আমার কখনো এতো রাগ ওঠে না। আজ কী করে যে এতো রাগ উঠে গেলো---বুঝতে পারলাম না।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। পরপর দুটো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছি রাতে। একটা মধ্যরাতে, আরেকটা ভোররাতে। কাজেই, সকালবেলা মরার মত ঘুমুচ্ছিলাম।
ঘুম ভাঙে গেলো বাবার চিৎকার-চেঁচামেচিতে।
ভেবেছিলাম ঘোর কেটে গেলে লিখব, অথবা সম্ভবত ঘোর কেটে গেলেই লিখব। সেই ভেবেই অপেক্ষা করছিলাম, দু-চার দিন, কিন্তু ঘোর কাটল না, কাটছে না, বরং ঘোরের মধ্যেই পড়ে ফেললাম আরেকটা বই। সে জন্যেই লিখতে বসা। ঘোর কাটার অপেক্ষায় থাকলে হয়ত লেখাই হয়ে উঠবে না। লেখা না হয়ে ওঠা আরও অনেক সম্ভাবনাময় লেখার মত হারিয়ে যাবে, অনেক লেখাই যে রকম ভ্রুণ অবস্থায় হারিয়ে যায়। অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি বা হয়না। আমি এমন কিছু লিখ
সোনিয়া আমাদের লাগারে আসে রাজহংসীর মতো। মুখে একটা মিষ্টি হাসি। ভারতীয় পাকিস্তানীরা বেশ সমীহই করে তাকে। সেভাবেই এসেছিল সে দিন। একটা পাকিস্তানী এসে বায়না ধরল, “তোমার সহেলির সাথে পরিচয় করিয়ে দাও”। আমি জানি সোনিয়া জানতে চাইবে “কী বলেছে লোকটা”?
একটা মেয়ে কোন ছেলেকে পছন্দ করলে বা কোন ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করলে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলার আগেই আশে-পাশের মানুষ সেটা টের পায়। আমরা যে ভাবে একজনের উপড়ে আরেক জন রাতে শুই, সে অবস্থায় অন্যের অগোচররে স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব। আমার বিরহ গোপন থাকা সম্ভব নয়। কোন কাজে আসুক আর না আসুক, আমাদের যে কোন ব্যাপারে মাহবুব ভাই খোঁজ-খবর নিয়ে পরামর্শটাও দিয়ে যান। জ্বর-জাড়ি হলে রাতে কোন ঔষধের দোকান খোলা থাকে সেটা যেনে নিয়ে
সুখের স্বপ্নের মতো জাগরণে সোনিয়ার স্মৃতিরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় আমার চারপাশে। পাঁচ লিটারের রেড ওয়াইনের বোতল সময়ের সাথে খালি হতে থাকে। আমার চারপাশটা অন্ধকারে চেনা পথের মতো। কোন কিছু না দেখেও বেশ স্বচ্ছন্দেই হেঁটে যাই। আমার ভুবনে কেউ ঢুকতে পারে না। একটা নতুন পৃথিবী তৈরী করে নিয়েছি বেশ কিছু দিন হল। মাঝে মাঝে জসিম ক্ষেপে গিয়ে বকাঝকা করে। আমি তার কথা শুনতে না পেলেও ছায়ার মতো দেখি তার খিস্তিখেউড় আমার
ঈর্ষণীয় ভরাট গলায় গমগম করছে ঘর। মানুষের উপর প্রকৃতির প্রভাব বড় প্রখর!
বর্ষকালের দিনটা একটু বড়ই হয়। বিশেষ করে যে দিন বিকেল নাগাদ একটা ঝুম বৃষ্টি হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টার ঝরঝরানি। আকাশ কালো করা মেঘ বিকেল না পেরুতেই রাত নামিয়ে দেয়। ঘড়ি ধরে গৃহস্থের দিন চলে না। বরং আকাশের গায়ে শম্বুকগতিতে গড়িয়ে চলা সূর্যের রকমফের বুঝিয়ে দেয় কখন কী করতে হবে। তবে বর্ষার দিনে তেমনটা হবার জো নেই। একটানা বৃষ্টি হলে যদিও ঘড়ি দেখে বেলা আন্দাজ করে নিতে হয়। কিন্তু যখন ‘খেকশিয়ালের বিয়ে’ টাইপের বৃষ্টি হয় তখন সময়ের মর্জি বোঝা বড় দায়। মুষল ধারের বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় হয়তো গৃহিনীরা রাতের ভাত চড়িয়ে বসে আছে, গৃহকর্তার মুখে হাসি, যাক বাঁচা গেল, আজ আর বাজারে বেরুনো যাবে না, জন-মায়েন্দারের পাওনাটা অন্তত আরো একদিন টেনে নিতে পারবে, পাওনাদার মুনিষ-চাষাদের চোখে যখন অন্ধকার ঘিরে ধরেছে, আজ রাতেও উপোষ থাকতে হবে, হাঁস-মুরগী আর গৃহপালিত পশুগুলো যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরে ওঠার, তখনই হয়তো গৃহস্থের হাসি মুখে ঝামা ঘষে, চাষা-ভূসাদের অবয়ব উজ্জ্বল করে শেষ বিকেলের সোনারোদ ছড়িয়ে পড়ে ভেজা উঠনে, বৃষ্টিধোয়া মাঠের বুকে, ভূখা চাষিদের ভাঙা চালের ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলিয়ে। শিমুল তুলোর মতো বাতাসে উড়ে বেড়ানো ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র কিছু মেঘ ছাড়া গোটা মহাকাশে নীলের হরষ। জন-মায়েন্দাররা বেরিয়ে পড়ে পাওনা আদায়ে, গৃহস্থ কাঁথার তলায় দেহটা সেধিয়ে জর-সর্দির দোহায় দিয়ে হাট কামাইয়ের অজুহাত খোঁজে, গৃহপালিতারা ছুটে বেরিয়ে পড়ে অলিতে গলিতে।
একবার এক গল্পে পড়েছিলাম- ‘মেয়েটা মন খারাপ করিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর।’ সেই কলেজপড়ুয়া আমি সারাদিন এর অর্থ খুঁজে ফিরি চারদিকে, কোনভাবেই ধরতে পারি না। সুন্দর কিছু দেখলে মন খারাপ হবে কেন? তারপর,একদিন, নাদের আলীর দাদাঠাকুরের মতো যখন আরেকটু বড়ো হয়ে উঠি, তখন বুঝে যাই এর অর্থ। এই খুব ছোট ছোট ডিটেইলসগুলো দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি।
"দ্যাখেন আম্মু, এই লোকটার সাথে আমার অনেক মিল"... শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লেখা পার্থিব পড়তে পড়তে, বইটার একটা চরিত্র কৃষ্ণজীবনের ব্যাপারে আম্মুকে বললাম।
আম্মুর তেমন কোন আগ্রহ নেই বই-টইয়ের দিকে, তাও জিজ্ঞেস করলেন, "কেমন মিল?"