
রাজশাহী অঞ্চলের তো করা হয়েই গেছে। না হয়ে থাকলে আমিই করে ফাটায়ে ফেলতাম খাইছে

তারেক অণু এর ছবি

স্নাইপ , রাজশাহী হলেও রংপুর বাকি, দিনাজপুর বাকি, নওগাঁ বাকি, বগুড়া বাকি, পাবনা বাকি, আরও অনেক্কক্ক

আয়নামতি এর ছবি

আমি তো রাজশাহীর লুক তাই ওটার কথা বলেছিলাম হাসি । করতে হয় কি আসলে? অনুবাদ ?

আয়নামতি এর ছবি

ইনরাজিতে একটা বাক্য লিখতে গিয়ে দু'বার আছাড় খাই, তিনবার পানি। আমি কী এসব কাজ ফাইরবো ইয়ে, মানে...

তারেক অণু এর ছবি

ফাইরবেন--

Jamil এর ছবি

শাপলা পাতা মাছ কি স্টিং রে মাছের অপপর নাম ?

তারেক অণু এর ছবি

রে তো অনেক ধরনের হয়, শাপলা পাতা মাছে বা শঙ্কর মাছে যে এক ধরনের রে তাতে কোন সন্দেহ নেই

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

দারুণ একটা কাজ হচ্ছে। অবশ্য আপনার কাছ থেকে এমটিই আশা। পঞ্চতারকা। আর আমার পক্ষ থেকেও নাজমুল হক রাসেলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চলুক

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

আপনার সংগ্রহে এরাম পুরাতন কিছু থাকলে দিয়েন

সত্যপীর এর ছবি

দুই ফিট লম্বা দুর্গন্ধযুক্ত চিংড়ি, চামুয়া চিংড়ি যা খাওয়া যায়না।

মানুষের কালো হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কঠিন উপায়! এদের বংশের রমরমা চলতেছে নাকি? এভ্যোল্যুশন ইন অ্যাকশন মনে হচ্ছে। চামুয়া চিংড়ি নিয়া দুইটা লাইন দেন।

..................................................................
#Banshibir.

তারেক অণু এর ছবি

হ্যাঁ হ্যাঁ, আর কিছুই নাই যে!

সাফি এর ছবি

আচ্ছা, তখনও তো আগ্নেয়াস্ত্র বা মানুষ্য বসতি স্থাপনের বা নগরায়নের তেমন জোড়ালো চেষ্টা ছিলনা, তাহলে এই প্রাণীগুলো ঐ সময়ে বিলুপ্তির কারণ কী? উদাহরণঃ বুনো মহিষ।

রাসেল এর ছবি

নগরায়নের প্রভাব ছিলনা সত্যি কিন্তু বাংলার দক্ষিন অংশে তখন বসতি স্থাপনের চাপ তখনি শুরু হয়েছে ( ১৮০০-১৯০০)। গেজেটিয়ারটির বর্ননাতে প্রাকৃতিকভাবেই বরিশালের বিলগুলো শুকিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। সে কারনে বসতিস্থাপন দ্রুত হয়েছে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, আমি যে গ্রামের বাসিন্দা তার বসতির ইতিহাস বড়জোর ১৫০ বছরের। আর গ্রামের মাঝের খালের নাম মহিষকাটাখালি মানে মহিষ চলার ফলে সৃষ্ট খাল আর পাশের আরেকটি খালের নাম "শুয়ারচি" মানে বুনোশুয়োরের চলার ফলে তৈরি খাল। বিলের পানি শুকিয়ে যাবার ফলে মানুষের নতুনবসতি স্থাপনই মুলত বন্যপ্রানি বিলুপ্তির কারন।
ধন্যবাদ সবাইকে।

তারেক অণু এর ছবি

মাত্র ১০০ বছর আগের কথা তো! যথেচ্ছ শিকার একটা কারণ তো বটেই!

মন মাঝি এর ছবি

চলুক দারুন!

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মানুষ পারেই খালি এখান থেকে ওখান থেকে জিনিস বিলুপ্ত‌ ‌ করে দিতে।
আপনাদের আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তারেক অণু এর ছবি

হ্যাঁ, আর কিছু পারুক বা না পারুক, এইটা পারে

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক
২/৪ টা ছবি/স্কেচ পাওয়া যায়না?

তারেক অণু এর ছবি

চেষ্টা করছি, কিছু স্কেচ পাওয়া গেছে অন্য বইতে, কিন্তু মূলকপির বদলে ফটোকপি হওয়ার সেই ছবির মর্ম উদ্ধার করা ব্যপক কঠিন।

স্বপ্নসতী এর ছবি

অসাধারণ লাগলো। আশা করি শিগগিরই বাংলাদেশের সব জেলার জন্য এরকম ব্লগ পোস্ট লেখা হয়ে যাবে। শুভকামনা রইলো।

তারেক অণু এর ছবি

আশা করি, যদি মূল কপিগুলো হাতে পাই তবেই-

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার কাজ হচ্ছে। সিরিজ চলতে থাকুক।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

কর্ণজয় এর ছবি

কিছু কিছু কাজ, কাজের চেয়েও অনেক বড়- কিছু কিছু লেখা---

তারেক অণু এর ছবি

প্রাচীন বাংলার জীবন নিয়ে আপনার কোন লেখা থাকলে লিঙ্ক দিয়েন প্লিজ-

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।