গল্প: নীলুফার যখন মারা গেলো

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৩/২০০৮ - ১২:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাদের দেখা গিয়েছিলো এক সাথে, কেউ বলে শনিবারে আবার কেউ বলে শুক্রবারে। তবে বৃহস্পতিবারে সন্ধ্যায় লতু মোল্যার দোকানে তারা টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে চা খেয়েছিলো এমনটা গ্রামের অনেকেই দেখেছে - বলাবলি করছে এবং এ বিষয়ে কারো বিন্দু-বিসর্গ সন্দেহ নেই - তাদের দেখা গিয়েছিলো শুক্রবার জুম্মার নামাজে প্রথম কাতারে, হয়তো বিকালে কমলতলা বাজারেও তারা ছিলো। এখনো এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি যে তারা এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেছে অথবা কোথাও যাবে যাবে করছে। তারা, মানে আমাদের সতেরো নম্বর কমলতলা ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন মেম্বার আবদুল কালাম এবং তার ডানহাত ছুট্টোমিয়া, এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেলে এবং কিছুদিন পরে ফেরত এলে গ্রামের কারো কিছু বলার থাকবে না, করার থাকবে না। বিভিন্ন সময়ে কালাম মেম্বর এবং ছুট্টোমিয়া একসাথে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো, সাথে যোগ দিয়েছিলো তুলশীপাড়া গ্রামের সুজিত সাহা, যথারীতি পরে ফিরেও এসেছে - সেটা গ্রামবাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এবার নীলুফার আক্তার মারা যাওয়ার পর এলাকার লোকজনের মনে হয় কালাম মেম্বর এবং ছুট্টোমিয়া আবার এলাকা ছাড়া হবে। সাথে তুলশীপাড়ার সুজিত সাহাও হারিয়ে যাবে কিনা এবং গেলে কতোদিন পরে তারা ফিরে আসবে এ বিষয়ে কেউ কেউ কানাঘুষা করে।

দুই.
তবে এই কানাঘুষাটা তেমন ঘন হয় না নীলুফারের মৃত্যূ শোকে। রেল লাইনের ডান পাশে ডিস্ট্রিক্ট রোডের ঢালু খালি জমিতে ছনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়ার ঘরঅলা যে বাড়ী, সেটা নীলুফারদের বাড়ী। নীলুফারের মৃত্যূতে এলাকার লোক শোকাহত হয়, তবে শোক জানানোর আসরটা নীলুফারদের বাড়ীতে বসে না। মানুষের মুখে মুখে নীলুফারের মৃত্যুর খবর কমলতলা বাজার, লতু মোল্যার দোকান, প্রাইমারী স্কুলের মাঠ কিংবা ডিস্ট্রিক্ট রোডের শেষ মাথায় নতুন গজিয়ে ওঠা মোবাইল ফোনের দোকানে ছড়িয়ে যায়। এইসব শোকগুজার স্থানের কোথাও আমরা নীলুফারের বাবা, গরীব চাষী সালামাতুল্লাকে দেখি না। সালামাতুল্লা কী করছে, কী খাচ্ছে, মেয়ের শোকে কেমন ভেঙে পড়েছে সে খবরও কেউ নেয় না। গ্রামের লোকজন নীলুফারের জন্য মন খারাপ করে, কারণ নীলুফার গরীব সালামাতুল্লার মেয়ে, নীলুফারের এখনো মরার বয়স হয়নি, কিংবা একই গ্রামের একটা মানুষ আচমকা মারা গেলো - এই সব ভেবে ভেবে লোকজন মন খারাপ করে । তবে এই মন খারাপে নীলুফারের বর্ননা কিংবা নীলুফারের সাথে কোনো স্মৃতিময় ঘটনা উঠে আসে না। কারণ, নীলুফারকে তারা কেউ দেখেনি। তাদের অনেকেই নীলুফারের নাম জেনেছে তার মৃত্যুর সংবাদের পরে, কিংবা জানাযারও পরে। যেসব ছেলেমেয়ে প্রাইমারী স্কুলে দল বেঁধে খালি পায়ে যায় কিংবা লতু মোল্যার দোকানে দশ টাকার কেরোসিন কিনতে শিশি হাতে আসে তাদের অনেককেই গ্রামবাসী চিনে আবুল হোসেন - সামসুদ্দিন - আলাউদ্দিন কিংবা তারামিয়ার ছেলেমেয়ে নামে। এদের মাঝে কখনো নীলুফার ছিলো না। কেউ কেউ ভাবে - নীলুফার হয়তো পর্দানশীল ছিলো, হয়তো লাজুক ছিলো, হয়তো পরপুরুষকে দেখা দিতো না সে - তাই এলাকার চা দোকান কিংবা বাজারে আনাগোণা করা মানুষরা নীলুফারকে দেখেনি কখনো। মনে মনে - অনেকে এটাও মেনে নেয় যে - গরীব সালামাতুল্লার বাড়ীতে যাওয়ার প্রয়োজন কখনো হয়নি, তাই তার মেয়ে নীলুফারকে দেখাও হয়নি। ডিস্ট্রিক্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে কারও কখনো পিপাসা লাগেনি যে গরীব সালামাতুল্লাহর বাড়ীতে গিয়ে এক মগ পানি চাইবে অথবা পিপাসা লেগেছিল কিন্তু গরীব এবং নোংরা বলে কেউ পানির আশায় সালামাতুল্লার বাড়ীমুখো হয়নি। কেউ কেউ ভাবে - কখনো পানি চাইতে গেলে হয়তো নীলুফার পানি এগিয়ে দিতো, নীলুফারের ফরসা কিংবা কালো - মোটা অথবা চিকন হাত দেখা যেতো। বাড়ীর বৌ-ঝিদের কেউ কেউ নীলুফারকে দেখেছিল, তার লম্বা চুল ছিলো, পায়ে আলতা ছিলো, হাতে চুড়ি ছিলো, কপালে হয়তো টিপও ছিলো এবং তাকে দেখা গিয়েছিলো কালাম মেম্বরের বাড়ীর বাইরে আর্সেনিকমুক্ত পানির কলতলায়। আলাউদ্দিনের বৌ মুখে পান চিবিয়ে তারামিয়ার বৌয়ের মাথায় সুগন্ধি নারিকেল তেল মাখতে মাখতে নীলুফারের যে বর্ননা দেয় তাতে নীলুফারের এক রকম কল্পনা মনে আসে, কিন্তু এ বর্ণনা গ্রামের বাকী দশ বিশটা মেয়ের সাথে মিলে যায় এবং নীলুফার ক্রমশ: সাবিনা - সুলিমা - মর্জিনাদের একজন হয়ে যায়, আসল নীলুফারকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং তুলশীপাড়ার কল্পা মাসী এ খবর দেয় যে - গত তিন বছর নীলুফারের চেহারা গ্রামের কেউ দেখেনি, কারণ নিলুফার মাদ্রাসায় পড়তো, সেখানেই থাকতো এবং বছরে ছ'মাসে বাড়ী আসলেও বোরখা পড়ে চলতো, কল্পা মাসীর বাড়ীর সামনে দিয়ে হেঁটে যেতো। একদিন পথ চলতে 'তুমি কোন বাড়ীর মেয়ে গো' জিজ্ঞেস করে কল্পা মাসী নীলুফারের পথ থামিয়েছিলো, নীলুফারও থেমে খানিকটা জিরিয়ে নিয়েছিলো এবং বলেছিলো সে - কমলতলার সালামাতুল্লার সেজো মেয়ে নীলুফার। বোরখার ফাঁক গলিয়ে কল্পা মাসী সে'দিন নীলুফারের চোখ দেখেছিলো, নাকের দুপাশে ফর্সা মুখও দেখেছিল - মনে হয়েছিল নীলুফারের বয়স পনেরো অথবা ষোলো। এভাবেই অনেকে প্রথম জানলো - নীলুফার সালামাতুল্লার একমাত্র মেয়ে নয়, আরও মেয়ে আছে - এই ভেবে কারো কারো শোক হয়তো খানিকটা কমে আসে এবং লতু মোল্যার দোকানে এক কাপ গরম চায়ে ঠোঁট চুবায়। কেউ হয়তো আস্তে করে বলে - মেম্বর সা'ব তো এখনো গেরামে আছে।

তিন.
কমলতলা ইউনিয়ন গোরস্তানে নীলুফারকে মাটি দিয়ে বৃদ্ধ সালামাতুল্লা ঘরে ফেরে, সে হয়তো দাওয়ায় বসে থাকে - আকাশে তাকায়, হয়তো মগে ঢেলে পানি খায়। ছোটো মেয়ে শরীফা হয়তো একপ্লেট ভাত পাশে রেখে যায়, হয়তো রেখে যায় না; কারণ চুলায় আগুন জ্বলেনি। সালামাতুল্লাহ কন্যা শোকে পাথর হয়ে যায়, তবে ঠিক তার পরদিন লোকজন দেখে হাতে ঝুড়ি আর কাঁস্তে নিয়ে সে জমিতে নিড়ানি দিতে চলেছে - নিজের জমি নয়, হতে পারে আবুল হোসেন, আলাউদ্দিন কিংবা সামসুদ্দিনের বর্গা ক্ষেত। কেউ কেউ অনুমান করে নীলুফারের মৃত্যুতে সালামাতুল্লাহ খুব অখুশী হয়নি, কারণ পাঁচটা মেয়ের বিয়ে দেয়া নিয়ে সে প্রায়ই দু:শ্চিন্তায় থাকতো, আজকাল ডিমান্ড ছাড়া পাত্র আসে না - এতোসব কষ্টের কথা খাঁ খাঁ রোদের দুপুরে ঝিল গাছের তলায় বসে বিড়িতে ফুঁক দিয়ে সালামাতুল্লাহ বলেছিলো - পাশের মোস্তফা কিংবা সাইফুল্ল্যাকে। মোস্তফা কিংবা সাইফুল্ল্যা জানতো সালামাতুল্লার পাঁচ মেয়ে, এর মাঝে কতো জনের বিয়ে হয়েছে সেটা জানতো না, জানার আগ্রহ হয়নি অথবা সালামাতুল্লার বাড়ীতে কখনো ডেকোরেশন কোম্পানীর লাইট জ্বলেনি বলে বিয়ের খবর তারা কেউ জানেনি। এমনকি সালামাতুল্লার সেজো মেয়ের নাম নীলুফার এটা মোস্তফা-সাইফুল্ল্যারাও জানতো না। অথচ সালামাতুল্লাহ মনে মনে নীলুফারকে নিয়ে গর্ব করতো। সাত বছর বয়সে মা মরে যাওয়ার পর নীলুফার কান্না করেছিলো খুব, বড় বোন আকলিমা পাঁচ দিনের মিলাদের পর স্বামীর বাড়ী চলে গিয়েছিল। মেজ বোন শিরিনা সারাদিন সাংসারিক কাজ করতো আর নীলুফার ব্যস্ত থাকতো ছোটো শরীফা এবং লতিফাকে নিয়ে। লতিফা মারা গিয়েছিলো দশ মাস বয়সে, মায়ের মৃত্যুর চারমাস পরে, জ্বরে - ঠান্ডায় এবং হয়তো ক্ষুধায়। বছর তিনেক আগে কমলতলা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের পাশে 'কমলতলা এতিমখানা ও মহিলা মাদ্রাসা' চালু হলে সালামাতুল্লা খবর নিয়ে, ছুট্টোমিয়ার সুপারিশে, নীলুফারকে মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল এবং পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় সে তিরিশটা এতিম মেয়ের আবাসিক হোস্টেলে মুফতে থাকা খাওয়ার সুবিধাও পেয়েছিলো। নীলুফার এতিমখানায় যাওয়ার পর কিছুদিন সালামাতুল্লার ঘরটা খালি খালি মনে হয়েছিলো, মনে হয়েছিলো - বাড়ীর সামনের বড় খেজুর গাছটা কেটে ফেললে যে রকম শুন্য লাগে একপাশ, সেরকম খালি হয়ে গেছে সালামাতুল্লার ঘর। তবে এই ভেবে ভালো লেগেছিলো - অন্যান্য উনত্রিশ এতিম সাথী এবং তিনবেলার খানা খেয়ে এতিমখানায় নীলুফার অবশ্যই ভালো আছে। এতিমখানায় টিনের ঘরে সারাদিন কিতাবে নামাজে ইবাদতে আদবে নীলুফার গুণবতী পরহেজগার হয়ে উঠবে, ভালো ঘরে বিয়ে হবে, সুখে থাকবে - এমনটা ভেবে ভেবে সালামাতুল্লাহ কোনও সকালে-দুপুরে অথবা বিকালে এবং হয়তো রাতেও মুখ লুকিয়ে সুখের হাসি হেসেছিলো। ভালো লেগেছিলো যখন গত কার্তিকে নীলুফার ছুটিতে বাড়ী এসেছিল - সারা শরীর ঢাকা পবিত্রাকন্যা। দুইদিনে নীলুফার ঘরদোর সাফ করে তকতকে করে রেখেছিলো। রোজ সকালে আজানের আগে উঠে যখন নামাজ কলেমা এবং সুর করে নিঁচু স্বরে অজিফা পড়তো তখন সালামাতুল্লার মনটা অন্য রকম রোশনাইতে ভরে যেতো। মনে হতো এই সকালে দলে দলে ফেরেশতা গরীব সালামাতুল্লার ভাঙ্গা বাড়ীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে, রহমত আর বরকতের ফিনফিনে বাতাসে ভরে যাচ্ছে ঘর। এ বাতাসে এবার ভালো ফলন হবে, গাইটা বেশি দুধ দিবে এবং সামনের শীতে ঠান্ডা কাশির ভাবটা কমে যাবে। সালামাতুল্লার ইচ্ছা করতো মেয়ে নীলুফারের জন্য কিছু ভালোমন্দ বাজার করবে, শিরিনা রান্না করে নীলুফারের পাতে খানিকটা বেশি ঝোল দিবে - সালামাতুল্লা বলবে - 'তোদের মা'য়ের রান্নাও এরকম ছিলো'। এসব ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো কিনা তা আমরা জানি না, কারণ - নীলুফার বাড়ী এসে কি খেয়েছিলো তা আমাদের কানে আসেনি, সালামাতুল্লাও এরকম সাংসারিক সুখের গল্প কারও সাথে করেনি। তবে নীলুফারকে মাটি দেয়ার পরদিন অথবা তারও পরদিন সালামাতুল্লাহ যখন দুপুরে না খেয়ে জমিতে কাজ করে তখন ঝিল গাছের তলায় বসে সাইফুল্ল্যাহ বিড়ি হাতে আস্তে করে আঙুল তুলে মোস্তফাকে বলে - দেখ, ছুট্টোমিঞা না? মোস্তফা এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে সেদিকে তাকায় আর বিড়বিড় করে বলে - এরকম চক্কর দিতাছে ক্যা?

চার.
তখনও কালাম মেম্বর এবং ছুট্টোমিঞা গ্রাম ছাড়া হয়নি। তারা কমলতলা বাজারে পেপার পড়ে, চা খায় - সুজিত সাহার আড়তে কথা বলে। কেউ কেউ চাল-ডাল-তেল কেনার ভান করে সুজিতে আড়তের কিনারে ঘুরঘুর করলেও বুঝতে পারে না কালাম মেম্বরেরা কী নিয়ে কথা বলে। কখনও তারা রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, কখনও মাছের বাজার পাঁকা করার কথা বলে, চাল-ডাল-তেলের আগুন দামের আলাপ করে, হয়তো মরে যাওয়া নীলুফারকে নিয়েও দু'চারবার মন খারাপ করে। অনেক রাতে তারা কমলতলা প্রাইমারী স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে এক সাথে ঘরে ফিরে - এমনটাও লতু মোল্যার দোকানে বসে কেউ কেউ দেখে। এই দেখায়ও মানুষের মনে সন্দেহ দূর হয় না, তারা লতু মোল্যার দোকানে - ডিস্ট্রিক্ট রোডের শেষে ফোনের দোকানে এমন কি কমলতলা বাজারেও মানুষ ভাবে - এরা উধাও হয়ে যাবে, এদের দেখা যাবে না কয়েকদিন। মানুষের এ সন্দেহ অমূলক নয় সেটা সবাই জানে। কারণ, অনেক সংকট মুহুর্তে গ্রামে কালাম মেম্বর এবং ছুট্টো মিঞাকে পাওয়া যায় না। শোনা যায় - তারা সে সময় স্থানীয় সরকারের জেলা অফিসে গিয়েছিলো এলাকার বরাদ্দ আনতে, কাগজপত্রের জটিলতায় ফিরতে দেরী হয় দুইদিন তিনদিন করে পাঁচদিন। এই ফাঁকে কারা যেনো কমলতলা ছাত্র পরিষদের পলাশকে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। লাশ ঝুলে একরাত এক বেলা - খবর পেয়ে পুলিশ আসে তবে কাউকে ধরে না। তুলশীপাড়ার সুজিত সাহা এসে পুলিশের সাথে কথা বলে - বোতাম খোলা শার্ট পরে পলাশের বাবা অথবা বড় ভাইকে কান্নায় জড়িয়ে ধরে। এরকম অনেকেই কাঁদে। এবং পাঁচদিন পরে এলাকায় কালাম মেম্বর - ছুট্টো মিঞা ফিরে আসে। আসরের নামাজ শেষে দু'জন পলাশের কবরের সামনে মোনাজাত ধরে। পেছন পেছন এলাকার আরও কয়েকজন বৃদ্ধ, রুগ্ন কিছু কিশোর শামিল হয়। উপড়ানো মাটির সবুজ ঘাসগুলো ততদিনে মলিন হয়ে গেছে, মানুষের শোকও কমেছে। শোক পেরিয়ে পরদিন কালাম মেম্বর গ্রামের রাস্তা বাঁধাইয়ের ঘোষণা দেয়, ট্রাকে করে ইট আসে, খুন্তি-শাবলের ঠুক ঠুক শব্দে গ্রামের লোক উন্নয়ন দেখে, এবং আস্তে আস্তে পলাশকে ভুলে যায়। তবে পলাশ খুনের সময় কালাম মেম্বর-ছুট্টো মিঞার এলাকায় না থাকার কথা মানুষ ভুলে না। তারা মনে রাখে, কারণ - আরও আগে যেবার গ্রামের নিতাই শীলের ঘর দখল করলো সামসুদ্দিনের ভাতিজারা সেবার নিতাই শীল দৌড়ে গিয়েছিলো কালাম মেম্বরের বাড়ীতে, কালাম মেম্বর বাড়ী ছিলো না, ইউনিয়ন পরিষদের অফিসেও ছিলো না, ছুট্টো মিঞাও ছিলো না। পরে জানা গেছে - তুলশীপাড়ার সুজিত সাহাও ছিলো না এলাকায়। নিতাই দুই রাত তিন দিন কালাম মেম্বরের পুকুর ঘাটে ঝিম মেরে বসে ছিল, হয়তো কেউ দয়া করে কিছু খেতে দিয়েছিল, হয়তো দেয়নি। তবে তিনদিন পরে সকালে পুকুরে নিতাইয়ের লাশ ভেসে উঠেছিলো। কেউ কেউ বলে - না খেয়ে দূর্বল হয়ে ঘুমের ঘোরে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, কেউ বলে পুকুরের অদেখা শক্তিটা টেনে ডুবিয়েছে, কেউ আবার বলে - তার মৃগী রোগ ছিল। পঁচা লাশ দেখতে গ্রামে পুলিশ এসেছিলো কিনা সেটা কারও মনে পড়ে না। তবে কালাম মেম্বর - ছুট্টো মিঞা এবং সুজিত সাহা গ্রামে ফিরেছিলো বারো দিন পরে। সাথে ছিলো তুলশীপাড়ার নগেন যোগীর অন্ধ ছেলে, অন্ধ নয় - ভালো চোখ নিয়ে ফিরেছিল। কমলতলা ইউনিয়নের লোকজন জানে - নগেন যোগীর অন্ধ ছেলেটাকে চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়ার শংকর নেত্রালয়ে নিয়েছিল সুজিত, খরচ দিয়েছে কালাম মেম্বর এবং সঙ্গী ছুট্টো মিঞা। অন্ধ ছেলের জগত দর্শনে মানুষের মাঝে শোরগোল পড়ে যায়। কমলতলা পেরিয়ে তুলশীপাড়ায় লক্ষীপূজার ঢোল একটু জোরেই বাজে। সে উৎসবে ঈশ্বর হয়ে যায় - কালাম মেম্বর। মাঝ রাতে উৎসবের মাঝে এলাকার লোক দেখে কালাম মেম্বর - ছুট্টো মিঞা এবং সুজিত সাহা মসজিদের পুকুর ঘাটে কী কী আলাপ করে। কেউ কেউ মনে করে - তারা হয়তো নিতাই শীলের জন্য মন খারাপ করে, আবার হয়তো সামসুদ্দিনের ভাতিজাদের নতুন বাড়ী দাওয়াত নিয়েও কথা বলে। এবং এভাবেই কমলতলার অনেকে নিতাই শীলের কথা ভুলে যায়, তার বৌ-ছেলে এলাকা ছেড়ে কোথায় গেলো সে প্রশ্ন আর মনে পড়ে না। তবে এই কথা সবার মনে পড়ে - অনেক অকল্যাণময় ঘটনার সাথে এই তিনজনের এলাকা ছাড়ার মিল পাওয়া যায়। এবং গ্রামবাসী এটাও খেয়াল করে যে, খারাপ ঘটনার সময় কিংবা তারও পরে তারা গ্রামে থাকে না এবং শেষে ফিরে আসে কোনও এক সুসংবাদ নিয়ে। সেদিন লতু মোল্যার দোকানে তারামিয়া কোন এক বেখেয়ালে এরকম ঘটনা আঙুলে গোণে - তালিকায় অনেক আগে তুলশীপাড়ার মন্দির ভাঙ্গা, সুবিদালীর মেয়ে স্কুল থেকে না ফেরা, আলাউদ্দিনের পুকুরের মাছ চুরি, বার্ষিক নাটকের রাতে নবতরুণ ক্লাব ঘরে আগুন লাগা উঠে আসে। পাশ থেকে রং মিস্ত্রি জেবালাম্মদ মনে করিয়ে দেয় - নুরুল হুদার বৌ উত্তরদীঘির বশিরের সাথে ভেগে যাওয়া এবং তৈয়বালীর বিদেশ যাওয়ার আগেরদিন পাসপোর্ট হারানোর ঘটনা। এইসব ঘটনা অথবা সমস্যা সমাধানে এলাকার মাথা হিসাবে সবার প্রথমে কালাম মেম্বরের কথা মনে পড়ে, মনে হয় - একমাত্র কালাম মেম্বরই এসব সমস্যার মিটমাট করতে পারবে। অথচ এলাকাবাসী বিষ্ময় নিয়ে বারবার দেখে এসব ঘটনার সময় অথবা পরে কালাম মেম্বর বাড়ী নাই। ছুট্টো মিঞাও নাই, মাঝে মাঝে সুজিত সাহাও নাই। ঘটনা দূর্ঘটনার হিসাব ডান হাতের কড়ে রেখে তারামিয়া এবং জেবালাম্মদ অন্য হাতের আঙুলে আনন্দের সংবাদগুলোর হিসাব রাখে - এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি, সবার জন্য ৩ কেজি গম, স্কুল ভবনে রং করা, অথবা মসজিদে দু'দফায় কার্পেট, ফ্যান আর মাইকের আচমকা আগমন - এইসব লেনদেন গোণা শেষ হলে তারামিয়া এবং জেবালাম্মদ একে অন্যের দিকে তাকায়, চোখে কিছু ইশারাও হয়তো দেয়, তারা কী বলে সেটা কেবল তারাই বুঝে, লতু মোল্যা বুঝে না - হয়তো বুঝে, কিন্তু না বুঝার ভান করে - এবং শেষে দোকানের সামনে টুং-টাং ঘন্টা বাজিয়ে চলে যাওয়া কটকটিঅলার দিকে তাকায়।

পাঁচ.
এরকম অনেক কিছু অনেকেই ভাবে, এবং খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয় - নীলুফার গত তিন বছর 'কমলতলা এতিমখানা ও মহিলা মাদ্রাসা'র হোস্টেলে ছিলো। সরকারের এমপি এবং দলের দক্ষিণ জেলা সাধারণ সম্পাদকের সরাসরি তদারকী থাকায় অনুমান করা যায় - নীলুফার তিন বেলা খাবার পেয়েছে, বৃষ্টি বাদলায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। তাহলে নীলুফার মারা গেলো কেনো? এবার এ প্রশ্নে এলাকার কেউ কেউ কপাল কুঁচকায়। নীলুফারের কী কঠিন কোনো অসুখ ছিল, সেটা গোপন ছিলো বলে টের পায়নি এবং আচমকা মারা গেলো এই শুক্রবার রাতে? মরার আগে নীলুফার কী বলেছিলো, সে কি কাউকে দেখতে চেয়েছিলো অথবা কিছু খেতে চেয়েছিলো? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমরা, কমলতলা ইউনিয়নের লোকেরা, জানি না। তবে লতু মোল্যার দোকানে সামসুদ্দিনের ভাতিজা খবর দেয় - নীলুফার রাতে ঘুমের ঘোরে মারা গেছে, তার হাত দুটো সোজা করা ছিলো, চোখ দুটো বোঁজা ছিলো, মুখে হাসি ছিলো। এতিমখানার সুপারভাইজর, কালাম মেম্বরের স্বামীহীন বড় বোন, মোছাম্মাত জয়নাব বেগম এ কথা জানায় যে - নীলুফার আগের রাতে এশারের নামাজ পড়ে, ভাত খেয়ে নিয়মমতো বিছানায় গিয়েছে, রাতে কোনো শব্দ করেনি, এবং আরেক ছাত্রী আছিয়া সকালে নীলুফারকে নামাজের জন্য ডাকতে গেলে দেখে নীলুফারের শরীর বরফ শীতল হয়ে আছে। ক্রমশ: ডাকাডাকি-ধাক্কায় নীলুফারের মৃত্যু সংবাদ ঘোষিত হয় কমলতলায়, গরীব কৃষক সালামাতুল্লার বাড়ীতে, তুলশীপাড়া থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিক্ট রোডের ফোনের দোকান পর্যন্ত।

সেই থেকে আমরা নীলুফারের মৃত্যুর সাথে কালাম মেম্বর - ছুট্টোমিঞা এবং সুজিত সাহার সংযোগ খুঁজি। এতিম খানায় তাদের যোগাযোগ কেমন ছিলো, তারা কখনো নীলুফারের সাথে বাতচিতে গিয়েছিলো কিনা, নীলুফারের অন্য সখীদের সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করি। এখানে আমরা কিছু গোপন ফিসফিসানি শুনি - কালাম মেম্বর মাঝ রাতে এতিমখানায় যেতো - তবে সত্যতা জানতে জয়নাব বেগমকে আমরা জেরা করতে পারি না। কেউ কেউ সালামাতুল্লাহকে ডেকে জিজ্ঞেস করে গত তিন মাসে তার সাথে কারো দ্বন্দ্ব হয়েছে কিনা। এরকম জীবন্ত একটা মেয়ে রহস্যজনকভাবে মরে যাওয়ার পরে কোনো পুলিশ এলো না সেটা নিয়ে আমরা কথা বলি। লতু মোল্যার দোকানে এসব আলাপ থামায় আলাউদ্দিন, বলে - গরীবের মেয়ে মারা গেলে কোর্ট কাঁচারি খরচ চালাবে কে? এরপর আমরা নিশ্চিত হই - খুন কিংবা হত্যা নয়, এখানে দৃশ্যমান কোনো শত্রু নেই, অতএব - নীলুফার অজানা কোনো অসুখে মারা গেছে।

এসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেও আমরা, কমলতলার লোকেরা, কালাম মেম্বর-ছুট্টোমিঞা এবং সুজিত সাহার উপর নিয়মিত চোখ রাখি। কিন্তু এবার তারা এলাকা ছাড়া হয় না - তাদের দেখা যায় কমলতলা বাজারে সুজিত সাহার আড়তে, প্রাইমারী স্কুলের মাঠে আর পরের জুম্মার জমায়াতের প্রথম সারিতে। তবুও আমরা অপেক্ষা করি - কখন তারা এলাকা ছাড়া হবে এবং নতুন একটি সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এসে আমাদের মুখে হাসি এনে দিবে।


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

পড়লাম...ভালো লাগল...
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!

তারেক এর ছবি

দম দেখলেন? এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। হাসি
এরকম এক নিঃশ্বাসে পড়া হয়েছিল শহীদুল জহির। এবং অতঃপর বারবার... এটাও পড়ব আরো অনেকবার। তাই তো প্রিয় পোস্টে যোগ করে রাখলাম।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ভালৈছে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অমিত আহমেদ এর ছবি

সচলে যাদের গল্প আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি তাদের একজন হচ্ছে আনোয়ার সাদাত শিমুল। শিমুলের লেখার হাত, ভাব প্রকাশ কিংবা ভঙ্গি নিয়ে সন্দেহ কখনোই ছিলো না। শিমুলের গল্পের সাথে পরিচিত হবার পর আমি পিছে ফিরে গিয়ে ওর পুরানো লেখা গুলোও পড়ি ও আবিষ্কার করি এ শিমুল এক দিনে হয়নি। আগের গল্প গুলোতে বিস্তারিত বর্ণনায় গাফলতি ছিলো, তাড়াহুড়া করে গল্প শেষ করার ছেলেমানুষী ছিলো। সেসব শিমুল আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠে আজকের শিমুল হয়েছে। এটা সে পেরেছে কারণ সমালোচনায় ও কখনোই বিরক্ত হয়নি। যে যা বলেছে শুনেছে, তারপর নিজে যা ভালো বোঝে করেছে। এই গল্পটা একটা প্রমান। খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিমুল যেভাবে তুলে এনেছে আমি মুগ্ধ হয়েছি! "আর্সেনিক", "খেজুর গাছের উপমা", "সুগন্ধি নারিকেল তেল" আর কত উদাহরণ দেবো! শিমুল এ গল্পে নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গিয়েছে। শিমুলকে বিপ্লব!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নিঝুম এর ছবি

কেমন যেন অন্যরকম আর ইউনিক প্যার্টানে লিখা গল্প।দুইবার পড়তে হোলো।শিমুল ভাইয়ের লিখা মানেই এক কাপ চা নিয়ে আয়েশ করে পড়া।চা শেষ হয়নি কিন্তু গল্প শেষ।আবারো নতুন গল্পের প্রতীক্ষায়...

--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

শিমুলের গল্প মানেই সেইরকম ভালোকিছু ....
এবারের গল্পটা পড়ে মনে হলো লেখার স্টাইলে পরিবর্তন এনেছেন ....
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বোঝা যাচ্ছে, শিমুলের লেখা হয়তো একটা নতুন বাঁক নিচ্ছে। বিষয় এবং উপস্থাপনার ভঙ্গিতে। ভালো লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

কনফুসিয়াস এর ছবি

ভাইরে, এইটা কি লিখলেন? মাথা তো আউলাইয়া গেলো একদম। দুর্দান্ত।
*
আগের যে কোন গল্পের চেয়ে একদম আলাদা একটা ভাষা-ভঙ্গী, তারচেয়ে বড় কথা, তাকাবার ভঙ্গীটাও ভিন্ন, মানুষগুলোকে, গ্রামটাকে, গ্রামের গাছ-পালা মাঠ সবকিছুকে দেখবারও।
একদম ভিন্ন রকমের শিমুল। তবে এনাকেও আমার ভীষনই পছন্দ হলো।
*
এইরকম করে চললে কিন্তু মন্দ হয় না। আপনি বেলাইনে না গিয়ে এরকম কয়েকটা নামান দেখি। পড়তে ইচ্ছা করতেছে।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমারো একই অবস্থা রে ভাই! ইচ্ছা করতাসে মাথার চুল গুলা সব ছিইড়া বোয়ামে ভইরা রাখি। আমার মতে শিমুলের লেখা সেরা গল্প এটা।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

গ্রেট
টেকনিকটা ঝাপসালাইজেশন হলেও
গল্পটা একেবারে পরিষ্কারাইজড

দুর্দান্ত

নজমুল আলবাব এর ছবি

ইদানিং আপনারে দেখি ঝাপসা ব্যারামে পাইছে

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বয়স চল্লিশের কাছাকাছি গেলেই এই ব্যামোটা হয়, বৃদ্ধ লীলেন ভাই (চাচা?)'র জন্য মিলাদ পড়াই চলেন বাউল ভাই।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নজমুল আলবাব এর ছবি

আল্লাহুম্মা আমিন নয় কিয়ার জমিন
তিন কিয়ার আমার তিন কিয়ার ধু.গো'র
বাকিটা ঝাপসা মানুষর... সুম্মা আমিন

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

তুখোর লেখা শিমুল! এক কথায় তুখোর!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এখনও পড়ি নাই। অনেকটা তেঁতুলের আঁচারের মত সময় নিয়ে পুরো স্বাদ উপভোগ করে পড়তে হবে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

পড়ে মুগ্ধ হলাম আগের বারগুলির মতোই। খুবই তীক্ষ্ম, ওজনদার গল্প। ধারেও কাটে, ভারেও কাটে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

নিঘাত তিথি এর ছবি

পাঠক হিসেবে বলছি, একদম পরিপূর্ণ স্বাদের একটি গল্প। গল্প পড়ার পরে "একটি সত্যিকারের ভালো" গল্পের তৃপ্তি পেলাম। একই সাথে এটিকে শিমুলের সেরা লেখা বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক আনোয়ার সাদাত শিমুল তার নিজের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে আমাদের চোখের সামনে, দেখতে বড় ভালো লাগছে।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

শেখ জলিল এর ছবি

গল্পের আঙ্গিক পরিবর্তনের জন্য শিমুলকে সাধুবাদ। লেখনীর এই বাঁক পরিবর্তন গল্পকারকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিঃসন্দেহে আনোয়ার সাদাত শিমুল তুখোড় গল্পলেখক।
..তবে বিস্তারিত বর্ণনায় লেখককে আরও একটু সাবধানী হতে মন বলছে....এ আমার একান্ত নিজস্ব মতামত।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

এ পর্যন্ত ৯জন রেটিং করেছেন এবং সবাই পাঁচ তারা দিয়ে এ লেখাকে অসাধারণ বলেছেন। অনেকে বলেছেন এটাই এ পর্যন্ত লেখা শিমুলের সব গল্পের মধ্যে সেরা। নিজের লেখাকে নিজেই ছাড়িয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা শিমুল করছেন তার প্রশংসাও সবাই করেছেন। সবার প্রশংসাধ্বনির সাথে আমিও গলা মেলাই। বহুত খুব....বহুত খুব...

সরলরৈখিক গল্প বলার ভঙির বাইরে এসে শিমুল হয়তো এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বাস্তবতার বিচিত্র সম্ভাবনার মাঝে পাঠককে ছেড়ে দিতে, নানা তল থেকে কাহিনীকে আলো ফেলে এর মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাস-আধাবিশ্বাসের একটা ধোঁয়াশা তৈরি করতে। এতে আধা-ভাঙা, আধা-শোনা কাহিনীর চেয়ে কাহিনীর আবহ, কাহিনীর ব্যঞ্জনা, এর প্রতিবেশ-পরিবেশের অনুরণন পাঠককে মোহাবিষ্ট রাখে বেশি। নানা মননের পাঠক একই গল্প পড়ে হয়তো নানা সিদ্ধান্তে পৌঁছান এমনকি গল্পকেও পাঠ করেন নানাভাবে। যেমন কাহিনীর শুরুতেই শিমুল সুনির্দিষ্ট তথ্যকে অদরকারী করে তোলেন তার বর্ণনায় - সে গল্প শনিবার, শুক্রবার না বৃহস্পতিবারের তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে।

বাস্তবতার এই যে বহুমাত্রিকতা, এর বহুতলীয় সম্ভাবনা এবং এ নিয়ে গল্পকারদের যাদুই বুনন তা আমরা জোরেশোরে পাই মার্কেজের মধ্যে, সদ্যপ্রয়াত শহীদুল জহিরের মধ্যে, এমনকি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর মধ্যেও।

তবে গল্পটি পড়ে আমার মনে হয়েছে শিমুল হয়তো শহীদুল জহিরকেই স্মরণ করেছেন এই লেখায়। এরকম আরো কয়েকটা গল্প লিখে ফেলার পর হয়তো শিমুল এই পদ্ধতিটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করার বিষয়ে আরো দক্ষ হয়ে উঠবেন।

এই ধরনের গল্পের জন্য যে রহস্যময়তা, গুজবময়তা, কানাঘুষার পরিবেশ যুত্সই হয়, বাংলার গ্রামের ধারণা-হাঁড়ির খবর জানা সংস্কৃতি -তা হয়তো যথাযথ সরবরাহ করতে পারে না। সে কারণে শিমুলের চেষ্টাটা আরো কষ্টকর ছিল। অথবা এ কারণেই বেশ কিছু জায়গায় শিমুল সরলরৈখিক ভঙ্গিতে সমতল পাটাতনে এসে পড়ছিলেন তার বর্ণনায়। তাতে হয়তো গল্পের ঢংয়ে বিচ্যুতি ঘটেছে কিন্তু পাঠকের পাঠের আনন্দ বেড়েছে অনেক, বিরক্তিও কমেছে নিশ্চই।

এরকম আরো কিছু গল্প শিমুল লিখে ফেললে তখন আমরা হয়তো বুঝতে পারবো পদ্ধতিটা কতটা শিমুলের নিজস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ ভাষাভঙ্গির কারণে নতুন ধারার কী কী গল্প তিনি আমাদের শোনাতে পারলেন তার বিবেচনাও তখন করা যাবে। মুগ্ধতা নিয়ে এই প্রতীক্ষা আমরা করতে পারি।

-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

nira এর ছবি

Beautifully written.. bhalo lekha

অনিন্দিতা এর ছবি

এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম।
চমৎকার লেগেছে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

নাহ্ পোলাটারে একবার রাইন্ধা বাইড়া খাওয়ানোই লাগবো.....



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

দ্রোহী এর ছবি

শিমুল।

আপনার এই গল্প পড়ে এতই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে আপনাকে আমার বাসায় দাওয়াত দিয়ে ফেললাম। খাওয়া দাওয়ার পর আমি নিজ হাতে আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াবো।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমার একটা বিষয় জানবার কৌতুহল হচ্ছে ।
আনোয়ার সাদাত শিমুলের আমরা যারা নিয়মিত পাঠক,তারা তার গল্প বলার ভংগি ও গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে বেশ পরিচিত । পরিচিত বলেই আমরা এই গল্পে চট করে ধরে ফেলতে পারি যে তিনি তার লেখার ধরন,গল্পের বিষয়,বলার ভঙ্গিমা বদলেছেন । এই বদলানো যে পাঠক সাগ্রহে গ্রহন করেছে সে ও মন্তব্য সমুহ থেকে অনুমেয় ।
তবে আমি জানতে চাচ্ছি লেখক তার নিজস্ব ধরন কি সচেতনভাবে বদলালেন? তার কি কোন তাড়না হচ্ছিলো-এইবার কিছুটা বদলানো দরকার? নাকি সময় তার নিজস্ব নিয়মেই আনোয়ার সাদাত শিমুলকে আরো উৎকর্ষতা দান করছে?

শুভ কামনা । একটা পরিপুর্ন গল্প পাঠের আনন্দ হলো ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- নাহ্, নীলুফার মরেনি, শিমুলের লেখায় নূতন জীবন পেয়েছে।

গল্পটা পুরো চেটে খেয়েছি এবং তারপর মন্তব্যগুলোও। গল্পের প্রথম কয়েকটা লাইন পড়ার পরই মনে হয়েছে, খুব পরিচিত একটা ছাঁচ! জানি না, আমি ভুলও হতে পারি। কিন্তু সেই আদলটা যদি সত্যি হয়, শিমুলকে অভিনন্দন জানাতে মোটেও কার্পণ্য করবো না।

ইউ হ্যাভ ডান ইউর জব উইথ এক্সিলেন্স(ী)
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্য লিখবো বলে লগ-ইন করে , অনেকক্ষণ বসে ছিলাম । ভাবছিলাম , এই রকম প্রতিক্রিয়া দেখালে , পরে না আবার গনশত্রুতে পরিনত হয়ে যাই!!
নিঝুমের গল্প বিষয়ে , আজ আবার শিমুলেরটা !! ধারণা করি , দু'জন-ই খুব জনপ্রিয় সচলায়তনে ( মন্তব্য গুনে গুনে ধারনা হলো ) ।
তবু , আমার কথাগুলো মিলে যাচ্ছে ( আবার ও !! ) শোহাইল মতাহির চৌধুরী'র সঙেই !
শহীদুল জহির , কি এই মায়াবাস্তবতা নামের ল্যাটিন কাঠামো খুব সংক্রামক রোগ নতুন লেখকের জন্য ।
শিমুলের আরোগ্য কামনা করছি ।

অরিত্র আন্দালিব

অমিত আহমেদ এর ছবি

নাহ! শহীদুল জহির পড়তেই হচ্ছে এখন। লজ্জা নিয়েই স্বীকার করছি এই অধম তাঁর লেখা পড়েনি। কেউ কি কোনো অনলাইন সোর্স দিতে পারবেন আমাকে? তাহলে কৃতজ্ঞ থাকতাম।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

হাসান মোরশেদ এর ছবি

অরিত্র আন্দালিব যে মায়াবাস্তবতার প্রসংগ টানলেন ধরে নিচ্ছি সে ল্যাটিন সাহত্যের জাদু বাস্তবতা- মুলতঃ মার্কেজ পাঠের মাধ্যমে বাংলা পাঠকেরা যার সাথে অধিক পরিচিত হয়েছেন । কারো নাম উল্লেখ না করেই বলি আমাদের ছোট গল্পের অনেক পরিচিতজনই এই ধারা অনুসরন করেছেন,কেউ সফল ভাবে উতরে গেছেন কেউ যাননি ।
যাহোক জাদুবাস্তবতার যে রুপক ও আপাতঃ অতিলৌকিক ধারনা আমরা পাই, শিমুলের এই গল্পে কি আদৌ কি তার কোন ছোঁয়া আছে? শিমুলের এই গল্পে যতোটা বিমুর্ত,রূপক নির্মান তারচেয়ে ইংগিতময়তা অধিক । পাঠক বুঝতে পারে, ঘটনা কি? ঘটনা কারা ঘটালো? । জাদুবাস্তবতার মায়াজাল কতোটুকু এখানে? সাধারন পাঠক হিসাবে আমি তো বরং নিরেট বাস্তবতাই দেখি । নিতাই শীলের ঘর দখল করে নগেন যোগীর অন্ধ ছেলের চোখের চিকিৎসা করিয়ে দেয়া, ক্ষমতাবানদের নিরাপদ দুরত্বে থেকে স্বার্থ হাসিল করা-আমাদের যাপিত জীবনের নিরেট এই সব বাস্তবতার গল্প তো শিমুল তার গল্পে স্পষ্ট ভাবেই আঁকেন । এখানে তো কোন রূপক নেই,বিমুর্ততা নেই? নির্মান ও বর্ননায় ক্রিয়া কৌশল যতোটুকু সেটা লেখকের মুন্সীয়ানা মাত্র ।

এইসাথে এ ও বলা বোধ হয় অপ্রাসংগিক হবেনা কথিত জাদুবাস্তবতা আমাদের সাহিত্যে কোন আমদানীকৃত দারুন বিপ্লব নয় । মার্কেজের গল্পের ' তিনশ দিন ধরে বৃষ্টিপাত' কিংবা হাতের ছোয়ায় কাঁচের গ্লাসের রং বদল-এই জাদু বাস্তবতা আমাদের ঠাকুরমার ঝুলির গল্পেই তো আছে, আছে পুঁথি সাহিত্যে ।

----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এখানে আমার আরেকবার মন্তব্য করতে ইচ্ছে করছে। জাদুবাস্তবতাবাদ বা অন্য কোনো বাদ ধরে লিখবো ভেবে যদি কোনো লেখক লিখতে বসেন, তাহলে বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। একেকটা লেখা একেকটা ভাষাভঙ্গি, উপস্থাপনা-কৌশল দাবি করতে পারে। লেখক সেই দাবি অনুযায়ীই চলবেন, কোনো ঘরানা মনে রাখা জরুরি বলে আমি মনে করি না।

আরেকটা কথা বলি। খুবই ব্যক্তিগত অভিমত। ধরা যাক, শিমুল এই একই উপস্থাপনা রীতি ও ভাষা ব্যবহার করে দশটি গল্পের একটি সংকলন প্রকাশ করলো। তখন সেগুলি পরপর পড়তে গেলে একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর লাগবে না? অন্য কারো কথা জানি না, আমার লাগবে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দু:খিত, দেরীতে হাজির হয়েছি বলে।

মন্তব্যের ঘরে দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ মত-পাল্টামতের অংশটুকু পড়ে নিজেই ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই - জাদু বাস্তবতা কিংবা এরকম অনেক সাহিত্য তত্ত্বীয় বিষয়ে আমার জানার পরিধি খুব সীমিত অথবা নেই বললেই চলে। তাই গল্প লেখার সময় এসব বিষয় মাথায় ছিলোই না। আগের লেখাগুলোর মতোই গল্প বানাতে চেয়েছি, তবে বর্ণনা-ভাষারীতি পাল্টেছে।

শ্রদ্ধেয় শোহেইল মতাহির চৌধুরী, জুবায়ের ভাই, মোরশেদ ভাই এবং অরিত্র আন্দালিব যে বিষয়গুলো বলেছেন - সে প্রেক্ষিতে আমার নিজের অবস্থান ব্যাখ্যায় নিচের কথা -

নীলুফারকে নিয়ে এ গল্প লেখা শুরু করেছিলাম মাস তিনেক আগে এবং অংশ বিশেষ খসড়া করা ছিলো। গল্পের মূল স্রোতটা আগেই ঠিক করা ছিলো প্রথম থেকেই। থিমটা ছিলো এরকম - একজন মানুষ ভীষণ ক্ষমতাবান, চারপাশের মানুষ বিপদে আপদে মানুষটির শরণাপন্ন হয় - অথচ মানুষের সন্দেহ এ লোকটি অনেক কু-কীর্তির সাথে জড়িত। এতসব জেনেও কেউ প্রতিবাদ করে না, কেবল সন্দেহ করে, এর বেশি কিছু না। বরং এলাকার উন্নয়ন এবং মানুষের সাহায্যে লোকটি থাকে সবার আগে। সবাই ধারণা করবে - নীলুফার খুনের সাথে কোনো না কোনোভাবে এ লোকটি জড়িত। কিন্তু - কেউ মনে-প্রাণে চাইবে না লোকটি অপরাধী প্রমাণিত হোক, কারণ - লোকটি না থাকলে সামাজিক/ব্যক্তি উন্নয়ন সাহায্য থেমে যাবার শংকা থাকে। এবং এভাবেই প্রভাবশালী লোকটি এলাকার মানুষের সমীহ ও শ্রদ্ধা নিয়ে বেঁচে থাকে। এটা ছিলো প্রথম ভাবনার সারাংশ।

সুহৃদ ব্লগার যাঁরা আমার আগের গল্পগুলো পড়েছেন - এবার তাঁরা খেয়াল করেছেন, গল্পের বিষয় ও বলার ভঙ্গিমা বদলেছে। প্রিয় মোরশেদ ভাই প্রশ্নটি শুরুতেই রেখেছেন, এবং প্রশ্ন করেছেন - এ পরিবর্তন কেনো কিংবা কোন তাড়না বোধ থেকে হলো। এ প্রেক্ষিতে :
আগে প্রতিবার লিখতে গিয়ে মনে হতো - আমি বর্ণনা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। একটা তাড়াহুড়া কাজ করতো এবং হঠাৎ সমাপ্তিতে চলে যেতাম। দুয়েকবার বর্ণনা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও গল্পের মন্তব্যের ঘরে জেনেছি - ডিটেইলসগুলো বাড়তি অথবা অপ্রয়োজনীয়। তাই মাঝে ডিটেইলসের চেষ্টাও করিনি আর। বরং - সংলাপ নির্ভর হয়ে গল্প লিখতে চেয়েছি। প্রসংগত, ব্লগার/লেখক নজমুল আলবাব-অমিত আহমেদ-কনফুসিয়াস এই তিনজনের গদ্য বর্ণনার আমি মুগ্ধ পাঠক, এবং নিয়মিত চোখ রাখি - তাঁরা কোন কৌশলে গল্প বলে যাচ্ছেন। অমিতের সাথে একদিন আলাপ হচ্ছিলো - গল্পের বর্ণনা বিষয়ে আমার তাড়াহুড়া প্রবণতা নিয়ে। উপরে অমিতের মন্তব্যে প্রসংগটি এসেছে। এ প্রবণতা থেকে বের হতে আমি সংলাপ নির্ভরতা এড়ানোর চেষ্টা করেছি। মূল চরিত্রগুলোর বাইরে থেকে পর্যবেক্ষক হয়ে গল্প বলতে চেয়েছি। আর বিষয় বদলের মূল কারণ হলো - খেয়াল করছিলাম, আমার গল্পগুলো শহুরে নব্য ধনীক প্রজন্ম কিংবা তাদের চারপাশে চক্কর খাচ্ছে, ইংরেজী শব্দের প্রাধান্যে হয়তো বিরক্তিকরও হয়ে উঠছে। এখন বর্ণনারীতি না পাল্টে যদি সংলাপ নির্ভর হয়ে লিখতাম, তাহলেও মূল ঘটনাগুলো একই থাকতো - নীলুফার মারা যেতো, গরীব বাবার আবেগে এ মৃত্যুর প্রভাব তেমন পড়তো না, কালাম মেম্বরের অপরাধ সংশ্লিষ্টতা সংলাপে প্রকাশ পেতো, পলাশ-নিতাই শীল-মন্দির ভাঙ্গার ঘটনার বিপরীতে আই-ওয়াশিং উন্নয়নে গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হতো। মায়াবাস্তবতার জাল নয় বরং দৈনন্দিন ঘটনাকেই ধরতে চেয়েছি, আপনি যেটাকে বলেছেন - নিরেট বাস্তবতা।

শোহেইল ভাইয়ের বিশ্লেষণ পরম পাওয়া। তাঁর কথাগুলো মাথায় রাখার চেষ্টা করবো। তবে শহীদুল জহির স্মরণ, যেটাকে অরিত্র আন্দালিব বলেছেন - সংক্রামক; সে প্রসংগে বলি - আমি শহীদুল জহিরের নতুন পাঠক। এবারের বইমেলায় বই কিনে, এখনো পর্যন্ত পড়েছি - পাঁচটি গল্প। শহীদুল জহিরের লেখা পড়ে মারাত্মক মুগ্ধ হয়েছি - সেটা কতোটুকু মায়াবাস্তবতার জাল, তা না ভেবেই নীলুফারের গল্প লিখেছি। আমার নিজেরও মনে হয়েছে - ক্ষেত্র বিশেষে বর্ণনায় শহীদুল জহিরের প্রভাব পড়েছে। নবীশ গল্পকারের জন্য এ প্রভাব হয়তো ক্ষতিকর, হয়তো নতুন জানালা অথবা অন্য কিছু। তবে নিসংকোচে বলি - এ গল্পে প্রভাবটুকু আরোপিত কিংবা ইচ্ছাকৃত নয়।

আলবাব ভাই গল্প পড়েই জিজ্ঞেস করেছেন 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' পড়েছি ? বলেছি - পড়িনি। অর্থ্যাৎ তিনিও প্রভাব খেয়াল করেছেন। তবে এ গল্প যখন লেখা শুরু করি তিন মাস আগে, এবং পরে আঁটকে যাই ডিটেইল সংকটে - তখনি আলবাব ভাই কিছুটা জানতেন এ গল্পের কথা। কাকতালীয়ভাবে, নীলুফারের গল্প ঘষামাজা করে ব্লগে দেবো সিদ্ধান্ত নিই যে দুপুরে, সেদিন বিকালে ব্লগে খবর পাই - শহীদুল জহির আর নেই!

এরকম ধাঁচে আরও লেখার যে প্রসংগ প্রথমে কনফুসিয়াস, পরে শোহেইল ভাই এবং শেষে জুবায়ের ভাই বলেছেন - সেটা নিয়েও আমি দ্বিধাগ্রস্থ। কারণ, একই রকম চরিত্র প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখলে - চক্করে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে, আবার - এক ধাঁচে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নিজেকে যাচাইয়ের সুযোগও তৈরি হয়।

প্রতি-মন্তব্য বিশাল হয়ে গেলো। সবাইকে ধন্যবাদ। তবে শেষে ভালোলাগা এবং আনন্দের কথাটা বলে যাই। সচলায়তন সৃষ্টির প্রথম থেকেই আশা ছিলো - লেখা নিয়ে মনকাড়া সব আলোচনা হবে। প্রশংসার পাশাপাশি তীব্র সমালোচনায় সরগরম হয়ে উঠবে সচল-সমাজ। বিশেষ করে, অগ্রজরা এগিয়ে আসবেন। মাঝে বেশ কিছুদিন এ আশায় কোনো গতি দেখিনি। দু'দিন আগে নিঝুমের গল্প বিশ্লেষণ পোস্টে শোহেইল ভাইকেও এ কথা বলেছিলাম। এবার এ গল্পে সেরকম কিছু মন্তব্য দেখলাম। নতুন লিখিয়েদের জন্য এমন সুযোগ হয়তো শুধু সচলায়তনেই সম্ভব।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অমিত আহমেদ ও কনফুসিয়াস:
মন্তব্যের প্রাসংগিক কিছু কথা উপরে বলেছি। প্রাণখোলা প্রশংসার জন্য কৃতজ্ঞতা।

নিম-নিখারা'র লীলেন ভাই যখন 'দূর্দান্ত' বলেন, তখন জবাবহীন হয়ে যাই!

তারেক, নিঝুম, আরেফিন:
আপনাদের নিয়মিত মন্তব্য আমার খুব ভালো লাগে। হাসি
রায়হান আবীর ও পরিবর্তনশীলকেও ধন্যবাদ।

হিমু ভাই: আপনার নিয়মিত প্রশংসা ও সমালোচনা না পেলে এ ধার কিংবা ভার কোনোটাই হতো না।

নিঘাত তিথি: সেরা গল্প বিষয়ে আপনার আর অমিতের মন্তব্য বাঁধাই করে রাখতে মন চাচ্ছে। আপনার মতো সুলেখকের এমন মন্তব্য আজীবন মনে থাকবে, ভবিষ্যৎ ব্যাপ্তিটা যেখানেই যাক অথবা থামুক।

প্রিয় ধুসর, জ্বিনের বাদশা এবং জলিল ভাইকে গল্পটি পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। স্টাইল বদলের প্রেক্ষিতে - উপরে বিস্তারিত বলেছি, সাবধানী হওয়ার পরামর্শটা তাই যথাযথই গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে খেয়াল রাখবো।

বদ্দা এবং দ্রোহী: দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করলাম। এইমাত্র বলাই'দা জানালেন - আচারের বয়াম হাতে তিনিও যোগ দিবেন ;)। ধন্যবাদ, প্রিয় দুই মানুষ।

nira ও অনিন্দিতা: কমেন্টের ঘরের নিয়মকানুন পূরণ করার ধৈর্য্য ও আগ্রহের জন্য অতিথি পাঠকের মন্তব্য আমাকে অন্যরকম অনুভূতি দেয়। থ্যাংকস ।

অতিথি লেখক এর ছবি

যাহোক জাদুবাস্তবতার যে রুপক ও আপাতঃ অতিলৌকিক ধারনা আমরা পাই, শিমুলের এই গল্পে কি আদৌ কি তার কোন ছোঁয়া আছে? শিমুলের এই গল্পে যতোটা বিমুর্ত,রূপক নির্মান তারচেয়ে ইংগিতময়তা অধিক । পাঠক বুঝতে পারে, ঘটনা কি? ঘটনা কারা ঘটালো? । জাদুবাস্তবতার মায়াজাল কতোটুকু এখানে? সাধারন পাঠক হিসাবে আমি তো বরং নিরেট বাস্তবতাই দেখি ।

জনাব হাসান মোরশেদ , গ্লাসের রং বদল কি, টানা দুই দিন/দুই রাতের ( অকল্পনীয় ) মৈথুন ( দ্রষ্টব্য : সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো ) -ই ম্যাজিক রিয়ালিজম/মায়া বাস্তবতাবাদ/ জাদু বাস্তবাতার দ্যুতক , সূচক কোনটাই নয় । এটা কেবল একটা ফর্ম বা কাঠামো , যা কী না শুরু হয়েছিলো মার্কেজ র ও আগে , রেড ইন্ডিয়ানদের সাহিত্যে । ( দেখা যেতে পারে ডি . ব্রাউন নামের লেখকের যে কোন ও বইয়ে )

হ্যা , আপনার অই কথাটার সন্গে আমি একমত যে এই ফর্ম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কেউ সফল , কেউ উতরাতেই পারেননি । এক্ষেত্রে আমি কেবল এক ও অদ্বিতীয় শহীদুল জহিরের কথাই বলতে পারি । ( শিমুলের এই গল্পে যার প্রভাব মারাত্মক ! ) । এর আগে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্ তার কাদো নদী কাদো , কিংবা চাদের অমাবশ্যা য় ও তার প্রয়োগ দেখিয়েছেন , কিন্তু শহীদুল জহিরের মতো এমন সফল মনে হয়নি আমার ( আমি সব বিচারে বলছি না । বলতে চাইছি , ম্যাজিক রিয়ালিজম ব্যাবহারের ক্ষেত্রে ) ।

আমাদের আরেক শক্তিমান কথাকার শাহাদুজ্জামান ও তার লেখায় মেটাফিকশন নামের এই ধারারই এক ফর্মে গল্প লিখছেন ।

যাক কথা সেটা নয় । প্রকৃত সমালোচনা লেখকের কাজে আসে । কিন্তু চোখ বোজা বাহবা ? ক্ষতিই করে বেশী মনে হয় । শিমুল এই কথাটা বুঝেছেন বলে ভালো লাগলো । বিশেষ করে নতুন লেখকদের এই মানসিকতা আশাবাদীই করে ।

আমাদের অভিঙতা তো আমাদের হাতাশই করে ! নন্দিত নরক দিয়ে লেখা শুরু করা লেখকের শেষ পরিণতি হলুদ হিমু কালো RAB ( বাংলায় য-ফলা আসছে না ! ) দিয়ে !!!!!

ভালো থাকুন সবাই ।
অরিত্র আন্দালিব

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রিয় অরিত্র আন্দালিবঃ
আপনার প্রথম মন্তব্যে গল্পকার আনোয়ার সাদাত শিমুলের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন কারন আপনার বিবেচনায় মনে হয়েছে,শিমুল তার গল্পে প্রয়াত শহীদুল জহির তথা মায়াবাস্তবতাকে অনুসরন করেছেন । আপনার মন্তব্যের অংশ বিশেষ ছিলো এরকমঃ

শহীদুল জহির , কি এই মায়াবাস্তবতা নামের ল্যাটিন কাঠামো খুব সংক্রামক রোগ নতুন লেখকের জন্য ।
শিমুলের আরোগ্য কামনা করছি ।

লেখক শিমুল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন । কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি এখনো আপনার মন্তব্যের সার উদ্ধার করতে পারিনি । আমি ম্যাজিক রিয়েলিসমের তত্বগত আলোচনায় যাচ্ছিনা, আগ্রহী পাঠকের জন্য শুধু লিংক দিয়ে দিচ্ছি-
ম্যাজিক রিয়েলিজম এর টুকটাক
যা হোক মার্কেজ বলুন,কার্পেন্টিয়ার বলুন কিংবা একেবারে হালের ইসাবেল আলেন্দের কথাই বলুন অথবা গুন্টার গ্রাসের এ টিন ড্রামের কথাই বলি- ম্যাজিক রিয়েলিজমের যে ধারনা আমরা পাই - আনোয়ার সাদাত শিমুলের এ গল্পে কোথায় সে সবের উপস্থিতি?
সহজ কথায়- আমি বুঝতে পারিনি এই তীর্যক,নিরেট,স্পষ্ট ও পরিচিত গল্পকে কেনো বোদ্ধা সমালোচক যাদুবাস্তবতা/মায়াবাস্তবতা/ম্যাজিক রিয়েলিটির তকমা জুড়ে দিচ্ছেন?

আর যদি এটা ম্যাজিক রিয়েলিজম হয়েই থাকে সে ক্ষেত্রে কেনো তাকে সংক্রামক বলে দ্রুত আরোগ্য কামনা করতে হবে? আগে ও বলেছি,আবারো বলি-ম্যাজিক রিয়েলিজম তো আমাদের সাহিত্যে ল্যাটিন থেকে উড়ে আসা কোন ধারনা নয় । মহাভারত,রামায়নে ও জাদু বাস্তবতা ছিলো ।

ভালো থাকুন সবাই ।
অরিত্র আন্দালিব কে আবারো ধন্যবাদ আলোচনার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ।
শিমুলের জন্য শুভ কামনা ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

শিমুল তার গল্পে প্রয়াত শহীদুল জহির তথা মায়াবাস্তবতাকে অনুসরন করেছেন
জনাব হাসান মোরশেদ ,
শহীদুল জহিরের সব রচনাকর্মই কি কেবল ম্যাজিক-রিয়েলিজম কে প্রতিনিধিত্ব করে ? বললেন যে , শহীদুল জহির তথা মায়াবাস্তবতা !!অর্থাত্ আপনি ধরেই নিয়েছেন , যে , আমি লেখক শিমুলকে ম্যাজিক-রিয়েলিজমের চর্চা বাদ দিতে বলেছি !! ( যদি ও তা তাঁর লেখায় আদৌ আছে কি না সন্দেহ ! যা আছে , তা শহীদুল জহিরের তীব্র অনুকরণ ! )
আসলে আমার কথা খুব সহজ , আরো সহজ হয় আপনি যদি শিমুলের এই গল্প কে পাশে রেখে শহীদুল জহিরের যে কোনও লেখা পড়েন ; আপনি শিমুলের শুভাকাংখী হলে ,আপনি ও আরোগ্য কামনা করবেন ।

শুভ কামনা সবার জন্য ।
অরিত্র

নজমুল আলবাব এর ছবি

শিমুলের সুস্থতা কামনা করে শুরু করছি। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে সুস্থই আছে।

গল্পটা লেখার প্রক্রিয়ায় আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম। শিমুল লিখতে পারছিলেননা। অথবা তিনি এই গল্পের জন্য উদ্দিষ্ট ভাষা সংকটে ভুগছিলেন। কারন, শব্দ হাতড়ানোর সেই সময়ে তিনি ডিজুস প্রজন্ম নিয়ে আমাদের জন্য একটা গল্প দিয়েছিলেন। আমার সাথে আলাপ হয়েছিল এইসব শব্দহীণতা নিয়ে। এরপর তিনি দেশে আসলেন।
বই মেলা থেকে শহীদুল জহির সংগ্রহ করলেন। এবং মজে গেলেন। নীলুফার মৃত্যু সংক্রান্ত জটিলতার একটা সমাধান পেলেন।

আর কি আশ্চর্য যেদিন গল্পটা আমার হাতে আসলো সেদিনই জহির মৃত্যুকে ধারণ করেছেন! গল্পটা সচল হলো যখন তখন শহীদুল জহিরে মগ্ন একদল পাঠকের সামনে পড়লো।

একদল প্রশংসা করছেন, একদল বলছেন জহীরের ভাষায় কথা বলছেন শিমুল। যাদুবাস্তবতা বা এই ধরনের শব্দও চোখে পড়ছে। যা আমাদের মত পাঠকদের বিষয় নয়। সাধারণ পাঠকরা কখনই গল্প অথবা কবিতা পড়ে যাদু কিংবা মায়া খুজেননা। কিংবা এইসব উপাদন তাদেরকে গল্পের পাঠে অন্যকোন ভাবও ফেলেনা। কোন গল্পে যাদু আছে আর কোন গল্পে যাদু নাই, কোন গল্পের চিত্রকল্পে আধুনিকতা আছে কোনটায় উত্তর আধুনিকতা আছে তা কি আর পাঠকে খুঁজে? আমি অন্তত খুঁজিনা। আমি যাদু দেখি জুয়েল আইচের, সে টিভিতেই হোক আর স্টেজেই। আমাদের কৈশোরে একবার আরিফ জেবতিক যাদু দেখিয়েছিলেন আর বালকবেলায় জগন্নাথপুরে যাদু দেখিয়েছিল এক সাপুড়ে। এখনও নিয়মিত বৌ আমারে যাদু দেখায়... নিরঞ্জ দে সেও দেখায় আরেক ধরনের যাদু

১৯৯৫ সালে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল পড়ে শুরু, এরপর ডুমুর খাইয়ে নয়নতারা ফুল কেন নেই এ সংক্রান্ত ব্যাখান পড়িয়ে প্রায় ১২ বছরেও আমারে শহীদুল জহির কোন যাদু দেখাতে পারেননি। অথবা আমি যাদু দেখিনি, আমার সে চোখ নেই। আমি শুধু গল্পই পড়েছি। নিজের মতো করে সেইসব গল্প অনুবাদ করেছি।

এইযে পড়া, পাঠকের বোধের নাগালে যাওয়া, কিংবা যেতে পারা সে যেভাবেই হোক সেটা মনে হয় সবার থাকেনা। শিমুলের আছে মনে হয়। তাই তার কয়েকজন পাঠক জোটে গেছে। এই পাঠকেরা তার এক ধরনের ভাষা পড়ে প্রায় অভ্যস্থই হয়ে গেছেন। সেই পাঠকদেরকেই তিনি এ সপ্তাহে নতুন ভাষাভঙ্গি উপহার দিয়েছেন। যা শহীদুল জহির প্রভাবিত। হয়ত সরাসরি এই ভাষায়ই কথা বলতেন জহির। কিন্তু শিমুলের পাঠক হিসাবে আমাদের সেটা খুব বড় সমস্যায় ফেলেনা। আমার গল্পটা বেশ বুঝে নিই। পাঠক হিসাবে আমার মধ্যে কোন অনুযোগ অন্তত তৈরি হয়না। কেন শিমুল অন্যের ভাষা ধার করলে এই প্রশ্নটাও জাগেনা। তবে এই ভাষাটাইবা কেন শিমুলের নয় সেই প্রশ্নটা আমাকে পুড়ায়।

আমি চরম গালিবাজ। অশ্লিল ভাষায় কথা বলি। এই ব্লগেই আমার বাল্যবন্ধু আছে, তাকে যদি কেউ হাটু গেড়ে বসে বলে, আলবাব খুব ভদ্র সে হয়তো ভদ্রতা দেখিয়ে কিছু বলবেনা, কিন্তু মনে মনে বলবে, হ তুমি জানো। তাই বলেকি আমার ভাষা সবসময়ই বাজে? মনে হয় না। আমিতো মাঝে সাঝে প্রমিত বাংলায় মোটামুটি কথা বলে যাই। চালিয়ে নিতে পারি অন্তত। এই যে ভাষা বদলাই এইটা কি আমার অসুস্থতার লক্ষন? প্রেসে গিয়ে আমি অনায়াসে মেশিনম্যানকে খাইস্টা একটা গালি দিই। আবার অফিসে বসে কাস্টমারের সাথে বিগলিত হয়ে কথা বলি, এই পরিবর্তনটাতো প্রয়োজনের নিরিখেই হয়।

শিমুল তার গল্পের খাতিরে ভাষাটা বদলেছেন। সেই বদলে যাওয়া ভাষা শহীদুল জহিরের সাথে মিলে গিয়েছে বলেইকি তিনি অসুস্থ হয়ে গলেন?!? আমার মাথায় এই বিষয়টা সান্দায়না, একেবারেই সান্দায়না।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমি এগুলি বুঝি না মন খারাপ



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

একজন নবীন লেখক পূর্ববর্তী বা দূরবর্তীদের লিখনভঙ্গি, ভাষা, প্রকরণ বা দর্শন এইসব বিষয়ে প্রভাবিত হতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু শহীদুল জহিরের মতো কেউ যখন দক্ষিণ আমেরিকার জাদুবাস্তবতায় প্রভাবিত বা আচ্ছন্ন হন, তখন তা দোষের হয় না কেন?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

গল্পটার ভাষার ভঙ্গিতে শহীদুল জহিরের ছাপ আছে, এমনটা আমার কাছে মনে হয়নি। তবে শিমুলের আগের গল্পগুলির চেয়ে এর ভাষাভঙ্গি ভিন্ন।

যাদুবাস্তবতার প্রসঙ্গে আরোগ্যকামনার ব্যাপারে বলি, এই "আরোগ্য" শব্দটির ব্যবহার আমার কাছে স্থূল মনে হয়েছে। এই গল্পে যাদুবাস্তবতার সংক্রমণ কোথায় ঘটলো, সেটাও আমার কাছে স্পষ্ট না। আমি এ-ও মনে করি, একজন পাঠকের কখনোই উচিত নয়, লেখকের কিভাবে লেখা উচিত, সে ব্যাপারে উপদেশ দেয়া। লেখকের লেখা পছন্দ না হলে পাঠক সাফ জানিয়ে দিতে পারে যে, ভাই, আপনার লেখা আমার কাছে ভালো লাগে নাই। কিন্তু তাকে কোন একটি ধারায় ঢুকতে হবে বা কোন একটি ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এ প্রত্যাশা জানানো, আমার বিচারে, অনুচিত।

শিমুলের পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায় আছি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত আহমেদ এর ছবি
নিঝুম এর ছবি

আমি এ-ও মনে করি, একজন পাঠকের কখনোই উচিত নয়, লেখকের কিভাবে লেখা উচিত, সে ব্যাপারে উপদেশ দেয়া। লেখকের লেখা পছন্দ না হলে পাঠক সাফ জানিয়ে দিতে পারে যে, ভাই, আপনার লেখা আমার কাছে ভালো লাগে নাই। কিন্তু তাকে কোন একটি ধারায় ঢুকতে হবে বা কোন একটি ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এ প্রত্যাশা জানানো, আমার বিচারে, অনুচিত।

হিমু ভাইয়ের সাথে পুরোপুরি একমত।
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

সৌরভ এর ছবি

হিমু ভাইয়ের মন্তব্যে উত্তম জা-ঝা।
স্থূল ভাষায় আক্রমণ যদি কোন কারও কাছে আলোচনায় অংশগ্রহণের উপায় মনে হয়, তবে তার সত্যিকারের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার হালকা সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে।

পাঠক যদি বলে দেয়, লেখক কীভাবে লিখবে, তাহলে তো সম্পর্কটা দোকানদার আর ক্রেতার মত হয়ে গেলো।
লেখক লিখবেন তার ইচ্ছেমতোন। নতুন কোন নিরীক্ষা, পুরাতন কোন ধারার নতুন করে প্রয়োগ হতেই পারে। শব্দের বিন্যাস আর গল্প বলে যাওয়ার ধরনে আসতেই পারে পরিবর্তন। সেটাই তো কাম্য।

বেটোভেন এ প্রভাবিত ইতিহাসজয়ী সুর প্রণেতার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। তার অর্থ এই নয়, তারা অনুকরণ করছেন।
শরৎবাবু প্রথম যখন লেখা শুরু করেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ করছেন - তাকে এরকমটা শুনতে হয়েছিল। (এই তথ্যটুকুর জন্য অমিত আহমেদ এর কাছে কৃতজ্ঞ)।

শিমুল এইধারায় আরো গল্প বলবেন, সেই আশায় থাকলাম।
আমরা মুগ্ধ পাঠক অপেক্ষায় আছি, প্রিয় আনোয়ার সাদাত শিমুল, এইটা মনে রাখবেন আশা করি।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

রানা মেহের এর ছবি

একটু দেরী হয়ে গেল।
প্রশংসার সাগরে আপনি এর মধ্যে
নিশ্চয়ই গোসল করে ফেলেছেন।
তবু বলি।
ব্লগে পড়া আমার সেরা গল্পগুলোর মধ্যে
'নীলুফার যখন মারা গেল' একটা।
ভালো থাকুন

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অরিত্র আন্দালিবের কথার সূত্র ধরে অনেক মন্তব্য প্রতি মন্তব্যে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ। মূল প্রসংগে - যা বলার আগেই বলে ফেলেছি, তাই অহেতূক পুনরাবৃত্তিতে যেতে মন চাইছিলো না। আগ্রহও ছিলো না একদম।
অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক দিন।

-

রানা মেহের:
আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো।
কখনো আলাপের সুযোগ হয়নি, আজ বলে ফেলি -
বন্ধুসভায় আপনার সে-ই গল্পটি 'অভ্রের জন্য নিষিদ্ধ'(?) পুরোটা কবিতার ফরম্যাটে, উপরে লেখা 'গল্প'। ঐ সময়ে কিছুই বুঝিনি - পরে আবার পড়েছি, তখনও না।
আপনার আরো কিছু লেখা - খুব কঠিন লেগেছিলো - খুব। সময়টা কবে - ১৯৯৯-২০০০ হবে! ঐ সময়।

সচলে যখন আছেন, অনুরোধ করি লেখাগুলো তুলে দেন। আমরা সবাই পড়ি। এবার না বুঝলে আপনাকে ধরবো। বুঝাইয়্যা দ্যান। চোখ টিপি

ধন্যবাদ।

রানা মেহের এর ছবি

শিমুল
অভ্রের কাছে নিষিদ্ধ যে কোন গল্প টা
আমি নিজেও মনে করতে পারছিনা।
(তখন যা লিখতাম, নিজেও যে খুব বুঝতাম, তা না।
বুঝে লিখলে আবার লেখক হয় নাকি?????????)

আমার মহান আম্মা
আবর্জনা ভেবে পুরনো লেখার খাতা
বন্ধুসভার পাতা সহ আমার পুরো টেবিলটাই ফেলে দিয়েছেন
(আম্মা সব সময়ই দুরদর্শী)

আমারো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে পুরনো লেখা
গুলো তুলে আনি। স্মৃতি খাই।
(আসলে নতুন কিছু লেখার সামর্থ নেই!!)।
আর উপায় নেই এখন।
অপুর কাছে থাকলে পড়ে দেখতি পারি বড়জোর

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হায়!
অভ্রের জন্য/কাছে নিষিদ্ধ, বুঝিনি বলে কোন গল্পটা ঠিক বুঝাতে পারবো না। কারণ, কোনো লাইন/ঘটনাই কোট করতে পারছি না মন খারাপ

নতুন কিছু লেখার 'সামর্থ্য/উপায়' নিয়ে আরেকবার ভাববেন কি! তাহলে, আমরা পাঠকরা ঋদ্ধ হই।

শামীম হক এর ছবি

অনেক দেরী করে পড়লাম। সবাই সবকিছু বলে ফেলেছে এর মধ্যে। আমি আর কী বলবো? এক কথায় অসাধারণ!

যুবরাজ এর ছবি

প্রায় ১০ মাস পরে গল্পটা পড়ে, আমার অনুভুতি প্রকাশের কোন ভাষা নেই।অসাধারন হইসে।
----------------------------------------------------------
হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা

হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা।
----------------------------------------------------------------------------

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমিও দেরি করে পড়লাম। এক টানে পড়ে সারলাম। দ্বিতীয় বার চোখ বুলিয়ে একটা কথা মনে হল -- অনুচ্ছেদগুলো একটু বেশি লম্বা যেন। কোথাও কোথাও ভেঙে নতুন অনুচ্ছেদ শুরু করলে রিডেবিলিটি বাড়তো আরও। স্রেফ ব্যক্তিগত অভিমত।

গল্প এবং বলার ধরন নিয়ে কী আর বলবো - বাড়াবাড়ি রকম ভাল!

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ এর ছবি

শিমুল,
এখানে আসা হয়না অনেকদিন...আজকে আর না এসে পারলাম না...

আমি আসলে মুগ্ধতা আর উচ্ছাস প্রকাশ করার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা...
আপনার একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে এই অসামান্য শক্তিশালী গল্পটা মাকেও গর্বিত করেছে..

'অথবা গল্পহীন সময়' এর জন্য শুভ কামনা থাকলো...

শিমুল, আবারো বলি, আপনি আমাকে তাক লাগায়ে দিসেন, ভাই...

--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
মন, সহজে কি সই হবা?
চিরদিন ইচ্ছা মনে আল ডাঙ্গায়ে ঘাস খাবা।

--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
মন, সহজে কি সই হবা?
চিরদিন ইচ্ছা মনে আল ডাঙ্গায়ে ঘাস খাবা।

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ এর ছবি

সংশোধনঃ
'...মাকেও গর্বিত করেছে'
পড়ুন '...আমাকেও গর্বিত করেছে'
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
মন, সহজে কি সই হবা?
চিরদিন ইচ্ছা মনে আল ডাঙ্গায়ে ঘাস খাবা।

--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
মন, সহজে কি সই হবা?
চিরদিন ইচ্ছা মনে আল ডাঙ্গায়ে ঘাস খাবা।

রেনেট এর ছবি

বহুল আলোচিত গল্পটি অনেক দেরীতে হলেও পড়লাম। গল্পের গঠন, প্রকাশভঙ্গী অসাধারণ।

---------------------------------------------------------------------------
If your father is a poor man, it's not your fault ; but If your father-in-Law is a poor man, it's definitely your fault.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

বলার ভাষা পাচ্ছিনা। খুব ভাল লাগল। বর্ননাগুলো খুব বাস্তব।

--------------------------------
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

শিমুল ভাই- বেশি কিছু বলার নাই... আপনি আমার অন্যতম একজন প্রিয় লেখক (ক্যান আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আজ থেকে নিশ্চিত হলাম)...
আরো নিলুফারের জন্ম হোক আপনার হাতে...
উপরের বহু মন্তব্য পড়লাম, যেই ঘরানার প্রভাব শিমুল ভাইয়ের এই গল্পে বিদ্যমান বলে অনেকের মনে হচ্ছে- সেই শহীদুল জহিরের গল্প খুব সম্প্রতি পড়েছি- আমি নিতান্ত নাদান কিসিমের পাঠক-তবুও মনে হয় নাই এই লেখায় তাঁর প্রভাব আছে...

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

জি.এম.তানিম এর ছবি

৩ দিন আগে এক বসায় শেষ করলাম আপনার বই। সেই থেকে ভক্ত হয়ে আছি। এবারে আপনার একটি বই আসলে আরো ভালো লাগত।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

হাসিব এর ছবি

সচলে ভালো গল্প কেউ লেখে কিনা একজন জানতে চাইলো । এইটার লিংক দিলাম ।

পথিক পরাণ এর ছবি

এক অদ্ভুত রহস্যময়তা, তার ভেতরেই রহস্যের বীজ, মেঠো পথের আলের ধুলোমাখা টুকরো টুকরো শব্দ চিত্র। হতে পারত বা হতে পারে ধরণের অনেকগুলো ইঙ্গিত উৎস খুলে দিয়ে পাঠকের মনে মনে অনেকখানি গল্পের অবয়ব নির্মাণের স্বাধীনতা দিয়ে দেয়ার এই ক্ষমতাটা খুব স্বল্প লেখকের থাকে। নিলুফারের মৃত্যুর গল্পের ভেতর দিয়ে লেখকের সেই ক্ষমতার এক বাঙময় প্রকাশ দেখলাম যেন। অদ্ভুত সুন্দর কথাচিত্র!!

--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি কেবল...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।