মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৬ [কর্ণ ২]

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০৭/২০১৪ - ৬:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের লগে অর্জুনের দেবদত্ত শঙ্খ আর তার উত্তরে ভীষ্মের শঙ্খের নাদে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। মাঠের পশ্চিমে কুরু আর পূর্বে খাড়ায়া আছে পাণ্ডব-পাঞ্চাল। দুই রঙের পোশাকে দুই পক্ষ দাঁড়াইছে যাতে পরিষ্কার চিনা যায় পাট্টি আর বিরোধীদল। হাতির সামনে হাতি; ঘোড়ার সামনে ঘোড়া; পায়দল খাড়া পায়দলের সম্মুখে; গদারু গদা বাগাইয়া আছে গদারুর দিকে; তিরন্দাজ-তিরন্দাজ মুখোমুখি আর বর্শাতি-ভল্লব খাড়া পরস্পর কপাল নিশানা করে... সকলেই রেডি হইয়া প্রস্তুত আছে সেনাপতির হুংকারের অপেক্ষায়... ঠিক এই সময় যুধিষ্ঠির ঘটাইল কাণ্ডখান...

যুধিষ্ঠির ছিল দুই দলের মাঝখানে; পাণ্ডব-পাঞ্চালের সকলেরই ছিল তার দিকে চোখ। হঠাৎ সে অস্ত্র ফালাইয়া- বর্ম ছাইড়া- রথ থাইকা নাইমা- হাত জোড় কইরা হাটা দিলো শত্রুসেনাপতি ভীষ্মের দিকে...

শত্রু দলের ভিতর দিয়া হাটা দিছে নিরস্ত্র যুধিষ্ঠির; দৌড়াইয়া গিয়া ভীম তারে আটকায়- দুর্যোধনের সেনা দেইখা যুদ্ধের আগেই কি সারেন্ডারের পিলান করতাছ তুমি?

যুধিষ্ঠির কথা কয় না। হাঁটে। ভীমেরে আটকাইয়া কৃষ্ণ হাসে- যাইতে দেও। যুদ্ধ নিয়মের পয়লা ফায়দাটা উঠাইতাছে রাজা যুধিষ্ঠির। নিয়মমতো নিরস্ত্র যুধিষ্ঠির এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ...

ভীষ্ম যখন যুধিষ্ঠিরের কাছ থিকা আশা করতাছিল আক্রমণ তখন সে পাইল সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। যুদ্ধের মাঠে এইরকম বেকুব জীবনেও আর বনে নাই সে। অস্ত্রমস্ত্র ছাইড়া আইসা যুধিষ্ঠির তার পায়ে পেন্নাম ঠুইকা খাড়ায়- আপনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অনুমতি চাই পিতামহ আর আশীর্বাদ করেন যাতে বিজয়ী হই... যুধিষ্ঠিরের এমন কাণ্ডে গঙ্গাপুত্রের আবেগ জল হইয়া মাঠেতে গড়ায়- নাতিরে; কী আর কমু। খালি ভাতের দায়ে ঠেইকা আছি দুর্যোধনের লগে। নাইলে আমি তো তোর লগেই যাইতে চাই আর জয়ও চাই তোর..
.
ভীষ্মের কাছ থিকা সইরা যুধিষ্ঠির একইভাবে গিয়া খাড়ায় গুরু দ্রোণের সামনে- পেন্নাম গুরুদেব। গুরুরে পেন্নাম না কইরা আমি কোনোদিনও অস্ত্র ধরি নাই; তাই শত্রুপক্ষে থাইকাও আপনের পেন্নাম করি...

সারা জীবন অর্জুনরে বড়ো শিষ্য কইলেও দ্রোণের শিষ্যগো মাঝে পদে সব থাইকা বড়ো যুধিষ্ঠির; স্বয়ং রাজসূয় যজ্ঞ করা চক্রবর্তী সম্রাট; যার সামনে শত শত ব্রাহ্মণ হাত জোড় কইরা থাকনের কথা; সেই চক্রবর্তী সম্রাট শত্রু হইয়াও শুধু গুরু হইবার কারণে তারে আইসা পেন্নাম কইরা অনুমতি চায়। এমন কাণ্ডে ভরদ্বাজের লোভী পুত্রেরও চোখ চক চক কইরা উঠে; জগতের এমন বিরল সম্মান মাইনসেরে না দেখাইলে কী হয়?

যদিও যুধিষ্ঠির জিতা গেলে সব থিকা বড়ো ক্ষতি দ্রোণেরই। কারণ পাশা খেইলা যুধিষ্ঠির যেই রাজ্য হারাইছে সেই ইন্দ্রপ্রস্থের বর্তমান রাজা স্বয়ং এই গুরু দ্রোণ; যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের জিতা যাওয়া মানে কিন্তু দ্রোণের রাজ্য হারাইয়া আবার ভিক্ষুক বামুন বইনা যাওয়া। কিন্তু এতগুলা মাইনসের সামনে গুরু বইলা সম্মান দিলো; গুরুর গাম্ভির্য রাইখা তারেও তো কিছু তো কইতে হয়। তাই সকলরে দেখাইয়া দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের আশীর্বাদ কইরা কানে কানে কয়- ভাতের দায়ে দুর্যোধনের কাছে বান্ধা পড়া থাকলেও আমি কিন্তু তোমারই জয় চাই যুধিষ্ঠির...

যুধিষ্ঠির তারপর যায় মামা শল্যের কাছে। পেন্নাম টেন্নাম কইরা কয়- কথাটা মনে রাইখেন মামা। আপনে কইছিলেন যে যুদ্ধের সময় কর্ণের মাথা আউলা কইরা রাখবেন। শল্য কয়- হ। মনে আছে। করব। আর তুমি যে আমারেও সকলের সামনে পেন্নাম করলা তাতে খুব খুশি আমি...

যুধিষ্ঠির ফিরতি পথ ধরে আর কৃষ্ণ ভীম-অর্জুনরে কয়- তোমরা যুদ্ধ জানতে পারো; কিন্তু পলিটিক্স বোঝে রাজা যুধিষ্ঠির। যুদ্ধের আগেই দেখো কেমনে শত্রুপক্ষের তিন পালের গোদারে প্রণাম নমস্কার কইরা আবেগে ভাসাইয়া দিলো। এখন নিশ্চিত থাকতে পারো; খালি এই প্রণামের কারণেই এই তিনজন কোনোভাবেই পাণ্ডবগো উপর অস্ত্র উঠাইব না; যদি না পাণ্ডবরা আগে অস্ত্র উঠায়...

যুধিষ্ঠির যখন মুরুব্বিগো পটাইতে ব্যস্ত তখন কৃষ্ণ গিয়া খাড়াইছিল কর্ণের সামনে- ভীষ্ম না মরলে তো তুমি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবা না ঠিক করছ। তা অতদিন বইসা না থাইকা না হয় আমাগো পক্ষেই যুদ্ধ করলা; ভীষ্ম মরলে আবার গিয়া যুদ্ধ করবা দুর্যোধনের পক্ষে...

কর্ণ কৃষ্ণের দিকে তাকাইয়া হাসে- আমি তো আর তোমাগো মতো ভাড়াটিয়া সিপাই না কৃষ্ণ যে; যার কাছে বেতন পাব তার পক্ষেই অস্ত্র ধরব। আমি যুদ্ধ করি যারে আমি সমর্থন করি তার লাইগা। যুধিষ্ঠির বেতন দিতে পারব না দেইখা তুমি যেমন তোমার সৈন্য দুর্যোধনরে ভাড়া দিয়া নিজে একলা গেছো পাণ্ডবগো লগে আবার পয়সার লোভে পাণ্ডবগো মামা শল্য আইসা যোগ দিছে দুর্যোধনের দিকে; আমারে তুমি সেই দলে না ফালাইলেই ভালো...। আমি যুদ্ধ করি বা না করি; দুর্যোধনের পক্ষেই আছি...

নিজের দলে ফিরা আইসা যুধিষ্ঠির একটা আওয়াজ দেয়- কুরুপক্ষের কেউ কি দল ছাইড়া আমাগের দলে আসতে চাও?

এই ডাকে নিজের দল ছাইড়া পাণ্ডবপক্ষে আইসা যোগ দেয় ধৃতরাষ্ট্রের পোলা যুযুৎসু। এইটাও যুদ্ধের নিয়মের মধ্যে পড়ে। গতকাল দুইপক্ষ মাঠে উপস্থিত হইবার লগে লগেই দুই দলের মাঝখানে আইসা খাড়াইছিলেন কুরু-পাণ্ডব পিতামহ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন- কিছু নিয়ম কানুন ঠিক কইরা দিতে চাই যুদ্ধ শুরুর আগে। ...যেহেতু দুই পক্ষই পরস্পর আত্মীয়; তাই যুদ্ধ শেষ হইবার পর কিংবা শুরু হইবার আগে কারো ভিতর কোনো শত্রুতা থাকবার পারব না; আত্মীয়-আত্মীয় হিসাবেই পরস্পরের লগে পরস্পরের যেমন সম্পর্ক থাকব তেমনি পরস্পরের শিবিরেও থাকব পরস্পর যাতায়াতের অবাধ অধিকার.... এইটা আমার পয়লা বিধান...

দ্বৈপায়নের কথায় দ্বিমত করার কোনো লোক থাকার কথা না। তিনি কথা বাড়াইতে থাকেন- দ্বিতীয় কথা হইল গালাগালির উত্তর মুখ খারাপ কইরাই দেওন লাগব। যারা অস্ত্র ফালাইয়া ভাগব তাগোরে কিন্তু মারা যাইব না। যুদ্ধ কিন্তু হইতে হইব সমানে সমান; হাতির লগে হাতি সওয়ার; ঘোড়ার লগে ঘোড়সওয়ার; রথীর লগে রথী আর পায়েদলের লগে পায়েদল মানুষই কেবল যুদ্ধ করবার পারব....

কেউ কোনো কথা কয় না; বাণারসীর সুবীর নন্দী ছাড়া জগতে এই বুড়ারে ঘাটাইবার সাহস কোনোদিন পায় নাই কেউ। ...সক্কলে কথা মাইনা নিছে দেইখা তিনি আরো ছোটখাটো নিয়ম বাড়াইতে থাকেন- আরেকখান কথা; কারো সম্পর্কে না জাইনা কিন্তু তারে আক্রমণ করা যাইব না। কেউ যদি কাউরে দেইখা ডরে তাব্দা খাইয়া যায় তবে কিন্তু তারেও কেউ মারতে পারবা না। কিংবা ধরো যে লোক অন্য কারো লগে লড়াই করতাছে; কিংবা কেউ যদি আত্মসমর্পণ কইরা ফালায় কিংবা কারো যদি বর্ম না থাকে; তাগোরেও যেমন মারা যাইব না তেমনি কোনো রথের সারথি কিংবা জোগানদার- বাদ্যকার কিংবা কামলাগোরে আঘাত করতে পারবা না কেউ...

দ্বৈপায়নের কথায় ভীম মিনমিন করে কৃষ্ণের কানে- শর্ত চাপাইতে চাপাইতে দাদায় তো যুদ্ধরে ছুডুকালের খেলাধুলা বানাই ফালাইতাছে দেখি...

কনুইয়ের গুতা দিয়া ভীমরে থামায় কৃষ্ণ- নিয়ম মাইনা নেওয়া মানে কিন্তু নিয়ম পালন করা বোঝায় না; বুঝছ? আর এইসব নিয়ম ভাঙলে তোমারে ওই বুইড়ার গালাগালি শোনা ছাড়া কিছুই করা লাগব না; নিশ্চিন্ত থাক। কিন্তু নিয়ম থাকলে মাঝে মইধ্যে নিয়মের সুবিধাও নেওন যায়। ...কালা ঠাকুরের নিয়মগুলা কিন্তু ভালো। কামে লাগব। থাউক...

কারো কোনো কথা নাই বুইঝা দ্বৈপায়ন এইবার সবাইরে বুঝাইয়া দেন জগতে পরথম যুদ্ধ সাংবাদিকতার নিয়ম। হাত ধইরা সঞ্জয়রে আইনা খাড়া করেন সকলের সামনে- এরে চিনা রাখো সকলে। গবলপুত্র এই সঞ্জয়ের যুদ্ধের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের থাকব অবাধ অধিকার। কেউ তারে যেমন বাধা দিতে পারব না; তেমনি কেউ তারে চাইপা ধইরা কোনো সংবাদ নিবারও চেষ্টা করতে পারব না। এই সঞ্জয় সংবাদ সংগ্রহ কইরা জানাইব আন্ধা রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে... এইটাই আমার শেষ বিধান...

দুই দলই তিনটা কইরা বাহিনী নামায় পয়লা দিন। কুরুতে পয়লা বাহিনীর নেতা দ্রোণ; তার পিঠ বাচাইয়া দ্বিতীয় দলের নেতা ভীষ্ম আর সকলের পিছনে তৃতীয় দলের নেতা দুর্যোধন স্বয়ং। পাণ্ডব-পাঞ্চালে পয়লা দলেই দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুু; এক্কেবারে দ্রোণের মুখামুখি। দ্বিতীয় দলের নেতা তিনজন; ভীম সকলের সামনে তারপর অর্জুন তারপর অর্জুনের পিঠ সামলাইবার লাইগা পিছনে সাত্যকি। আর সব শেষ দলের তিন নেতার মধ্যে থাকেন বিরাট দ্রুপদ আর স্বয়ং যুধিষ্ঠির....

ভীষ্ম-ভীম আর ভীমের পোলা ঘটোৎকচ ছাড়া সকলেই মূলত হাত মশকো করে পরথম দিন। ভীষ্ম আর ভীম গণ- মাইর দিয়া ছত্রভঙ্গ কইরা দেয় বহু সেনাসৈনিক। বিরাটের দুই পোলার মধ্যে উত্তর মারা যায় শল্যের হাতে আর শ্বেত মরে ভীষ্মের হাতে। কুরুপক্ষের বড়ো কেউ মরে না পয়লা দিন। কিন্তু সেনাসৈন্যের দুরবস্থা দেইখা দিনের শেষে যুধিষ্ঠির যায় ঘাবড়াইয়া- যুদ্ধ যা করার তা তো দেখি একলাই ভীম করল। অর্জুন তো পুরা উদাসীন... এই অবস্থায় ভীষ্মরে সামলাইব কেডা? একলা গদা দিয়া ভীমতো একশো বছরেও এই যুদ্ধ কুলাইতে পারব না...

কৃষ্ণ কয়- অর্জুনের পক্ষে ভীষ্মরে মারা যেমন সম্ভব না তেমনি সম্ভব না গুরু দ্রোণেরেও আঘাত করা। আপনে বরং দ্রুপদের দুই পোলা শিখণ্ডী আর ধৃষ্টদ্যুুরে দায়িত্ব দেন এই দুইজনারে ঠেকাইতে। যদিও শিখণ্ডী আর ধৃষ্টদ্যুু দ্রোণেরই শিষ্য কিন্তু তাদের যেমন চোখের পর্দা নাই তেমনি দ্রোণের শিষ্য হইবার কারণে তারা দ্রোণের দুর্বলতাও জানে...

যুধিষ্ঠির ডাইকা ধৃষ্টদ্যুুরে কয়- ভীষ্ম আর দ্রোণরে পাইড়া ফালাইতে তোমরা দুই ভাই ছাড়া আমার কোনো গতি নাই ভাই...

দ্বিতীয় দিনে পাণ্ডবগো লগে ভীষ্ম আর দ্রোণের কিছু খেলা খেলা লড়াই হইলেও দুই পক্ষই দুই পক্ষরে এড়াইয়া চলে কৌশলে। অর্জুন শুরু করে সেনা-সৈনিক মারা। দুর্যোধন গিয়া ভীষ্মরে কয়- আপনের লাইগা আমার দোস্ত কর্ণ ঘরে বইসা খায়; আর আপনে যুদ্ধ করতে আইসা ভাগেন অর্জুনের ডরে...

দুর্যোধনের গুতা খাইয়া ভীষ্ম গিয়া আবার অর্জুনের লগে কিছু তিরাতিরি করেন। ভীম কলিঙ্গের রাজা শতায়ু আর তার পোলাপান প্রায় সবাইরেই শুয়াইয়া ফালায়। সেইটা ঠেকাইতে আইসা ভীষ্ম রথের ঘোড়া মাইরা ভীমেরে থামাইতে চাইলে ভীম গদাম দিয়া ভীষ্মের সারথি শুয়াইয়া সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু কইরা দিলে তিনি রথ ছাইড়া ঘোড়ায় চাইপা দেন সটান...

তিন নম্বর দিনে ভীম তীর মাইরা দুর্যোধনরে তার নিজের রথের উপর ফালাইয়া দেয় অজ্ঞান কইরা। তার উপরে তার গদামের চোটে সৈন্য সামন্ত পুরাই ছত্রখান। জ্ঞান ফিরা পাইয়া দুর্যোধন ভীষ্মরে কয়- আপনে আমারে আগেই কইতে পারতেন যে পাণ্ডব- সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুুের লগে যুদ্ধ করতে আপনে ভয় পান। আপনে দ্রোণ আর কৃপাচার্য অত ডরালুক জানলে আমি আপনাদের লগে যুদ্ধের প্লান না কইরা কর্ণের লগেই করতাম...। এখন মনে হইতাছে আপনেরা আছেন আমার সৈনিকদের পাণ্ডবগো দিয়া ধ্বংস করাইতে। আপনেরা কেউ যুদ্ধ যেমন জানেন না; তেমনি লড়াই করার সাহসও নাই কারো...

দুর্যোধনের খোঁচায় ভীষ্ম আবার শুরু করেন ক্ষ্যাপা যুদ্ধ। অর্জুনের লগে একেবারে সত্যি সত্যি যুদ্ধ। ক্ষ্যাপা ভীষ্মরে দেইখা অর্জুন বেকুব বইনা যায়। রথ ঘোরাইয়া- ঘোড়া দাবড়াইয়া কৃষ্ণ অর্জুনরে বাচাইতে পারলেও অর্জুন কাবু হইয়া পড়ে। ভীষ্মের তীরে অর্জুনরে ঘায়েল হইতে দেইখা পাণ্ডব-পাঞ্চাল সৈনিকরা শুরু করে পলায়ন। সাত্যকি পিছন থাইকা ডাইকাও কাউরে ফিরাইতে পারে না। শেষে অবস্থা বেগতিক দেইখা যুদ্ধ করব না এই প্রতিজ্ঞায় মাঠে আসলেও নিজের চক্র নিয়া গিয়া কৃষ্ণ খাড়ায় ভীষ্মের সামনে...

কৃষ্ণরে অস্ত্র তুলতে দেইখা ভীষ্ম ধনুক নামাইয়া হাসেন- তুমি না কইছিলা যুদ্ধ করবা না?
কৃষ্ণ কয়- তীর খাইয়া মইরা গেলে প্রতিজ্ঞার কী দাম?

কৃষ্ণ আগাইয়া যায় ভীষ্মের দিকে। দৌড়াইয়া গিয়া তার পায়ে পইড়া অর্জুন কৃষ্ণরে থামায়। ...ভীষ্মের হাত থিকা অর্জুনরে বাচাইয়া দেয় কৃষ্ণ আর কৃষ্ণের হাত থিকা ভীষ্মরে বাচায় অর্জুন। মারামারি কাটাকাটি চলতে থাকে মাঠের অন্যদিকে; এইদিকে দাদায়-নাতিতে আবার সমঝতা ভাগাভাগি হয়...

যুদ্ধের চাইর নম্বর দিনটাও ভীমের দিন। ভীমের গদামে পুরা একদল কুরু সেনা যুদ্ধ ছাইড়া পলায়। পরে ভীষ্ম আইসা ভীমেরে ঠেকান। ভীমের লগে যুদ্ধ করতে এখন ভীষ্ম অনেক বেশি সতর্ক। এই পেটলা মানুষটা দাদাফাদা বোঝে না; গদার পুরা শক্তি দিয়াই বাড়িখান মারে। ভীমের লগে ভীষ্মের লড়াইর ফাঁকে দুর্যোধন তীর মাইরা ভীমেরে অজ্ঞান কইরা ফালায়। কিন্তু হুশ ফিরা পাইয়াই সে শল্যরে পিডাইয়া মাঠ ছাড়া করে। আর তারপর মাটিতে পাইড়া ফালায় ধৃতরাষ্ট্রের আট আটটা পোলারে- জলসন্ধ-সুষেণ- উগ্র-অশ্ব- কেতু- বীরবাহু- ভীম আর ভীমরথ...

ভীমেরে আটকাইতে আসে ভগদত্ত। ভগদত্তের হাতি বাহিনীর সামনে ভীম এক্কেবারে বেকায়দায় পইড়া রথের ডান্ডা ধইরা ঝুইলা বাচার উপায় খোঁজে। বাপেরে এমন ডান্ডাঝোলা দেইখা ভগদত্তের সামনে রাক্ষস চেহারা নিয়া আইসা খাড়ায় ঘটোৎকচ। এই ঘটোৎকচের যুদ্ধকলায় আর্যাবর্তের সকলেই দারুণ আনাড়ি। বাকিরা বাকিদের শিক্ষার ঘরানা জানে বইলা আক্রমণের কৌশলও যেমন জানে; ঠেকানোর কায়দাটাও জানে। কিন্তু সম্পূর্ণ হড় কৌশলের এই মায়া যোদ্ধার কোনো কায়দা সম্পর্কেই কারো কোনো আইডিয়া নাই। জঙ্গলে পশুর লগে যুদ্ধ করা ঘটোৎকচ বাহিনী হাতি সোয়াররে আক্রমণ না কইরা শুরু করে হাতির শুঁড়ের মইধ্যে তীর আর বর্শা বিন্ধানো; আর লগে লগে শুরু হয় ভগদত্তের হাতি বাহিনীর আউলাঝাড়া দৌড়...

ঘটোৎকচের হাত থিকা ভগদত্তরে রক্ষা করতে আইসা দ্রোণ-ভীষ্ম নিজেরাই ফাইসা পড়েন; ঘটার হাত থিকা ভগদত্তরে বাচাইবেন; নাকি নিজেরা বাঁচবেন তার কুলকিনারা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত ভীষ্ম সেইদিনের মতো সূর্য ডোবার আগেভাগেই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা কইরা বসেন...

পাঁচ নম্বর দিনে অবস্থাও চাইর নম্বর দিন থাইকা ফারাক করে না খুব। ভীমই আর তার পোলায়ই পিটাইতে থাকে সমানে। ভূরিশ্রবার হাতে মারা পড়ে সাত্যকির দশ পোলা। ভীষ্মের হাতে কিছু পাণ্ডব সৈনিক মরে। ছয় নম্বর দিনেও ভীম একলাই দাবড়ায়; একবার তীর মাইরা দুর্যোধনরে বেহুঁশও কইরা ফালায়। পরে কৃপাচার্য রথে তুইলা নিয়া দুর্যোধনরে বাঁচান। অভিমন্যু আর দ্রৌপদীর পোলাদের হাতে মারা পড়ে ধৃতরাষ্ট্রের চার পোলা বিকর্ণ-দুর্মুখ-জয়ৎসেন আর দুষ্কর্ণ। চাইর নম্বর দিন যুদ্ধ শেষ হইয়া গেছিল সূর্য থাকতে থাকতেই। ছয় নম্বর দিন যুদ্ধ গড়াইয়া সূর্যাস্তেরও আরো কিছুক্ষণ পর...

কিন্তু এমন দুঃখ কই রাখে দুর্যোধন; যার গদাগদি করার কথা সেই ভীম নাকি তারে তীর মাইরা কাবু কইরা ফালাইল দুই দুইবার। সে দৌড়াইয়া যায় ভীষ্মের কাছে- আপনে হাতপা গুটাইয়া বইসা আছেন বইলাই এই দশা হইল আমার...

ভীষ্ম কয়- হাত পা ছড়াইয়াই বা করবটা কী? পাণ্ডবগো পক্ষে যারা আছে তাগো লগে পাইরা উঠা অত সোজা না। ভীম অর্জুন তো দূরের কথা; ভীমের পোলা ঘটারে ঠেকাইতেই জান বাইরাইয়া যাইতাছে সবার। ...তোমার লাইগা আমি সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হইল জানের মায়া বাদ দিয়া যুদ্ধ করা। ...যাও কথা দিলাম; কাইল থাইকা জানের মায়াটাও ছাইড়া দিমু আমি...

দুর্যোধন যখনই গুতা দেয় তখনই নিজের বাহাদুরি দেখাইতে ভীষ্ম গিয়া খাড়ান অর্জুনের সামনে। সাত নম্বর দিনেও হইল তাই। কিন্তু সেইদিন কৃষ্ণের ক্ষেইপা উঠা দেখে আইজ আর অর্জুনের লগে সত্যি সত্যি যুদ্ধে যান না ভীষ্ম। দুর্যোধনরে দেখাইবার লাইগা কতক্ষণ তিরাতিরিই করেন। অন্য দিকে দ্রোণের লগে যুদ্ধ করতে গিয়া রাজা বিরাট মাইর খাইয়া নিজের পোলা শঙ্খের রথে উইঠা পলাইতে যায়; কিন্তু ততক্ষণে তীর মাইরা দ্রোণ ফালাইয়া দেয় বিরাটের পোলা শঙ্খরে। সাত্যকির দাবড়ানি খাইয়া মাঠ ছাইড়া ভাগে অলম্বুষ। আর অন্যদিকে আইজ ভগদত্ত ঘটোৎকচরে ঠাঠা প্যাদানি দিয়া ভাগাইয়া দেয় যুদ্ধক্ষেত্র থাইকা। অর্জুন-উলুপির পোলা ইরাবান মাইর দেয় অবন্তি দেশের বিন্দু আর অনুবিন্দু বাহিনীরে। আবার অন্যদিকে নকুল-সহদেব তাগো মামা শল্যের লগে খেলাখেলা কিছু যুদ্ধও কইরা নেয় ফাঁকতালে এইদিন...

দ্রৌপদীর ভাই শিখণ্ডী গিয়া খাড়ায় ভীষ্মের সামনে। কিন্তু ভীষ্মের অস্ত্রপাতির সাইজ আর চেহারা দেইখা দেয় পিছটান। সেইটা দেইখা যুধিষ্ঠির কয়- তুমি না প্রতিজ্ঞা করছিলা যে ভীষ্মরে মারবা? এখন পলাইতাছ ক্যান? যুধিষ্ঠিরের খোঁচা খাইয়া শিখণ্ডী আবার আগাইয়া যায় ভীষ্মের দিকে কিন্তু মাঝখান থাইকা বাগে পাইয়া শল্য তারে ভালোই পিটানি দেয়। সেইটা হজম কইরা শিখণ্ডী আবার ভীষ্মের সামনে পৌছাইতে পৌছাইতে সূর্য অস্ত গিয়া সেইদিনের মতো যুদ্ধ শেষ হইয়া যায়...

আট নম্বর দিনে ভীমের হাতে মরে ধৃতরাষ্ট্রের আরো আট পোলা- সুনাভ-অপরাজিত-কুণ্ডধার- পণ্ডিত- বিশালাক্ষ-মহোদর- আদিত্যকেতু আর বহ্বাশী। এইটা দেইখা দুর্যোধন আবার গিয়া ধরে ভীষ্মরে- আপনে আসোলে কোনো বালও ছিড়তাছেন না আমাগো লাইগা....

ভীষ্ম কয়- কী ছিড়ার আছে না আছে জানি না। কিন্তু একটা সত্য কথা হইল যে ভীমের হাত থিকা তুমি আর তোমার ভাইগোরে ভগবানেও বাচাইতে পারব না। ভীম ধৃতরাষ্ট্রের পোলাদের মইদ্যে যারে পাইব তারেই মারব; সুতরাং তোমারে কই; মরার কথা মাথায় রাইখা ঠান্ডা মাথায় যুদ্ধ করো; তাতে যদি কিছু হয়...

এই দিন অর্জুনের পোলা ইরাবান শকুনির ছয় ভাইরে মাইরা গিয়া শেষ পর্যন্ত মইরা যায় অলম্বুষের হাতে। যুদ্ধে পাণ্ডব বংশের পয়লা সন্তানের মৃত্যু এইটা। কাকাতো ভাইরে মরতে দেইখা পাগলা ক্ষেপা ক্ষেইপা উঠে ভীম-হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ। স্বয়ং দুর্যোধন ঘটোৎকচরে সামলাইতে আইসা বেসামাল হইয়া পড়ে; দুর্যোধনরে বাচাইতে আইসা ঘটার হাতে নিজের ধনুকটাও হারাইয়া ফেলেন ধুনর্বিদ্যার গুরু দ্রোণ। বাপেরে বাচাইতে আইসা ঘটার হাতে ডবল প্যাদানি খায় অশ্বত্থামা। তিনজনরে আড়াল দিতে আইসা থাবড়ানি খায় মদ্ররাজ শল্য আর ঘটোৎকচের হাতে কুরু বীর দ্রোণ-দুর্যোধন-শল্য-অশ্বত্থামার রক্তমাখা দুর্দশা দেইখা কুরু সৈনিকরা শুরু করে পলায়ন। ভীষ্ম আর সঞ্জয় তাগোরে পিছন থাইকা ডাকেন কিন্তু সৈনিকরা ভাগতে ভাগতে কয়- বেতন না দিলে নাই; কিন্তু এর সামনে যাইতে কইয়েন না মোদের...

দুর্যোধন দৌড়াইয়া যায় ভীষ্মের কাছে- দাদাজান কিছু করেন। আমি তো অতদিন খালি ভীমের হিসাব করতাম। কিন্তু এখন তো দেখি ভীমের পোলায়ই আমাগোরে পিডাইয়া যুদ্ধ শেষ কইরা ফালাইতাছে। কিছু করেন দাদাজান...

ভীষ্ম কন- পোলাপাইনগো রক্ত গরম; গায়ে গতরে শক্তিও যেমন বেশি; ফুসফুসে জিগরও তেমন বেশি। তুমি বরং তোমার বয়েসি যুধিষ্ঠির আর তার ভাইগো লগেই লড়াই কইর। ভাতিজা টাতিজা জাতীয় জোয়ান পোলাপানগো সামনে তোমার না যাওয়াই ভালো...

কুরু বাহিনীর একমাত্র ভগদত্তই ঘটোৎকচরে কাবু করতে পারছিল যুদ্ধের সাত নম্বর দিন। তাই ভগদত্তরে গিয়া ভীষ্ম তেলানো- আপনে ছাড়া ভীমের পোলারে সামলানোর কেউ নাই; আপনে একটু আগান জংলিটার দিকে...

ভগদত্তের হাতে গতকাল মাইরা খাইয়া তারে সামলানোর কৌশল বাইর কইরা ফালাইছে ঘটোৎকচ। আইজ আর ঘটার সাথে সুবিধা করতে পারে না ভগদত্ত। ঘটা সমানে পিটাইতে থাকে তারে। পিটাপিটি কইরা আবর্জনা সরানোর কাম আছিল ভীমের; কিন্তু বাপের কাম পোলায় কইরা ফালাইতাছে দেইখা ভীম গদা থুইয়া তীর নিয়া খেলানেলা করতে করতে মাইরা ফালায় ধৃতরাষ্ট্রের আরো সাত পোলারে- অনাধৃষ্টি- কুণ্ডভেদী- বিরাজ- দীপ্তলোচন- দীর্ঘবাহু-সুবাহু আর কনকধ্বজরে মাইরা ফালায়...

পোলা ইরাবানের মরার সংবাদ শুইনা অর্জুন ভীষ্ম আর কৃপরে আক্রমণ কইরা বসে। কিন্তু ততক্ষণে সূর্যও ডুইবা যায় আর যুদ্ধও শেষ হইয়া যায়...

রাত্তির বেলা দুর্যোধন আবার সকলরে ধাতায়। কয়- ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ-শল্য-ভূরিশ্রবা কেউই যুদ্ধের কোনো বালও বোঝেন না। কর্ণ কয়- ভীষ্ম না জানেন যুদ্ধ; না আছে তার শইলে অস্ত্র চালানের শক্তি; আবার অন্যদিকে আমারেও যুদ্ধ করতে দিবেন না তিনি। তুমি ভীষ্মরে কও অস্ত্র ছাইড়া দিতে। তাইলে আমি পাণ্ডবগো টাইট দিতে পারি...

কর্ণের এতোবড়ো খোঁচা হজম করা ভীষ্মের পক্ষে কঠিন। তিনি দুর্যোধনের দিকে তাকান- খাড়াও যুদ্ধ কারে কয় আমি দেখামু কাল...

নয় নম্বর দিনে ভীষ্ম সত্যিই যুদ্ধ দেখাইলেন। তছনছ কইরা দিলেন পাণ্ডবগো। শিখণ্ডীও কোনো সুবিধা করতে পারল না। কৃষ্ণ অর্জুনরে টাইনা নিয়া গেলো ভীষ্মের সামনে কিন্তু ভীষ্মের মাইরে অর্জুন কাহিল হইয়া পড়লে আবারও যুদ্ধ না করার প্রতিজ্ঞা ভাইঙ্গা; রথের চাকা তুইলা ভীষ্মরে দাবড়ানি দিয়া; গায়ে তীর খাইয়া অর্জুনরে বাচাইতে হয় কৃষ্ণের। এই দিন অবশ্য অর্জুন-সুভদ্রার পোলা অভিমন্যু ভালোই দাবড়ায় কৌরবদের; অলম্বুষও পলায় অভিমন্যুর হাতে মাইর খাইয়া। কিন্তু তার পরেও দিনের শেষে এক্কেবারে ভাইঙ্গা পড়ে যুধিষ্ঠির- কোন আক্কেলে যে আমি ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছিলাম... কৃষ্ণ; ভাইরে যুদ্ধ টুদ্ধ বাদ দে... আমি বনে যামু। বনবাসই আমার লাইগা ভালা....

কৃষ্ণ কয়- ঘাবড়াইয়েন না বড়ো ভাই। যা হউক কাইল একটা ব্যবস্থা করব ভীষ্মের... ধৈর্য ধইরা খাড়া থাকেন...

বুইড়া মানুষের হুশবুদ্দি ঠিক নাই। নাতিগোর লাইগা তার মায়াও যেমন আছে তেমনি তাগোরে মারতেও চান না তিনি; কথাখান ঠিক। কিন্তু যখনই দুর্যোধনের ধাতানি খান তখনই পাণ্ডবগো লাইগা মায়াটায়া ভুইলা সত্যি সত্যি মারামারি শুরু করেন ভীষ্ম। এইরকম দুপেলুয়া মাইনসেরে ভরসা করা কঠিন। ইনারে পাইড়া ফেলাই সব থিকা ভালো; যদিও ইনি পড়লে কর্ণ নামবে যুদ্ধে; সেইটা আরো ভয়ানক। কিন্তু কর্ণের ক্ষেত্রে একটা সুবিধাও আছে। কর্ণের কাছ থিকা কেউ মায়ার মাইর যেহেতু আশা করে না; সেহেতু তার সামনে অসতর্কও থাকব না কেউ। কিন্তু এই বুইড়ারে দাদা বইলা কাছে গেলে তিনি শত্রু হইয়া মারেন তীর... এইরকম চেমা দোস্ত থাইকা কড়া শত্রু কর্ণ বহুগুণ ভালো...

অর্জুন নরম দিলের মানুষ। দাদা ভীষ্মরে টার্গেট করতে অর্জুনের হাত কাঁপে কৃষ্ণ তা জানে। তাই অর্জুনরে পিছনে রাইখা ভীষ্মের সামনে কৃষ্ণ শিখণ্ডীরে পাঠায়- আইজ ভাগতে চাইলে কিন্তু খবর আছে তোর...

শিখণ্ডী চোখ বন্ধ কইরা তীর মারতে থাকে বুড়া ভীষ্মের গায়ে। ভীষ্মরে যারাই বাচাইতে আসো তাগোরে পিছন থাইকা সামলায় অর্জন। জোয়ান শিখণ্ডীর এমন ঝাড়া আক্রমণে রথ থাইকা পইড়া যান গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম...

ভীষ্মের পতনে যুদ্ধ থাইমা যায়। কুরুপক্ষে শুরু হয় হাহাকার। পাণ্ডবপক্ষে মাটি দাপাইয়া নাচে ভীম- বুড়া হাবড়া তবে লেটসে অত দিনে...

দুই পক্ষেরই নরম দিলের সকলে গিয়া খাড়ায় মাটিতে পইড়া থাকা ভীষ্মের সামনে। অর্জুন কাইন্দা কাইটা নিজের তীরের খোপ খুইলা ভীষ্মের মাথার নিচে ঠেক দিয়া বালিশ বানায়। ভীষ্ম হাসেন- একটা যোদ্ধারে তার উপযুক্ত বালিশই তুমি দান করলা অর্জুন...

ভীষ্মের চিকিৎসা চলতে থাকে কিন্তু কেউই আশা করে না যে এত তীর খাওনের পর এমন লেতর মানুষটা আবার উইঠা খাড়া হবে। তিনি পইড়া মরণের অপেক্ষা করেন আর দুর্যোধনের হাত ধইরা কন- যুদ্ধ করিস না ভাই...

কান্দাকাটি হাহাকার কইরা সকলে চইলা গেলে ভীষ্মের পা ছুইয়া নিঃশব্দে আইসা খাড়ায় কর্ণ- আপনি যারে দুই চোখে দেখতে পারেন না; আমি সেই রাধাপুত্র কর্ণ...

ভীষ্ম দেইখা লন তার আশেপাশে আর কেউ আছে কি না; আছে খালি কিছু সেনাসৈনিক। তিনি তাগোরে বাইরে যাইতে কইয়া কর্ণের হাত জড়াইয়া ধরেন- আমি জানি তুমি কুন্তীর পোলা। তুমি পাণ্ডবগো পছন্দ করো না আর দুর্যোধনের দোস্ত তাই তোমারে ছুডু করার লাইগাই এত বাজে কথা কইতাম। কিন্তু আমি ভালো কইরাই জানি যে তোমার যুদ্ধ কৌশল আর শক্তি কৃষ্ণের সমান কিংবা তার থিকাও বেশি। ... যত যাই হোক; পরশুরামের শেষ শিষ্য তুমি। তোমার ধ্বংস-ক্ষমতাও আমি জানি। তাই মরার কালে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ; আমার মরার মধ্য দিয়াই যেন সব অশান্তির শেষ হইয়া যায়। পাণ্ডবরা তোমার ছোটভাই। তোমারে অনুরোধ করি; তুমি তাগো লগে মিলা যুদ্ধটা বন্ধ কইরা দেও...

কর্ণ কয়- কুন্তীর পোলা হইতে আমারে কইয়েন না আপনে। রাধার পোলা হিসাবেই যেমন বাইচা আছি আমি; মরতে হইলেও মরতে চাই রাধার পোলা থাইকা...। কুন্তী আমার কেউ না... আর দুর্যোধনরে ছাড়তে পারব না আমি। আমার জীবনের সব সম্মানই আমি পাইছি দুর্যোধনের কাছে; দরকার হইলে আমি জীবনটাও তারে দিতে রাজি। ... বুড়া হইয়া রোগে ভুইগা মরার ইচ্ছা আমার নাই। গায়ে শক্তি থাকতে যুদ্ধেই মরতে চাই আমি...

তিন কূলে মূলত নির্বংশ ভীষ্মের কেউ নাই। এইসব কুরু-পাণ্ডব নাতিটাতি সব তার সৎমা সত্যবতীর পোলার বংশধর। তিনি মিত্র থাকলে শক্তি বাড়ে তাই কুরুবংশ তার সম্মান করে। তিনি শত্রু হইলে বিপদ বাড়ে তাই পাণ্ডববংশ তারে তেলায়। কিন্তু দুই পক্ষই যখন দেখে ভীষ্মের শত্রুতা-মিত্রতা দুইটারই দিন শেষ; তখনই সইরা পড়ে সব...

তীরের জ্বালা নিয়া মাঠের এক কোনায় ছাপড়ার নিচে শুইয়া মৃত্যুর অপেক্ষা করেন নিঃসঙ্গ শান্তনু সন্তান। আর ভীষ্মের দিন শেষ শুনে বহু দূরে হাহাকার কইরা উঠে কুন্তী। এইবার তার গর্ভের প্রথম সন্তান অস্ত্র নিয়া খাড়া হইব শেষ সন্তানের সামনে। ...একটা গর্ভপাত কুন্তীরে তবে মাইনা নিতেই হবে...
২০১৪.০৩.০২ রোববার

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৫ [কর্ণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৪
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

লাল কমল এর ছবি

ভীষ্মের শরশয্যার ব্যপারটা একটু বলবেন? ছোটবেলায় মহাভারতে দেখতাম যে ভীষ্ম অনেক গুলো তীরের উপর শুয়ে আছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বিষয়টাতো সোজা; ঝাঁকে ঝাঁকে তীর খেয়ে পড়ে যাওয়া; তীরের কারণে শরীরর মাটিতে না লাগা; সাহিত্য কইরা কইলে হয় শরশয্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

অবশেষে নতুন পর্ব পাইলাম! চলুক

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দেখা যায় তীর খায়ে কেউ মরে না, খালি অজ্ঞান হয়। সেই জমানায় কি তীরের ডগায় ঘুমের ওষুধ মাখানো থাকতো?

Emran

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এক দেড়শো হাতের বেশি দূরে হইলে তীর খাইয়া কারো মরার কথা না; পইড়া যাওনই হয়তো বেশি

০২
অষুধ মাখানোর প্রচলন বোধহয় তখনো হয় নাই। অন্তত আমি পাইনি

সত্যপীর এর ছবি

তীরের ডগায় বিষ মাখানো ক্ষত্রীয় সৈয়দি বংশের পুলার নিষেধ আছিল বইলা ঋগ্বেদ এ আছে শুঞ্ছি।

..................................................................
#Banshibir.

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তীর ধনুকের জনক তো বলা হয় ভৃগুরে। তার বংশে যুদ্ধ বিশারদ শুক্র-পরশুরাম আর দাবি করা হয় লতায় পাতায় বংশধারী হইল কৃষ্ণ....

সৈয়দি বংশ তো অংগিরা-বৃহষ্পতি-ভরদ্বাজ-দ্রোণ-অশ্বত্থামা; এরা তো দুই নম্বরি মানুষজন; নিষেধটা করছে কেডায়? ঋগ্বেদের কোথায় বলেন তো?

সত্যপীর এর ছবি

পুরাণ বেদ ঋগ্বেদ নিয়া আমার জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। ভারতে মধ্যযুগে বিষ মাখানো তীর নিয়া পড়তে গিয়া কোন এক বইয়ে পাইছিলাম যে ঋগ্বেদে এই কথা আছে, আপাতত সার্চ দিয়া এইটা পাইলাম, লেখা by the laws of Manu, Kshatriyas were forbidden to poison their arrows.

..................................................................
#Banshibir.

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

কুন্তী! কে কুন্তী? ওহোহো, মনে পড়ছে। আপনি এতদিন পরে আবার....। ভুলেই গেছিলাম, কুন্তীকাহিনী। হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কুন্তী হইল রাজা জন্মেজয়ের দাদার দাদি...

সত্যপীর এর ছবি

কুপাকুপি পোস্ট। মারাত্মক হৈছে, যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা ভালু পাই।

কৃষ্ণরে অস্ত্র তুলতে দেইখা ভীষ্ম ধনুক নামাইয়া হাসেন- তুমি না কইছিলা যুদ্ধ করবা না?
কৃষ্ণ কয়- তীর খাইয়া মইরা গেলে প্রতিজ্ঞার কী দাম?

হো হো হো

..................................................................
#Banshibir.

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। কৃষ্ণ দুইবার যুদ্ধে খাড়াইছে; একবার চক্র নিয়া আরেকবার চাকা নিয়া

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইটা কার মাথায় মারলেন?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ণুড়া'র মাথায় শয়তানী হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

খালি ভাতের দায়ে ঠেইকা আছি দুর্যোধনের লগে।

ভাতের দায়ে ঠেকল কেমনে? হেরা কি ভাত খাইত নাকি? খাইত তো রুটি।
শিখণ্ডীর কাহিনী খুব শটে মারা হয়ে গেছে, কেন সে এত সহজে ভীষ্মরে কাইত কইরা দিতে পারলো, সেই ইংগিতটা থাকা দরকারি ছিল।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কথাখান হইব অন্নদায়। তয় শটকাটে বুঝাইতে গেলে যাহা অন্ন তাহাই রুটি তাহাই ভাত
তবে এদের ভাত কিংবা রুট খা্ওয়ার তেমন বর্ণনা পাই নাই কোথা্ও। মাংসটাংস ফলমূল খাইতে দেখছি;
পায়েসের বর্ণনা আছে; কিন্তু সেই পায়েস কী দিয়া বানাইত; চাল নাকি অন্য কিছু তা পাই নাই

০২
শিখণ্ডী এইখানে লং করার সুযোগ নাই। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে তরুণ শিখণ্ডী বনাম বৃদ্ধ ভীষ্ম আর তরুণ ধৃষ্টদুম্ন্য বনাম বৃদ্ধ দ্রোণের দ্বৈরথে যা হইবার তাই হইছে দুই ক্ষেত্রে; ভীষ্ম কুলাইয়া উঠতে পারেন নাই; আর কৃষ্ণ-অর্জুন মিলে ভীষ্মের সমস্ত ব্যাকাপ বন্ধ কইরা রাখছিল তখন। ফলে এক তরুণের লগে যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারেন নাই ভীষ্ম...
আমার হিসাবেও তাই বলে

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আপনার হিসাব ঠিকই আছে। তবে মহাভারতের বিভিন্ন ভার্সনে ভীষ্মের আবার আর এক বাতিকের বর্ণনা আছে, আমি সেই ইংগিত করেছিলাম। অশুভ কোন কিছু তাঁর দৃষ্টিতে পড়লে ভীষ্ম তৎক্ষণাৎ অস্ত্র সংবরন করতেন। শিখণ্ডী যেহেতু একজন হিজড়া মানব, সুতরাং তাকে দেখলে ভীষ্ম তাকে অশুভ বিবেচনা করে অস্ত্রচালনা থেকে বিরত থাকতেন। এ কারনেই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে নিশ্চল ভীষ্মের বিরুদ্ধে অন্যরা তিরন্দাজি করতে পেরেছে। রুপক হিসেবে বাংলা সাহিত্যেও এ জাতীয় দৃষ্টান্তে শিখণ্ডীর বহুল ব্যবহার রয়েছে। হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কথাখান প্রচলিত; মহাভারতমতেই প্রচলিত যে কুফা কিছু দেখলে ভীষ্ম অস্ত্র ফালাইয়া দেন; আর হিজড়া মানে কুফা মানে শিখণ্ডী মানে হিজড়া....

কিন্তু কথাখানের খণ্ডণ মহাভারতেই আছে; শিখণ্ডীর তীরে ভীষ্ম পড়েন দশ নম্বর দিন; কিন্তু সাত নম্বর দিন্ওে ভীষ্ম শিখণ্ডীর সাথে যুদ্ধ করেন; মেরে শিখণ্ডীরে তাড়িয়ে দেন; শিখণ্ডীরে দেখলেই যদি তার অস্ত্র ফেলে দেবার কথা থাকতো তবে দশ নম্বর দিনে না হয়ে তা সাত নম্বর দিনেই হতো...

০২
ভীষ্ম মা্ইর খাইয়া পইড়া যাইতে পারেন; এইটা যারা ঢাকতে চাইছে তারাই আসোলে দশ নম্বর দিনের কাহিনী এডিট করে ভীষ্মরে মহান বানাইতে চাইছে...

০৩
শিখণ্ডী কিন্তু হিজড়া না; রীতিমতো বিবাহ করে পোলাপানের বাপ..
কোনো কারণে সে হয়তো মেয়ের সাজে থাকতো

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনি যদি এরকম বছরে একটা করে পর্ব ছাড়তে থাকেন তাইলে তো কেয়ামত তক এই সিরিজ চলবে মনে হচ্ছে শয়তানী হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তাইলে তো ভালৈ হয়। কিয়ামতে দ্বৈপায়নরে ধইরা কিছু প্রশ্নের উত্তর জাইনা নিয়া পর্ব এডিটের কাম শেষ করতে পারে

এক লহমা এর ছবি

যাক, পাওয়া গেল। দেঁতো হাসি
ভাল লেগেছে।
একখান কথা আছিল; "ভীষ্ম আর সঞ্জয় তাগোরে পিছন থাইকা ডাকেন কিন্তু সৈনিকরা ভাগতে ভাগতে কয়- বেতন না দিলে নাই; কিন্তু এর সামনে যাইতে কইয়েন না মোদের..." ভীষ্ম ডাকতেই পারেন; কিন্তু সঞ্জয়! সঞ্জয় ও কি ডাকাডাকি করেছিলেন?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সঞ্জয় কিন্তু যুদ্ধ করছে; এক্কেবারে বর্ম পইরা
কুরুযুদ্ধের পরে উল্লেখযোগ্য মাত্র যে ১০জন মানুষ জীবিত থাকে তার মধ্যে সঞ্জয় একজন
[পাণ্ডবপক্ষে ৫ পাণ্ডব-কৃষ্ণ আর সাত্যকি;সাত জন। কুরুপক্ষে কৃপাচার্য-অশ্বত্থামা আর সঞ্জয়; তিনজন]

বিধুভূষণ ভট্টাচার্য এর ছবি

মহাভারতের কথা অমৃত সমান
মাহবুব লীলেনে ভনে শুনে পূণ্যবান!

অতিথি লেখক এর ছবি

যুধিষ্ঠিরের খোঁচায় ভীষ্ম আবার শুরু করেন ক্ষ্যাপা যুদ্ধ

এখানে খুব সম্ভবত ‘যুধিষ্ঠিরের’ স্থানে ‘দুর্যধনের’ হবে।
নীড় সন্ধানী যথার্থই বলেছেন, আসলেই এভাবে পোষ্ট দিলে কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। তারপরেও ধন্যবাদ তবুও তো দিলেন।
যথারীতি ব্যপুক হইসে।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ ধরিয়ে দেবার জন্য। ঠিক করে দিলাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।