মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ১২

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: রবি, ২৫/০১/২০১৫ - ৬:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অভিষেকের আসরে হায় হায় করে যুধিষ্ঠির- মানুষ হারতে হারতে জিতে আর আমি হতভাগা জিততে জিততে হারি। কী পাইলাম আমি যুদ্ধ কইরা? জয়তো পাই নাই আমি; গৌরবটাও নাই। যাগো মারছি তারা যেমন নিকটাত্মীয় তেমনি মারার বীরত্বও দাবি করতে পারি না আমরা। যুদ্ধ কইরা খালি গায়ের ঝাল মিটছে আমাদের। দুর্যোধন ঠিকই কইছে; সে আমারে বিষণ্ন এক বিধবা দুনিয়া দান কইরা গেছে। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না রে ভাই। এমন রাজত্ব আমি টানতে পারব না। আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু...
অর্জুন তারে বোঝায়- অতকিছু কইরা এখন এইসব কইলে কি হবে?
ভীম তারে ধাতানি দেয়- তুমি একটা আইলসা। তুমি কাজকর্ম বাদ দিয়া ঠোলা বামুনগো মতো বক বক কইরা দিন কাটাইতে চাও তাই এমন কথা কও...
নকুল সহদেবও তারে বোঝায়। দ্রৌপদী কয়- আপনের মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিছে। আপনেরে এখন গাছের লগে বাইন্ধা রাখা দরকার...
কৃষ্ণ কয়- যারা মইরা গেছে বিলাপ করলে তো আর ফিরা আসব না তারা...

সকলে বোঝায় কিন্তু বোঝে না যুধিষ্ঠির। সে খালি কয় আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কন- রাজা হইয়া সন্ন্যাসীর মতো কথা কইও না যুধিষ্ঠির। তোমার যদি মন উতলা হয় তবে যজ্ঞ কইরা প্রায়শ্চিত্ত কইরা লও। এর লাইগা সবচে ভালো যজ্ঞ হইল অশ্বমেধ...
যুধিষ্ঠির কয়- আমি রাজকর্ম জানি না ভগবান। আমরে আপনি রাজকর্ম শিখান...
দ্বৈপায়ন কন- সেইটার লাইগা উপযুক্ত মানুষ হইলেন ভীষ্ম। তিনি এখনো জীবিত। তুমি তার কাছে যাও...

গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম এখনো শিখণ্ডীর তীরের জ্বালা নিয়া বাইচা আছেন। অভিষেকের পর সবাইরে নিয়া যুধিষ্ঠির তার কাছে হাজির হইয়া রাজকার্য আর ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জিগায় আর তিনি তার অভিজ্ঞতা থাইকা উত্তর দেন। বেশ কয়েকদিন চলে এইভাবে। তারপর যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুর ফিরা আসার মাস দেড়েক পর সংবাদ পায় ভীষ্মের অবস্থা যায় যায়...

তীর খাওয়ার আটান্ন দিন পর মারা গেলেন ভীষ্ম আর ভগিরতীর তীরে তার শেষকৃত্য কইরা আবারও কাইন্দা গড়াগড়ি যায় যুধিষ্ঠির- কী চাইলাম আর কী পাইলাম মুই? এত দুঃখের ভার কেমনে টানি? ভীষ্ম আর কর্ণের মৃত্যুর কথা কেমনে ভুলি? আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু...
তার দুঃখ দেইখা শেষ পর্যন্ত মৃত পোলাদের বাপ ধৃতরাষ্ট্রও তারে বোঝান- দুঃখ করতে হইলে তো করা লাগে আমার আর গান্ধারীর। তুমি কেন অত দুঃখ পাও?

দ্বৈপায়ন ব্যাস এইবার ক্ষেইপা উঠেন- কোনোকালেই তোমার মাথায় পাকনা বুদ্ধি আছিল না; এখনো নাই। তুমি বারবার পোলাপাইনের মতো ন্যাকামি করতাছ আর সবাই তোমারে বেহুদা বুঝাইতাছে। হয় তুমি কারো কথার পাত্তা দেও না; না হয় তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি পুরাটাই গেছে। তোমারে না কইছিলাম অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে? তো এমন ব্য ব্যা কইরা কান্তাছ ক্যান?
যুধিষ্ঠির কয়- আমার যে যজ্ঞ করার পয়সা নাই ভগবান...
- অ এই কতা। তা কইলেই পারো সোজাসুজি...

দ্বৈপায়ন যুধিষ্ঠিররে এক গুপ্তধনের সন্ধান দেন হিমালয়ের ভেতর। কোনো এক কালে এক রাজা মরুত্ত এইগুলা সংগ্রহ করছিলেন নিজে যজ্ঞ করার লাইগা; সেইগুলা এখনো গচ্ছিত আছে হিমালয়ের ভিতর...

কিছুদিন পর সুভদ্রা আর সাত্যকিরে নিয়া কৃষ্ণ ফিরা যায় দ্বারকায় আর হস্তিনাপুরে বিষণ্ন পাঁচ পাণ্ডবের লগে দ্রৌপদী বাইচা থাকে অভিমন্যুর গর্ভবতী বৌ উত্তরার দিকে তাকাইয়া। হয়ত উত্তরার গর্ভেই টিকা যাইতে পারে পাণ্ডবদের বংশের বাতি। পাশাপাশি চলতে থাকে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন। যুযুৎসুরে ভারপ্রাপ্ত রাজা বানাইয়া যুধিষ্ঠির হিমালয়ে গিয়া মাটি খুইড়া নিয়া আসে মরুত্তর গুপ্তধন। আর উত্তরার সন্তান প্রসবের কাল হিসাব কইরা বলরামসহ পুরা পরিবার নিয়া কৃষ্ণ আইসা উপস্থিত হয় হস্তিনাপুর...

প্রসবের দিন বাকিসব পুরুষদের লগে কৃষ্ণও আছিল প্রসূতিঘরের বাইরে। কিন্তু ভিতরমহলে নারীদের সাড়াশব্দ হঠাৎ নিশ্চুপ হইয়া গেলে সমস্ত লজ্জাশরম বাদ দিয়া সাত্যকিরে নিয়া কৃষ্ণ গিয়া হাজির হয় ভাগিনাবধূ উত্তরার প্রসূতিঘরে...

উত্তরার পোলা হইছে। কিন্তু বাচ্চাটা সম্পূর্ণ অচেতন। উত্তরা পাথর। দ্রৌপদী সুভদ্রা কৃষ্ণরে ঘিরা ধরে; কুন্তী দেয় চিক্কুর- কৃষ্ণ কিছু কর...

কৃষ্ণ যুদ্ধ বিশারদ। কৃষ্ণ কূটনীতিবিদ। কিন্তু যাদব বংশ একই সাথে বহন করে দুই মহান ভার্গব; ঔষধি বিদ্যার গুরু চ্যাবন আর শল্যবিদ্যার গুরু শুক্রাচার্যের উত্তরাধিকার...

কৃষ্ণের চেষ্টায়; কৃষ্ণের ঔষধিতে শিশুটা চিৎকার দিয়া উঠে আর পাণ্ডব বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার পাইয়া চাইরপাশে বাইজা উঠে ঢোল নাকাড়া বাদ্য বাদন আর মানুষের হাসি...

বহু পরীক্ষা পাশ দিয়া পাণ্ডববংশ পাইছে এই উত্তরাধিকার তাই কৃষ্ণ তার নাম রাখে পরীক্ষিৎ...

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের নেতৃত্বে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ হইয়া যায় ভালোয় ভালোয়। অঢেল দান পায় ব্রাহ্মণসহ সকল গরিব আর দরিদ্রজন। কিন্তু দ্বৈপায়ন আবিষ্কার করেন নতুন এক প্রচ্ছন্ন দরিদ্র মানুষ- কুন্তী...

সম্রাট যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ থাইকা দানে পাওয়া নিজের অংশটা তিনি আইসা তুইলা দেন পুত্রবধূ কুন্তীর হাতে- এইগুলা তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ...

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ১১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৯
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ১০ [দুর্যোধন]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৯ [কর্ণ ৪]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৮ [দ্রোণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৭ [কর্ণ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৬ [কর্ণ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৫ [কর্ণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৪
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এই এক নারী!সারা জীবন বুকে পাথর চাপা দিয়া ক্যামনে ছিল?চাপা দু:খই উনারে সনাতন ধর্মে পাচ জন শ্রেষ্ঠনারীর মধ্যে এক নারী হিসেবে গন্য করছে বোধহয় । শেষ বেলায় কৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুর ছাইড়া যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন বরদান হিসেবে শুধু দু:খ কষ্টই চাইছিল কৃষ্ণের কাছে।লীনেন দা, আমার এই বিবৃতি অবশ্য একটু ভক্তির দিকে হেইলা পড়ছে!

-------------
রাধাকান্ত

bashabi এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। মহাভারত এর অনেক অলৌকিক ঘটনাবলির বিশ্বাস যোগ্য ব্যক্ষা পাচ্ছি আপনার লেখা গুলোর মাঝে।

কর্ণ যে আসলে দুর্বাসা মুনির পুত্র সেটা বুজতে পেরেছিলাম। গান্ধারীর শত পুত্র নিয়ে ধন্দ ছিল. আপনার দেয়া ব্যাক্ষা বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো. আমার অবস্স্য ধারণা ছিল এরা সবাই গান্ধারীর পুত্র না হলেও ধৃতরাষ্ট্রের পুরো হতে পারে। (রাজা দের তো হারেম এ দাসী বাদীর অভাব ছিল না.)

কিন্তু দ্রৌপদির বস্ত্রহরণ এর সময় অলৌকিক ঘটনাটার কথা প্রচলিত সেটার explanation কি? যদি দ্রৌপদির বস্ত্রহরণ করতে দু:শাসন সফল হয় তাহলে এরকম একটা গল্প কিভাবে প্রচলিত হলো কৃষ্ণর দয়ায় দ্রৌপদির শাড়ি লম্বা হচ্ছিল আর দু:শাসন শেষ পর্যন্ত tired হয়ে হল ছেড়ে দিয়েছিল। আপনার অনুমান জানালে ভালো লাগবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।