আত্মকথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০৫/২০১৫ - ৩:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একদিন খবর পেলাম ছোট ফুপা মৌলবাদী হয়ে গেছেন। খবরটা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। কারণ আমার সেই সুদূর অতীতের কথা মনে পড়ে গেল।

তখন আমি ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ি। ছোট মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন, ছোট ছোট সুখ-দুঃখ। দুনিয়ার বড় বড় বিষয়গুলো সম্পর্কে তখনো ধারণ হয় নি। আমার বাবা খুবই আত্মীয়পরায়ণ মানুষ, আত্মীয়স্বজন ছাড়া থাকতেই পারেন না। তাই মোটামুটি আধুনিক জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানুষ আমরা। আধুনিক বলার কারণ, আমাদের বিল্ডিং এর এক এক ফ্ল্যাটে এক এক আত্মীয়স্বজন। এক ফ্ল্যাটে থাকেন আমার ছোট ফুপু। তখন তার একটা মেয়ে আছে, এক-দেড়বছর বয়সী হবে। ছোট বাচ্চা আমার খুব ভাল লাগে তাই আমি দিনরাত ফুপির বাসায় বসে থাকি। বাবা-মা দুজনেই ডাক্তার হওয়ায় কেউই আমাকে বেশি সময় দিতে পারতেন না, তাই আমি ফুপির বাসায় থাকলে তারা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতেন। ফুপা বড়ই আমুদে মানুষ। সবসময় হাসি-ঠাট্টা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ফুপিকে বিভিন্ন কায়দায় রাগিয়ে মজা পেতেন, কান্ডকারবার দেখে আমিও মজা পেতাম। অবসর সময়ে টিভিতে হিন্দি চ্যানেল দেখে খ্যাক খ্যাক করে হাসতেন। আমাকে মজার মজার গল্প শোনাতেন বলে আমি তাকে বড়ই পছন্দ করতাম।

যেহেতু আমি সারাদিন ফুপির বাসায়ই বসে থাকি, সেহেতু আম্মু ফুপাকে বললেন আমাকে যেন বিজ্ঞান পড়ান (ফুপা খুব ভাল ছাত্র ছিলেন বলে পরিবারে সুনাম ছিল)। তাই এরপর থেকে সন্ধ্যায় একটা আলাদা রুমে ফুপা আমাকে পড়াতে শুরু করলেন। যে দুঘন্টা পড়াতেন, আমার হাত ধরে বসে থাকতেন। আমাকে কোলে বসিয়ে কোমড়ে ও নিতম্বে হাত দিতেন। গালসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুমু খেতে চেষ্টা করতেন। আমার তখন দুনিয়ার এসব নোংরামি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। তবু সহজাত প্রবৃত্তিতেই হয়তো বিষয়টা ভাল লাগত না। তাই বাধা দেয়ার চেষ্টা করতাম। তবু তিনি আমাকে রীতিমত জোর করেই কোলে দিয়ে "আদর" করার চেষ্টা করতেন। তাই একসময় আমি তাকে ভয় পেয়ে শুরু করি, এবং এড়িয়ে চলতে শুরু করি। পড়তে যাওয়াও বন্ধ করে দিলাম, মাকে বললাম ফুপা পড়াতে পারেন না। বিন্দুমাত্র যৌনশিক্ষা না থাকায় এসব যে কাউকে বলতে হবে বা প্রতিবাদ করতে হবে এই কথাটিও আমার মাথায় আসে নি।

মাস ছয়েক পরের কথা। ঈদের সময় আমরা সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি যাই। ফুপির শ্বশুরবাড়ি একই গ্রামে। তাই সেই ঈদে ফুপি আমাদের তার শ্বশুর বাড়িতে থাকার দাওয়াত করলো। গেলাম সবাই মিলে। রাতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল ফুপির রুমের একটা আলাদা খাটে। জানি না কোন এক অজানা ভয়ে আমার মন কেঁপে উঠল। কিন্তু তবু কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। ঘুমুতে গেলাম এবং একসময় ঘুমিয়েও পড়লাম। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। টের পেলাম আমার ঠোট ভিজে উঠছে। বুকের উপর কারো হাত চেপে বসেছে। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম খাটে, চিৎকার করার বা বাধা দেয়ারও সাহস ছিল না। হয়তো কিছু সেকেন্ড পর, কিন্তু আমার মনে হয় অনন্তকাল পর আমার ঠোট ভিজে যাওয়া বন্ধ হল, বুকের উপর থেকে হাত সরে গেল। তার কিছুক্ষণ পর দেখি কেউ দরজা খুলল, আলো-আধারিতে বোঝা গেল ফুপি ঘরে ঢুকছেন। অর্থাৎ ফুপি হয়তো কিছুক্ষণের জন্য বাথরুম গিয়েছিলেন, ওই সময়টুকুতে আমার আপন ফুপা, ছোট্ট একটি মেয়েকে যৌন হয়রানি করেছেন।

যখন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম , এই মানুষটাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি এই ঘটনা। হ্যাঁ, বলার সাহস হয়নি। তাছাড়া ফুপির এখন দুই মেয়ে এক ছেলে, সুখের সংসার। কাকে বলব? কি হবে বলে?

সেই ফুপা এখন মৌলবাদি হয়েছেন। সেই ফুপা এখন পত্রিকায় অভিজিৎ হত্যার ছবি দেখিয়ে বলেন, খুব ভাল হয়েছে মেরেছে। সেই ফুপা এখন নিজের পাঁচবছরের মেয়েকে বোরকা পড়াতে চান ! সেই ফুপা এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। দিনরাত বিধর্মী নাস্তিকদের গালি দিয়ে পয়েন্ট সংগ্রহ করে বেহেশতের বাহাত্তুর হুর পাওয়ার পথ সুগম করেন। সেই ফুপা, যার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া তের বছরের ভাস্তিকে যৌন হয়রানি করতে। সেই ফুপা, যিনি একজন অসুস্থ বিকৃতমনস্ক শুয়োরের বাচ্চা।

সত্যবাদী নারী


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

পড়লাম। সবগুলো লেখা পড়ছি সচলের পাতায় যা যা আসছে। এগুলি বহুবার শোনা অনেক ঘটনার সাথে মিলে যায়, শুধু অবস্থান আর শুয়োরদের চরিত্রটা ভিন্ন হয়। কিন্তু কেউ বলে না কথাগুলি। চিৎকার দিয়ে সকলকে শুনিয়ে বলে না। বলুন, বলতে থাকুন, সবাইকে শুনিয়ে বলতে থাকুন...

এবং যদি আপনার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ঐ মৌলবাদীর ফেসবুকের একাউন্টে গিয়ে এই লেখা পোস্ট করে আসুন কিংবা অন্যভাবে হলেও অন্য কাউকে দিয়ে তার মুখের উপর থুঃ থুঃ-টা ফেলে আসুন...

রানা মেহের এর ছবি

এই ছোটফুপা তার পাঁচবছরের মেয়েকে বোরখা পড়াতে চান তার নিজের পাপ ঢাকার জন্য। নামাজ পড়েন নিজের মনের কদর্যতা লুকিয়ে রাখার জন্য

আমাদের ফুপা, মামা, দুলাভাই কিংবা ভাই যারাই বাচ্চাদের ওপর এইসব যৌন নির্যাতন করে, তারাই দেখবেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর জাতি ও ধর্মের ত্রানকর্তা হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ থেকে নয় কিন্তু মধ্যবয়সে এই হঠাত ধার্মিক হওয়া প্রত্যেকটা লোককে আমি সন্দেহের চোখে দেখি।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

স্বয়ম

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

এই লেখা অনেকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেবে কিন্তু।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

এ এক অনুভূতি বটে, খালি আঘাত খায়। চরম নির্যাতিত আর কি।

স্বয়ম

ওডিন এর ছবি

আপনার লেখাটা পড়ার ঠিক আগেই পড়া আরেকটা লেখায় যে কমেন্টটা করে এলাম, সেইটা এইখানেও খুবই প্রাসঙ্গিক। বাচ্চারা সবচে বেশি অ্যাবিউজের শিকার হয় একেবারে চেনাজানা লোকদের দিয়ে। আমার এক বন্ধু, সে ছেলে, বয়স্কদের সাথে খুবই বেয়াড়া দুর্বিনীত ব্যবহার করে। বিশেষ করে পরিবারের লোকজনের সাথে। কথায় কথায় গালিগালাজ এইসব আরকি। এজন্য অনেকেই ওকে ভাল চোখে দেখতো না। আমরা বড় হওয়ারও অনেক অনেক দিন পরে আমি জানতে পারি ওর আপন চাচা নাকি ওকে প্রায় রেগুলারলি অ্যাবিউজ করতো। সেই থেকে বয়স্কদের প্রতি ওর যে ঘেন্নাটা জন্মে গেছে, সেইটা সাসটেইন করছে। যদিও কখনও কাউকে সে বলে নাই ঘটনাগুলো।

আমার মনে হয় আমাদের যে পারিবারিকভাবে শেখানো হয় গুরুজনদের মান্য করতে হবে, তাদের সব আদেশ মেনে চলতে হবে, কথার পিঠে কথা বলা যাবে না, এইসবকিছুতেই সিরিয়াস ঘাপলা আছে। কোনরকম অ্যাবিউজের শিকার হলেও তাই ভয়ে কেউ কিছু বলে না। মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক, আমাদের শিষ্টাচারের নামে এমন অনেক কিছু শেখানো হয় যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যায়ের রক্ষাকবচ হয়ে দেখা দেয়।

স্বয়ম

আয়নামতি এর ছবি

একদিন ফোনটা তুলে ফুপা নামের ঐ মানুষ(!)টাকে বলুন অতীতে তিনি আপনার সাথে কী করেছিলেন।
তার পাঁচ বছরের মেয়েটার সাথে কেউ যদি সেরকম করে তার প্রতিক্রিয়াটা জানতে চান।
হুদাই কেন আপনি একা কষ্ট বয়ে বেড়াবেন? পাল্লাটা ঝামা দেন রে ভাই!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

তীব্র ঘৃণা ঐ মানুষ নামের অমানুষটাকে। রেগে টং

তারেক অণু এর ছবি

জানোয়ারদের কাছে শিশুরাও মাংসপিণ্ড। আমাদের বেড়ে ওঠায় বিশাল ফাক এই যৌন বিষয়ে শিক্ষা না থাকা এবং তার জন্য সেটার প্রতিবাদ না করে সারা জীবন কালো দাগ বয়ে বেড়ানো-

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মন খারাপ

উপরে আয়নামতির পরামর্শটা ভেবে দেখতে পারেন। ঐ 'মানুষ'টাকে ফোনে বা মুখোমুখি জানাতে পারেন আপনার ঘৃণার কথাটা। তার শিশুকন্যাটাকে তার সামনেই প্রকাশ্যে ধারণা দিতে পারেন যে জানোয়ারেরা স্পর্শ করলে কুঁকড়ে না থেকে বরং প্রতিকার করাটাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পিশাচগুলোর অপকর্মগুলো প্রকাশ করে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয় না বলে তারা ক্রমাগত এমন কিছু করে যায়। পিশাচগুলোর ঘনিষ্টজনদের কাছে তার মুখোশ খুলে দেয়া হোক। তাতে তার ঘনিষ্টজনেরাও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করবে, আস্থায় রাখবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দময়ন্তী এর ছবি

ছোটবেলায় যা হয়েছে হয়েছে, এখন তো আর আপনি ছোট নন। ঐ অসভ্য মনুষ্যেতর জীবটিকে পরিস্কার জানান ও আপনার সাথে কী কী করেছিল, তারপরে জিগ্যেস করেন ওর মত লোকেদের জন্যই কি ওর মেয়েকে বোরখা পড়াতে চায়? চেঁচামেচি নয়, রাগারাগি নয়, ঠান্ডা মাথায় সবার সামনে জিগ্যেস করুন।

আর আমার ধারণা আপনার অন্য ভাইবোনরাও এর শিকার হয়ে থাকতে পারে, তাদের সাথে কথা বলে দেখবেন নাকি?

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

কয়েকটা লেখা পড়ার পর মন্তব্য করার ভাষা হারিয়ে ফেলছি বোধহয়!
কী বলব! বলে কীইবা হচ্ছে!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

তিথীডোর এর ছবি

প্রত্যেকটা লেখা পড়ছি, মন্তব্য করার চেষ্টা করছি। রাগে, জিদে মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল, কিছু লেখা তো আরো বেশি!

অতিথি লেখকরা এই ইস্যুতে এতো সাহস করে চমৎকার সব পোস্ট লিখছেন, সেখানে মন্তব্যে সচলদের অংশগ্রহণ কম থাকাটা দুঃখজনক।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

Rain Soaked Poet এর ছবি

অতিথি লেখকরা এই ইস্যুতে এতো সাহস করে চমৎকার সব পোস্ট লিখছেন, সেখানে মন্তব্যে সচলদের অংশগ্রহণ কম থাকাটা দুঃখজনক।

সহমত। অনেকেই হয়তো পড়ে মন খারাপ করছেন, অনেক ধরনের অনুভূতি হচ্ছে, তার ফোলেই হয়তো কিছু লিখার মানসিকতা পাচ্ছেন না। কিন্তু যারা পরছেন, তাঁরা যদি একটি শব্দ ও লিখে যান, তাহলেও কিছু এই অতিথিরা মনে শক্তি পাবেন। তাঁদের কষ্টের কথা মানুষ পড়ছে। ভালবাসছে।

স্বপ্নহারা এর ছবি

উনারা সবাই একটা পর্যায়ে গিয়ে মৌলবাদীই হন এবং ধর্মের নামে আকাম করেন আর বলতে থাকেন এই নারীরাই সব শয়তানীর উৎস।

ঘৃণায় গা রিরি করছে! এই ধরনের ঘটনাগুলোর সংখ্যা এর বেশী যে আশেপাশে কে যে করে নাই সেইটাই সন্দেহ লাগে।

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

তার পরিবারকে বলে দিন এখন

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।