ইতিহাস পুনর্পাঠ (৯ - ১০)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/১০/২০১১ - ৫:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৯.
৬২৫ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানব বাংলার ক্ষমতায় আসেন। মাত্র আট মাসের মাথায় পশ্চিম থেকে আগত কনৌজের হর্ষবর্ধণ অথবা পূর্ব থেকে আগত কামরূপের ভাস্করবর্ধণের হাতে তাঁর পতন ঘটে। ৬২৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরের প্রায় ১২৫ বছরের ইতিহাস ইতিহাসের বই থেকে প্রায় বিলুপ্ত। ঐতিহাসিকরা এই সময়টাকে “মাৎস্যন্যায়” বলে দায় সারতে চান। এই সময়ে বাংলা কখনো কনৌজ আর কামরূপের মধ্যে ভাগ-জোক হয়েছে; কখনো মধ্যভারতের শৈলরা, কখনো উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুক্তপিড়রা থাবা বসিয়েছে। ঐতিহাসিকেরা এ’কথাটা বলেন না এই হানাদার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে সময় সময় কোন স্থানীয় শক্তিরা হঠিয়ে দিয়েছে। কনৌজ বা কামরূপের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে যুদ্ধে হারিয়ে হঠানো মুখের কথা না। বিচ্ছিন্নভাবে দু’য়েকটা খণ্ডযুদ্ধে তাদের হারানো গেলেও তাদেরকে হঠানোর জন্য অনেক ক্ষমতা সম্পন্ন শাসক/সেনাপতি দরকার ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা অমন কারো নাম জানাতে ব্যর্থ হন। বাস্তবে একক ক্ষমতাসম্পন্ন অমন কোন শাসক তখন বাংলায় ছিলেন না, তাই ঐতিহাসিকদের নাম জানানোর কোন ব্যাপারও নেই। একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, আসলে এই সময়ে বাংলায় তৃণমূল পর্যায়ের গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল। ফলে, ব্যাপক পর্যায়ের জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে বহিরাগত হানাদারেরা বার বার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এই গণতান্ত্রিক চর্চ্চাটা ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে যায় পরবর্তী একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝখানে বাংলার সীমিত কিছু জায়গায় স্থানীয়ভাবে খড়্গ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার কথা আমরা জানতে পারি। কিন্তু তাদের বিস্তৃতি ও প্রসার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। আমরা শুধু জানতে পারি, এই সময়ে (মাৎস্যন্যায় কালে) ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের দাপট চরমে ওঠে। তাদের পারস্পারিক বিরোধ, স্থানীয় ভূস্বামীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ জনজীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এরপর নিরূপায় জনগণ তাদের অধিপতি হিসাবে গোপালকে মনোনীত করে - এভাবে পাল রাজ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস বইয়ের এই পাঠটি ত্রুটিপূর্ণ। মাৎস্যন্যায় পর্ব থেকে সাধারণ জনগণকে উদ্ধার করতে হলে ব্যাপক পর্যায়ে সাংগঠনিক বিস্তার ও দৃঢ় নেতৃত্বের দরকার। তাছাড়া অমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার পর কেউ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাবে না।

প্রকৃতপক্ষে এই সময়কালে পূর্বে উল্লেখিত গণতান্ত্রিক চর্চ্চাটির ফলে ৭৫০ সালে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব হয়। আচার্য আনন্দগর্ভ তারানাথের (প্রকৃত নাম কুঙ দ্গা স্ন্যাং পো) মতে যা ছিল মহাজনপদের পতনের পর উপমহাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিজয়ীকে ‘গোপাল’ উপাধীতে ভূষিত করে প্রশাসনের ক্ষমতায় বসানো হয়। লক্ষণীয়, গোপাল কোন নাম নয় এবং এর অর্থ ‘জনগণের রক্ষক’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনগণের এই রক্ষক অচিরেই ভক্ষকরূপে আবির্ভূত হয়ে রাজতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষত্রিয়কূলোদ্ভূত এই শাসককে আমরা পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হিসেবে দেখতে পাই। অহিংস ধর্মের এই ভেকধারী আসলে পরবর্তী বিশ বছরে তার আগের এক শতাব্দীতে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে ধ্বংস করে তার পুত্র ধর্মপালকে পরবর্তী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথ পরিষ্কার করে রেখে যান। এই জন্যই গোপালকে পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পরই রাজতন্ত্রের উত্থান বা স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ে নেপোলিয়নের উত্থান সে’কথা সাক্ষ্য দেয়। তাতে ঐ বিপ্লবটা অমর্যাদাকর কিছু হয়ে যায় না। আমাদের ইতিহাসের বইগুলোতে উল্লেখিত মাৎস্যন্যায় নামক কালো অধ্যায়টি আসলে এ’দেশে গণতান্ত্রিক চর্চ্চা ও সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।

১০.
বাংলাদেশের ইতিহাস বইয়ের একজন ভিলেনের নাম ‘রাজা গণেশ’। দিনাজপুরের সন্তান কংস রাও বা কংস শাহের পূর্ব পুরুষ কয়েক শতাব্দী ধরে দিনাজপুর এলাকার ভূস্বামী ছিলেন। বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংসের শাসনামলে স্বীয় যোগ্যতায় তিনি প্রসাশনের উচ্চ পদে আসীন হন এবং ‘রাজা’ উপাধী পান। রাজা গণেশের শুরুটা এভাবে। তাঁর ভিলেনত্বটা আসে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে তাঁর নিজের রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করায়। তাঁর বিরুদ্ধে সুলতান গিয়াস উদ্‌ দীন আযম শাহ্‌ ও তাঁর পৌত্র শিহাব উদ্‌ দীন বায়েযীদ শাহ্‌কে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এই অভিযোগগুলো প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর বদনামের আরো কারণ হচ্ছে ক্ষমতার লোভে তিনি নিজের পুত্র যদুকে ধর্মান্তরিত করেন। প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকদের দুর্বলতার কারণে স্থানীয় ভূস্বামী ও শাসকগণ (যাঁরা মূলত হিন্দু) ও জৌনপুরের আধ্যাত্বিক নেতা সৈয়দ নূর কুতুব উল্‌ আলমের প্রভাব বাড়তে থাকে। প্রভাবের এই দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে রাজা গণেশ বনাম সৈয়দ নূর কুতুব উল্‌ আলমে গিয়ে ঠেকে। সুতরাং রাজা গণেশ নিজ লোভ চরিতার্থ করার জন্য নাকি সৈয়দ শাহেবের চাপে পড়ে যদুকে ধর্মান্তরিত করান বা করাতে বাধ্য হন সেটা আমরা জানতে পারি না।

সৈয়দ সাহেবের প্রভাব কতটা ছিল সেটা বোঝা যায় শিহাব উদ্‌ দীন বায়েযীদ শাহের মৃত্যুর পর যদু’র ‘জালাল উদ্‌ দীন মুহাম্মাদ শাহ্‌’ হিসাবে ক্ষমতায় আসীন হওয়া। এতে রাজা গণেশের ক্ষমতা প্রাপ্তি হল আবার সৈয়দ সাহেবের ইচ্ছায় ক্ষমতায় হিন্দুরা বসতে পারলো না। কিন্তু এর বছরখানেকের মধ্যে রাজাজী তাঁর পুত্রকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে পুনরায় স্বধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যান আর তাঁকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে নিজেই ক্ষমতায় বসেন। এর দুই বছরের মাথায় রাজাজীর মহাপ্রয়াণ ঘটলে সৈয়দ সাহেবদের প্রভাবে যদুকে আবার ‘জালাল উদ্‌ দীন মুহাম্মাদ শাহ্‌’ হিসাবেই ক্ষমতায় আসীন হতে হয়। তিনি পনের বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর চৌদ্দ বছরের পুত্র শামস্‌ উদ্‌ দীন আহমাদ শাহ্‌ ক্ষমতায় বসেন। তার মাত্র তিন বছরের মাথায় জৌনপুরীদের আক্রমণে তিনি নিহত হলে ইলিয়াস শাহী সালতানাত আবার প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, অখণ্ড বাংলার শেষ বাঙালী শাসক হচ্ছেন শামস্‌ উদ্‌ দীন আহমাদ শাহ্‌। এরপর আজ পর্যন্ত অখণ্ড বাংলার শাসন ক্ষমতায় কোন বাঙালী অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। এর ৩২২ বছর পর বাংলার বিদেশি শাসক আরেক সতের বছর বয়সী নবাব সিরাজ উদ্‌ দৌলার পতন নিয়ে বাঙালীরা হাহাকার করলেও শামস্‌ উদ্‌ দীন আহমাদ শাহের নাম আমরা প্রায় জানিই না। অথচ বাঙালী হিসাবে শামস্‌ উদ্‌ দীন আহমাদ শাহের পতনই বাঙালীর ইতিহাসের একটি বড় ট্রাজেডি। বড় আশ্চর্যের বিষয় এই যে, শুধুমাত্র হিন্দু বলে বহিরাগত ইলিয়াস শাহী শাসকদের সরিয়ে ক্ষমতায় বসা রাজা গণেশ আজ ইতিহাসের ভিলেন হয়ে গেছেন। অথচ বাঙালীদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বাঙালীদের হিরো হবার অধিকার রাখেন।


মন্তব্য

কর্ণজয় এর ছবি

ধন্যবাদ...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পড়ার আর মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

উচ্ছলা এর ছবি

হাইস্কুলে পড়া ভুলে যাওয়া ইতিহাস আবার পড়লাম।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। ভালো লেগেছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে না থাকলে হয়তো চলে, তবে মুল বিষয়গুলো ভুললে চলবে না। ১৯৭১ সালের ইতিহাস যেমন ভোলার কোন উপায় নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা  এর ছবি

এই পোস্টটা একটা বিশেষ প্রাপ্তি। অনেক কিছু ভুলে যেতে বসেছি। সেই কবে স্কুলে পড়েছিলাম এই সব ইতিহাস। পাণ্ডব'দা আপনি আবার পড়তে দিলেন।

এই পোস্ট চলতেই থাকুক। চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট কীভাবে আর কতদিন চলবে তা জানি না, তবে আমার চেষ্টা থাকবে। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাসনীম এর ছবি

দারুণ।

প্রায় কিছু জানতাম না, মাৎসন্যায় কালটা ১০০ বছর ধরে চলা অরাজকতা বলেই ধারণা ছিল।

পারলে একটা ট্যাগে করে দিও এই অনুপোস্টগুলোর জন্য।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ বস্‌। প্রথম দুটো ইতিহাস নিয়ে তাই এগুলোকে হয়তো 'ইতিহাস' বা 'ভুলে যাওয়া ইতিহাস' - এই ধরনের ট্যাগ দেয়া যায়। তবে সেটা আমার পছন্দ নয়। একটা জুতসই ট্যাগ পেলে সেটা লাগিয়ে দেবো। পরের দুয়েকটাও ইতিহাস নিয়ে করার চেষ্টা আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রণদীপম বসু এর ছবি

ইতিহাস তো ক্ষমতাসীনের অনুকূলেই লেখা হয় ! যেভাবে আমরা ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে আমাদের ইতিহাসপাঠ্যে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে চিনি !

অবশ্য ইতিহাস যে ক্ষমতাসীনের অনুকূলেই রচিত হয়, এটাও যে একটা ইতিহাস, এই ইতিহাসও কেউ না কেউ লিখবে অবশ্যই। এই যেমন আপনি লিখছেন অনুপোস্টের পোশাক চড়িয়ে !

আসলে মহাকাল কাউকে না কাউকে দিয়ে সঠিক কাজটি করিয়ে নেয় শেষপর্যন্ত, কথাটা আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইতিহাস কীভাবে লেখা হয় আর তার ত্রুটিগুলো কী সেটা নিয়ে ইবনে খালদুনের একটা চমৎকার বিশ্লেষণ আছে - সেটা আপনার জানা থাকার কথা। সাধারণ মানুষের, বিশেষত নিম্নবর্গের মানুষের কনটেক্সট থেকে ইতিহাস লেখার চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। নিজে সেই গোত্রভূক্ত বলে ইতিহাসগুলোকে এভাবে দেখতে পাই।

পড়ার আর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ বস্‌।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পাঠক এর ছবি

এটা পড়ে, অণুপোস্টগুচ্ছ-০১ টা পড়লাম। অনেক না জানা তথ্য জানলাম। ভালো হচ্ছে পাণ্ডব, সত্যি খুব ভালো একটা সিরিজ হচ্ছে এটা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ পাঠক। সিরিজ চালানোর চেষ্টা করবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফাহিম হাসান এর ছবি

অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ প্রিয় ফটুরে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আশালতা এর ছবি

ক্লাস নাইনের ইতিহাস পরীক্ষায় এসেছিল, মাৎস্য ন্যায় সম্পর্কে কি জান ? একজন লিখেছিল মাৎস্য মানে মাছ । তারপর রুইমাছ পুঁটিমাছ সহ যাবতীয় প্রজাতিসহ বিশাল এক মাছের রচনা। সে রচনাও আবার ভারী উপাদেয়, বিভিন্ন 'তত্বজ্ঞানে' ভরপুর। ক্লাস টিচার সেটা পড়ে শুনিয়েছিলেন, হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মাৎস্যন্যায় সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জ্ঞান যদি এই পর্যায়ের হয় তাহলে তার দায়টা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরও বটে। আমাদের স্কুলগুলোতে ইতিহাস কীভাবে পড়ানো হয় তা আমি জানি। তাতে শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে যদি - মনোযোগ দেবার দরকার নেই, অদরকারী, বোরিং ইত্যাদি মনে করেন তাহলে তাদের দোষারোপ করা যাবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ওডিন এর ছবি

ইন্টারেসটিং। মাৎস্যন্যায় এর কথাটা ইশকুলের ইতিহাস বইয়ে খুব আবছাভাবেই লেখা ছিলো ( অন্য সবকিছুর মতোই) , তাই নতুনকরে কিছু চিন্তাভাবনার খোরাক পাওয়া গেলো।

তবে লেখা যেহেতু 'অণু', সহপাঠ হিসেবে কয়েকটা বইয়ের নাম দিলে আমার জন্য একটু ভালো হতো মনে হয় হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মাৎস্যান্যায় স্কুলের বইয়ে এক লাইন কি দুই লাইনে সারা হয়। এর কারণ, মূল ইতিহাস বইগুলোতেও এই ব্যাপারে প্রায় কিছু নাই। শাসক হিসাবে গোপালকে নির্বাচন করা, কনৌজী আর কামরূপীদের নিয়মিত হঠানো এই কাজগুলোর কার্যকারণ অনুসন্ধান করার ব্যাপারটা ঐতিহাসিকেরা প্রায় করতেই চান না। তাছাড়া ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে রাজা/সম্রাট/নবাব/লর্ড ইত্যাদি না থাকলে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক হাঁসফাঁস করেন। এ'জন্য মহাজনপদের ইতিহাস পড়ানো হয় না। পড়ানো হয় পৃথিবীর আদিতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসকারী সম্রাট অশোকের ইতিহাস।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পুনশ্চঃ রেফারেন্স বইয়ের নাম যোগ করতে গেলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে যাবে। আমি চাই পাঠকরা একটু খাটাখাটুনি করুন। যাদের আগ্রহ আছে তারা ঠিকই পেয়ে যাবেন - এমন কি নেট ঘেঁটেও। ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আরো চমকপ্রদ ইতিহাসও পেয়ে যাবার কথা। তবে যারা খাটুনিটা দিতে আগ্রহী না তারা পোস্টের কনটেন্টের ব্যাপারে আস্থাবান থাকতে পারেন। 'মাইনাস চারশ ডিগ্রী সেলসিয়াস' বলে পার পেয়ে যাওয়ার দিন ফুরিয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কল্যাণF এর ছবি

চলুক পান্ডবদা আগের অণুপোস্টের লিঙ্কটা উপরে যোগ করে দেওয়ার কঠোর আমরণ দাবি। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ওরে কে আছিস ফৌজদারকে আগে গোস্ত-পরোটা খাওয়া! অনশন ভাঙার জন্য মিনারেল ওয়াটার আর মালয়েশিয়ান বিস্কুট নিয়ে আয়!! আর অনশন শেষে খাওয়ার জন্য বিরিয়ানী নিয়ে আয়!!! (সূত্র)

এটা যদি সিরিজ হিসাবে চলে তাহলে একটার সাথে আগের কতগুলোর লিঙ্ক দেবো? এরচেয়ে একটা ভালো ট্যাগ সাজেস্ট করুন তো। তাহলে সেটা ট্যাগে লাগানো যেতে পারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কল্যাণF এর ছবি

খুবি গর্বীত বোধ করতেছি পান্ডবদা, এই লন ট্যাগ সাজেশনঃ যে চোখে বাংলাকে দেখিনি।

আপনার এই পোস্ট বুকমার্ক করার দরকার মনে হইছে, তাই একটা পোস্ট থিকা সবগুলায় নেভিগেশনের সুবিধার জন্য লিঙ্ক যোগ করার দাবি থিকা নড়ি নাই, পোস্টের শুরুতে না করে শেষে লিঙ্ক যোগ করা হোক এই ছাড় দিয়া সমঝোতার প্রস্তাব সহ পানি-পুনি খাইলাম।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বুকমার্ক করার সুবিধার্থেই তো একটা জুতসই ট্যাগ চাইলাম। ট্যাগটা হলে ওটার উপর পাঠক ক্লিক করলে এক ক্লিকেই আগের সব লেখা পেয়ে যাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফকির লালন এর ছবি

১। মাতস্যন্যায় অরাজকতার সময় বলেই পরিচীত আছে, অন্তত পাঠ্যবইয়ে সেইরকমই লেখা। শক্ত রাজার অনুপস্থিতি যে এনার্কিই হবে এমন নাও হতে পারে। স্বাধীন পঞ্চায়েততন্ত্র হবারও সম্ভাবনা থাকে। তবে সেরকম কোন ভিন্ন আলোকপাত ইতিহাসে আছে কি?
২। পড়েছি কোথাও, কইবর্ত নামে এক ব্রাত্যজন নাকি পুন্ড্র এলাকা স্বাধীন করেছিলো, সে এ মাটির মানুষ হবে বলে ধারণা করি।
৩। সব পড়ে তেভাগা আন্দোলনের কথাও মনে হলো। রাজশাহী-মালদহ এলাকা অনেক বিদ্রোহের ভূমি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. শক্ত রাজার অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে অ্যানার্কি'র অনিবার্য উপস্থিতি নয়। মাৎস্যন্যায় নিয়ে খুব বিস্তারিত না থাকায় স্বাধীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটার কথা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। তবে মূল লেখায় আর উপরে ওডিনকে বলা কার্যকারণগুলো থেকে অনুমিত সিদ্ধান্তটি আমি যেমনটা বলেছি এমনটা হবার কথা। তাছাড়া আমরা জানি, অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় প্রশাসন হিসেবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই আছে। সুতরাং, আপনার অনুমিতিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

২. কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে সামনের কোন একটা পর্বে লিখব।

৩. মুঘল আমলে দাক্ষিণাত্যের শাসকদের ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত ছিল, "যে যায় দক্ষিণে, সে-ই হয় বাগী (বিদ্রোহী)"। কে জানে উত্তরবঙ্গের মাটিই অমন 'বাগী' তৈরী করে কিনা! গোটা বাংলাতে প্রায়ই এমন বিদ্রোহের আগুন জ্বলার কারণ নিয়ে পরের কোন একটা পর্বে লিখব। একটা ব্যাপার কি লক্ষ করেছেন, পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে তেভাগা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ এই বিষয়গুলো এখনো অন্তর্ভূক্ত হয়নি! কংগ্রেস-মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগ-বিএনপি না হলে ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া সম্ভব না মনে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

চমৎকার একটা সিরিজ হচ্ছে। "প্রদোষে প্রাকৃতজন" বইতে কি এই সময়টা ছিল? ভুলে গেছি মন খারাপ

ট্যাগ কি "ইতিকথা" হতে পারে? চিন্তিত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. না, 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' আর 'দুষ্কালের দিবানিশি' ১২০০ সালের দিককার ঘটনা নিয়ে লেখা। এখানে প্রসঙ্গ-৯ অষ্টম শতকের ঘটনা আর প্রসঙ্গ-১০ পঞ্চদশ শতকের ঘটনা নিয়ে লেখা। দ্বাদশ আর ত্রয়োদশ শতকের কিছু ঘটনা নিয়ে সামনে কোন পর্বে লেখার আশা রাখি।

২. "ইতিকথা" ঠিক লাগসই মনে হচ্ছে না। আরেকটু ভেবে জানাও।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিহান এর ছবি

বাবা ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। সেই সূত্রের ইতিহাস আমার প্রিয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিয়ে বাড়াবাড়ির কথা শৈশবে শুনতাম বাবার কাছে। আপনার লেখা অনেক অনেক ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

ইদানীং পৃথিবী অনুভব করে, একটা সূর্যে চলছেনা আর
এতো পাপ, অন্ধকার
ডজনখানেক সূর্য দরকার।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার ইতিহাস পাঠের শুরুটাও আমার বাবার কাছ থেকে, যদিও উনি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন না। ইতিহাসের এই ভিন্ন পাঠের শুরুটাও উনার কাছ থেকে - যেখান থেকে বুঝেছি স্কুলের বইয়ে লেখা ইতিহাসই সব নয়।

আমাদের স্বভাব হচ্ছে "স্বদেশী ঠাকুর ফেলে বিদেশী কুকুর পূজা করা"। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য এ'দেশের সন্তান ফকির মজনু শাহ্‌, ভবানী পাঠক, মীর নিসার আলী, দুদু মিয়া, সূর্যসেন'রা আমাদের হিরো হতে পারেন না। আমাদের হিরো হয় সিরাজ উদ্‌ দৌলা, মীর কাশিম'রা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফকির লালন এর ছবি

তিতুমীরদের বিদ্রোহ কি ওহাবী ভাবধারা প্রসূত, পিউরিটান রিফর্মিস্ট আন্দোলন প্রভাবিত?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তীতুমীরের ধর্মীয় স্কুলিং অবশ্যই ওয়াহাবী। হজ্জ্ব থেকে ফিরেই তাঁর সশস্ত্র সংগ্রামে নামার পেছনে ওয়াহাবী সংযোগ থাকতে পারে। মুসলমানদের লুঙ্গী (তহবন্দ) পরানোর পেছনেও এক ধরনের রিফর্মিস্ট চিন্তা থাকতে পারে। তবে আমি উনাকে দেখতে পাই এমন একজন বিপ্লবী হিসাবে যিনি ঔপনিবেশিকতা (ব্রিটিশ) ও সামন্তবাদ (জমিদার)-এর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। গণমানুষের প্রধান দুই শত্রুকে চিনতে তাঁর কোন ভুল হয়নি। যেখানে উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের সংগঠন কংগ্রেস-মুসলিম লীগ সামন্তবাদকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিতই করতে পারেনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

কয়েকটা জিনিস একটু অস্পষ্ট রয়ে গেছে, পরে প্রশ্ন করব।

১৫০০-১৬০০ সালের বাংলার (আফগান) কররানী বংশকে নিয়ে আপনার লেখা চাই।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রশ্ন এখনই করে ফেলেন বা পরে মনে হলে মেইল করে জানান। এই বিষয়গুলো ভাবনাতে থাকতে থাকতেই অস্পষ্টতাগুলো দূর করতে চাই।

কররাণীদের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য আপনার জন্য বিসমিল্লাহ্‌'র কাবাব আর নূরাণী'র শরবত তোলা থাকলো। কররাণীরা ১৫৬৪ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেছেন। দিল্লীর তখতে তখন আকবর আসীন ছিলেন। সম্ভবত দাউদ খান কররাণী হচ্ছেন বাংলার একমাত্র শাসক যিনি ভারত আক্রমণের সাহস দেখিয়েছিলেন এবং মুঘলদের পরাজিত করে গোটা ভারত বাংলার অধীনে আনার পরিকল্পনা করেছিলেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

কররানি'দের নিয়ে তো তেমন কথাবার্তা ওঠে না। ওই শাসনের পটভূমিতে একটা গল্প লিখব বলে কিছু মেটেরিয়াল জোগাড় করেছিলাম, কিন্তু এতদূর থেকে যে বইপত্র পড়তে পাওয়া যায় না। গল্পটাও যুতমত হয়নি শেষমেষ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটু ধৈর্য ধরুন। অণুপোস্টগুচ্ছের চতুর্থ কিস্তি কররাণীদের নিয়ে লেখার আশা রাখি। কালা পাহাড় আসিতেছে - এইবার আপনার গল্প না দাঁড়িয়ে যাবে কোথায়!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

খুব ভাল লাগল, আরো লিখা পড়তে চাইছি। পোষ্ট করতে থাকুন অনুগ্রহ করে--

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চেষ্টা চলছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পথিক পরাণ এর ছবি

মাৎসন্যায় -এর নতুন পাঠটি ভালো লাগলো। পাল বংশের পরে বাংলায় সেন বংশ ছিল কিছুদিন। এরপর ১৭ জন অশ্বারোহীর গল্প। এই বিষয়গুলা একটু অন্য আলোয় আপনার থেকে জানতে মুঞ্চায়।

গণেশ আর তাঁর পুত্র প্রপৌত্রদের নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ আমার ভাবনাকে শক্ত বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করল।

অনেক শুভেচ্ছা।

------------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ ---

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পাল বংশের শেষ, সেন বংশের উত্থান, কৈবর্ত বিদ্রোহ আর তুর্কীস্থানী অশ্বারোহীদের নিয়ে পরের পর্বে লিখেছি - পড়েছেন নিশ্চয়ই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।