মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৭ [কর্ণ ৩]

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: রবি, ২৮/১২/২০১৪ - ১:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যে কুমারী কন্যারে সমাজের আড়ালে পরের বাড়িতে সন্তানের জন্ম দিতে হয় চিক্কুর চাইপা রাখার অভ্যাস তার এমনিতেই থাকে। প্রসব চিৎকার চাইপা রাখার অভ্যাসে কুন্তী আইজ চাইপা রাখে গর্ভপাতের গোঙানি। ...তার গর্ভের প্রথম পোলায় আজ নামব গর্ভের শেষ সন্তানের সামনে। মৃত্যুপণে। ...মায়ের পেটের ভাই জাইনাও কর্ণ অস্ত্র চালাইব অর্জুনের দিকে আর শত্রু জাইনা অর্জুন মারব কর্ণরে....

কর্ণ কুরুপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তাই পাণ্ডবপক্ষের প্রধান শত্রুও সে। ভাঙতে সে রাজি কিন্তু মচকানো যায় নাই তারে। ভীষ্ম তারে যুদ্ধ থাইকা দূরে রাখছেন দশদিন। কুন্তী তারে লোভাইছে। কৃষ্ণ তারে তেলাইছে কিন্তু বিন্দুমাত্র নড়ে নাই কর্ণ। পরশুরামের শিক্ষার লগে গুরুর বদ অভ্যাসী অহংকারটাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক তার। সে সব ছাড়তে পারে; শুধু ছাড়তে পারে না অহংকার আর দুর্যোধন...

কর্ণের প্রতিজ্ঞার সুযোগ পাণ্ডবেরা পুরাটাই নিছে যুদ্ধের পয়লা দশদিন। একলা ভীষ্ম দশদিনে পাণ্ডবগো যে পরিমাণ নাড়াইছেন; তার লগে যদি.যোগ হইত কর্ণের আগ্রাসন তবে অতদিনে নিভা যাইত পাণ্ডবগো চিতার আগুন। অবশ্য এখনো কর্ণ থিকা আরো কিছু সুবিধা পাইব পাণ্ডবজনে। অর্জুন ছাড়া বাকি চাইর পাণ্ডবের কাউরেই হত্যা করব না সে; কেউ না জানলেও কুন্তী জানে যে এই কথা মাতা কুন্তীরে দিছে সে...

অর্জুন বহুত সুরক্ষিত কৃষ্ণের সাথে। মাথা গরমে ভুলের কোনো কারণ ঘটবে না তার। কিন্তু কর্ণের না আছে কোনো বন্ধু; না আছে তার কোনো সহায়। ...কুন্তী নিজের চোখে পানি খোঁজে। পায় না। বুক হাতড়াইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাইর করে সে- ভাসাইয়া দেয়া পোলারে তবে হারাইতে হবে এইবার...

অতদিন ভীষ্ম আছিলেন কৌরবদের প্রধান সেনাপতি। দুর্যোধন কর্ণরে জিগায়। কর্ণ দ্রোণের নাম কয়- তুমি দ্রোণাচার্যরে প্রধান করো; অন্য কাউরে করলে দ্রোণ আনুগত্য দিবেন না....

কুরুপক্ষে দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি হইলেন ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণাচার্য; ভীষ্ম যেমন আছিলেন পরশুরামের ছাত্র; দ্রোণও তাই। কিন্তু দুইজনের মূল তফাতটা হইল; ভীষ্ম আছিলেন যোদ্ধা; বহু যুদ্ধ করছেন তিনি; বহু সেনা চালাইছেন জীবনে। কিন্তু দ্রোণ অস্ত্রগুরু- অস্ত্র বিশারদ; অস্ত্র শিক্ষা দিতেন; কিছুকাল ধরে রাজাগিরিও করেন। কিন্তু জীবনে কোথাও কোনো যুদ্ধ তিনি করেন নাই কুরুযুদ্ধের আগে। ভীষ্মের অধীনে মাত্র দশ দিন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়া তিনি হইলেন কুরুপক্ষের দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি...

সেনাপতি হইয়া বড়োই আপ্লুত দ্রোণ। দুর্যোধনরে কন- গাঙ্গেয় ভীষ্মের পর তুমি যে আমারে সেনাপতি বানাইছ তাতে আমি যে কী খুশি কেমনে তোমারে কই? কও বাপ; তুমি কী চাও আমার কাছে? যা চাইবা; তোমার জন্য তাই করব আমি...

দুর্যোধন কয়- বেশি কিছু করা লাগব না গুরুদেব। আপনে যদি খালি যুধিষ্ঠিররে আমার কাছে জীবিত ধইরা আনতে পারেন তাইলেই হয়...

দ্রোণ একটু থতমত খাইয়া কন- তুমি যুধিষ্ঠিররে মারতে না কইয়া জ্যান্ত ধইরা আনতে কইলা; বিষয়টা আমারে একটু বুঝাওতো বাপ?

দুর্যোধন কয়- যুধিষ্ঠিররে মারলে যে পাণ্ডব-পাঞ্চালরা কিলাইয়া আমাগো ভর্তা বানাইব সেইটা তো দশদিনেই টের পাইছেন গুরুদেব। তার থিকা যদি যুধিষ্ঠিররে জ্যান্তা ধইরা আইনা আবার পাশা খেলায় হারাইয়া বনে পাঠাইতে পারি তয় আন্ডাবাচ্চা নিয়া পাণ্ডবরা আবার সন্ন্যাসী হবে। এইটাই সব থিকা ভালো উপায়...

যা চাইব তাই দিবার কথা দিয়া চিপায় পড়েন দ্রোণ। পাণ্ডবগো যুদ্ধের যে নিশানা তাতে এখন পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে কেউই পৌছাইতে পারে নাই। দুর্যোধন কয় কি না তারে ধইরা আনো গুরুদেব...

দ্রোণ কথা ফিরানও না আবার কথা দেনও না। আমতা আমতা কইরা কন- আইজ আমি অবশ্যই যুধিষ্ঠিররে ধইরা তোমার কাছে দিমু; তয় খালি অর্জুন যদি না তার আশেপাশে থাকে। বোঝোই তো; অর্জুন আমার শিষ্য হইলেও তার সামনে থাইকা যুধিষ্ঠিররে ধরা অসম্ভব...

কথাখান পৌছাইয়া যায় যুধিষ্ঠিরের কানে। অর্জুনরে ডাইকা কয়- তুই ভাইরে ফালাইয়া আইজ সরিস না কোথাও। নাহয় কোন ফিকিরে হয়ত গুরু আইজ আমারে বাইন্ধা নিয়া গিয়া পাশা খেলতে বসায় তা মোর কপালেই জানে...

অর্জুন কয়- ধইরা না হয় নিলেন তিনি। কিন্তু আপনে পাশা না খেললেই তো হয়...
যুধিষ্ঠির কয়- এমন কথা কইস না ভাই। জানোসই তো পাশা খেলার প্রস্তাব ফিরাইতে পারি না মুই...
অর্জুন কয়- সমস্যা নাই। তিনারে হত্যা করতে আমার আপত্তি হলেও দাবড়ানি দিতে কোনো অসুবিধা নাই। ডরাইয়েন না ভাই...

এগারো নম্বর দিনে দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুু আটকাইয়া রাখে গুরুরে বহুক্ষণ। শিষ্যের ঘাট পার হইয়া দ্রোণ মুখামুখি হন ধৃষ্টদ্যুুপিতা আর নিজের বাল্যবন্ধু দ্রুপদের; যে কি না আবার দ্রোণপিতা ভরদ্বাজের শিষ্য। অভিমন্যু বৃহদবলের ভুঁড়ি মাটিমাখা কইরা জয়দ্রথরে নাকানি-চুবানি দেওয়া শুরু করলে শল্য আইসা তারে ঠেকান। অভিমন্যুর আক্রমণে শল্যের সারথি মরলে শল্য অভিমন্যুর লগে গদাগিরি করতে যায় আর ভীম আইসা অভিমন্যুরে কয়- ঘটোৎকচ আমার অর্ধেক কাম সাইরা ফালাইতাছে লাথাইয়া-কিলাইয়া। এখন তুমি ভাতিজাও যদি গদাগিরি করো তয় আমার তো যুদ্ধে রিটায়ার নিয়া রাজা বিরাটের বাড়ি গিয়া আবার বাবুর্চির কাম নিতে হয়। ...তুমি রেস্ট করো। বেইমান মামুর হাড্ডিরে আমিই বরং পাঞ্জিপুথি ছাড়া অমাবস্যা পূর্ণিমা চিনাই...

শল্য কিন্তু নাদান না। ভীমের গদামে সে মাটিতে পইড়া হাপাইতে লাগলেও ভীমেরেও সে মাটিতে পাইড়া ফালায়। ভীম উইঠা খাড়ায় কিন্তু ততক্ষণে কৃতবর্মা নিজের রথে কইরা শল্যরে নিয়া পলায়...

ভীষ্মের অভাব একদিনেই বোঝে কুরুক্ষেত্রের মাঠ। পাণ্ডবপক্ষের সকলেই কমবেশি পিটাইতে থাকে কুরু সেনাসৈনিক। পাণ্ডবদের মাইর খাইয়া নেতৃত্বহীন কুরু সৈন্যরা পলায় যে যে দিকে পারে। নয়া সেনাপতি দ্রোণ এরে ডাকে তারে ডাকে কিন্তু কে শোনে কার ডাক। এমন অবস্থায় নিজের নেংটি বাচাইতে দ্রোণ চিক্কুর দিয়া কন- তোমাগের পলাইবার যেমন কোনো কারণ নাই; তেমনি যুদ্ধ করারও প্রয়োজন নাই। তোমরা খাড়াইয়া দেখো আমি এখনই কেমনে যুধিষ্ঠিররে বন্দী কইরা যুদ্ধের ইতি টাইনা দিতাছি দুর্যোধনের পক্ষে...

সকলে খাড়াইয়া এইবার সত্যি তামাশা দেখে। দ্রোণ বাহাদুরি দেখাইতে যুধিষ্ঠিরের দিকে আগাইতে গিয়া পয়লা চোটেই বুকে তীর খায় যুধিষ্ঠিরের দেহরক্ষী কুমারের হাতে। তার পরেও দ্রোণ আগায়। তার হাতে মারা পড়ে অগ্রবর্তী দলের ব্যঘ্রদত্ত আর সিংহসেন। এমন সময় দ্রোণের সামনে আইসা খাড়ায় অর্জুন। অর্জুনরে দেইখা দ্রোণ পিছনের রাস্তা মাপতে মাপতে সূর্যাস্ত হইবার আগেই ঘোষণা কইরা দেন যুদ্ধের সমাপ্তি...

যুদ্ধের এই এগারো নম্বর দিনটা আছিল কর্ণের পয়লা দিন। এইদিন কিছু খুচরা খাচরা সৈন্য মারা আর রাজা বিরাটের লগে তিরাতিরি কইরা হাতের জাট ভাঙা ছাড়া কিছুই করে না সে। তার পোলা বৃষসেন বরং এইদিন বাপের থাইকা বেশিই কোপায়...

রাত্তির বেলা দ্রোণ দুর্যোধনের কাছে মিনমিন করেন- আমি আগেই কইছিলাম অর্জুন থাকলে যুধিষ্ঠিররে আমি কিছু করবার পারব না। তোমারে তো কইলাম; কিন্তু তুমি তো অর্জুনরে যুধিষ্ঠিরের কাছ থিকা সরাইবার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলা না। তাই আবারও কই; কেউ যদি অর্জুনরে যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়া সরাইয়া নিয়া যায়; তাইলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনতে পারি...

কথাখান লুইফা নেয় ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা আর তার ভাইয়েরা; যারা রাজা বিরাটের গরু চুরি করতে গিয়া পাণ্ডবগো প্যাদানি খাইছিল অজ্ঞাতবাসের শেষ দিন। সুশর্মা কয়- হয় দুনিয়াতে অর্জুন থাকব; না হয় থাকব ত্রিগর্তজাতি; এই প্রতিজ্ঞা করলাম আমরা। আমাদের সংশপ্তক বাহিনী কাইল হয় অর্জুনরে মারব না হয় মরব অর্জুনের হাতে...। এইবার বাকিদের আপনেরা সামলান গুরু দ্রোণ...

বারো নম্বর দিনে সংশপ্তক ত্রিগর্তবাহিনী মাঠের দক্ষিণ দিক থাইকা অর্জনরে চ্যালেঞ্জ দিয়া বসে। কেউ চ্যালেঞ্জ দিলে যদি না নেয়া হয় তবে তো মান সম্মানের বিষয়। অর্জুন কয়- ভাইজান; জানের থাইকা বড়ো মান। আমারে তো এখন যাইতেই হয় ত্রিগর্ত বাহিনীর ডাকে...

যুধিষ্ঠির কয়- ভাইরে। তুই সইরা গেলে দ্রোণ আমারে ধইরা নিয়া আবার শকুনির লগে পাশা খেলতে বসাইব মাঠের বাইরে। তুই যদি যাইতে চাস তয় আমার লাইগা একটা ব্যবস্থা কইরা যা; যাতে দ্রোণের খপ্পরে না পড়তে হয় আমার...

অর্জুন পাঞ্চাল বংশীয় সত্যজিৎরে দেখাইয়া কয়- আইজ সত্যজিৎ আপনেরে আগলাইয়া রাখব। আর যদি সত্যজিৎ মইরা যায়; তয় আপনি যুদ্ধ থাইকা ভাগল দিয়েন। যা করার বাকিটা করব নে পরে...

সংশপ্তকেরা পুরাটাই ভুজুং। মশামাছির মতো মরতে থাকে অর্জুনের বাণে। তীর খাইয়া প্রতিজ্ঞা টতিজ্ঞা ভুইলা ভাগতে থাকে সুশর্মার বাহিনী সংশপ্তক। পরে এদের সাপোর্ট দিতে পিছে আইসা খাড়ায় কৃষ্ণের কাছ থিকা দুর্যোধনের ভাড়া করা নারায়ণী সেনা। এরাও মরে পঙ্গপালের মতো...

অর্জুন মারতাছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা বহু তাই অর্জুনরে ব্যস্তই থাকতে হয় দক্ষিণে। এই সুযোগে দ্রোণ একেবারে কোমর বাইন্ধা আগাইয়া যান যুধিষ্ঠিরের দিকে। তার লগে আছে দুর্যোধন আর তার ভাইবেরাদর- যাদব বংশীয় কৃতবর্মা- কৃপাচার্য- ভূরিশ্রবা-শল্য- বিন্দু- অনুবিন্দু-সুদক্ষিণ-অশ্বত্থামা-জয়দ্রথ-ভীমরথ-হাতিবাহিনীসহ ভগদত্ত আর সকলের পিঠ বাচাইবার লাইগা সকলের পিছে কর্ণ...। মানে প্রায় পুরা কৌরব বাহিনী...

দ্রোণ বাহিনীরে পয়লা ঠেকায় ধৃষ্টদ্যুু । আটকাইতে না পারলেও সে দ্রোণের বাহিনী ছত্রভঙ্গ কইরা দেয়। সত্যজিৎ বহুক্ষণ দ্রোণরে আটকাইয়া মইরা গেলে অর্জুনের কথা মতো যুধিষ্ঠির পলায়। এর ফাঁকে পাঞ্চাল কেকয় আর মৎস্য যোদ্ধারা দ্রোণরে ঘিরা ধরে তীর দিয়া। এক পর্যায়ে সাত্যকি- চেকিতান- ধৃষ্টদ্যুু- শিখণ্ডী সকলেই দ্রোণ বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হইতে থাকলে পাণ্ডব বাহিনী শুরু করে যুধিষ্ঠিরের মতো ভাগল...

এই দেইখা দুর্যোধন ডাইকা কর্ণরে কয়- পাঞ্চালরা ভাগতাছে। এখন খালি ভীমের ভাগল দিবার বাকি...
কর্ণ কয়- ভুল হিসাব কইর না দুর্যোধন। মাকুন্দা এই ভীম মইরা যাইতে পারে; কিন্তু ভাগব না; তারে ডর দেখানোও সম্ভব না... আমাদের বরং দ্রোণরে বাচাইবার লাইগা আগানো উচিত। নাইলে সবাই যেমতে তারে ঘিরা ধরছে তাতে দ্বিতীয় সেনাপতিরেও না আইজ তোমার হারাইতে হয়...

দ্রোণরে বাচাইতে আগাইলেন কর্ণ আর দুর্যোধন। অন্যদিকে হাতি বাহিনীসহ ভীমরে আক্রমণ কইরা বসে ভগদত্ত। কুরুক্ষেত্রের সবচে বড়ো হাতি বাহিনী দুর্যোধনের শ্বশুর ভগদত্তের । হাতিসোয়ার যোদ্ধার ক্ষেত্রে তীর ছাড়া অন্য অস্ত্র প্রায় অচল। দূর থাইকা হাতির ডাক শুইনা অর্জুন কৃষ্ণরে কয়- ভগদত্তরে থামাইতে না পারলে আইজ হাতি দিয়া পাড়াইয়া সে সবাইরে চ্যাপটা কইরা দিব। তুমি ভগদত্তের দিকে রথ ঘোরাও...

সুশর্মা আর সংশপ্তকেরা অর্জুনের পিছু ধাওয়া করলেও সে গিয়া খাড়ায় ভগদত্তের সামনে। অর্জুনরে দেইখা ভীম ছাইড়া ভগদত্ত আগাইয়া যায় অর্জুনের দিকে। অর্জুন না যত কৌশলি যোদ্ধা তার থিকা বড়ো কৌশলি সারথি কৃষ্ণ। ভগদত্ত হাতি নিয়া দাবড়ানি দেয় অর্জুনের রথে। কিন্তু হাতির সুবিধা যেমন তার দৌড়ের গতি আর শইলের ভার; তেমনি তার অসুবিধাও তাই। হাতি একবার দৌড় শুরু করলে তারে সহজে না যায় থামানো; না যায় ঘোরানো... সে এক ধাক্কায় বহুদূর গিয়া আস্তে আস্তে থামে...

হাতির দৌড়ের লাইন ছাইড়া কৃষ্ণ নিয়া অর্জুনরে খাড়া করে ভগদত্তের হাতির পিছনে আর ভগদত্তর হাতি থামবার আগেই তার বিচিতে ঢুইকা যায় অর্জুনের কয়েকটা তীর...

হাতি প্রাণীটা কোনো অবস্থাতেই লাফাইতে পারে না। বিচিতে গাঁথে তীর; সেই তীর নিজের রানে বাড়ি খাইয়া আবার গিয়া গুতায় সেই বিচিতেই। এরই মাঝে উথাল পাতাল হওয়া হাতির সোয়ার ভগদত্ত বর্শার নিশানা কইরা বসে অর্জুনের দিকে...

অর্জুন এক্কেবারে বেখেয়াল আর অসহায় আছিল এই বর্শায়। কিন্তু আঘাতটা ঠেকাইয়া দেয় কৃষ্ণ তার ঢালে...

ভগদত্তের মাহুত শেষ পর্যন্ত আর হাতি সামলাইতেই পারে না। হাতিটা থামতে গিয়া হুড়মুড় পইড়া গড়াগড়ি খায়। মাটিতে পইড়া ভগদত্ত নিজেরে সামলাইতে হামাগুড়ি দেয়। অর্জুন কৃষ্ণরে কয়- যুদ্ধ করবা না কইয়া তুমি কিন্তু আবারো যুদ্ধে অংশ নিলা ঢাল ব্যবহার কইরা...

কৃষ্ণ কয়- অংশ না নিলে ভগদত্তের এই বর্শা খাইয়া তোমার আর এই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকত না অতক্ষণ। ...লও এইবার ভগদত্তরে গাঁথো...

বুকে এক তীর খাইয়া দুর্যোধনের শ্বশুর ভগদত্ত আর উঠে না কুরুক্ষেত্রের মাঠে...

কর্ণের কথাই ঠিক। ভীম এখনো একবারের লাইগাও আড়ালে যায় নাই। কর্ণ দুর্যোধন আর অশ্বত্থামা আইসা উপস্থিত হইলে ভীম তাগোরেও আক্রমণ কইরা বসে। এতগুলা বড়ো যোদ্ধার লগে ভীম একলা লড়তাছে দেইখা শেষ পর্যন্ত সাত্যকি নকুল সহদেব আইসা তারে হাত দেয়। এই ফাঁকে ধৃষ্টদ্যুু আবার দ্রোণরে আক্রমণ করে আর একটু পরে দক্ষিণ দিক সাফ কইরা দ্রোণের সামনে আইসা খাড়ায় অর্জুন...

অর্জুনরে দেইখা দ্রোণ কর্ণরে ডাকেন অর্জুনরে ঠেকাইতে। কর্ণ অর্জুনরে ঠেকায় কিন্তু তার তিন ভাই মরে অর্জুনের হাতে। এর ফাঁকে ভীমের গদামে শুইয়া পড়ে আরো কয়জন...

সইন্ধ্যায় দুর্যোধনের ধাতানি খাইয়া কোঁকায় দ্রোণ- কইছিলাম তো যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনব। কিন্তু এইটাওতো কইছিলাম যে যদি অর্জুন তার আশেপাশে না থাকে। আইজ তো পিরায় তারে ধইরা ফালাইছিলাম। কিন্তু অর্জুন তো আইসা পড়ল শেষ দিকে..
.
- আপনেরে মতো যুদ্ধমূর্খরে সেনাপতি করাই ভুল হইছে আমার। আপনার সকল কারিগরি খালি মুখে...

দ্রোণ আরো বহুক্ষণ মিনমিন করে। তারপর আবারও সে পরের দিনের লাইগা প্রতিজ্ঞা ঝালাই করে দুর্যোধনের কাছে। তবে এইবার সে যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনার কথা আর কয় না। কয়- কাইল নিশ্চয়ই পাণ্ডবগো কোনো এক বড়ো বীরেরে ফালামু আমি। এইটা নিশ্চিত। তুমারে কথা দিলাম...

দুর্যোধন খাকারি দেয়- পাণ্ডবগো বড়ো বীর তো অর্জুন আর ভীম। অর্জুনরে তো আপনে ডরানই। আর ভীম একলাইতো আইজ আপনাগোরে পিটাইয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত তক্তা বানাইল...। ঠিকাছে... দেখি কাইল কী ছিড়েন আপনে...

কর্ণ যে দুইদিন ধইরা যুদ্ধে নামছে; সেই দুইদিনই কৃষ্ণ অর্জুনরে দূরে দূরে রাখে। আবার সেনাপতি দ্রোণও কর্ণরে রাখেন সকলের পিছনে পিঠ বাচানোর কামে; কারণ পাণ্ডবগো যুদ্ধ পরিকল্পনার কোনো হিসাবই মিলাইতে পারতাছেন না তিনি...

তেরো নম্বর দিনেও অর্জুন দক্ষিণে যায় সংশপ্তকদের লগে যুদ্ধে। পাণ্ডব বীর ধরার ফাঁদ বানাইতে দ্রোণ রচনা করেন চক্রব্যূহ। ...এইটা একটা গাণিতিক হিসাব। দাবার মতো। কোন দিকে আক্রমণ দেখাইব আর কোন দিকে আক্রমণ শানাইব তা বুঝতে শত্র“রা ধান্দায় থাকে। সামনে আগাইতে আগাইতে সৈনিকরা বহুদূর ঢুইকা যায় কিন্তু মূল আক্রমণটা আসে পিছন কিংবা অন্য অসতর্ক দিক দিয়া। ...সেনা বিন্যাস দেইখা কৌশল ঠিক করতে হয় চক্রব্যূহ মোকাবেলা করার। এই কামটা খুব ভালো জানে কৃষ্ণ অর্জুন কৃষ্ণের পোলা প্রদ্যুু আর কিছুটা জানে অর্জুন-সুভদ্রার ১৭ বছর বয়সের পোলা অভিমন্যু...

দ্রোণের চক্রব্যূহ দেইখা ঘাবড়ায় যুধিষ্ঠির। অর্জুন দক্ষিণে গেছে; কৃষ্ণও গেছে তার লগে। এখন এই ব্যূহের ফান্দে পইড়া না সকলের প্রাণ যায়। যুধিষ্ঠির দৌড়াইয়া গিয়া অভিমন্যুর হাতে ধরে- আইজ তুই ছাড়া তোর বংশরে রক্ষা করার আর কেউ নাই বাপ...

অভিমন্যু কয় আমি যাইতে পারি কিন্তু ফান্দে পইড়া গেলে কেমনে এর থাইকা বাইর হইতে হয় সেইটাতে আমার জানা নাই জ্যাঠা...

যুধিষ্ঠির কয়- তুই ভাঙতে পারলেই হইব। তোর পিছে পিছে আমরা গিয়া তোরে সাপোর্ট দিমু...

অভিমন্যু সামনে আর পিছনে বাকি পাণ্ডবেরা- ভীম নকুল সহদেব যুধিষ্ঠির। অভিমন্যু ব্যূহ ভেদ কইরা ঢুইকা পড়ে দ্রোণ সৈনিকের ভিতর; কিন্তু ঠিক তখনই সে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে কাকা জ্যাঠার বাহিনী থিকা। এইটাই এই ব্যূহের কৌশল। একজন একজন কইরা আটকাইয়া কতল করা। অভিমন্যুরে ব্যূহে ঢোকার সুযোগ দিয়াই অগ্রবর্তী দলের জয়দ্রথ পথ বন্ধ কইরা দেয় বাকি পাণ্ডবগো ঢোকার...

ব্যূহের ভিতরে ঢুইকা অভিমন্যু দেখে কৌরব পক্ষের সকল বড়ো যোদ্ধার সামনে সে এক্কেবারে একা...। সমানে আক্রমণ করতাছে দুর্যোধন- দ্রোণ-অশ্বত্থামা-কৃপাচার্য-কর্ণ- শল্য...

শল্য বইসা পড়ে অভিমন্যুর তীর খাইয়া। শল্যের ভাই যায় মইরা। এই দেইখা ঘাবড়াইয়া যায় দ্রোণ। কৃপাচার্যের কাছে গিয়া কয়- অর্জুনের পোলাও দেখি অর্জুনের সমান। এরে সামলানোও তো সহজ হইব বইলা মনে হয় না আমার...

দ্রোণের এই কথা কানে যায় দুর্যোধনের। সে কর্ণ আর দুঃশাসনের গিয়া কয়- বুইড়া বামুন ডরাইছে অর্জুনের বাচ্চা পোলারে দেইখা। এরে তোমরা ফালাও...

দুঃশাসন কয়- খাড়াও ভাইজান। আমিই ফালাইতাছি তারে...

কিন্তু অভিমন্যুরে মারতে গিয়া অভিমন্যুর তীরে নিজেই অজ্ঞান হইয়া পড়ে দুঃশাসন। কর্ণ আগাইয়া আইসা কয়েকটা তীর খাইয়া আবার পিছায়। দ্রোণ কৃপাচার্য নিজেদের জান বাচাইয়া থাকে দুরে...

এর মাঝে অভিমন্যুর হাতে মারা গেছে শল্যের পোলা রু´রথ আর দুর্যোধনের পোলা লক্ষ্মণ। নিজের পোলার মরণ দেইখা পাগলা ষাঁড়ের মতো চিল্লাইতে থাকে দুর্যোধন। দুর্যোধনের ধাতানি খাইয়া আবার সকলে আইসা ঘিরা ধরে অভিমন্যুরে- দ্রোণ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামা- বৃহদবল আর কৃতবর্মা...

এর মাঝেও বৃহদবলরে মাইরা ফালায় অভিমন্যু। দ্রোণ আবারও ডর খায়। কয়- আমার তো মনে হয় আমি অর্জুনরেই দেখতাছি চোখের সামনে। সে কোন দিকে যায় আর কোনদিকে মারে তাই তো ঠাহর করতে পারতাছি না আমি... কর্ণ। তুমি ছাড়া এরে ঠেকাইবার মতো কাউরে দেখি না বাপ। যদি পারো তয় এর হাত থিকা ধনুক ফালাও আর এর রথ নষ্ট করো...

কর্ণের তীরে অভিমন্যুর হাত থিকা ধনুক পড়ে। কর্ণ তার সারথি আর ঘোড়া মারে আর আর তার উপরে একলগে তিরাইতে থাকেন দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা দুর্যোধন শকুনি...

রথ সারথি আর ধনুক হারাইয়া অভিমন্যু তলোয়ার নিয়া খাড়ায়। সেইটাও দ্রোণের তীরে হাত থাইকা ছুইটা গেলে ভাঙা রথের চাকা নিয়া অভিমন্যু সবাইরে দাবড়ায়। সেইটাও হাত থিকা পইড়া গেলে হাতে তুইলা নেয় গদা; কিন্তু ততক্ষণে দুঃশাসনের পোলার গদার বাড়িতে মাটিতে গড়াইতে হয় তারে...

অভিমন্যুরে হারাইয়া কান্দে যুধিষ্ঠির। আর সন্ধ্যায় ফিরা পাগলা হইয়া উঠে অর্জন। এই যুদ্ধে তার দ্বিতীয় পোলার মৃত্যু এইটা। এর আগে গেছে ইরাবান। অর্জুনের বিলাপ থামাইতে পারে না কেউ। সকল ভাইরে সে ঝাড়ি লয় তার পোলারে রক্ষা করতে না পারার লাইগা। শেষে কৃষ্ণ আইসা তারে ধরে- হা হুতাশ কইরা কী লাভ? দ্রোণের চক্রব্যূহের মূল দ্বারপাল হইল জয়দ্রথ। সে যদি বাকিদের ঠেকাইয়া না রাখতো তবে কি আর অভিমন্যুর এই পরিণতি হইত আইজ?

অর্জুনের সকল রাগ গিয়া পড়ে জয়দ্রথের উপর। সে সকলরে শোনাইয়া কয়- কাইল যদি না সূর্য ডোবার আগে আমি জয়দ্রথরে মারতে পারি তয় আগুনে ঝাঁপ দিয়া নিজে মইরা যাইমু কইয়া দিলাম...

অর্জুনের পণ শুইনা ঘাবড়াইয়া যায় জয়দ্রথ। রাত্তিরে দুর্যোধনরে গিয়া কয়- হয় আমারে রক্ষার লাইগা তোমরা একটা ব্যবস্থা করো; নাহয় আমি নিজের দেশে গিয়া পলাইয়া নিজের জান বাচাই। কারণ অর্জুন যখন কইছে কাইল আমারে মারব; সে মাইরাই ফালাইব আমারে...

দুর্যোধন কয়- অত ডরাও ক্যান? তুমি নিজেও দ্রোণের শিষ্য আর বহুত বড়ো যোদ্ধা। তার উপরে আমরা তো আছিই তোমার লগে। অর্জুন কইলেই হইল যে তোমারে মারব?

দ্রোণ কন- ডরাইও না। আমি কথা দিলাম কাইল আমি তোমারে রক্ষা করব অর্জুনের হাত থিকা। কাইল আমি এমন ব্যূহ বানাইমু যে অর্জুনের পক্ষে তা ভাইঙা তোমারে ধরা সম্ভব হইব না...

কথাখান কইয়া নিজে নিজেই ডর খান দ্রোণ। সেনাপতি হইবার পয়লা দিন তিনি কইছিলেন যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনবেন। সেইটাতো পারেনই নাই; শেষ পর্যন্ত তিন নম্বর দিনে অর্জুনের ১৭ বছরের পোলা মাইরা দুর্যোধনের দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইছেন। এখন যে কথা কইলেন- কাইল অর্জুনের হাত থিকা তোমারে আমি রক্ষা করব... যদি না পারেন?

ইজ্জত বাচাইবার লাইগা দ্রোণ নিজের কথার লগে একখান লেঞ্জা জুইড়া দেন- তয় বাপ। জন্মিলে মরিতে হয় এইটাতো জানো। আমরা কেউই বাচব না চিরকাল। তাই তোমারে কই; মরণের চিন্তা বাদ দিয়া তুমি যুদ্ধ করো। আমরা তো আছিই। কপালে থাকলে যে কারো মরণ হইতে পারে যেকোনো দিন...

রাত্তিরে অর্জুন ঠান্ডা হইলে কৃষ্ণ কয়- তুমি আমারে না জিগাইয়া বেকুবের মতো যে পণ করলা কাইলই জয়দ্রথরে মারবা না হয় নিজে মরবা। এতো বড়ো দুঃসাহস করাটা ঠিক হয় নাই তোমার। কর্ণ ভূরিশ্রবা বৃষসেন কৃপ আর শল্যের মতো যোদ্ধারা আছে জয়দ্রথের লগে। এই অবস্থায় কামটা যদি করতে না পারো তয় সকলে যে আমাগোরে নিয়া হাসব সেইটা ভাবছ?

অর্জুন কয়- সর্বদাই তোমার পরিকল্পনায় আমি অস্ত্র চালাই কৃষ্ণ। কাইল না হয় আমার অস্ত্র চালানোর লাইগা তুমি পরিকল্পনা করো...

পাণ্ডব শিবিরে বাকি কারো ঘুম নাই। অর্জুন এমন এক পণ করছে যে; হয় সে কাইল জয়দ্রথরে মারব না হয় নিজে মরব আগুনে ঝাঁপ দিয়া। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিররে সান্ত্বনা দেয়- আমার উপরে ভরসা রাখেন ভাই। একটা ব্যবস্থা হইব কাইল যাতে সাপ না মরলেও লাঠি থাকে ঠিকঠাক...

কৃষ্ণ পরিকল্পনা শানায়। নিজের চ্যালাগো ডাক দিয়া কয়- চাইর ঘোড়া জুইড়া আমার রথ রেডি রাখো সকল অস্ত্র বোঝাই দিয়া। দরকার পড়লে কাইল আমি নিজেই চালামু অস্ত্র...

চৌদ্দ নম্বর দিনের সকালে জয়দ্রথরে দ্রোণ রাখেন সকলের পিছে। হাতি বাহিনী নিয়া সবার আগে অর্জুনের সামনা সামনি হয় দুর্যোধনের ভাই দুর্মর্ষণ। সেইটারে সরাইয়া অর্জুনের মোকাবেলা করে দুঃশাসনরে। মাইর খাইয়া দুঃশাসন দ্রোণের শরণে গেলে অর্জুন আইসা তারে সালামালকি দেয়- পেন্নাম গুরুদেব। আপনে আমার কাছে ভগবানের সমান। আমার পণ রক্ষায় আপনে আমারে আশীর্বাদ করেন...

অর্জুনের কথায় দ্রোণ হাসেন- তেলাইয়া পার পাইবা না অর্জুন। আমারে না মাইরা কিন্তু জয়দ্রথরে ছুইতে পারবা না তুমি...

অর্জুন শুরু করে দ্রোণেরে মারা। কৃষ্ণ কয়- খামাখা সময় নষ্ট করো ক্যান? ইনারে ফালাইবা না যখন তখন তিরাতিরি বন্ধ করো তার লগে...

কৃষ্ণ রথ সরাইয়া নেয়। পিছন থাইকা দ্রোণ টিটকারি মারেন- অর্জুন কি ভাগতাছ দ্রোণাচার্যের ডরে?

যাইতে যাইতে অর্জুন কয়- গুরুরে জয় করা যেমন গৌরবের কিছু না; তেমনি গুরুর সামনে থাইকা ভাগাও কিন্তু লজ্জার কিছু না গুরুদেব...

কৃষ্ণ এইবার দেখায় তার রথ চালানোর আশ্চর্য কৌশল। সকলের ফাঁকে ফোকরে সে প্রায় গিয়া সামনে খাড়ায় জয়দ্রথ বাহিনীর। দুর্যোধন দৌড়ায় দ্রোণের নিকট- খাড়াইয়া করেনটা কী আপনে? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারতাছি না যে আপনে জীবিত থাকতে অর্জুন আপনেরে পাশ কাটাইতে পারে। আমার তো মনে হইতাছে আপনি আমার কাছ থিকা মোটা বেতন নেন আর কাম করেন পাণ্ডবদের। ...ভুলটা আমারই হইছে। জয়দ্রথ যখন পলাইতে চাইছিল তখন আপনার মতো বেইমানের ভরসাতেই আমি তারে কুরুক্ষেত্রে রাখছি...

দ্রোণ শুরু করেন অজুহাত- বাপ তুমি আমার কাছে আমার পোলা অশ্বত্থামার মতো। তোমার কাছে সত্য কইতে শরম নাই। তুমি নিজেই তো জানো যে কৃষ্ণের থাইকা বড়ো সারথি এইখানে কেউ নাই। তুমি তো নিজেই দেখছ যে আমি যখন তীর ছাড়ি অর্জনরে গাথার লাইগা; আর সেই তীর যখন গিয়া মাটিতে গাঁথে তখন কৃষ্ণের ঘোড়া দাবড়ানির কারণে অর্জুন থাকে তীর থাইকা একশো হাত দূরে...। তীরের মুখ তো আর ঘোড়ার মতো মাঝপথে বদলান যায় না বাপ। ...তাছাড়া আমার যা বয়স; আমি কেমনে অর্জুনরে ধাওয়া করি বলো?

এইসব অজুহাতে দুর্যোধন ধাতানি লাগায়। এইবার দ্রোণও একটু গরম দেখান- শোনো। আমি কিন্তু অর্জুনের বিষয়ে তোমারে কোনোদিনও কোনো কথা দেই নাই। আমি তোমারে কথা দিছি যুধিষ্ঠিররে ধইরা দিবার বিষয়ে। এখন যুধিষ্ঠিররে বাদ দিয়া তোমার কথামতো আমি অর্জুনের পিছু ধাওয়া দিতে পারি না। আমি আমার পণ রক্ষা করতে গেলাম। তুমি নিজে গিয়া অর্জুনরে ঠেকাও...

দ্রোণ ভাগল দিতে চান। দুর্যোধন গিয়া তার সামনে খাড়ায়- তিরন্দাজ হইয়া আপনে অর্জুনরে ঠেকাইতে পারেন না আর আমারে কেমনে কন গদা নিয়া গিয়া তিরন্দাজ ঠেকাও?

দ্রোণ এইবার একটা বর্ম আগাইয়া দেন দুর্যোধনের দিকে- এই বর্ম পইরা তুমি অর্জুনের সামনে গিয়া খাড়াও। কারো তীরই এই বর্ম ভেদ করতে পারব না। এর বেশি তোমারে কোনো সাহায্য আমি করতে পারব না বাপ। আমারে মাফ কইরা দেও...

সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কৃষ্ণ অর্জুন এখনো জয়দ্রথরে ধরতে পারে নাই। অর্জুন কৃষ্ণরে কয়- ঘোড়াদের পেটে দানাপানি নাই। একটু থামা দরকার। আমারো কিছু দানাপানি খাওয়া লাগে...

কাদা খুইড়া অর্জুন পানি বাইর কইরা খায়। কৃষ্ণ ঘোড়াদের দানাপানি দেয়। কিছু বিশ্রাম কইরা আবার রওয়ানা দেয় তারা। এইবার তারা সামনে জয়দ্রথরে দেখে। কিন্তু পথ আগলায় দুর্যোধন। কৃষ্ণ কয়- বাদ দেও জয়দ্রথ। পালের গোদারে যখন পাওয়া গেছে তখন দুর্যোধনেরই পাড়ো এইবার...

দুর্যোধনরে তীর মারতে গিয়া অর্জুন তার শরীরের বর্মটা চিনতে পারে- এইটা গুরু দ্রোণ দুর্যোধনের বাইন্ধা দিছেন। এই বর্ম অর্জুনও বান্ধে। এই বর্মে তীর বিন্ধানো কঠিন। কিন্তু দুর্যোধন জীবনের পয়লা দিন বানছে বইলা বান্ধনে কিছু ফাঁক রইয়া গেছে। অর্জুন কয়- অসুবিধা নাই। এরেই তবে ধরি এইবার...

অর্জুনের তীরে দুর্যোধনের হাত থিকা তীর পড়ে। বর্মের চিপা দিয়া কিছু তীর বিন্ধে তার দেহে। দুর্যোধনের ঘোড়া আর সারথি মরে। এমন সময় দুর্যোধনরে কভার দিতে আইসা খাড়ায় কর্ণ ভূরিশ্রবা কৃপ আর শল্য...

অর্জুন বেকায়দা দেইখা বাজায় তার দেবদত্ত শঙ্খ। কৃষ্ণও বাজাইতে থাকে তার পাঞ্চজন্য শঙ্খ পাণ্ডবগো সাহায্যের আশায়....

এর মাঝে অন্য মাঠে অলম্বুষরে মাইরা ফালাইছে ভীমের পোলা ঘটোৎকচ। দ্রোণ তিরাতিরি করেন পাঞ্চাল বাহিনীর লগে। এমন সময় অর্জুন আর কৃষ্ণের শঙ্খ শুইনা যুধিষ্ঠির সাত্যকিরে কয়- তোমার দুই গুরু অর্জুন আর কৃষ্ণ বিপদে আছে। তুমি ছাড়া তাগোরে রক্ষার কেউ নাই...

সাত্যকি কয়- আমি সইরা গেলে কিন্তু দ্রোণ আপনের বন্দী কইরা ফালাইতে পারে...

যুধিষ্ঠির কয়- তুমি যাও। আমি গিয়া ভীম আর ঘটোৎকচের বগলে খাড়াইলে দ্রোণের সাহস হইব না কিছু করার...

দ্রোণ আগান না যুধিষ্ঠিরের দিকে। তিনি গিয়া সাত্যকির সামনে খাড়ান- তোমার গুরু অর্জুন তো আমার সামনে থাইকা পলাইছে। আশা করি তুমিও পলাইতে চাইবা না ডরে...

সাত্যকি দ্রোণরে পাশ কাটাইতে গেলেও তিনি তারে আক্রমণ কইরা বসেন। সাত্যকি থামে না। যাইতে যাইতে তীর মাইরা দ্রোণের ঘোড়া আর রথের সারথিরে ফালাইয়া থুইয়া অর্জুনের দিকে আগাইবার আগে কয়েকটা তীর বিন্ধাইয়া দেয় দ্রোণের শরীরে। দ্রোণ ফিরা যান শরীরের ক্ষত মেরামত করতে। আর সাত্যকি আগায় অর্জুনের দিকে....

রাস্তায় দুর্যোধন বাহিনীরে নাস্তানাবুদ কইরা আগায় সাত্যকি। তার দাপট দেইখা দুঃশাসন আইসা দ্রোণের বগলে খাড়ায়। দ্রোণ কন- কওতো জয়দ্রথ কি জীবিত আছে এখনো? তা তুমি ভাইগা আইলা ক্যান? পাশা খেলার আসরে তুমি না কইছিলা পাণ্ডবরা সব নপুংসক? তোমার সেই লাফানি এখন কই?

দ্রোণের খোঁচায় দুঃশাসন আবার সাত্যকির পিছু নিয়া মাইর খাইয়া দেয় আরেকটা ভাগল...

বিকালের দিকে দ্রোণের হাতে মরে কেকয় রাজের পোলা বৃহৎক্ষেত্র- শিশুপালের পোলা ধৃষ্টকেতু আর ধৃষ্টদ্যুুের পোলা ক্ষত্রধর্মা। কৃষ্ণ আর অর্জুনের কোনো সাড়াসংবাদ না পাইয়া যুধিষ্ঠির ভীমরে কয়- আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। তুই গিয়া দেখ কী হইতাছে ওইদিকে এখন...

ভীম কয় অর্জুনের লগে যতক্ষণ কৃষ্ণ আছে তৎক্ষণ ডরের কিছু নাই তবুও যখন কইতাছ তখন আমি যাই...

দ্রোণ পাহারা দিতাছেন কোন সময় যুধিষ্ঠিররে একলা পাওয়া যায়। সামনে আগানও না; আবার সরেনও না। তার সামনে দিয়া যখন ভীম যাইতেছিল অর্জুনের দিকে; একটা তীর ছুইড়া তিনি তারে নাড়ান- অর্জুন ভাগছে ডরাইয়া। আশা করি আমার ডরে তুমিও ভাগবা না ভীম?

মুখ না খুইলা হাত চালায় ভীম। তার গদামে দ্রোণের ঘোড়া আর সারথি মইরা গেলে তিনি নিজে মাটিতে লুটান। ভীম গিয়া খাড়ায় তার সামনে- আমি অর্জুনের মতো ভদ্দরলোক কিংবা দয়ালু কোনোটাই না। তোর মতো ছোটলোক বামুনরে সম্মান দেখানোর ঠেকাও নাই আমার...। তরে মাটিতে পুইতাই তবে অন্য দিকে যাই...

ভীমরে গদা উঠাইতে দেইখা পড়িমরি দৌড়ান দ্রোণ। দৌড়াইয়া গিয়া আরেকটা রথে উইঠা বাচান নিজের জান- বাপরে। মাইজা পোলাটারে আদব কায়দা কিছুই শিখায় নাই কুন্তী...

রাস্তায় ভীমের হাতে মরে ধৃতরাষ্ট্রের আরো চাইর পোলা- বিন্দু-অনুবিন্দু-সুবর্মা আর সুদর্শন। কিছুদূর আগাইয়া অর্জুন আর কৃষ্ণরে অক্ষত দেইখা শঙ্খ বাজাইয়া যুধিষ্ঠিররে কুশল সংবাদ দেয় ভীম; কৃষ্ণ অর্জুনও সংবাদ দেয় তাগো অক্ষত দেহে বাইচা থাকার...

দুর্যোধন আবার দৌড়াইয়া আসে দ্রোণের কাছে- গুরুদেব। পয়লা অর্জুন আপনের অতিক্রম কইরা গেলো। তারপর গেলো সাত্যকি। তারপর এখন দেখি ভীমরেও আপনে ঠেকাইতে পারলেন না। ঘটনাটা আমারে একটু বুঝাইয়া কনতো আপনে...। আপনে তো কোনো কামেরই না...

দুর্যোধনের কথায় দ্রোণ আবোল তাবোল বকতে শুরু করেন- আমি আর কী করব? শকুনির বুদ্ধিতে তুমি যদি পাশা না খেলতা। নিজের কাকাতো ভাইগো লগে যদি যুদ্ধে না জড়াইতা তাইলে আইজ আর এই দশা হইত না...

দুর্বাল বইলা দুর্যোধন আবার ছোটে জয়দ্রথরে বাচাইতে...

রাস্তায় কর্ণরে দেইখা ভীম পাশ কাইটা যায়। কর্ণ তারে ডাকে- তোমার সম্পর্কে জীবনেও যা কেউ কল্পনা করে নাই আইজ তুমি তাই করলা ভীম। শত্র“রে ডরাইয়া পাশ কাইটা গেলা....

একমাত্র কর্ণরেই ডরায় ভীম। আর কেউ তারে মাকুন্দা কইলে সোজা গদার বাড়ি দিয়া তারে মাটিতে শুয়াইয়া ফালায় ভীম। কিন্তু এই কর্ণ প্রকাশ্যেই তারে মাকুন্দা বইলা ডাকে। বনবাসের তেরো বছর যতবারই ভীম বন থিকা বাইর হইয়া হস্তিনাপুর আইসা মারামারি করতে চাইছে। ততবারই যুধিষ্ঠির কর্ণের ভয় দেখাইয়া তারে ঠেকাইছে। কিন্তু এত বড়ো কথার পর ভীমের পক্ষে সইরা যাওয়া কঠিন...

ভীম ফিরা আইসা ধুমা তীর চালাইতে থাকে কর্ণের দিকে। কর্ণ বেশ মজা পায়- গদারু মানুষ হইলেও তুমি দেখি ভালোই তীর চালাইতে পারো...

কর্ণ ভীমেরে মারে না। খালি তার মাইর ঠেকায়...

কর্ণ ভীমের হাত থিকা তীর ফালাইয়া দেয় তীর মাইরা। রথের ঘোড়া মারে। ভীম রথ ছাইড়া ঢাল তলোয়ার নিয়া আগাইয়া আসে কর্ণের দিকে। কর্ণ ভীমের ঢাল ভাইঙা ফালায়। ভীম ক্ষেইপা তলোয়ার ছুইড়া মাইরা কর্ণের হাত থিকা ধনুক ফালাইয়া দেয়। কর্ণ আরেকটা ধনুক তোলে। ভীম এইবার গিয়া মরা হাতি আর ভাঙা রথের আড়ালে লুকাইয়া রথের টুকরা টাকারা ছুইড়া মারতে থাকে কর্ণের দিকে। কর্ণ কয়েকটা তীর মাইরা ভীমরে কাবু কইরা ফালায়। তারপর সামনে গিয়া ধনুকের আগা দিয়া তার পেটে গুতা মাইরা হাসে- হালা মাকুন্দা বৃকোদর। খালি যুদ্ধ করার লাইগা ফাল পাড়লেই হয় না; যুদ্ধ জানাও লাগে। যুদ্ধক্ষেত্র তোর জায়গা না; তোর উপযুক্ত জায়গা হইল বাবুর্চিখানা। যা বনে গিয়া মুনিঋষি হইয়া ফলমূল খা; না হয় কারো বাবুর্চিখানায় চাকরি নিয়া বাবুর্চিগিরি কর আর খন্দক ভর...

ভীম বেকুব বইনা যায়। কর্ণ তারে মারে না ক্যান? ভীম হা কইরা তাকাইয়া থাকে। কর্ণ হাসে- যাও। কৃষ্ণ আর অর্জুনরে সাহায্য করতে আসছিলা হয় সেইখানে যাও। অথবা বাড়ি ফিরা যাও; যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার থাকার দরকার নাই...

ভীমের আঁতে লাগে। কয়-ছোটলোকের বাচ্চা আমারে দয়া দেখাইতে হইব না তোর। হয় মার না হইলে আমার লগে মল্লযুদ্ধ কর। তোরে দেখাইতাছি আমি লড়াই জানি কি না...

কর্ণ হাসে- সেইটাও একটা কথা। আমার মতো বড়ো যোদ্ধার লগে যেমন তোমার মতো নাদানের যুদ্ধ করা ঠিক না। তেমনি আমার মতো ছোটলোকের লগেও কিন্তু তোমার মতো রাজপুত্তুরের লড়াই করা মানায় না...

ভীম আবারও হা কইরা থাকে। অর্জুনের চোখে পড়ে ভীমের কাছে কর্ণ। অর্জুন তাড়া দিয়া আসে কর্ণের দিকে। ভীম সইরা গিয়া সাত্যকির রথে উঠে। কর্ণ গিয়া খাড়ায় দুর্যোধনের কাছে...

ভীমরে অর্জুনের কাছে রাইখা আসার পথে সাত্যকি মুখোমুখি হয় ভূরিশ্রবার। ভূরিশ্রবা সাত্যকিরে মাটিতে পাইড়া ফালায়। তারে লাইত্থাইতে লাইত্থাইতে একহাতে চুলের মুঠি ধইরা আরেক হাতে তলোয়ার তোলে মাথা নামাইতে। ঠিক তখনই কৃষ্ণের চোখে পড়ে সাত্যকির দুরবস্থা। কৃষ্ণ কয়- সাত্যকিরে বাচাও...

অর্জুনের তীর আইসা বিধে তলোয়ার ধরা ভূরিশ্রবার ডান হাতে। তলোয়ার পইড়া যায়। ভূরিশ্রবা অর্জুনের দিকে তাকায়- খুব বাজে কাম করলা অর্জুন। যাউরা যাদবের কথায় যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করলা তুমি। আরেকজনের লগে যুদ্ধ করা কারো উপর আক্রমণ করা যুদ্ধ নিয়মে নিষেধ...

ভূরিশ্রবা অর্জুন আর কৃষ্ণরে গালাগালি করতে ব্যস্ত এরই মধ্যে সাত্যকি উইঠা যে অস্ত্র ভূরিশ্রবার হাত থিকা পড়ছিল সেইটা তুইলাই ভূরিশ্রবার মাথাটা আগলাইয়া ফালায় ধড় থাইকা। আশপাশে সকলে এইবার হায়হায় কইরা উঠে- যুদ্ধ নিয়মের আরেকখান লঙ্ঘন। গালাগালিরত কাউরে অস্ত্র দিয়া আঘাত করতে নিষেধ কইরা দিছেন দ্বৈপায়ন...

সাত্যকি কয়- যেকোনো উপায়ে শত্রু কমানোই যুদ্ধের সব থিকা বড়ো নিয়ম...

সূর্যাস্তের আর সামান্য বাকি। দুর্যোধন কর্ণরে কয়- আরো কিছুক্ষণ যদি অর্জুনরে ঠেকাইয়া রাখা যায় তবে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা বিফলে যাইব আর তারেও গিয়া ঢুকতে হইব আগুনে...

সাত্যকি ভীম অর্জুন। তিন বাহিনীর আক্রমণে বেসামাল হইয়া উঠে কুরু সেনাসৈনিক। অর্জুন পৌছাইয়া যায় জয়দ্রথের কাছে। জয়দ্রথের সারথি আর ঘোড়া মইরা গেলে জয়দ্রথ পলাইতে থাকে। পলাইতে পলাইতে গিয়া সে হাজির হয় তার পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের আশ্রমে। বৃদ্ধক্ষত্র নিজের পোলারে রাজ্য দিয়া বহুদিন থাইকাই কুরুক্ষেত্রের পাশে সামন্তপঞ্চকে ব্রহ্মচর্য জীবন যাপন করেন। অর্জুন আর কৃষ্ণও পিছু নেয় জয়দ্রথের। এর মধ্যে সূর্য ডুইবা যায়। সূর্য ডুইবা গেছে তাই এখন অর্জুনের আগুনে ঝাঁপ দিয়া নিজের জীবন শেষ করার পালা। দুর্যোধনের বাহিনী গা ঢিলা দিয়া হাসাহাসি করে- জয়দ্রথ বাইচা গেলো। চলো এখন গিয়া দেখি অর্জুন কেমনে আগুনে ঝাঁপ দিয়া মরে...

পাণ্ডব বাহিনীও যুদ্ধ শেষের আড়মোড়া ভাঙে। অর্জুন ধনুক নামায়। জয়দ্রথ ভালো কইরা আকাশে দেখে সূর্যের কোনো চিহ্ন আছে কি না। ...নাই। সূর্য ডুইবা গেছে। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা বিফলে গেছে। তার আর প্রাণের ভয় নাই। নিশ্চিন্ত জয়দ্রথ এইবার আইসা খাড়ায় পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের আশ্রমের আঙিনায়। আর তখনই আশ্রমের বাইরে ঘাপটিমারা কৃষ্ণ অর্জুনের কানে কানে কয়- গাঁথো হালারে...

অর্জুনের তীরে ভ্যাবাচেকা জয়দ্রথ লুটাইয়া পড়ে ব্রহ্মাচারী বাপের সামনে আর পোলার এমন মৃত্যুতে হার্ট অ্যাটাক কইরা বাপ বৃদ্ধক্ষত্র লুটাইয়া পড়েন পোলা জয়দ্রথের পাশে...

অর্জুন কইছিল জয়দ্রথরে মারবে সূর্য ডোবার আগে। কিন্তু জয়দ্রথ মরল সূর্য ডোবার পরে। সকলেই কানাঘুসা করে। কেউ মাঠ ছাইড়া যায় না। দুর্যোধন ক্ষেইপা উঠে দ্রোণের উপর- আপনে না আছিলেন সকলের সামনে। আপনের না কথা ছিল পাণ্ডবগো ঠেকাইবার। গত কাইল আপনের বাহাদুরি সফল করার লাইগা সকল পাণ্ডবগো যে জয়দ্রথ একলাই আটকাইয়া রাখল ব্যূহের বাইরে; আইজ তারেই রক্ষা করতে পারলেন না আপনে। আপনারে অতিক্রম কইরা অর্জুনতো গেলোই; সাত্যকি ভীমও আপনারে অতিক্রম কইরা গেলো। ...আমার কপালটাই খারাপ। যারে আমি বিশ্বাস কইরা সেনাপতি বানাই সেই আমার লগে বেইমানি করে। পিতামহ ভীষ্ম আমার সেনাপতি হইয়া পাণ্ডবগো লগে দয়ার যুদ্ধ কইরা গেছেন। আপনেও অর্জুন ভীম আর সাত্যকিরে ডরাইয়া জয়দ্রথরে খুন করাইলেন আইজ...

দ্রোণ এইবার পাল্টা খোঁচা মারে- খালি আমার উপরে দোষ চাপাও ক্যান? আমি তো বরাবরই কই যে অর্জুনের লগে পাইরা উঠা সম্ভব না আমার পক্ষে। কিন্তু আইজ তো তুমি কৃপ কর্ণ শল্য অশ্বত্থামা সকলেই জয়দ্রথের পাশে ছিলা; তোমরা কেন পারলা না অর্জুনরে ঠেকাইতে? কৃষ্ণ আর অর্জুন যেভাবে যুদ্ধ করে; জয়দ্রথ ক্যান; এখনতো নিজের জীবনের লাইগাও ডর লাগে আমার...
- আপনে এতটা অকর্মা আর কাপুরুষ তা আমি জানতাম না গুরুদেব....

দুর্যোধনের এই কথায় আবার ক্ষেইপা উঠেন দ্রোণ- আইজ রাত্তিরেও যুদ্ধ হইব। আমি তোমারে কথা দিতাছি দুর্যোধন; সমস্ত পাণ্ডব সেনা ধ্বংস না কইরা বর্ম খুলব না আমি...

দুর্যোধন কয়- রাত্তিরে যুদ্ধ করতে চান করেন। কিন্তু বড়ো গপ্প আর দিয়েন না। পয়লা দিন কইছিলেন যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনবেন; তার বালও ছিড়তে পারেন নাই এতদিনে। তার উপরে আপনি সেনাপতি হইবার পর থাইকাই আমার বড়ো বড়ো যোদ্ধাগুলারে হারাইতাছি আমি...

দ্রোণ বাইরাইয়া যান সৈন্য সমাবেশ করতে। দুর্যোধন কর্ণরে কয়- আমার নিজের কাছে নিজেরেই পাপী মনে হইতেছে এখন। জয়দ্রথ আমার ছোট বইনের স্বামী। প্রাণ রক্ষার লাইগা সে পলাইতে চাইছিল। কিন্তু এই দ্রোণের উপর ভরসা কইরাই আমি তারে পলাইতে না দিয়া নিজের বইনরে বিধবা করলাম.... কর্ণরে। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির দল নিয়া এই জগতে আমার মতো আর কেউ যুদ্ধ করছে জানি না। কিন্তু একটা কথা তোমারে কইয়া দেই; কেউ না থাকলেও আমি যুদ্ধ কইরা যামু...

কর্ণ দুর্যোধনরে সান্ত্বনা দেয়। গুরু দ্রোণরে আর কিছু কইও না তুমি। তিনি যুদ্ধ করতাছেন ঠিক। কিন্তু বয়স্ক মানুষ; নড়তে চড়তে কষ্ট হয় তার; অস্ত্র চালাইতেও হাতে জোর পান না। যুদ্ধেও তার অভিজ্ঞতা নাই। তার পক্ষে পাণ্ডবগো জয় করা কোনোদিনও সম্ভব না। আর জয়দ্রথের পুরা বিষয়টাই কৃষ্ণের চাল। সূর্য থাকা পর্যন্ত আমরা কিন্তু অর্জুনরে ঠিকই ঠেকাইয়া রাখছিলাম। সূর্য ডোবার পর জয়দ্রথও নিশ্চিন্ত হইয়া বাইরাইয়া আসছিল বাপের আশ্রমের আঙিনায়। কিন্তু কৃষ্ণ যে সূর্য ডোবার পরেও অর্জুনরে দিয়া জয়দ্রথরে হত্যা করাইব ঘুণাক্ষরেও কেউ তা অনুমান করতে পারি নাই আমরা। সূর্য ডোবার পরে আমরা সকলেই ঢিলা দিছিলাম। আর সেই সুযোগটাই নিছে কৃষ্ণ...

রাত্তিরের যুদ্ধে ভূরিশ্রবার বাপ সোমদত্ত পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে আইসা আক্রমণ করে সাত্যকিরে। কিন্তু উল্টা তীর খাইয়া ভাগতে হয় তার। অশ্বত্থামার হাতে মারা যায় ভীমের নাতি আর ঘটোৎকচের বড়ো পোলা অঞ্জনপর্বা। পোলার মৃত্যু সংবাদ শুইনা অশ্বত্থামার উপর ঝাপাইয়া পড়ে ঘটা। অবস্থা বেগতিক দেইখা অশ্বত্থামা কয়- বাপ ঘটোৎকচ। আমি তোমার পিতার সমতুল্য; তোমার বাপ ভীম আমার থাইকা ছয় বছরের ছোট। তোমার লগে আমার যুদ্ধ করা ঠিক না; তুমি সম্পর্কে আমার ভাতিজা হও...

এইসব ভুজুং আটকাইয়া রাখতে পারে না ঘটোৎকচেরে। সে হামলাইয়া পড়ে অশ্বত্থামার উপর। সোমদত্ত আবার ফিরা আইসা একই সাথে পইড়া যায় ভীম আর সাত্যকির সামনে। ভীমের গদাম আর সাত্যকির তীরে তারে আর উইঠা খাড়াইতে হয় না যুদ্ধ করার লাইগা। এইবার সোমদত্তের বাপ বাহ্লীমকরাজ আগাইয়া আসলে ভীমের এক গদামেই তার যুদ্ধের শখ মিটা যায়...

কুরু সেনাদের অবস্থা খুবই খারাপ। দুর্যোধন কর্ণের কাছে যায়- দোস্ত তুমি ছাড়া আমার সৈনিকদের রক্ষা করার কেউ নাই...
কর্ণ কয়- আমি জীবিত থাকতে তোমার চিন্তিত হইবার কোনো কারণ নাই...

কর্ণের কথা শুইনা কৃপাচার্য হাসেন- হালা গাড়োয়ানের পোলা। তোমার খালি মুখে মুখেই ভড়ং। যাও না। পাণ্ডবগো সামলাইয়া দেখাও একবার...
কর্ণও ক্ষেইপা উঠে- বুইড়া অক্ষম ব্রাহ্মণ। আবার বাজে কথা কইলে জিব কাইটা ফালাইমু কইলাম...
তারপর আবার দুর্যোধনের দিকে ফিরে- এই আরেকটা কালসাপ পুষতাছ তুমি। খায় তোমার আর গান গায় পাণ্ডবগো...

কৃপাচার্য হইল গিয়া অশ্বত্থামার মামা। ঘটোৎকচের হাত থাইকা পলাইয়া অশ্বত্থামা আসছিল বিশ্রাম করতে। মামারে কর্ণ এমন গালাগালি করতাছে দেইখা তলোয়ার নিয়া কর্ণের দিকে ধাওয়া করে অশ্বত্থামা- তুই হইলি গিয়া এক নম্বর অক্ষম। খালি নিজের ভড়ঙে দুনিয়ায় আর কাউরে চোখে পড়ে না তোর। অর্জুন যখন তোর সামনে জয়দ্রথরে মারল তখন তোর ভড়ং কই ছিল? মামায় তো ঠিকই কইছে; পাণ্ডবগো লগে লড়েতে গেলে তোর নিজের গু নিজেরই খাইতে হইব। আইজ তোর ভড়ং ছাড়ামু আমি...

দুর্যোধন আর কৃপাচার্য অশ্বত্থামারে আটকান। দুর্যোধন কয়- তোমরা যদি নিজেরা মারামারি করো তয় আমি কার উপর ভরসা করি কও...
কৃপাচার্য কর্ণের দিকে ফিরেন- খালি দুর্যোধনের লাইগা আমরা তোমারে ক্ষমা করলাম। তয় কইয়া দেই তোমার ভড়ং কিন্তু অর্জুনেই ভাঙবো...
অশ্বত্থামা দুর্যোধনরে কয়- আমি বাইচা থাকতে তোমার চিন্তার কিছু নাই। আমিই অর্জুনরে ঠেকাইয়া রাখব...
দুর্যোধন কয়- গুরু দ্রোণ পাণ্ডবগো এড়াইয়া চলেন। তুমিও তাই করো। এখন কেমনে কও তোমার উপর ভরসা করি?
অশ্বত্থামা কয়- বাদ দেও পিছনের কথা। এখন দেখো কী করি না করি...

সন্ধ্যা শেষ হইয়া অনেক অন্ধকার। তবুও যুদ্ধ থামে না। দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠির; দুইজনই নিজেগো অর্ধেক পদাতি সৈন্যের হাতে মশাল ধরাইয়া দিলো শত্রুমিত্র চিনা যুদ্ধ করার লাইগা। প্রত্যেকটা হাতির পিঠে সাতটা; রথের উপর দশটা ঘোড়ার উপর দুইটা আর সৈনিকদের সামনে পিছনে দেওয়া হইল দরকার মতো মশাল...

যুদ্ধের আগামাথা কেউ ঠাহর করতে পারে না। কোথাও পাণ্ডবরা দাবড়ায়। কোথাও কৌরবরা। সৈনিক আর বীরেরা নিজেগো নাম উচ্চারণ কইরা শত্র“র উপর আক্রমণ শানাইতে থাকে। অর্জুনের পাগলা তীরে কৌরবরা দিশাহরা হইয়া পলাইতে থাকে। দুর্যোধন দৌড়াইয়া গিয়া দ্রোণের সামনে খাড়ায়- আপনি আরেকটা ফাউল ভড়ং দেখাইতে আইজ রাত্তিরে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছেন। এখন পাণ্ডবগো মাইর খাইয়া আমার সেনারা পলাইতাছে আর আপনে খাড়াইয়া তামাশা দেখতাছেন...

কর্ণও শুরু করে পাগলা তীর। কর্ণের তীরে পাণ্ডবরা ভাগতে থাকলে যুধিষ্ঠির গিয়া অর্জুনরে ধরে- ওইদিকে কর্ণ আমার সবগুলা সৈনিক সাফ কইরা ফালাইতাছে আর তুমি এইখানে বইসা তিরাতিরি করতাছ। যাও গিয়া কর্ণরে ঠেকাও...

জয়দ্রথরে মারার সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তই অর্জুন নেয় না কৃষ্ণরে না জিগাইয়া। যুধিষ্ঠিরের কথা শুইনা অর্জুন কৃষ্ণের দিকে তাকায়- কৃষ্ণ। আমাদের মনে হয় কর্ণের সামনে যাওয়া উচিত...

কৃষ্ণ নড়ে না। কয়- কর্ণের সামনে তোমার যাওয়া ঠিক হইবা না অর্জুন। কর্ণের ধনুক সাড়ে চাইর হাত; তোমার ধনুক থাইকা আধাহাত লম্বা। তার তীরও তোমার তীর থাইকা বেশি দূর যায়। অন্য যেকোনো ভয়ংকর অস্ত্রেও কর্ণ বহুত কঠিন যোদ্ধা। তাছাড়া এই যুদ্ধে কর্ণ এখনো অক্ষত আছে। কর্ণের সামনে তোমার যাওয়া ঠিক না। কর্ণের সামনে ঘটোৎকচরে পাঠানো দরকার এখন। সে রাত্তিরকালে যুদ্ধে যেমন এক্সপার্ট তেমনি গায়ের শক্তি আর অস্ত্র চালনায়ও কর্ণরে ঠেকাইয়া রাখার মতো...। তুমি থাকো...

কৃষ্ণ ঘটোৎকচরে গিয়া ফুলায়- তুমি ছাড়া কর্ণরে ঠেকাইবার মতো আমাগো পক্ষে আর কেউ নাই বাপ। তুমি ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা ভগদত্ত দুর্যোধন শল্য সবাইরে দাবড়াইছ; খালি বাকি আছে কর্ণ। এইবার তোমার কর্ণরে দাবড়ানি দিবার পালা...
অর্জুন কয়- হ ভাতিজা। আমারও মতে এই যুদ্ধে তুমি- তোমার বাপ ভীম আর সাত্যকিই হইলা গিয়া সব থিকা বড়ো বীর। আর রাত্তিরের যুদ্ধে তোমার উপ্রে কেউ নাই। তুমি কর্ণের দিকে আগাইয়া যাও। সাত্যকি পিছন থাইকা তোমারে হাত দিব...

ঘটোৎকচ একটা হাসি দেয় কৃষ্ণের দিকে- কাকা অর্জুনরে কর্ণ থিকা দূরে রাখতে চাও কাগু? ...অসুবিধা নাই। যদি মরি তয় ছোটমা দ্রৌপদীরে গিয়া কইবা; ঘটোৎকচ নাদানের মতো বেঘোরে খুন হয় নাই। যুদ্ধ কইরা মরছে সব থিকা বড়ো যোদ্ধার লগে...

ঘটোৎকচ যাইবার আগে অর্জুনের সামনে খাড়ায়- যদি মইরাও যাই তবু তুমি নিশ্চিন্ত থাইক কাকু। কর্ণরে ঘায়েল না কইরা মরব না আমি...

ঘটারে নিয়া দুর্যোধনের চিন্তার সীমা নাই। দুর্যোধনের পক্ষে বড়ো হড় যোদ্ধা ছিল অলম্বুষ। আজকেই ঘটা তার কম্ম সাবাড় কইরা দিছে। এখন যখন সে কর্ণের দিকে আগাইতে গেলো তখন আরেক হড় যোদ্ধা অলায়ূধরে দুর্যোধন পাঠায় ভীমেরে আক্রমণ করতে; যাতে বাপেরে বাচাইতে ঘটা ব্যস্ত হইয়া কর্ণ বাহিনী থাইকা দূরে থাকে।

কিন্তু ভীমের কাছে পৌছাইবার আগেই ঘটা অলায়ূধের মাথা কাইটা ফিককা ফালায় দুর্যোধনের সামনে। ঘটার আক্রমণে কর্ণের অগ্রবাহিনীর সকল কুরু সৈনিক পলায়। বেগতিক দেইখা দুর্যোধন দৌড়ায় কর্ণের কাছে- রাক্ষসটার হাত থিকা থাইকা আমাদের রক্ষা করো কর্ণ...। ভীমের এই পোলারে আইজ পর্যন্ত ঠেকাইতে পারে নাই কেউ...

কর্ণ আগাইয়া যায়। ঘটোৎকচ আগাইয়া আসে। বর্শার আঘাতে কর্ণের চাইর ঘোড়া মাইরা কর্ণরে মাটিতে নামাইয়া আনে ঘটা। কর্ণ রথ থাইকা নাইমা আসে আর ঘোর অন্ধকারে কাঁসার বর্ম পরা কোঁকড়া চুলের ঘটোৎকচ সোজা গিয়া খাড়ায় তার মুখামুখি- পেন্নাম জ্যাঠা...

কর্ণ থতমত খায়। ঘটা হাসে- বুঝাইতে চাই যে অন্যরা যা জানে না তা আপনে যেমন জানেন; আমিও তেমনি জানি। আইসেন জ্যাঠা। আইজ কুন্তীর ফালাইয়া দেওয়া পোলা আর ফালাইয়া দেওয়া নাতির মইদ্যে একজন যাবে নিশ্চিত...

বহু বছর আগে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ভীমের এই পোলাটা তারে প্রণাম কইরা নিজের পরিচয় দিয়া কইছিল- দ্রৌপদী ডর দেখাইছে যে কর্ণরে দিয়া খুন করাইব তারে... আইজ তাইলে সত্যিই সেই দিন উপস্থিত। কিন্তু কর্ণ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নাই যে ঘটোৎকচ তার পরিচয়ও জানে...

কর্ণ কিছুটা উদাসীন। ঘটোৎকচ হাসে- হয়ত ছুটু মা দ্রৌপদীর অভিশাপ সইত্য হইব আইজ। আপনের হাতেই মরব আমি। কিন্তু আমারে ছুডু লাঠিয়াল ভাইবেন না জ্যাঠা। কাগু কৃষ্ণ ডরাইয়া অর্জুন কাকারে পাঠায় নাই আপনের সামনে। পাঠাইছে আমারে... সুতরাং বুঝতেই পারতাছেন...

কর্ণ হাসে- তোমার বিষয়ে বহুত শুনছি আমি; শুরু থাইকা আইজ পর্যন্ত এই কুরুক্ষেত্র টের পাইছে তোমার ক্ষমতা। তোমারে তো নাই; বরং কোনো শত্রুরেই ছোট ভাবি না আমি...

তাইলে আসেন জ্যাঠা। হইয়া যাক জ্যাঠায়-ভাতিজায়। আপনের ঘোড়া মাইরা ফালাইলাম বইলা মনে কিছু নিয়েন না। রথের উপর বইসা তিরাতিরির মাঝে কোনো বাহাদুরি আছে বইলা মনে হয় না আমার। আসোল লড়াই হইল সামনা সামনি...

কর্ণের বয়স ৬৩ আর ঘটোৎকচ ৩২। হাতিয়ার লড়াই আর গায়ের শক্তিতে অর্ধেক বয়েসি ঘটোৎকচ খুব সহজ হইবার কথা না কর্ণের কাছে...। তার উপর ঘটোৎকচের মূল কৌশল তার মায়াযুদ্ধ...

অন্ধকারে দীর্ঘ বর্শাই জুতসই হাতিয়ার। কর্ণ আর ঘটা দুইজনের হাতেই বর্শা। কালো কুচকুচে ঘটা অন্ধকারে একদিকে আক্রমণ কইরা মুহূর্তে অন্য দিকে সইরা যায় প্রতি আক্রমণের টার্গেট থাইকা...কিন্তু কর্ণ তিরাতিরির লাইগা বিখ্যাত হইলেও সে কুড়ালি পরশুরামের ঝুলিঝাড়া ছাত্র। হাতল অস্ত্রে সেও তিন কাঠি আগাম। কুড়াল বর্শা যতটা না চালাইতে হয় তার থিকা নাইচা কুইদা বেশি বাচাইতে হয় কুড়াল-বর্শার আঘাত। অল্পকাল লড়াই কইরাই সে বুইঝা ফালায় ঘটার কলা কৌশল...

ঘটা হাতের থাইকা পায়ের কাজ করে বেশি। কর্ণ তার পা মাপে। নিশ্চিত হয়ে যায় ঘটা এর পরে কোনখানে লাফ দিব... এবং ঘ্যাঁচ...

ঘটা যেই দিকে গিয়া লাফ দিয়া খাড়াইব সেইদিকেই ঘটার হৃৎপিণ্ড বরাবর দুই হাতে বর্শা চালান দেয় কর্ণ। বর্শাটা ঘটার বুকে বিঁধে পিছন দিকে বাইর হইয়া যায়। ঘটা পড়ে না আর কর্ণও বর্শাটা বাইর কইরা আনতে পারে না ঘটার বুক থাইকা তার মধ্যেই আরেকটা ঘ্যাঁচ...

ঘটার বর্শা বিঁধে যায় কর্ণের দেহে...

নিজের বর্শা ছাইড়া লাফ দিয়া সইরা আসে কর্ণ। বিন্দুমাত্র শব্দ না কইরা নিথর হইয়া পড়ে ঘটোৎকচ...

ঘটোৎকচ মরায় দুর্যোধন বাহিনী খুশি তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু পাণ্ডবপক্ষে রথের উপর উইঠা খুশিতে নাচতে থাকে কৃষ্ণ...

অর্জুন বড়ো বেশি বিরক্ত হয় কৃষ্ণের উপর- ঘটোৎকচ কথা কওয়ার সময় তোমারে ছাইড়া কথা কইত না ঠিক; কিন্তু তার মানে এইটা না যে তার মৃত্যুতে দুর্যোধনের মতো তুমিও খুশিতে লাফাইবা। তোমার মনে রাখা উচিত সে আমার ভাতিজা; তার বাহিনীটাই ছিল আমাদের পয়লা সম্বল ...আর সে আমাদের পক্ষের সবচে বড়ো যোদ্ধাদেরও একজন...

কৃষ্ণ কয়- কেন লাফাই বুঝতে পারলে তুমিও লাফাইতা অর্জুন। ঘটোৎকচ মরার আগে কর্ণের বগলে বর্শা গাইথা গেছে। বাম হাতেই কিন্তু কর্ণ গুণে টান দিয়া তীরের নিশানা করে... একটা ডানহাতি তিরন্দাজের বাম বগলে বর্শা বিধা মানে তার তিরাতিরির প্রায় শেষ এইটা বোঝো? ... ঘটা যে মরার আগে তোমার শত্রুরে শক্তিহীন কইরা গেছে এইটা বুঝলে খুশিতে তুমিও লাফাইতা অর্জন...। কর্ণ এখন পঙ্গু...

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৬ [কর্ণ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৫ [কর্ণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৪
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

শান্ত এর ছবি

জয়দ্রথরে মারার ঘটনা আমার যতটুকু মনে পড়ে এই রকম:

সূর্যাস্ত তখনও হয়নি কিন্তু জয়দ্রথরে এখনও খুজে পাওয়া যায়নি। তখন কৃষ্ণ তার সূদর্শন চক্র দিয়ে সূর্যকে আড়াল করেন। সবাই মনে করে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। জয়দ্রথ আড়াল ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসে। অর্জুন গিয়ে দাড়ায় তার সামনে। সেই সময় কৃষ্ণ চক্রকে সরিয়ে নেন। অর্জুন তীর চালায়। জয়দ্রথের বাবা জয়দ্রথকে বর দিয়েছিলেন, যার সামনে জয়দ্রথের মাথা মাটিতে পড়বে সেই ভষ্ম হয়ে যাবে (বা এইরকম কাছাকাছি কিছু)। সেই কারণে অর্জুন তীর চালায় জয়দ্রথের গলায় এবং সেই তীর জয়দ্রথের কাটা মুণ্ডু উড়িয়ে নিয়ে ফেলে জয়দ্রথের বাবার কোলে। তপস্যারত জয়দ্রথের বাবা চমকে উঠেন এবং কাটা মাথা মাটিতে পড়ে যায়। সাথে সাথে জয়দ্রথের বাবাও ভষ্ম হয়ে যান।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সুদর্শন চক্র দিয়া সূর্য ঢেকে দেয়ার একটা ভার্সন আছে বিশ্বাসী মহাভারতে
আর জয়দ্রথের কাটা মুণ্ডু উড়ায়ে নিয়ে যাওয়াও বিশ্বাসী মহাভারত

০২
জয়দ্রথরে অর্জুন মারে সূর্য ডোবার পরেই; কোনোভাবেই আগে না

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার এই সিরিজের যে জিনিষটা আমার সবচেয়ে মজা লাগে সেটা হচ্ছে সব ঘটনার একটা লৌকিক ব্যখ্যা। শ্রীকৃষ্ণের নারায়ণ অস্ত্র বুকে ধারণ, ঘটোৎকচ বধে কৃষ্ণের উল্লাস ... জয়দ্রথের শিরচ্ছেদে বৃদ্ধক্ষত্রের মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু একটা বিষয় কাভার দেয়াটা মনে হচ্ছে কঠিন - এদের বয়স। কর্ণের বয়স তেষট্টি হবে কি? তাহলে ভীষ্ম, দ্রোণ, এঁদের বয়স কত হবে ?

-সো

মাহবুব লীলেন এর ছবি

'মহাভারতের মহাভজঘট' নিয়া আলাদা একখান লেখা লিখব
যার মধ্যে থাকবে মহাভারতের বংশ-ভূগোল-সংখ্যা বয়স; যেইগুলা পুরাটই ভজঘট পাকাইয়া আছে বিশ্বাসের কাব্যে আর কাব্যিক বিশ্বাসে...

যেই হিসাবে কর্ণের বয়স ৬৩; সেই হিসাব মাইনা নিলে কিন্তু স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীর বয়স হয় ৪ বচ্ছর;
আর ভীষ্মের বয়স ৯৯'র বেশি/এক হিসাবে ১৪০ বছর!

গল্পের মধ্যে এইটারে আনতে গেলে অন্য যারেই আনা যাক না কেন; ভীষ্ম আর দ্বৈপায়নরে বাদ দিয়া মহাভারতের গল্প বলতে হবে...

দ্রোণ ভীষ্ম থেকে বয়সে কিছু ছোট; কিন্তু তারপরেও ৯০'র কাছাকাছি; কারণ যুদ্ধের সময় তার নিজের ছেলের বয়স খাড়ায় ৬৩-৬৪

অবশ্য মহাভারতে বহুবার নিজের বয়সের দোহাই দেয়ার কারণে মনে হয় দ্রোণ বোধহয় কুরুযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন

খেকশিয়াল এর ছবি

পরশুরাম কি ভীষ্মেরো গুরু আছিলো? কিন্তু সে তো ব্রাহ্মণগো ছাড়া আর কাউরে শিখাইতো না, আর ক্ষত্রিয় তো দেখতেই পারতো না। কর্ণ না হয় মিথ্যা বইলা শিখছিলো, ভীষ্মও কি কোন চালবাজি করছিলো?

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

খেকশিয়াল এর ছবি

আচ্ছা পাইলাম উইকিতে

মায়ের সাথে থাকাকালীন ভীষ্ম দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বশিষ্ঠ মুনির কাছে বেদ ও বেদাঙ্গ এবং পরশুরাম মুনির কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন। এমনকি তিনি গুরু পরশুরামের বিরুদ্ধেও বিজেতা হন। সে যুদ্ধ ২৩ দিন ব্যাপী চলেছিল।

যা বুঝলাম, গঙ্গার পোলা দেইখা খাতির পাইছে, শান্তনুর ক্ষত্রিয় রক্ত থাকা সত্ত্বেও হে হে

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পরশুররামের চরিত্রে কিন্তু খাতির জিনিসটা নাই; নিজের মায়ের মাথা সে কাটছে; গুরু শিবের পোলার দাঁত ভাঙছে; শিষ্য ভীষ্ম কথা না শোনায় তারে আসছে মারতে....

আর কর্ণরে সব সময় গালাগাল করছে মাথাগরম পাতলা পোলা কইয়া

০২
মনে হয় না ভীষ্মরে সে গঙ্গার কারণে নিছে শিষ্য হিসাবে; বিনা প্রশ্নেই নিছে শিষ্য হিসাবে কর্ণের মতো

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পরশুরাম আচার্য ছিলেন না; তার কোনো গুরুকূলও ছিল বলে শুনিনি কোথাও। তার মাত্র তিন শিষ্যের কথাই পা্ওয়া যায়; ক্ষত্রি ভীষ্ম; ব্রাহ্মণ দ্রোণ আর শূদ্র কর্ণ...

০২

পরশুরাম ক্ষত্রিয়দের উপর ক্ষ্যাপা ছিলেন বহু আগে; তাগোরে মাইরা টাইরা তার রাগ কইমা গেছিল বহুত আগেই... তার পরে ক্ষত্রিয়দের উপর তার রাগের কোনো হদিস আমি পাই নাই; তেমনি তিনি ক্ষত্রিয় বা অন্য কাউরে শিখাইতেন না এই হদিসও পাইনি কোথাও...

০২
নৃসিংহপ্রসাদ বলেন- কর্ণ যে নিজেরে ভার্গব পরিচয় দিছে সেইটা মিছা না দুইটা কারণে (১) নিজেরে মনে মনে পরশুরামের শিষ্য হিসাবে ধইরা নিয়া গুরুর পরিচয়ে নিজের পরিচয় দেয়া; যেইটা সেইকালে সাধারণ নিয়ম আছিল; যেমন ভরদ্বাজি বামুন এইসব আর (২) মা কুন্তীর দিক থাইকা সে ভার্গব বংশজাত: ভৃগুমুনির তিন পোলার মধ্যে ছোট পোলা ঋচিক হইল পরশুরামের ঠাকুরদা আর মাইজা পোলা শুক্রাচার্য দেবযানীর বাপ; যেই দেবজানির পোলা যদুর বংশধর হইল যাদব মানে কুন্তীর বংশ...

খেকশিয়াল এর ছবি

না কইলাম ক্যা, ব্রাহ্মণ ছাড়া কাউরে নাকি শিখাইতো না, এরকম সবখানেই পাইছি তাই।

যদুবংশের পোলারা মাইগ্রেশনের উপর থাকতো মনে হয়, অনেকটা যাযাবর প্রকৃতি। যে দেশে গরু খায় বারো মাস সবুজ ঘাস সেদিকেই যাইতো গা।

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অস্ত্রবিদ্যা শিখাইবার লাইগা দ্রোণ ছাড়া সে আর ব্রাহ্মণ পাইব কই? অন্য যে ব্রাহ্মণ অস্ত্র চালাইত সেই শুক্র তো তার ঠাকুর্দার বড়ো ভাই

০২
আর তো কোনো অস্ত্রধারী ব্রাহ্মণ মনে পড়ে না কৃপ আর অশ্বত্থামা ছাড়া...

খেকশিয়াল এর ছবি

হ তাউ তো কথা হো হো হো

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ক্যাম্নে ল্যাখেন? হাসতে হাসতে রথ হইত পইরা গেলাম দেঁতো হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

রথ থাইকা কাদায় পড়লে কিন্তু যুদ্ধবিরতি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।